অটোয়া, মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল, ২০২৪
শান্তিনিকেতন ভ্রমণে আমার অভিজ্ঞতা - মোবারক মন্ডল

    ভ্রমণ মানেই আমার কাছে একটা বাড়তি আনন্দ, মনে বয়ে আনে অনাবিল সুখ,তার সাথে প্রকৃতিকে উপভোগ করার সুযোগ। ভ্রমণের আনন্দ বরাবরই আমি উপভোগ করে থাকি আর সেটা যদি হয় শিক্ষা সংক্রান্ত তবে সে আনন্দে বয়ে আনে বাড়তি সংযোজন। প্রতি বছর দু'একবার হলেও বেরিয়ে পড়ি ভ্রমণ পিয়াসী মনের খোরাক জোগানোর জন্য।
     শীত যখন সারা রাজ্যকে জড়িয়ে ধরেছে, ডিসেম্বরের শেষে নতুন বছরের আগমনে, এই সময় বেরিয়ে পড়লাম শান্তিনিকেতনে উদ্দেশ্যে, ঝরে পড়া শিশিরের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলা, বকুলবীথি, আম্রকুঞ্জ, ঘণ্টাতলা, নতুন বাড়ি, উদয়নগৃহ, কালোবাড়ি, সিংহ সদন, শান্তিনিকেতন ভবন, কাচের মন্দির ইত্যাদির সঙ্গে হারাতে অন্য এক ভুবনে। এই সময়ে শান্তিনিকেতনের হিমেল বাতাস দেয় অনাবিল এক প্রশান্তি, খোয়াই বনের ফাঁকফোকড় পড়ে মিঠেল রোদ। বিকেল হতেই কুয়াশার চাদর মুড়ি দিতে শুরু করে পুরো শান্তিনিতেকন। লাল মাটির রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে তখন মনে পড়ে.. ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে'...
     গতবছরের ন্যায় এবারও আমি ও আমার প্রান প্রিয় চারবন্ধু, আব্দুস সালাম, বদিউজ্জামান ভাই, মালিক ও আজিজুল কবিগুরুর টানে একে অপরের ভ্রমণ সঙ্গী হলাম। রবিবার সন্ধ্যায় হাল্কা কেনাকাটার পর সোমবার ভোর চারটে কুঁয়াশা ও শীত উপেক্ষা করে গোসল সারলাম। নির্দির্ষ্ট সময়ে টুকটুকিতে চেপে কৃষ্ণপুর স্টেশনে পৌছালাম। ভোর ৫.২৫ এ ভাগীরথী এক্সপ্রেস ধরে জিয়াগন্জ পৌছে ওপার আজিমগন্জ হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হল। আমরা পাঁচজন বরাবরই খোলামেলা এবং খুবই অন্তরঙ্গ বন্ধু, আমাদের মধ্যে কোন কিছুই গোপন থাকে না এবং যতক্ষণ সাথে থাকি হাসি মজা এবং একে অপরকে নিয়ে হাসাহাসি চলতেই থাকে। চিরাচরিত নিয়ম মেনে শুরু হল সেই অনাবিল হাসির পর্ব।
     ভাগীরথী নদী পার হয়ে টিকিট কেটে 7.50 এ আজিমগন্জ থেকে কবিগুরু এক্সপ্রেস ট্রেন ধরলাম। আমাদের মধ্যে আব্দুস সালাম ভাই হল একটু নেতা গোছের মানুষ, তাই ভ্রমনের সব দায়-দায়িত্ব তার হাতে সঁপে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত হলাম।
     ট্রেনের ভ্রমন বরাবরই খুব ভালো লাগে, জানালার পাশে সিট নিয়ে বসলাম। যাতে করে প্রকৃতির সৌন্দর্য খুব ভালোভাবে উপভোগ করতে পারি। যাত্রাপথে কত মনোহর দৃশ্য দেখলাম, রাঢ়ের উঁচুনিচু ভূপ্রকৃতি, সরিষার ফুলের অপরুপ দৃশ্য। জনশূন্য ফাঁকা মাঠ, আর তখনই মনে পড়ল কবিগুরুর সেই কবিতার লাইন "অবারিত মাঠ গগণ ললাট, চুমে তব পদধূলি, গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি"। তার সাথে বন্ধুদের একে অপরকে নিয়ে হাসাহাসি, মজা, আর নিত্যনতুন যাত্রীদের ওঠানামা দারুন উপভোগ করছিলাম আর মনে কামনা করছিলাম বারবার ফিরে আসুক আমাদের জীবনে এই সোনালি মূহুর্ত।
