অটোয়া, রবিবার ৪ জুন, ২০২৩
নদী ও নারী - সুনির্মল বসু

    প্রতিদিন বিকেলে আমি নদীর কাছে বেড়াতে যাই। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন মনে আসে, তারপর যেতে যেতে এক নদীর সঙ্গে দেখা। আজো সেভাবেই এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। ওপার থেকে একটা নৌকো এসে, এঘাটে‌ দাঁড়ালো। ফাঁকা নৌকো থেকে একলা মাঝি নেমে‌ এলো। পরনে চেক লুঙ্গি, গায়ে স‍্যানডো গেঞ্জি, মাথায় এলোমেলো কাঁচা পাকা চুল, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। লোকটা আমার দিকে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, বাবুমশাই, তারে দেখিছেন, সেই মেয়ে পাছাপেড়ে শাড়ী পরে, মাথায় লাল ফুল, তার নাম জবা। যদি দেখা পান, তারে বলবেন,  তোমার স্বামী পরান তোমাকে খুঁজতিছে।
     আমি তো হতবাক। আমি এদের চিনি না। কে জবা, কে পরান, আমার জানার কথা নয়। তিনটি ছোকরা এগিয়ে এলো, বললো, তুই যা এখান থেকে।
     মাঝিটি ব‍্যাজার মুখে নৌকোয় গিয়ে বসলো, খানিক বাদে দেখি, মাঝ নদীতে।
     আমার মনে কৌতূহল রয়ে গেল। একদিন ওপারে সারেঙগা গায়ে পরান মাঝির খোঁজ করতে গেলাম। দীপক বাঙালী বলে একজনের সঙ্গে আলাপ হোল, দীপক বলল, পরান খুব ভালো ছেলে, কমার্সে হায়ার  সেকেন্ডারী পাশ। ও বঙ্কিম সাপুই এর কাছে নৌকো চালাতো,  পরিশ্রমী ছেলে। দুটো থেকে পরান মালিকের আজ ছটা নৌকো বানিয়েছে। এরপর পাশের জলটুঙগি গায়ের জবা বলে, একটি মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করে। কালোর মধ‍্যে জবা বেশ সুন্দরী। পরান বৌকে ভালবাসে খুব। দূরে কাজে গেলে, বা মোহনার দিকে গেলে, মাঝে মাঝে পরান বাড়ি ফেরে না। তবে বাড়ি ফেরার সময় ও জবার জন্য পুঁতির মালা, ইমিটেশন গয়না নিয়ে আসে। জবা খুশি হয় খুব।
     এবার দিন সাতেকের জন্য পরান নলহাটির মেলাতে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে দ‍্যাখে, জবার গায়ে অনেক দামী দামী গয়না। এত গয়না জবা,পেল কোথায় থেকে। ওর বাবা নেই,  একমাত্র গরীব বিধবা মা আছে। তাহলে কি জবা, বঙ্কিম সাপুই এর কাছে যায়। বঙ্কিম সাপুই এর স্বভাব ভালো নয়,  আজকাল পয়সা হয়েছে। পরানের মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। মনে মনে বলল,  আমার ভালোবাসার কোনো দাম নেই বুঝি। জবা, তোর জন্য আমি কী না করেছি,  আমার ভালোবাসার এই প্রতিদান।
     নদীতে সাড়াসাড়ি বান আসছে। সতর্ক বার্তায় জানাচ্ছে সংবাদ মাধ্যম।
     পরান জবাকে বলল, চল, বান দেখতে যাবি।
     না, পাগল নাকি, এই দূর্যোগে কেউ নৌকো নিয়ে বের হয়।
     তুই এত ভীতু।
     আমি ভীতু নই। তোমাকে ভালোবাসি আমি, নিজের চেয়েও। আমি তোমাকে হারাতে পারবো না।
     পরান সেদিন অন‍্য খেলায় মেতেছিল। বলল, চল জবা, ভয় নেই, আমি তো আছি।
     বাধ‍্য হয়ে অনিচ্ছায় নদীতে বান দেখতে গিয়েছিল ওরা। নদী সেদিন ক্ষেপে উঠেছিল। নদীর এমন রুদ্র মূর্তি মানুষ বহুদিন দেখে নি।
     পরান ফিরে আসে, জবা ফেরে নি। এ নিয়ে কদিন থানা পুলিশ হোল। এরপর জবার নিরুদ্দেশ নিয়ে এই গায়ে কালো মাথাব্যথা ছিল না।
     সেদিন সকালে পরানের শাশুড়ি মা এলেন। সব জেনে,  সুহাসিনী দেবী কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। বললেন, জবা কদিন আগে যখন তার কাছে যায়, তখন তিনি সামনের পাঁচ কাঠা জমি বিক্রি করে ওকে গয়না বানিয়ে দেন। বিয়ের সময় কিছু দিতে পারেন নি, তাই।
     পরানের মাথা ঘুরে যায়। এ আমি কী করেছি, জবা,  আমার এত বড় ভুল হোল কী করে। তারপর থেকেই পরানের এই অস্বাভাবিক আচরন।
     দীপক বাবুকে একটা সিগারেট দিলাম, নিজেও একটা ধরালাম। বিদায় নিয়ে ভাবছিলাম,  মানুষের জীবনে, কেন এমন ঝড় আসে।
     এপারে ফিরে এলাম। নৌকো থেকে সবে নেমেছি, নিম গাছের পাশ দিয়ে পরান মাঝি বেরিয়ে এলো, বলল, বাবু মশাই, তারে দেখিছেন, সেই মেয়ে পাছাপেড়ে শাড়ী পরে, মাথায় লাল ফুল, ওর নাম জবা, ওর সঙ্গে দেখা হলে বলবেন,  তোমার স্বামী পরান, তোমায় খুঁজতিছে।
     আমার মন বেদনায় ভরে গেল।
     দূরের নৌকো থেকে অন‍্য কোন মাঝির গান ভেসে এলো,
'আমায় ডুবাইলি রে, আমায় ভাসাইলি রে
অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে'।।

সুনির্মল বসু। পশ্চিমবঙ্গ, ভারত