অটোয়া, রবিবার ৪ জুন, ২০২৩
স্বার্থহীন জীবন - শাহজাহান

     আমার স্ত্রী আলেয়াকে নিয়ে আমার ছোট শালা নিলয়ের বিয়ে শেষ করে ত্রিশাল থেকে বাড়িতে  ফিরছিলাম। আমরা যখন ময়মনসিংহ ব্রিজের নিকট  আসলাম তখন রাত ১১ টা বাজে। আমরা গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ পিছন থেকে বাচ্চা কোলে দৌড়ে  এসে এক ভদ্র মহিলা ভাই, আমার বাচ্চাটাকে প্লিজ একটু রাখেন, না হলে ওরা আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলবে। আপনি কে? আর কারাই বা আপনার বাচ্চাকে মেরে ফেলবে?ভাই আমি কে এসব বলার মতো সময় এখন নেই, আপনি প্লিজ আমার বাচ্চাকে বাঁচান। 
     আমি বাচ্চাটাকে কোলে নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালাম ঠিক তখনই আলেয়া বললো, না এ বাচ্চা তুমি নিয়ো না। শুধু-শুধু উনার জন্য আমরা কেনো ঝামেলাই পড়বো? কি বলছো তুমি? উনার এতো বড় বিপদে অবশ্যই উনাকে আমাদের সাহায্য করা উচিত। এই বলে আমি ঐ মহিলাকে বললাম দেন বাচ্চাটাকে আমার কোলে দেন।মহিলা তাড়াহুড়ো করে বাচ্চাটাকে আমার কোলে দিলো এবং বললো, ভাই ৩০ মিনিটের মতো এখানে দাড়ান, ওরা চলে গেলেই আমি আমার বাচ্চাকে নিয়ে যাবো। এই বলে মহিলা দৌড়ে যখন রাস্তা  পাড় হতে যাবে ঠিক তখনই একটি ট্রাক মহিলাকে চাপা দিয়ে চলে গেলো। এক মুহুর্তের জন্য আমি আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। পরক্ষণেই ঢাকা থেকে সোনার বাংলা নামক বাসটি আসলো। কোথায় যাবেন? গেলে তাড়াতাড়ি উঠে আসুন, এমনিতেই আমাদের গাড়ি চার ঘন্টা লেট।আলেয়া বললো ভাই আমরা তারাকান্দা যাবো।ভাড়া ৫০ টাকা কর উঠেন। আমরা উনাকে এভাবে ফেলে রেখে চলে যেতে পারি না আমি বললাম। শোনো শুধু-শুধু এখানে দাড়িয়ে থেকে ঝামেলা বাধানোর কোনো মানে হয় না, উঠে এসো আলেয়া জোর গলায় বললো। কিন্তু এই বাচ্চাকে কি করবো? এই বলে আমি আলেয়ার মুখের দিকে তাকালাম। তোমার কি বুদ্ধি-সুদ্ধি লোপ পেয়েছে নাকি শুনি? দেখতেই পাচ্ছো ওর মা এই মাত্র, পরক্ষণেই বাসের হেলপারের আওয়াজ, ওস্তাদ বাড়ান উনারা যাবেন না। ভাই দাড়ান-দাড়ান আসছি এই বলে আলেয়া গিয়ে বাসে উঠে পড়লো। আমিও তার পিছু-পিছু গিয়ে উঠলাম। 
     বাসে উঠে দেখলাম যাত্রী খুবই কম। আর এ জন্যই আমাদের জন্য এতোক্ষণ দাড়ালো। হঠাৎ পিছন থেকে একজন ভদ্র মহিলা বললো ভাই বাচ্চাটাকে ওর মায়ের কোলে দেন। আমি চমকে উঠে ওর মায়ের কোলে?  ভদ্র মহিলা আবার আলেয়াকে উদ্দেশ্য করে ভাবি, বাচ্চাটাকে আপনার কোলে নেন। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম বাচ্চার মা বলতে আমার স্ত্রী আলেয়াকেই বুঝিয়েছেন। দাও বাচ্চাকে আমার কোলে দাও। হু নাও। আমার মনের ভেতর নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্চিলো, কে এই মহিলা? কারাই বা তাকে আর তার সন্তানকে মারতে চাই? ওই সময় এই মহিলার মৃত্যু না হলে হতো না? ইত্যাদি ইত্যাদি চিন্তা করতে-করতে আমার চোখদুটি লেগে গেলো। হঠাৎ বাসের হেল্পারের ডাক তারাকান্দার যাত্রীরা নামেন। এই যাও নামো বলে আলেয়া আমায় নাড়া দিলো। আমি হু চলো, কিন্তু ভাড়া তো দেওয়া হয়নি। তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই তোমাকে ডাক দেয়নি, ভাড়া আমি দিয়ে দিয়েছি। বাচ্চাকে আমার কোলে দাও। না লাগবে না। তুমি ব্যাগ টা নিয়ে নামো, বাচ্চা আমার কোলেই থাক। মনে হলো বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে আলেয়ার মাতৃত্ববোধ জেগে উঠলো। আলেয়া বাস থেকে আগে নামলো। 
     বাস থেকে নামার সাথে সাথেই কেউ একজন চেচিয়ে বললো, ওইতো নাজমা, ধর ওকে। সাথে-সাথে ২ জন ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সী ছেলে এসে আলেয়াকে ধরলো। আলেয়া চিৎকার করে, কে আপনারা? আমায় কেন ধরেছেন? ছাড়েন, ছাড়েন আমাকে। ততক্ষণে ঐ আদেশ করা লোকটা আলেয়ার কাছাকাছি এসে বললো, পালিয়ে যাবে কোথায় সোনা? এই যে সাহেব, হচ্ছে টা কি শুনি? এ মধ্যরাতে আপনারা আমাদের সাথে কি শুরু করেছেন? আপনাদের সাথে মানে? কে আপনি? আমি ওর স্বামী, কবির হাওলাদার। না, ও আমার স্ত্রী নাজমা। আলেয়া আবারও চিৎকার করলো, কি বলছেন আপনি এসব? আমি আপনার স্ত্রী হতে যাবো কেনো? এতক্ষণে লোকটার বুঝতে বাকি রইল না যে, এটা তার স্ত্রী নাজমা নয়। সোরি ভাই, আসলে একটা মিস্টেক হয়ে গেছে, কিছু মনে করবেন না। আচ্ছা ঠিক আছে যান। তিনজন ই চলে গেল সামান্য একটু দূরে।ঐ মহিলার স্বামী বলছে- নাজমাকে না পেলে আমার কোটি টাকার সম্পত্তি হাত ছাড়া হয়ে যাবে।
     আবার ঐ বাসের পিছনে চল, নাজমা মনে হয় ঐ বাসের ভিতরেই আছে। এই বলে লোকগুলো আবার মাইক্রোবাস করে বাসের পিছনে ছুটলো।  আমাদের বুঝতে বাকি রইলো না যে, এটা কোটি টাকার খেলা। তাইতো লোকটা, খেলায় জিতার জন্য নিজের স্ত্রী-সন্তানকেই মারতে উদ্বুদ্ধ। আর এটাও বুঝতে পারলাম ওরা যখন ব্রিজের কাছে এসে পৌছেছিলো, ঠিক তখনই আমাদের বাস ছেড়ে দিয়েছিলো। তাই, ওরা মনে করেছিল ওই বাসেই তাদের নাজমা উঠেছিল। আর তখন থেকেই ওরা আমাদের বাসের পিছু নিয়েছে। এবং আলেয়াকে বাচ্চা কোলে দেখে নিজের স্ত্রী মনে করেছে। আজ থেকে আমরাই এই মেয়ের মা-বাবা এই বলে আলেয়া আমার মুখের দিকে তাকালো। কিন্তু মানুষে যদি জিজ্ঞেস করে আমরা এই মেয়ে কোথায় পেলাম, তাহলে কি বলবো?