     সাড়ে দশটা নাগাদ বোলপুর ষ্টেশনে পৌছালাম। টুকটুক ধরে পৌঁছে গেলাম কবিগুরুর চরনে। হাঁটতে হাঁটতে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট পার করার পর পৌছালাম শান্তিনিকেতনের মূল ভবনে। সারা এলাকাটা বিভিন্ন গাছপালায় মোড়ানো। যন্ত্রচালিত যুগে এইরকম সবুজের সমারোহে ভরপুর এলাকা সত্যিই বিরল। একেকটা গাছ শত প্রাচীন। মনে হচ্ছে রবিঠাকুরের এরা উত্তরসুরী এবং তাঁর শত কবিতার সাক্ষী। হয়তো এরই মধ্যে কোন এক গাছের তলায় বসে কবিগুরু কবিতা লিখতেন।
     দেশ বিদেশের নানা রঙের নানা ঢংয়ের মানুষের আগমন ঘটেছে। তবে এই সেলফির যুগে এত সুন্দর প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখার থেকে সেলফি তুলতে প্রত্যকেই ব্যস্ত। নানা ঢংয়ে নানা পোজে ছবি...... হা আমরাও তার ব্যতিক্রম নয় অবশ্য।
     রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৪ সালে শান্তিনিকেতন ভবনটি তৈরি করেন। দেবেন্দ্রনাথ তিনটি স্ট্রাকচারে বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। ভবনটি একদিক থেকে দেখলে মনে হচ্ছে মন্দির, অন্য দিক থেকে দেখলে মসজিদ, আরেক দিক থেকে দেখলে গির্জা।
     বাড়িটির উপরদিকে খোদাই করা আছে ‘সত্যাত্ম প্রাণারামং মন আনন্দং’ উপনিষদের এই উক্তিটি। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এইবাড়ির একতলায় ধ্যানে বসতেন। বর্তমানে ভবনটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গাছের তলায় যে বেদীগুলো আছে তাতে বসেই চলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকার্যক্রম। এই জায়গাটার নাম হচ্ছে বকুল বীথি।
     ছাতিম তলা হচ্ছে শান্তিনিকেতনের মূল জায়গা। এখান থেকেই শান্তিনিকেতনের সৃষ্টি। বর্তমানে জায়গাটিতে ঘেরা রয়েছে। বছরে মাত্র দুইবার খোলা হয় এই ছাতিম তলা।
     ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঁচ জন শিক্ষার্থী নিয়ে এই ছাতিম তলায় ক্লাস শুরু করেন। যার নাম দেন বিশ্বভারতী বিদ্যালয়।
    এরপরে দেখলাম কালো বাড়ি। মাটির তৈরি, দেয়ালে রয়েছে শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু ও ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজের বিভিন্ন কারুকাজ। রবিঠাকুরের সহজপাঠ বইয়ে রয়েছে দেয়ালের সেইসব চিত্র। যেমন, তিনটে শালিক ঝগড়া করে, রান্নাঘরের চালে, অমল ও দইওয়ালা ইত্যাদি।
 “তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে...” সেই অতিপরিচিত ছোটবেলার কবিতার সে তাল গাছও দেখা গেল মাটির এক বাড়ির মাথা ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে। রবি ঠাকুর নাম দিয়েছিলেন, তালধ্বজ বাড়ি। এইরকম করে হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখলাম শান্তিনিকেতন। দেখলাম ইন্দিরা গান্ধীর হোস্টেল।
