অটোয়া, শনিবার ৩ জুন, ২০২৩
ভালোবাসার শক্তি - দীনেশ মাহাত

    'দীপু সোনা, ও দীপু সোনা, ভাত হয়ে গেছে রে খেয়ে নিবি আয়,' দীপুর মা জোরে জোরে ডাকছে তাকে, কিন্তু তার কোন সাড়া নেই। বৈঠকখানায় গিয়ে দেখে সে নেই। দুষ্টু ছেলেটি জ্বালিয়ে মারল দেখছি, এই বলল খিদে পেয়েছে, আর এখনই উধাও। 
     শান্তিপুর গ্রামটির মাঝামাঝি জায়গায় দীপুদের বাড়ি। বাড়ির বৈঠক খানায় তার বেশির ভাগ সময় কেটে যায়। জানালা দিয়ে সবুজ ঘাসের মাঠ দেখা যায়। দশ হাতের মধ্যে থেকে ধানের জমিন শুরু। রোয়ার কয়েক দিন পর মাঠময় সবুজে সবুজ। শুধু ধানখেত। আর আলে যেখানে সেখানে মহুয়া গাছ। সেই গাছগুলিতে কতই না গায়ক পাখিদের আড্ডা। শান্ত দীপু যখন জানালা দিয়ে বাইরে চায়, ওর মন উদাস হয়ে যায়। তাই সময় পেলেই সে মহুয়া তলায় গিয়ে বসে আর অনেক কথা ভাবে।
     আজ ও সেই মহুয়া তলায় বসে ভাবছে এই যন্ত্রনাময় ভব সাগরের কথা, কত কষ্ট, কত যন্ত্রনা, এই পৃথিবীতে, অশান্ত মন উদ্দাম ঘোড়ার ন্যায় ধাবমান। দু দিন আগে হয়ে যাওয়া আলোচনা সভায় গুরুদেবের অমৃত বাণী, বার বার তার হৃদয়ে বাজছে, ‘এই সংসার মায়াময় পুত্র, যেমন নাটকের চরিত্ররা ছদ্মবেশ ধারণ করে মানুষের মনোরঞ্জন করে আমরা তেমনি মিথ্যা মনোরঞ্জনের চেষ্টা করে চলেছি। ছদ্মবেশী দেহ এর আড়ালে আসল পরিচয় ভুলে আছি। আত্মকর্ম করো পুত্র, আর অশান্তিময় সংসার থেকে শান্তি মুক্তি প্রদেশে চলো।’ দীপু তার গুরুদেবকে খুব ভালবাসে। ভাবতে ভাবতে তার মন এতই উদাস হয়ে যায়, যে তার মন ভেসে ভেসে ঐ স্বদেশে পৌছে যায়।
     মায়ের  ডাকে তার ভাবনা ভেঙে যায়। দু জনে বাড়ি ফিরে এলে মা তাকে খাবার খেতে দেয়। প্রকৃতি প্রেমী এ দীপুর খুব মাতৃভক্তি। মায়ের অনুমতি না নিয়ে কোন কাজ করে না সে। ছেলেকে খেতে দিয়ে পাশে বসে কত পুরনো দিনে দুঃখের কথা বলে তার মা। কত বছর নিঃসন্তান অবস্থায় থাকার পর অনেক পূজা অর্চনা করে তাকে পেয়েছে। দীপু কে কোলে পেয়ে মায়ের বুক  ভরে গেছে। 
     তরুন দীপু মায়ের ভালোবাসার অতল সমুদ্রে তলিয়ে  যায় আর মনে প্রতিজ্ঞা করে মা, আমি তোর কোন দুঃখ রাখব না। বিয়ে বাড়ি উপলক্ষে  মা দীপুর দিদি বাড়ি গিয়েছিল,যেদিন ফিরে আসার কথা সেদিন না ফিরতে তার কি অভিমান। ফিরতে বলল, 'আজও যদি তুই না আসতিস মা, তবে আমি তোর সাথে কথা বলতাম না'।আসলে মায়ের ভালোবাসা ছাড়া এই পৃথিবী তার ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়।  কিন্ত  বিশ্ব পিতা যেন আড়াল থেকে বলেছিল, দীপু সোনা আজ তুমি একটা দিন মা কে ছেড়ে থাকতে পারছ না, তাহলে অনেক দিন দূরে থাকবে কিভাবে? দীপু সে কথা শুনতে পায় নি। 
     বাড়ি ফিরে আসতেই মায়ের প্রচন্ড শরীর খারাপ। দীপু কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে এসে দেখল মা বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় প্রচন্ড বমি করছে, বুকে প্রচন্ড ব্যাথা, তার মনটা কেমন দুঃখপূর্ণ হয়ে গেল। মায়ের  হিষ্ঠপুষ্ঠ শরীরে কোন দিন এভাবে রোগাক্রমন হয় না। মা তাকে কাছে ডেকে বলে, 'বাবা, বুকে আমার প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে, তুই একটু মালিশ করে দে।'  মায়ের কষ্ট লাঘব করতে দীপু তাই করে। ঈশ্বর কৃপায় কয়েক দিন পর মা সুস্থ হয়ে উঠলো। 