     শোনো, আমার বড় ভাইয়ের বউ অসুস্থ, এটা প্রায় আমাদের গ্রামের সবাই জানে এবং উনার যে বাচ্চা হবে এটাও।আমরা বলবো, ভাবি যমজ মেয়ে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। অসুস্থ মানুষ, যেখানে উনি নিজেই নিজের যত্ন নিতে পারেন না। সেখানে তিনি দুটি সন্তানের লালন- পালন কি করে করবেন? আর আমাদের তো কোনো সন্তান নেই। তাই আমরা একটা বাচ্চা নিয়ে এসেছি। ঠিক আছে তাহলে, আমরা দুজনেই একই কথা বলবো, এই বলে একটু সামনেই গিয়ে দেখি- আব্বাস দাড়িয়ে আছে। আব্বাস আমাদের পাশের বাড়ির ছেলে, মটর সাইকেল দিয়ে ভাড়া টানে। ত্রিশাল থেকে রওনা দেওয়ার সময়ই আমি ওকে ফোন দিয়ে আসতে বলেছিলাম। আমাদের দেখেই, আরে কবির ভাই,! এতো দেরি কেনো? অনেকক্ষণ ধরে দাড়িয়ে আছি। আর বলিস না, গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে-করতে দেরি হয়ে গেছে। ও আচ্ছা। আরে ভাবি, বাচ্চা কোথায় পেলেন? আলেয়া আব্বাসকে সব বললো, যা আমরা পূর্বেই ঠিক করে রেখেছিলাম। সব শুনে আব্বাস বললো, ভালোই হয়েছে আপনারা তো নিঃসন্তানই ছিলেন। আচ্ছা অনেক রাত হয়ে গেছে, উঠেন তাড়াতাড়ি চলে যায়।
     বাড়িতে পৌঁছে দেখি ১ টা বেজে গেছে, তাই আর দেরি না করে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে আমি ঘুম থেকে উঠে দুধের সন্ধানে চলে গেলাম। আলেয়া তখনও ঘুমাচ্ছে। আর ঘুমাবেই না কেনো? আমি ঘুমিয়ে পড়লেও ও ঘুমাতে পারেনি। কারণ বাচ্চা খুধায় কান্না করেছে অনেক রাত পর্যন্ত। করিমের বাড়ি থেকে আধা লিটার নিলাম এবং প্রতিদিন যাতে আধা লিটার করে দুধ দেয়, তা ঠিক করে এলাম।  দুধ নিয়ে বাড়ির কাছে আসতেই দেখি, বাড়িতে রীতিমতো ভিড় জমে গেছে। গেইট দিয়ে প্রবেশ করার সময় জমিরের বউ, বাচ্চা কোথায় পেলে তোমরা? কেনো, আলেয়া কি বলেনি? বাচ্চা কোথায় পেয়েছি? হ্যা বলেছে। এ বাচ্চা নাকি ওর বড় ভাইয়ের বউয়ের।যমজ বাচ্চার জন্ম দিয়েছেন, আর তিনি তো অসুস্থ, তাই তোমরা একজনকে নিয়ে এসেছো। আলেয়া যা বললো তা কি তোমার বিশ্বাস হয়নি? হবে না কেনো? হয়েছে তো। তাহলে আবার আমায় জিজ্ঞেস করছো কেনো? জমিরের বউ  না মানে মানে করে চলে গেলো।
     ঐদিন সকাল থেকে শুরু করে প্রায় সপ্তাহ খানেক, বাড়িতে ভিড় লেগেই ছিলো। মানুষ আসে বাচ্চা কোথায় পেলাম? জিজ্ঞেস করে। আর আমরা, আমাদের সেই মিথ্যা উত্তর দিয়েই সবাইকে বুঝালাম।বাচ্চাকে এনেছি আজ আট দিন। গতকাল রাতে একটা খাসি জবাই দিয়ে মসজিদের ইমাম সাহেব, বাচ্চার নাম রেখে গেলেন নার্গিস। আমাদের  দুজনেরই নামটি বেশ পছন্দ হলো। নার্গিসের মুখে সবসময়ই হাসি লেগেই থাকে। যেই কোলে নেওয়ার জন্য হাত বাড়ায়, তার কোলেই যায়।
     দেখতে-দেখতে ৫ টা বছর কেটে গেলো। নার্গিস ও অনেকটায় বড় হয়ে গেছে। ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করেছি এই জানুয়ারিতে। খুবই শান্ত -শ্রিষ্ট মেয়ে, সারাদিন  কোনো টু -টা শব্দ নেই। এতো অল্প বয়সেই আলেয়ার অনেক কাজে সহযোগিতা করে। সকালে মক্তবে আরবি পড়তে যায়। আবার সেখান থেকে এসে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে স্কুলে যায়। স্কুল থেকে আসার পর গোসল করে খাওয়া-দাওয়ার পর ১ ঘন্টা ঘুমায়। বিকালে কিছুক্ষন খেলাধুলার পর সন্ধায় আবার পড়তে বসে। এভাবেই দেখতে- দেখতে আরও ৫ টা বছর কেটে গেলো।
     একদিন সকালে, শীত তখনো শেষ হয়নি। আমি বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছিলাম, হঠাৎ নার্গিস এসে বললো, বাবা আজ আমাদের সমাপনী পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে। ওমা তাই তো, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। বাবা, তোমার মোবাইলটা আজ আমাকে দাও। কেনো মা, মোবাইল দিয়ে তুমি কি করবে? তুমি কি জাননা? আমাদের রেজাল্ট এখন মোবাইলে মেসেজ দিয়ে আনা যায়। হ্যা,জানি তো কিন্তু তুমি কি আনতে পারবো? হ্যা, বাবা পারবো। আমাদেরকে ক্লাসে স্যার শিখিয়েছেন, কি করে বাড়িতে বসে থেকেই মোবাইলে রেজাল্ট আনতে হয়।আচ্ছা ঠিক আছে, এই বলে আমি নার্গিসকে মোবাইল দিয়ে বাজারে  চলে গেলাম মিষ্টি আনতে। কারণ আমি জানি, নার্গিস জিপিএ-৫ পাবে। কারণ ক্লাস ওয়ান থেকে শুরু করে  ক্লাস  ফাইভ পর্যন্ত, সবসময়ই ক্লাসে প্রথম ছিলো। তাছাড়া ও এমনিতেই অনেক মেধাবী। একটা পড়া এক-দুইবার পড়লেই তার আতস্ত হয়ে যায়।মিষ্টি নিয়ে বাড়িতে ফিরতে-ফিরতে প্রায় ২ টা বেজে গেলো। বাড়িতে ঢুকেই দেখলাম অনেক ভিড়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক, আমাদের উপজেলার রিপোর্টার জালাল উদ্দিন সহ আরও অনেকেই। প্রধান শিক্ষক মতি মিয়া, আমাকে দেখেই বললো, বাহ কবির ভাই আপনি দেখছি মিষ্টি নিয়েই ফিরেছেন। আপনার মেয়ে, ঢাকা বোর্ডে প্রথম হয়েছে। কথাটা শুনার সাথে-সাথেই আমি কেঁদে ফেললাম। আমি জানতাম , আমি জানতাম- আমার  মেয়ে ভালো রেজাল্ট করবে। কিন্তু এতো ভালো  আমি কখনো আশা করিনি। আমার মা, আমার মুখ উজ্জ্বল করেছে।
     মতি মিয়া -শুধু তোমার নয়, আমাদের গ্রাম, স্কুল, উপজেলা, জেলা, সবকিছুরই মান বাড়িয়ে দিয়েছে, তোমার মেয়ে। দোয়া করি, তোমার মেয়ে অনেক বড় হোক। হ্যা, আমি আমার সবকিছু বিক্রি করে হলেও আমার মেয়েকে অনেক বড় ডাক্তার বানাবো। সবাইকে মিষ্টিমুখ করানোর পর জালাল উদ্দিন আমাদের সাথে নার্গিসের ছবি তোলে নিলেন। সেই ছবি নাকি কালকের পত্রিকায় ছাপানো হবে।