     দেশ বিদেশের নানাধরনের পর্যটকে ভরপুর খোয়াই এর সবুজ বনানীতে যেন আমরা হারিয়ে গেলাম। সোনাঝুরি, ইউক্যালিপ্টাস, অমলতাস গাছগুলির দিকে তাকিয়ে একটা বেলা কাটিয়ে দেওয়া যায়। দীর্ঘক্ষণ ঘোরার ক্লান্তি, খিদে, তৃষ্ণা নিবারণ করতে খোয়াইয়ের হালকা দিপ্রাহরিক আহার সেরে নতুন উদ্যমে বেড়িয়ে পড়লাম।
     হাঁটতে হাঁটতে প্রতিমুহূর্তে মনে করছিলাম এখানে এক সময় হেঁটে বেড়িয়েছেন রবিঠাকুরও, নিজের অজান্তেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল। সঙ্গীত ভবনের পাশ দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছিলাম বিভিন্ন রকমের সুর ও সঙ্গীতযন্ত্রের শব্দ যেন কানে গুন্জরিত হচ্ছিল। সেখানে রয়েছে রামকিঙ্কর বেইজের করা বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘কলের বাঁশি।’ দুই সাঁওতাল রমণীর কারখানায় কাজে যাওয়ার দৃশ্য।
     শান্তিনিকেতনে ঢোকার আগে শিল্পী প্রফেসর সেলিম মুন্সীর গ্যালারি ‘নীহারিকা’ থেকে নান্দনিক ভাস্কর্য এবং নানাচিত্রকর্ম। শান্তিনিকেতনের উপর করা অনেকগুলো কাজের প্রদর্শনীও দেখা গেল এখানে। গ্যালারির সামনের রাস্তা ধরে এগোলে বেশ কয়েকজন শিল্পীর বাসস্থান চোখে পড়বে। আরো সামনে এগোলেই চোখে পড়বে বিশাল মাঠ, প্রতিবছর এখানেই বসন্ত উৎসবের আয়োজন করা হয়।
     এবার গন্তব্য উত্তরায়ণ। আশ্রমে এসেই টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম উত্তরায়নের রবীন্দ্র মিউজিয়ামে। ঢোকার আগে বন্ধুদের বিতর্ক সৃষ্টি হল এখানে প্রবেশ করবে কি না, শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল ঢুকেই দেখা যাক। জুতা পরে প্রবেশ নিষেধ, তাই জুতা খুলে প্রবেশ করে কবিগুরুর প্রতি সন্মান প্রদর্শন করা হল। এখানে কবির ব্যবহার করা বিভিন্ন জিনিস, দেশ বিদেশ থেকে পাওয়া উপহার, নোবেল প্রাইজের রেপ্লিকা, বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানদের দেয়া উপহার, কবির নানা বয়সের ছবি দেখে বিস্মিত হলাম। এর সাথে দেখলাম কবিগুরুর বিখ্যাত সেই নোবেল পুরস্কার। যদিও এটা অরিজিনাল না প্রতিস্থাপিত। এমন একজন মহামনীষির ব্যবহার্য জিনিসপত্র দেখতে দেখতে উনিশ শতকের পুরানো যুগে হারিয়ে গিয়েছিলাম।
     এরপর এলাম উদয়নে। এখানেই তিনি মূলত বাস করতেন। এরপর একে একে দেখেনিলাম কবির ভাবনাকে আকার দেওয়া তাঁর প্রিয় বাড়ি গুলো শ্যমলী, পুনশ্চ, উদিচী, কোনার্ক। একি টিকিটে দেখেনিলাম শান্তিনিকেতন ভবন আশ্রমের সবচেয়ে পুরনো বাড়ি। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৪ সালে এই বাড়িটি তৈরি করিয়েছিলেন। বাড়িটি প্রথমে একতলা বাড়ি ছিল। পরে দোতলা হয়। তাঁর অনুগামীরাও এখানে এসে থেকেছেন। কৈশোরে বাবার সঙ্গে হিমালয়ে যাওয়ার পথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে কিছুদিন বাস করেন। শান্তিনিকেতন গৃহের পাশেই উপাসনা গৃহ। এরপর পায়ে পায়ে ঘুরে নিলাম ছাতিমতলা, ঘণ্টা তলা, আম্রকুঞ্জ, চৈত, অবাক হয়ে দেখলাম।