     কিন্তু হঠাৎ সেই সোমবার কলেজে তাকে ফোন করে জানাল,তার মা চলতে চলতে পড়ে অজ্ঞান অবস্থায়, বাড়ি ফিরে আর সেই চিরপরিচিত ডাক শুনতে পাই নি সে। মমতা ও ভালবাসাপূর্ণ মায়ের নিথর দেহটিকে সে দেখতে পেয়েছে, ভালো করে লক্ষ্য করেছে অনন্ত আদর লুকানো সেই হাত দুটিকে। কিন্তু ঈশ্বরের কি লীলা, পরমপিতা দীপুর চোখে মাত্র কয়েক ফোঁটা জল দিয়েছিল। তার কান্না আসেনি, কিন্তু অনন্ত সমুদ্র স্রোতের মতো, তার মনে শতভাবনার স্রোত এসে আছড়ে আছড়ে পড়ছিল। তার ঠাম্মা হয়ে নাতি নাতনীকে খেলানোর আশা, বৌমার ডাক, ' ও মা, ভাত খাবে এসো'  কিছুই পূর্ণ করতে পারলাম না মা, আমায় তুমি ক্ষমা করে দিও। 
     তারপর কেটে গেছে কয়েক মাস। সময় টা ছিল বসন্তের এক ভোর বেলা। কৃষ্ণচূড়া গাছের নতুন শাখা গুলো অপূর্ব সুন্দর লাল ফুলে পরিপূর্ণ। মাঝে  মাঝে কোকিলের কুহু কুহু তান ভেসে আসছিলো। সেদিন সন্ধ্যা থেকে দীপু র খুব মায়ের কথা মনে পড়ছে, বিশেষত সেই বৃষ্টি মুখর রাতে, তাদের খড়ের চাল ভেদ করে যখন বিছানায় জল পড়ছিল, মা তাদের কে জাগিয়ে বিছানা অন্য দিকে সরিয়ে দিচ্ছে,  বা কোন রাতে যখন সে বলে খাবার খাব না, তখন মা বলে আমিও তবে না খেয়ে থাকব। তারপর দু জনেই  খেয়ে শুয়ে পড়ার কথা। এসব কথা ভাবতে ভাবতে দীপু বৈঠকখানার ঐ পুবমুখো জানালার দিকে মাথা করে  ঘুমিয়েছিল।
     'দীপু, ওঠ বাবা,  সকাল হলো যে,’এমন এক ডাকে হঠাৎ তার ঘুমটা ভেঙে গেল। কোন দীর্ঘদিন চাওয়াকে পাওয়ার আনন্দে তার মনটা খুশিতে ভরে উঠল। চোখ খুলেই দেখল তার মা দাড়িয়ে। প্রথমটাই তো তার বিশ্বাসই হল না, সে ভাবল অন্যদিনকার মত গভীর রাতে সে স্বপ্নে তার হারিয়ে যাওয়া মা কে দেখছে না তো। না,  এটা স্বপ্ন নয়,  ভোরের আলোতেই সে তার অতি পরিচিত মায়ের মুখখানি, সেই কান্না থামানো মুখখানি দেখছে। মায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়ে প্রণাম জানায় সে। মা আশীর্বাদসূচক হাত বুলিয়ে দেয় দীপুর মাথায়। সে ফাঁকি দিয়ে, কথা না বলে চলে যাওয়া মা কে পেয়ে খুব খুশি। সে তো ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনায় করে প্রতি সন্ধ্যায়। তারপরেই কত প্রশ্ন উদয় হয় তার মনে, সে জিজ্ঞাসা করে, 'মা, তুই কোথায় গিয়ে ছিল? এই অসম্ভবকে সম্ভব করে ফিরে এলিই বা কিভাবে?’ বৈঠকখানার বিছানায় তারা পাশাপাশি বসে পড়লো আর মা বলতে শুরু করল, 'দীপু সোনা, আমি এক নতুন দেশে গিয়ে ছিলাম, সেখানে এই পৃথিবীর মত দুঃখ, পাপ নেই, আছে শুধু শান্তি। তুই পরম করুণাময়ের কাছে প্রতিদিন প্রার্থনা করতিস আমার ফিরে আসার জন্য, তোর ডাক শুনেছেন তিনি। তাই তোর মুখে হাসি ফোটাতে আবার পাঠিয়েছেন আমাকে। মায়ের প্রতি তোর গভীর ভালবাসায় এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। সে কথা এখন থাক বাবা, অনেক কাজ পড়ে আছে, সকাল হতে চলল, বাসন মাজতে হবে। তুই তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুয়ে নে। আমি ততক্ষণে বাসন মেজে তোর জন্য সকালের খাবার তৈরি করি। তোর তো আবার টিউশন আছে।'

দীনেশ মাহাত। পশ্চিমবঙ্গ, ভারত