     গ্রামের প্রায় সবাই আমাদের প্রসংসা করতে লাগলো এবং আমার ও বেশ ভালোই লাগছিলো। তবে এই ভালো লাগা বেশিক্ষণ দীর্ঘস্বায়ী হলো না। কারণ সন্ধায় যখন বাজারে গেলাম তখন চায়ের দোকানে গনি, আলতাব আর কদ্দুস আমাকে দেখে পরের মেয়েকে নিয়ে এতো আনন্দে আত্মহারা হয়ে কি লাভ? দুইদিন পর তো পরের মেয়ে পরের ঘরেই চলে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদ। দুই- একজন (আলতাফ,হেলাল)তো আমার সাথে সরাসরি- শুনলাম তুমি নাকি তোমার মেয়েকে ডাক্তার বানাবে? শোনো, পরের মেয়েকে ডাক্তার বানিয়ে কি লাভ? তার চেয়ে বরং পড়াশোনা বাদ দিয়ে ঘরের কাজে খাটিয়ে নাও। আমি রোবটের মতো দাড়িয়ে শুধু শুনলাম, কোনো উত্তর দিলাম না। কারন এতোদিনে প্রায় এই কয়েকজন বাদে বাকি সবাই ভুলেই গেছে নার্গিস আমার মেয়ে না, তাই আমি ওদের সাথে হাঙ্গামা বাধিয়ে বাকিদের মনে করাতে চাই না। তাই কোনো কথা না বলেই বাজার থেকে ফিরে এলাম।
     ঐদিন রাতে নার্গিস ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি আর আলেয়া মেয়েকে কোন স্কুলে ভর্তি করাবো এই নিয়ে আলোচনা করছিলাম। হঠাৎ নার্গিস, ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে উঠলো। কি হয়েছে মা? কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছো?  এই বলে আলেয়া নার্গিসকে জড়িয়ে ধরলো। নার্গিস হাফিয়ে - হাফিয়ে বললো আমি দেখলাম, একজন মহিলা একটা বাচ্চা কোলে রাস্তার মাঝ বরাবর দৌড়াচ্ছে, আর তার পিছনে কয়েকজন পুরুষলোক তাকে দাওয়া করছে। হঠাৎ একটা গাড়ি এসে মহিলাটিকে চাপা দিয়ে চলে যায়। মহিলাটি ওখানেই মারা গেলো। কিন্তু বাচ্চাটিকে আর দেখতে পেলাম না।
     ওগো মেয়ে কি বলছে এসব? আরে এসব কিছু না। নার্গিস মা তুমি ঘুমাও এসব কিছু না, স্বপ্ন তো স্বপ্নই। আলেয়া নার্গিসের সাথেই শুয়ে পড়লো। আমি শুয়ে-শুয়ে ভাবতে লাগলাম, এটা কি করে সম্ভব? নার্গিস যে স্বপ্ন দেখলো, এটা তো ওর মায়ের সাথেই মিলে যায়। এমনটা কি করে হতে পারে? ওর মা যখন মারা যায় তখন তো ও দুধের  বাচ্চা। মনে হয় নার্গিসের ভালো ফলাফল, ওর মা ওপাড় থেকে দেখছে, আর মেয়ের জন্য প্রানভরে দোয়া করছে। হইতো তাই নার্গিস এই স্বপ্ন দেখেছে। এটায় শেষ নয়, সেদিন থেকে প্রায় কয়েক দিন পর পরই নার্গিস এই একই স্বপ্ন, বারবারই দেখতে থাকে। হয়তো জীবনে যতদিন বাঁচবে, ততদিন দেখতেই থাকবে।
     নার্গিসকে হাজীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করে দিলাম। সে নিয়মিত স্কুলে যায় এবং মনোযোগ দিয়েই লেখা-পড়া চালিয়ে যেতে লাগলো। কারণ তার যে অনেক বড় ডাক্তার হওয়া লাগবে। এটা শুধু আমার নয়, এখন তার ও স্বপ্ন  হয়ে গেছে। এভাবেই ১ বছর কেটে গেলো। নার্গিস ৭ম শ্রেণিতে উঠেছে এবং এবারও ক্লাসে প্রথম হয়েছে। জানুয়ারীর ১৩ তারিখ হঠাৎ আলেয়া স্টোক করলো। তাড়াতাড়ি করে আলেয়াকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। এ যাত্রায় আলেয়া বেঁচে গেলেও  তার দুটি পা অবশ হয়ে গেলো। রান্নাঘর থেকে শুরু করে সমস্ত বাড়ির কাজ এখন নার্গিস নিজেই করে সেই সাথে আলেয়ার সেবা তো আছেই। সবকিছু করার পর আবার স্কুলে যায়, স্কুল থেকে এসে রান্নার কাজ শেষ করে আবার অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করে। এভাবেই দেখতে-দেখতে আরও ৬ টি বছর কেটে গেলো। 
     আজ আর আলেয়া নেই, সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে পরপাড়ে। নার্গিসও অনেক বড় হয়েছে, সেই সাথে দ্বায়িত্বশীলও। সংসারের সমস্ত কাজ করার পাশাপাশি জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি সবগুলো পরীক্ষায় জিপিএ -৫ পেয়ে কৃতিত্বের সাথে পাস করলো। নার্গিসকে বললাম, মেডিকেলের জন্য রেটিনাতে কোচি করতে। না বাবা, আমি কোচিং করবো না। আমাকে শুধু একটা মেডিকেলের প্রশ্ন ব্যাংক, ইংরেজি আর সাধারণ জ্ঞানের জন্য কয়েকটা বই  কিনে দাও। আর কোনো বই লাগবে না? না বাবা লাগবে না। বাকি গুলোর জন্য পাঠ্য বই পড়বো। শুধু কি পাঠ্য বই পড়লেই হবে মা? হবে বাবা, আমাদের স্যার বলেছেন, মেডিকেলের সব প্রশ্ন পাঠ্য বই থেকেই হয়। তাই নার্গিসকে আর কোচিং-এ ভর্তি করালাম না শুধু ঐ বই গুলো কিনে দিলাম। নার্গিস ঘরের কাজ শেষ করে সারাদিন পড়ে, আবার ঐদিকে রাত  দুইটা পর্যন্ত পড়ে। মেডিকেলে যেদিন আবেদন করবে, সেদিন নার্গিস সকাল-সকাল তারাকান্দা বাজারে চলে গেলো, তা না  হলে ময়মনসিংহের সিট খালি থাকবে না। তাছাড়া ঐদিন সার্ভারে অনেক সমস্যা ও করে। আবেদন শেষ করে নার্গিস বিকাল সারে চারটার সময় বাড়িতে এলো। বাবা ঢাকা প্রথম, সলিমুল্লাহ দ্বিতীয় আর ময়মনসিংহ মেডিকেল তৃতীয় সিরিয়ালে এবং তারপর বাকিগুলো দিয়েছি। ঠিক আছে মা, কোনো সমস্যা তো হয়নি? না বাবা, সব ঠিকটাকই হয়েছ। দিন যায় নার্গিসের পড়াশোনাও বেড়ে গেলো। দিনে ৩ ঘন্টও ভালো করে ঘুমায় না। মা নার্গিস, তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে। না বাবা, আমার কিচ্ছু হবে না। তুমি দেখো। তাই যেনো হয় মা। দেখতে দেখতে পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এলো। নার্গিসের সিট পড়লো আনন্দমোহন সরকারি কলেজে। পরীক্ষার দিন সকালে, আমি নার্গিসকে নিয়ে গেলাম। নার্গিস পরীক্ষার হলে ঢুকার আগে- আমার পায়ে সালাম করে, বাবা আমার জন্য দোয়া কইরো। এ কি বলছো মা, এটা কি বলতে হয়? তোমার জন্য আমার দোয়া, সবসময়ই থাকবে। পরীক্ষার এক ঘন্টা সময় শুধু আল্লাহর কাছে একটা প্রার্থনা করেছি, তিনি যেনো নার্গিসকে, মেডিকেলে চান্স পায়িয়ে দেন।পরীক্ষা শেষ করে অনেকেই বের হয়ে গেছে। কিন্তু নার্গিস এলো প্রায় সবার শেষে। কেমন হয়েছে মা? বাবা অনেক ভালো হয়েছে ৯৬ টা দাগিয়েছি। সবগুলোই কি হবে মা? আল্লাহর রহমতে আশা করা যায় বাবা। দোয়া করি মা, যেনো সব গুলোই হয়।