     আমরা বিকাল অবধি সারাক্ষন বিশ্বভারতী ও মিউজিয়াম টাই ঘুরে ঘুরে দেখলাম ও নতুন জ্ঞান আহরণ করলাম। কবিগুরুকে নতুন করে চিনলাম। বইয়ে পড়া বিষয়গুলোকে মিলিয়ে নিলাম। সত্যিই অসাধারণ কবি। বদিলুজ্জামান ভাই মৃদুস্বরে সারাক্ষণ রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছিলেন। মালিক ছিল আমাদের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অনেক তথ্য দিয়ে আমাদের চিনতে সাহায্য করছিল। গোটা এলাকাটা ফাঁকা আর বাধাহীন,  প্রকৃতির সৌন্দর্যে ঘেরা। আমার বারবার কবিগুরু এই লাইনটা মনে পড়ছিল -
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর।
     রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পচিন্তা ও চেতনায় প্রকৃতি অন্যতম এক অনুষঙ্গ। নানা কথামালায় তিনি বলেছেন প্রকৃতি ও পরিবেশের কথা। সেই কথামালা প্রমাণ করে তিনি কত আগেই না বুঝেছিলেন প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা না করা গেলে মাটি ও মানুষের যে চিরন্তন সম্পর্ক সেটা আর টিকবে না। দীর্ঘ জীবনপ্রবাহে আর লেখনীতে তাই প্রকৃতির প্রতি মমত্ববোধ আর দায়বদ্ধতা প্রকাশ করেছেন। প্রকৃতি ও পরিবেশ ভাবনায় তিনি ছিলেন একজন অগ্রগামী চিন্তার মানুষ। তিনি নিরন্তর প্রকৃতি ও সংরক্ষণের মাধ্যমে সমন্বয় অন্বেষণ করেছেন। সর্বদাই তিনি প্রকৃতির প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন সুনিপুণভাবে।
     রবীন্দ্রনাথ শুধু মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক নিয়ে বিস্তৃতভাবেই লেখেননি, তিনি শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করে তার বাস্তব রূপও দেখিয়েছিলেন। সব দিকে সবুজ বেষ্টনী দ্বারা শান্তিনিকেতন ঘেরা। পৃথিবীজুড়ে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কের বিরল উদাহরণ তিনি শান্তিনিকেতনের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছেন।
     শান্তিনিকেতন শিক্ষা দেয় প্রকৃতির মধ্যে প্রকৃতির সাথে মিশে অহংকার ছেড়ে অনারম্বর ভাবে বাঁচতে। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হতে। এখানে পড়ুয়ারা খোলা প্রকৃতির মাঝেই পড়াশুনা করছে। তাই এখানে নেই ডিজিটাল ক্লাসরুম নেই অট্টালিকা। আছে শুধু সবুজ প্রকৃতির আঁচলে মোড়া শান্তির পরিবেশ। এখানে বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন উপাদান ও রসদ।
     অবশেষে অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির ঝুলিকে পূর্ণ করে এবার ফেরার পালা। গোধুলি লগ্নে শরীরটাকে ক্লান্তি ও অবসাদে জড়িয়ে ধরেছে। মনটা তরুতাজা থাকলেও শরীর ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ছিল। সকলের চোখে মুখে সেই ছাপ স্পষ্ট লক্ষ করছিলাম। পরিশেষে তেভাগা এক্সপ্রেস ধরে বাড়ির পথে রওনা দিলাম....... 

মোবারক মন্ডল
করিমপুর
পশ্চিমবঙ্গ 
ভারত