     তিনদিন পর যখন ফলাফল প্রকাশ করলো, তখন আমি আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। নার্গিস সারা বাংলাদেশে প্রথম হয়েছে। সত্যিই এটা আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হইলো।কারণ নার্গিস কোনো কোচিং পড়েনি, বাড়ির সবকাজ করে যতটুকু সময় পেয়েছে সেই সময়টুকুই পড়ে ও প্রথম হয়েছে। সমস্ত গ্রামে এই খবর ছড়িয়ে পড়লো আর সবাই নার্গিসের প্রশংসা করতে লাগলো। আমি গ্রামের সবাইকেই প্রায় মিষ্টিমুখ করালাম।
     বিকালে অনেকগুলো টিভি চেনেল বাড়িতে এসে নার্গিসের ইন্টারভিউ নিলো। সেই সাথে অনেকগুলো কোচিং সেন্টারের পরিচালকও আসলো। তারা নার্গিসের ছবি তুললো আর তাদের কোচিং-এ নার্গিসকে যেতে বললো, তারা নাকি নার্গিসকে অভ্যর্থনা দিবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম নার্গিস তো কোনো কোচিং-এ যায়নি, তবে আপনারা সবাই কেনো ওর ছবি নিচ্ছেন? আরে চাচা এতে কোনো সমস্যা নেই। আমরা আপনার মেয়ের ছবি আমাদের কোচিং সেন্টারে টানিয়ে রাখবো। পরবর্তী বছর যারা মেডিকেলে পরীক্ষা দিবে যাতে তারা অনুপ্রেরণা পায়। এরা চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর আবার ও তিন-চারটা কোচিং সেন্টারের পরিচালক আসলো, নার্গিসের ছবি তুলতে। আমি বললাম, এই মাত্রই তো অনেকগুলো কোচিং সেন্টারের পরিচালক নার্গিসের ছবি তুলে নিলো। আবার আপনারা কেনো? চাচা নার্গিস এখন সবার, সবগুলো কোচিং সেন্টারেরই এখন নার্গিসের ছবি দরকার। তারা ও যাওয়ার আগে বলে গেলো তাদের কোচিং-এ  যাওয়ার জন্য। 
     অনেকগুলো কোচিং সেন্টারেই আমি নার্গিসের সাথে গেলাম। তারা নার্গিসকে অভ্যর্থনা হিসাবে ল্যাপটপ, টাকা পুরষ্কার দিলো। আর দেখলাম সবার কোচিং-এ লেখা প্রথম সহ সেরা দশজন, পনেরোজন, বিশজন আমাদের কোচিং থেকে চান্স পেয়েছে। এবার বুঝতে পারলাম কেনো তারা নার্গিসের ছবি তুলে এনেছিলো। এটা যে তাদের কোচিং ব্যবসারই একটা কাজ ছিলো। আর অন্য ছাত্র-ছাত্রীকে অনুপ্রেরণা যোগাতে নয় বরং তাদের নিজেদের ব্যবসার লাভের জন্যই ছবি তুলে এনেছিলো।
     আমার সারা জীবনের জমানো টাকা, ব্যাংক থেকে এনে নার্গিসকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করালাম। গতকাল নার্গিস ঢাকা চলে গেছে। যাওয়ার আগে রানুর মাকে ঠিক করে গেলো, আমাকে রান্না করে দেওয়ার জন্য। রানুর মা সকালে এসে ভাত-তরকারি রান্না করে দিয়ে যায়। আর আমি এগুলোই গরম করে করে তিন বেলা খায়। নার্গিস মাঝে-মাঝে বাড়িতে আসে একদিন -দুইদিন থেকে আবার চলে যায়। এভাবেই দেখতে-দেখতেই চারটি বছর কেটে গেলো।
     নার্গিস এবছর এম বি বি এস পাস করেছে।  ইন্টার্নিতে জয়েন্ট করবে সামনের সপ্তাহে। তাই এই কয়েকটা দিন বাড়িতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু হঠাৎ  বিকালে নার্গিস এসে বললো, বাবা চলো আমরা কাল  কোথাও ট্রুরে যায়। কোথায় যাবে মা? যাবো কক্সবাজার, না থাক ওখানে না চলো আমরা কুয়াকাটা যাই।সেখানে সূর্যোদয় আর সূর্য অস্ত এক সাথে  দেখা যায়। কিন্তু কোয়াকাটা তো অনেক দূরে। দূরে তাতে কি? আমরা তো আর হেটে যাবো না , গাড়িই আমাদের নিয়ে যাবে। এই বলে নার্গিস শামিম এন্টারপ্রাইজ এ ফোন দিয়ে আমাদের টিকেট কনফার্ম করলো।সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিটে বাস ময়মনসিংহ  ব্রিজের নিচ থেকে ছাড়বে। তবে সমস্যা  হলো ঐ বাস সরাসরি কুয়াকাটা পর্যন্ত যাবে না। বরিশাল নামাবে সেখান থেকে আবার কুয়াকাটার বাসে উঠতে হবে।
     পরের দিন বিকাল ৩.৩০ এ আমরা বাড়ি থেকে রওনা দিলাম। সন্ধ্যা ৬ টায় আমরা কাউন্টারে গিয়ে পৌছালাম এবং আমাদের টিকেট বুঝে নিলাম। বাস ঠিক সময়েই ছাড়লো। আমরা যখন মাওয়া ফেরিঘাটে গেলাম তখন ৮.৫৪ বাজে। নার্গিস বাড়ি থেকে নুডলস ও ডিম সিদ্ধ করে এনেছে। আমরা বাসে বসেই নাস্তা করে নিলাম। ফেরি পার হয়ে বাস আবার চলতে শুরু করলো। নার্গিস আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। চাঁদনী রাতে আমি বাসের জানালা দিয়ে বাহিরে থাকিয়ে দেখছিলাম গাছগুলো কেমন পিছনে ছুটে যাচ্ছে। নিঃশব্দ চারপাশ, মাঝে-মাঝে কিছু ঝিঝি পোকা ডেকে উঠে, সেটাও আবার অনেক দুরে । কতো দুরে সেটাও আন্দাজকরা যাচ্ছে না।  হঠাৎ একটা জোনাকি পোকা, বাসে ঢুকে পড়লো। জোনাকি সমস্ত বাস ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি জোনাকির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়লাম।
     বাবা উঠো, আমরা বরিশাল এসে পড়েছি, উঠো। তখন ভোর ৪ টা বাজে আমরা বাস থেকে নেমে দাড়ালাম। একটু পরেই কুয়াকাটাগামী একটা বাস আসলো। প্রায় অর্ধেক যাত্রীই বরিশাল নেমে গেলো। আমরা ঐ বাসে চেপে বসলাম ভাড়া ১৫০ টাকা করে প্রতি সিট। আমরা যখন কুয়াকাটা পৌঁছালাম তখন সকাল ৭.৩০ বাজে। আমরা মায়ের দোয়া আবাসিক হোটেলের দোতলায় একটা ডাবল সিটের রুম নিলাম। তারপর  আমরা দুজনেই ফ্রেশ হয়ে বাহির থেকে খেয়ে আসলাম। অল্প সময় বিশ্রাম করে আমরা সমুদ্রের পাড়ে গেলাম। নার্গিস পানিতে নেমে অনেকক্ষণ ভিজলো। পরে আমরা বাপ বেটি এক সাথে অনেকগুলো ছবি উঠালাম। সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত দেখার জন্য গেলাম। সূর্যাস্তের দৃশ্য আসলেই অনেক সুন্দর ছিলো। গোধূলির লাল আভা সমুদ্রে প্রতিচ্ছবি হয়ে ঝলমল-ঝলমল করছে। এর আগে কখনো এমনটা দেখা হয়নি। আমরা হোটেলে ফিরার সময় রাতের খাবার খেয়ে আসলাম। তারপর ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। তখন রাত প্রায় ৩ টা বাজে, হঠাৎ নার্গিসের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেলো। কি হয়েছে মা? নার্গিস কাঁদছিস কেনো? বাবা সেই স্বপ্নটা আজকে আবার দেখলাম ঐ মহিলা আমাকে বলছে আমি তোর মা। তুই আমার কাছে আসবি না? এই বলে ঐ মহিলা আমাকে কোলে করে তার কাছে নিয়ে যেতে থাকলো। তাই আমি ভয়ে---। আমি নার্গিসকে থামিয়ে বললাম, পাগল মেয়ে কান্না করে না, আরে স্বপ্ন তো স্বপ্নই। আর স্বপ্নের মাঝে কি কেউ কাউকে নিতে পারে? কোনো ভয় নেয় মা, ঘুমিয়ে পড়ো।
     ঐদিন আমি আর ঘুমাতে পারলাম না। ভাবতে লাগলাম এবার সময় হয়েছে, যে সত্যিটা এতোদিন মনের ভিতর চাপা দিয়ে রেখেছি তা নার্গিসকে কালই বলে দিবো। সকালবেলা নার্গিসকে ঘুমে রেখেই আমি বাহির থেকে পরোটা আর ডিম ভাজি নিয়ে আসলাম। নার্গিস ঘুম থেকে উঠার পর আমরা একসাথেই নাস্তা করলাম। নার্গিস তুমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছো। একজন বাবার যতটুকু দ্বায়িত্ব, হইতো আমি তা পালন করতে পারিনি। তবে মা, আমি তোমাকে আমার জায়গা থেকে সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এসব তুমি কি বলছো বাবা? পৃথিবীতে কয়জনের এমন ভাগ্য যে, তোমার মতো বাবা পায়? আমার কোন চাওয়া-পাওয়াকে তুমি অপূর্ণ রেখেছো কোনোদিন? কোনোকিছু মুখ থেকে বের করার আগেই তুমি তা আমায় এনে দিয়েছো। তোমার মতো এমন বাবা পেয়ে আমি সথ্যিই গর্ববোধ করি।
     নার্গিস আজ তোমাকে একটা সথ্যি কথা বলার আছে, যা আমি এত দিন বুকে চাপা দিয়ে রেখেছিলাম। কি এমন কথা বাবা? যা তুমি আমায় বলো নি। আমি তোমার বাবা নয়। আর যে মহিলাকে তুমি মাঝে-মাঝে স্বপ্নে দেখো সে আর কেউ নয়, তোমার গর্বধারিনী মা। এসব তুমি কি বলছো বাবা? হ্যা মা, আমি সথ্যি কথায় বলছি।আর যে লোকগুলোকে তুমি তাড়া করতে দেখতে, সেখানে একজন তোমার বাবা। না বাবা এ হতে পারে না, এটা আমি বিশ্বাস করিনা। বিশ্বাস তোমাকে করতেই হবে মা, কারণ বাস্তবতাকে তোমার মানতেই হবে। কিন্তু, বাবা কেনো মাকে মারার জন্য তাড়া করেছিলো? তাহলে শোনো, এরপর আমি সমস্ত ঘটনা নার্গিসকে বললাম। সব শুনে নার্গিস বললো, ঐদিন যদি আমার মা বেঁচে থাকতো তাহলে হয়তো  আমাকে বাঁচাতে পারবে না। এটা মনে হয় মা বুঝতে পেরেছিলো। তাই আমাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন আত্মাহুতি দিলেন। মা তুমি কোনো চিন্তা করো না। তোমার বাবার চেহেরা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, যদি কখনো তার সাথে দেখা হয়, সোজা তোমার কাছে নিয়ে আসবো। কোনো দরকার নেই বাবা, যে টাকার জন্য নিজের স্ত্রী -সন্তানকে মারতে পারে, সে আর যাই হোক। কারো বাবা হতে পারে না। আরে সথ্যিকারের বাবা তো তুমি, যে আমাকে জন্ম না দিয়ে ও বাবার দ্বায়িত্বটা পুরোপুরি পালন করে গেছো। সেই ছোট বেলা থেকে তোমাকেই বাবা বলে জেনেছি, তাই তুমিই আমার বাবা। আমার আর অন্য কোনো বাবা নেই। আমার মা আমাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে, তাই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, আমার মাকে যেনো তিনি জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করেন। এই বলে নার্গিস বিছানায় শুয়ে মাথা নিচের দিকে দিয়ে কাঁদতে লাগলো। আমি ও আর বাধা দিলাম না। কাঁদুক, মন ভরে কাঁদুক, কেঁদে-কেঁদে মনটাকে হালকা করুক। মনটা অনেক হালকা হয়ে গেলো, যে সত্যি টা আমাকে এতোদিন কুঁড়ে -কুঁড়ে খাচ্ছিলো, আজ আমি মুক্তি পেলাম। তবে নার্গিসের কান্না দেখে খুব খারাপ লাগছে। কারণ আলেয়ার মৃত্যুর পর ওকে আর কোনোদিন কাঁদতে দেখিনি। আবার নার্গিসের কাল রাতের স্বপ্ন টা আমাকে ভাবিয়ে তোললো, কেনো নার্গিস এ রকম স্বপ্ন দেখে? নার্গিস এতোদিন যে স্বপ্ন টা দেখে এসেছে তা তো সত্যিই ছিলো। কাল রাতে ও দেখলো ওর মা ওকে তার কাছে যাওয়ার জন্য ডাকছে। মানুষে তো বলে-কোনো মানুষকে যদি, কোনো মৃত মানুষ ডাকে তাহলে নাকি সেই মানুষ আর বেশিদিন বাঁচে না। তবে কি নার্গিস... না, না এ হতে পারে না ইত্যাদি- ইত্যাদি ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়লাম । বাবা উঠো, তিনটা বেজে গেছে। নার্গিসের ডাকে ঘুম ভাংলো। ঘুম থেকে উঠে দেখি নার্গিস বাহির থেকে দুপুরের খাবার এনে রেখেছে। খাবার কখন এনেছো? এই মাত্রই বাবা, যাও তাড়াতাড়ি গোসল করে এসো, তারপর খেয়ে বাইরে যাবো। কিছু কেনাকাটা করবো। গোসল করে খেয়েদেয়ে আমরা বাজারে গেলাম। নার্গিস কিছু ঝিনুকের মালা, চকলেট ও কিছু আচার কিনলো।
     তারপর গেলাম রাখাইন মার্কেটে। বাবা দেখতো এই পাঞ্জাবি টা কেমন?  হ্যা ভালোই তো। এই খদ্দরের চাদর টা দেখি তো নার্গিস দোকানদার কে বললো। দোকানদার চাদর দিলে তা আমার গায়ে জড়িয়ে বাবা এটা তোমায় বেশ মানিয়েছে। আমার জন্য পাঞ্জাবি আর চাদর আর ওর জন্য একটা থ্রি-পিছের কাপড় নিয়ে আমরা হোটেলে ফিরার পথে আমাদের বাড়ি আসার জন্য কাউন্টার হতে ঢাকার টিকেট কাটলাম। যদিও আমার কাপড় কেনার কোনো ইচ্ছে ছিলো না  তবুও না করলাম না, যদি আবার মন খারাপ করে। সকাল ৫ টায় বাস ছাড়বে, তাই রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের প্রায় ১১ টা বেজে গিয়েছে। ঢাকা থেকে যখন বাড়িতে আসলাম তখন ৩ টা বেজে গেলো। এভাবেই শেষ হলো আমাদের কুয়াকাটা ট্রুর।
     গতকাল নার্গিস ইন্টার্নিতে চলে গেছে। খুবই খারাপ লাগছে, বারবার কেনো জানি শুধু ওর কথা মনে পড়ছে। যদি ও দিনে ২ বার করে ফোনে কথা হয় । নার্গিস যাওয়ার আগে আমায় বলেছে ইন্টার্নি শেষ করে আবার উচ্চতর ডিগ্রির জন্য বিলাত যাবে। তখন আমায় সাথে করে নিয়ে যাবে। কিন্তু এই ৬ মাস তো অনেক দিন। আর এই দিন গুলো আমাকে একা একাই গুনতে হবে। রানুর মা আবার সকালে রান্না করে দিয়ে চলে যায়, আর আমি এগুলো সকালে আর বাকি খাবার ফ্রিজে রেখে রাতে গরম করে খায়। এভাবেই চলে গেলো আরও ৬ টি মাস।
     আজ নার্গিস বাড়িতে এসেছে। এসেই বললো বাবা আমি এবারও ইন্টার্নিতে প্রথম হয়েছি এবং স্যাররা আমার বিলাত যাওয়ার সব ব্যবস্থা করেছেন। আগামি মাসেই আমার ফ্লাইট। কিন্তু বিশ্বাস করো বাবা, আমি এসবের কিছুই জানতাম না। স্যার সবকিছু ঠিকটাক করে আমায় বলেছে। তাতে কি হয়েছে? এটা তো ভালো খবর, বিলাত না গেলে বড় ডাক্তার হবে কি করে? এটা যে আমার অনেক দিনের স্বপ্ন, তুমি অনেক বড় ডাক্তার হবে। কিন্তু বাবা আমি তো বলেছিলাম তোমায় সাথে করে নিয়ে যাবো।
     কিন্তু স্যার বলেছেন স্কলারশিপে গেলে নাকি একাই যেতে হবে।তাই আমি ঠিক করেছি আমি তোমাকে এভাবে একা রেখে যাবো না। পাগলি মেয়ে কোথাকার? একা তাতে কি হয়েছে? আমি আমাকে সামলে নিবো। কিন্তু বিলাত তো তোমায় যেতেই হবে মা, না হলে যে আমার স্বপ্ন পূরণ হবে না। তুমি কি আমার স্বপ্ন পূরণ করবে না মা বলো? নার্গিস অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো ঠিক আছে বাবা।
     একমাস পর নার্গিস বিলাত চলে যাবে, আবার আমি একা হয়ে যাবো। আবার একাই সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি নার্গিসের পথের পানে চেয়ে-চেয়ে দিন গুনতে হবে। একাকিত্ব জীবন কি যে যন্ত্রণাদায়ক তা এখন বুঝতে পারছি। মা-বাবার মৃত্যুর পর আলেয়া ছায়ার মতো আমার পাশে ছিলো। আমার সুখ-দুঃখ সবকিছুই ভাগ করে নিয়েছিলো। বিপদে-আপদে সবসময়ই আমায় সাহস যুগিয়েছে।  একাকিত্ব জীবনের কষ্ট অনুভব করেই মনে হয় আলেয়া মৃত্যুর আগে আমায় বলেছিলো-আরেকটা বিয়ে করতে। সেদিন আমি আলেয়াকে সঙ্গে সঙ্গে বলে দিয়েছিলাম, না এ জীবনে তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে স্থান দিতে পারবো না।  বাবা খাবে এসো নার্গিস ডাকলো। খাওয়া -দাওয়া শেষ করে আমি আমার রুমে শুতে গেলাম। কিছুক্ষণ পর নার্গিস এসে বাবা তোমার মোবাইল টা দাও তো। আমি মোবাইল দিলাম এবং নার্গিস একটা এন্ড্রয়েড ফোনে আমার ফোনের সিম ভরে দিয়ে বাবা এই নাও আজ থেকে এই ফোন তোমার। আমি যখন বিলাত চলে যাবো তখন তোমার সাথে ভিডিও কলে কথা বলবো। কিন্তু মা, তুমি এতো টাকা পেলে কোথায়?  বাবা আমি ইন্টার্নিতে প্রথম হওয়ায় আমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা বৃত্তি দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকেই দশ হাজার টাকা দিয়ে তোমার জন্য এই ফোন টা এনেছি, এই যে বাকি টাকাটা তোমার কাছে রেখে দাও। আমি টাকা দিয়ে কি করবো মা?  তার চেয়ে বরং এগুলো তুমি তোমার কাজে ব্যবহার করো। বাবা আরেকটা কথা ছিলো। কি কথা মা? বাবা আমি চায় বিলাত যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের গ্রামের হাসপাতালে আমি গ্রামের লোকদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করবো। আর এই টাকাটা সেই কাজেই ব্যয় করবো। যদি তোমার কোনো আপত্তি না থাকে।  আপত্তি থাকবে কেনো? এটা তো ভালো উর্দোগ। ধন্যবাদ বাবা, আমি জানতাম তুমি রাজি হবে। তাহলে আমি কাল থেকেই চিকিৎসা দেওয়ার কাজ শুরু করবো। ঠিক আছে বাবা তুমি তাহলে এখন ঘুমিয়ে পড়ো, এই বলে নার্গিস নিজেও ঘুমাতে গেলো। আমি নতুন ফোনটা কিছুক্ষণ দেখে তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম।
     পরেরদিন সকালে খাওয়া-দাওয়ার পর নার্গিস আমার পা ছুয়ে সালাম করে, বাবা আমার জন্য দোয়া কইরো, আজ আমি প্রথম রোগি দেখতে যাচ্ছি। ঠিক আছে মা, অনেক বড় ও। নার্গিস চলে গেলো হাসপাতালে, সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি রোগি দেখে। ফ্রি প্রেসক্রিপশন করে দেয়,মাঝে-মাঝে ফ্রি কিছু ঔষধ দেয়। এভাবেই বেশ কয়েকদিন চলে গেলো। গ্রামের সবাই নার্গিসের প্রসংসা করতে লাগলো,সাথে আমারও। যেই মানুষ গুলো (গনি, আলতাব, কদ্দুস,আলতাফ আর হেলাল) একদিন এতোকথা বলেছিলো, নার্গিসকে পড়ানোর দরকার নেই, পরের মেয়ে ইত্যাদি। তারাই আজ  আবার আমার কাছে এসে ভুল স্বীকার করলো,অনুতপ্ত হলো। আলতাফ বললো, আসলে ঐদিন আমি অনেক বড় ভুল করেছিলাম। তুমি আমাকে মাফ করে দাও। আসলে তুমিই ঠিক করেছো, পরের মেয়ে হওয়া সত্বেও তুমি নার্গিসকে ডাক্তার বানিয়েছো। আর আমি নিজের একটা সন্তানকেও মানুষ করতে পারলাম না। বড় ছেলে আজ পাচ বছর যাবৎ চায়নাতে গিয়ে পড়ে আছে। প্রথম-প্রথম দুই তিন মাস পর পর কয়েক হাজার করে টাকা দিতো। আর এখন দেয় না বললেই চলে, এই বলে আলতাফ কেঁদে ফেললো। আরে ভাই  তুমি কাঁদছো কেনো? দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আলতাফ হু, তাই যেনো হয় ভাই, তাই যেনো হয়। এভাবে আরো বেশ কয়েকদিন চলে গেলো। নার্গিসের বিলাত যাওয়ার সময় ও ঘনিয়ে আসছে।
     একদিন সকালে, নার্গিস এসে বললো  বাবা, নতুন এক ভাইরাস আবিষ্কার হয়েছে। চায়নার উহানে এই ভাইরাস প্রথম ধরা পড়ে। এবং সেখানে মহামারি আকার ধারন করেছে। এই ভাইরাসের নাম হলো করোনা ভাইরাস। এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের কোনো ঔষধ আবিষ্কার হয়নি। মানুষের সংস্পর্শের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়। তাই চায়না সরকার  সবকিছু লকডাউন করে দিচ্ছে। ফলে চায়নাতে কর্মরত অনেক বাংলাদেশী দেশে চলে আসছে। আমাদের আলতাফের ছেলে তো চায়নাতে থাকে। তাহলে তো সেও চলে আসবে? আচ্ছা বাবা চলো খাবে। আমার আবার রোগি দেখার সময় হয়ে যাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়ার পর নার্গিস রোগি দেখতে চলে গেলো। আর আমাকে কিছু ঔষধের লিস্ট দিয়ে ওগুলো আনতে বললো। তাই আমি সেগুলোই আনতে বাজারে যাচ্ছি। পথে আলতাফের সাথে দেখা হলো। আমায় দেখে বললো, কবির ভাই তোমার কথা আল্লাহ শুনেছেন। আগামীকাল আমার ছেলে বাড়ি আসবে। এ তো ভালো খবর। মহামারির জন্য যে চলে আসতেছে আমি আর তা বললাম না। শুধু বললাম সাবধানে থাইকো। এভাবে আরো আট-দশ দিন চলে গেলো। বাংলাদেশেও এখন অনেকেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। চায়নার সাথে বাংলাদেশের সকল যোগাযোগ বন্ধ। অনেকেই চায়নাতে আটকা পড়েছে দেশে আসার জন্য অনেক চেষ্টা করছে। কিন্তু আসতে পারছে না। নার্গিসের ও যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তিনদিন পর ওর ফ্লাইট।
     পরেরদিন সকালে আলতাফ এসে বললো, কবির ভাই নার্গিস কোথায়? ছেলেটার অনেক জ্বর, স্বর্দি-কাশি সাথে শ্বাসকষ্ট ও আছে। যদি ছেলেটা কে একটু দেখে আসতো। সাথে সাথেই নার্গিস ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে কি বলছেন চাচা? ওরে তো আমি হোম কোয়ারান্টাইনে থাকতে বলেছিলাম। গ্রামের প্রায় সবাই এখন করোনা ভাইরাস সম্পর্কে ভালোভাবেই জানে।আলতাফ চাচারও বুঝতে বাকি রইলো না, আসলে আমি কি বুঝাতে চাচ্ছি। আলতাফ চাচা কাঁদো কাঁদো গলায়, কে শুনে কার কথা? কতোকরে বললাম যাসনে বাবা, তবুও আমার কথা শুনলো না। চার-পাঁচ দিন আগে পাশের গ্রামের ওর বন্ধুকে দেখতে গিয়েছিলো। সেও নাকি চায়নাতে থাকতো। চাচা কাজটা কিন্তু খুবই খারাপ করেছে। আপনি কি জানেন? সমস্ত গ্রাম এখন ঝুঁকিতে আছে। চলেন আমার সাথে, এই বলে নার্গিস হ্যান্ড গ্ল্যাভস আর মাস্ক পরে আলতাফের বাড়ির দিকে যখন যাবে তখন আমি মা তুই? নার্গিস বললো, বাবা এটা আমার কর্তব্য, এই বলে চলে গেলো। বিকালে এম্বুলেন্স নিয়ে পুলিশ এসে আলতাফের ছেলে কে নিয়ে গেলো। আর আলতাফে বাড়ি লকডাউন করে দিয়ে গেলো চারপাশে শক্ত করে বেড়া দিয়ে গেলো। সবাইকে বলে গেছে কেউ যেনো ওই বাড়িতে না যায়। এবং ঐ বাড়ির সবার সাথে সকল প্রকার যোগাযোগ বন্ধ। নার্গিস বাড়িতে আসলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, পুলিশ কেনো নিয়ে গেলো? বাবা আমিই ফোন করেছিলাম, কারণ ওর এই গ্রামে থাকা মানে সবার বিপদ। ওইখানে ওরে আইসোলেশনে রাখবে। এতে সেও নিরাপদ থাকবে, সেই সাথে গ্রামের মানুষও।   
     আগামীকাল নার্গিসের ফ্লাইট। কিন্তু রাতে এসে বললো, বাবা আমি বিলাত যাবো না। যাবে না, কিন্তু কেনো? বিলাত না গেলে বড় ডাক্তার হবে কি করে? বাবা বেঁচে থাকলে পরেও যাওয়া যাবে। দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে আমি কি করে দেশের বাইরে যাবো? আমার এই সময়ে দেশের মানুষের জন্য কিছু করা দরকার। তাই আমি স্বেচ্ছাসেবক চিকিৎসক হিসাবে কালই ময়মনসিংহ মেডিকেলে যোগদান করবো। ঠিক আছে মা, তুমি যা ভালো মনে করো তাই করো।
     নার্গিস কাল বিলাত যাবে, বড় ডাক্তার হবে এটা গ্রামের সবাই জানতো। ওর না যাওয়ার বিষয়টাও গ্রামে দ্রুত চড়িয়ে পড়লো। সবাই নার্গিসের প্রসংসা করতে লাগলো। দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে মেয়েটা নিজের ভবিষ্যৎকেই ধুলায় মিশিয়ে দিলো। সত্যি, এমন মেয়ে হাজারে একটাও হয় না।
     নার্গিস সপ্তাহে একবার বাড়িতে আসে, একদিন থেকে আবার চলে যায় মেডিকেলে। আমি মাঝে মাঝে আলতাফের বাড়িতে যাই রাতে, যাতে কেউ না দেখে। তাদের প্রায় সব ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস, আমি রাতের অন্ধকারে দিয়ে আসি।এভাবে পনেরো দিন যাবার পর আলতাফের বাড়ির বেড়া খুলে দিয়েছে পুলিশ। আল্লাহর রহমতে আলতাফের ছেলে ও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এলো। আজ সন্ধ্যায় নার্গিস আবার বাড়িতে এসেছে। বরাবর থেকে এবার আমার সাথে দূরত্ব বজায় রাখছে। কি হয়েছে মা নার্গিস, তুমি দূরে দূরে কেনো থাকছো? বাবা আমি আমার নমুনা পরিক্ষা করতে দিয়েছি। আমি মনে হয় ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে গেছি বাবা। কি বলছো এসব মা? আমি ঠিকই বলছি বাবা তুমি আমার কাছে এসো না। আসবো না মানে?  হ্যা বাবা, আমি চায় না আমার দ্বারা তুমি-----। হ্যা বাবা, কাল রিপোর্ট আসবে। ওটা না দেখা পর্যন্ত তুমি একটু দূরে থাকো। এই বলে নার্গিস রুমের ভিতরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। অনেক ডাকাডাকি করলাম, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। শুধু বললো আমার খাবার টা তুমি জানালার ফাক দিয়ে রেখে যাও বাবা। আমি খাবার রেখে গিয়ে খেতে গেলাম। কিন্তু ভাত আমার গলা দিয়ে নামেনি। হাত ধুয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে রইলাম। চোখে কোনো ঘুম নেই। রাত প্রায় তিনটে বাজে হঠাৎ নার্গিসের চিৎকার বাবা আমায় ধরো আমায় নিয়ে গেলো। মা ও মা আমি যাবো না। আমায় ছেড়ে দাও। কি হয়েছে নার্গিস? দরজা খুলো। আমার গলার আওয়াজ শুনে নার্গিস অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে বাবা, ঐ স্বপ্ন টা আজ আবার দেখেছি। মা আমাকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে। আমি দৌড়ে পালাতে চাইলাম, কিন্তু শত চেষ্টা করেও দৌড়াতে পারছিলাম না। স্বপ্ন দেখে কি ভয় পেতে আছে? স্বপ্ন কখনো সথ্যি হয় না। দরজা খুলো নার্গিস আমি ভিতরে আসবো। না বাবা, আসতে হবে না। আমি ঘুমাবো, তুমিও গিয়ে ঘুমাও। কি আর করবো? আবার গিয়ে শুয়ে রইলাম, ঘুমহীন চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়লাম।
     যখন ঘুম ভাংলো দেখলাম, নার্গিসের রুমে তালা লাগানো, জানালা দিয়ে দেখলাম রুমে কেউ নেই। সাথে সাথেই  নার্গিসকে ফোন করলাম। নার্গিস তুমি কোথায়?  বাবা আমি চলে এসেছি। আমাকে মাপ করে দিয়ো বাবা। জীবনের এই প্রথম, তোমার সাথে আমি এমন ব্যবহার করেছি। বিশ্বাস করো বাবা, আমি তোমার ভালোর জন্য এমনটা করেছি। কি বলছো এসব তুমি? হ্যা বাবা, আজ সকালেই যখন জানতে পারলাম আমার  করোনা পজিটিভ তাই আর দেরি করলাম না। যদি আমার কাছ থেকে তোমার ও না না বাবা তুমি সাবধানে থেকো। আমার করোনা পজিটিভ এটা কাউকে বলো না। তাহলে আমাদের বাড়িও আলতাফ চাচার বাড়ির মতো লকডাউন করে দিবে। বাবা সাবধানে থাকবে, বার বার সাবান দিয়ে হাত ধুবে। আর দিনে মিনিমাম পাঁচ থেকে ছয় বার গরম পানি খাবে।  মানুষের কাছে এখন না যাওয়াই ভালো। ঘরে থাকবে। বাইরে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। বাবা রাখছি আমার কথা বলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে, এই বলে নার্গিস ফোন কেটে দিলো। কিছুক্ষণ পর আতিক, আমাদের পাড়ার মুদি দোকানদার শরীফের ছেলে পাঁচ কেজি চিড়া, দুই কেজি গুড় আর পাঁচ কেজি মুড়ি নিয়ে এলো। কবির চাচা এগুলো নার্গিস আপু আপনাকে দিয়ে যেতে বললো। নার্গিস কি তোদের দোকানে গিয়েছিলো? না চাচা যায়নি। আব্বাকে ফোন করে বললো দিয়ে যেতে। আর টাকা?  টাকা নার্গিস আপু বিকাশ করে দিয়েছে। আচ্ছা ঠিক আছে তুই এগুলো ভিতরে রেখে যা। ঠিক আছে চাচা এই বলে আতিক ওগুলো ভিতরে রেখে চলে গেলো। কিন্তু এগুলো কেনো নার্গিস পাঠালো? নার্গিসের কথা মতো আমি ওর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কথাটা গোপন রাখলেও পরেরদিন সকালে প্রত্যেকটা চেনেল, পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে করোনা রোগির চিকিৎসা করতে গিয়ে চিকিৎসক নার্গিস আক্তার  করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত।
     মুহুর্তের মধ্যে গ্রামে খবরটা ছড়িয়ে পড়লো। দেখলাম গ্রামের কেউ আমার আশেপাশে ও আসছে না, আমার সাথে কেউ কথা ও বলছে না। মনে হলো আমি সবার অচেনা হয়ে গেলাম। বিকালে যখন আলতাফের বাড়ির পাশ দিয়ে বাজারে যাচ্ছিলাম, তখন শুনলাম আলতাফ পুলিশকে ফোন করছে, আমার ছেলের করোনা হয়েছিলো যখন তখন তো আমার বাড়ি বেড়া দিয়ে গেলেন। এখন যে নার্গিস আক্রান্ত হয়েছে, তাহলে ওদের বাড়ি বেড়া দিচ্ছেন না কেনো? নার্গিসের বাবা সমস্ত গ্রাম ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতে তো গ্রামের বাকিরা ও আক্রান্ত হবে। এটা শুনার পর আমার পা আর সামনের দিকে এগোলো না। আমি বাজারে না গিয়ে ফিরে এলাম। সন্ধার আগে পুলিশ এসে আমাদের বাড়ি বেড়া দিয়ে গেলো। আর বলে গেলো- এই বাড়ির সাথে গ্রামের সবার  যোগাযোগ বন্ধ। নার্গিসকে কাল থেকে ফোনে পাচ্ছি না, বারবার বন্ধ দেখাচ্ছে। রানুর মা বেড়ার বাইরে থেকে ডেকে বলে গেলো, ভাইজান আমি আর আসবো না। আসবেই বা কেনো? তার ও তো মৃত্যুর ভয় আছে। আমি রান্না করতে পারি না। রাতে অল্প কয়টা চিড়া খাইলাম। এবার বুঝতে পারলাম নার্গিস কেনো এই চিড়া-মুড়ি পাঠিয়েছিলো। 
     সকালে নার্গিস ফোন করলো। মা নার্গিস তোমার ফোন বন্ধ কেনো? বাবা তুমি কেমন আছো? আমি ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছো? আজ একটু ভালো বাবা, তাই তো ফোন করতে পারলাম। বাবা আমাকে জন্ম না দিলেও তুমি বাবার দ্বায়িত্বটা পুরোপুরি পালন করেছো। কিন্তু আমাকে দেখো, আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। কিছুই করতে হবে না মা তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসলেই হবে মা। বাবা জানিনা একজন ডাক্তার হিসেবে আমি আমার দ্বায়িত্ব কতটুকু পালন করতে পেরেছি? তবে বাবা, আমি আমার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি। তুমি তোমার কর্তব্যে অটুট ছিলে বলেই আজ তোমার এই পরিণতি। পরিণতি বলছো কেনো বাবা? এটাই তো আমার স্বার্থকতা। সত্যি মা, এখনকার সময়ে তোমার মতো বড় মনের মানুষ একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি যদি মরেও যায় তবুও আমার কোনো দুঃখ নেই বাবা। শুধু দুঃখ হচ্ছে তোমাকে নিয়ে। আমার কথা ভেবে তুমি দ্বিতীয় কোনো বিয়েও করোনি। আমি জানি না, সত্যিকারের মা-বাবা কেমন হয়? তবে এতটুকু বলতে পারি তোমাদের মতো কোনো মা-বাবাই হবে না। পরক্ষণেই ঐ পাশ থেকে শুনা গেলো, এ কি করছেন আপনি? একজন ডাক্তার হয়েও আপনি নিজের এতো বড় ক্ষতি কেনো করছেন? এই বলে মনে হয় নার্গিসের হাত থেকে কেউ ফোনটা কেড়ে নিলো। আমার দুচোখ দিয়ে শুধু কান্নার অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
     আজ লকডাউনের নয়দিন হলো। আর এই নয় দিন,  ভাতের সাথে কোনো দেখা নেই। শুধু চিড়া-মুড়ি আর পানি খেয়েই কোনমতে দিন যাচ্ছে। কেউ আমাদের বাড়িতে আসে না। এই নয় দিনে গ্রামের কারও মুখ দেখিনি। নিজেও বের হতে পারি না আর কেউ আসেও না। গ্রামের বাকিদের কথা বাদই দিলাম। আলতাফ ও একদিন আমার বাড়ির ত্রি-সীমানায় পা রাখেনি। অথচ আলতাফের বাড়ি যখন লকডাউন ছিলো, তখন আমি ওদের বাড়িতে রাতের অন্ধকারে গিয়ে সব রকমের প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো দিয়ে আসতাম। ওর ছেলের যখন রোগ ধরা পড়লো আর কেউ নয় নার্গিসই একমাত্র মানুষ যে এগিয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো।  মানুষ এতোটা অকৃতজ্ঞ আর স্বার্থপর কি করে হতে পারে?
     মানুষ আজ আমায় সথ্যিই ভাবিয়ে তুলেছে। আমার নমুনা পরিক্ষা করে করোনা নেগেটিভ হওয়া স্বত্বেও আমার বাড়ির লকডাউন ছাড়েনি। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত না হয়েও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগির মতো দিন যাপন করে আসছি।
     পরেরদিন সকালে নার্গিসের ফোন থেকে ফোন আসলো। আমি ফোন ধরে মা নার্গিস কেমন আছো? ঐ পাশ থেকে আমি নার্গিস নয়, ম্যাডাম কাল রাতেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন। কথাটা শুনার পর আমি মাথা ঘুরে মেঝেতে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
     যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখলাম চারজন পুলিশ আর দুইজন স্বাস্থ্যকর্মী নার্গিসের লাশ নিয়ে আসলো। ওরা নার্গিসকে পলিথিনে মুড়িয়ে এনেছে। অনেকবার বললাম ওর মুখটা শেষবারের মতো দেখবো কিন্তু দেখতে দিল না। চারজন পুলিশ, দুইজন স্বাস্থ্যকর্মী আর আমি এই মোট  সাতজনে মিলে জানাযার নামাজ পড়লাম। তারপর  নার্গিসকে আমাদের গ্রামের গোরস্থানে কবর দিতে নিয়ে গেলাম। কিন্তু গ্রামের সবাই মানা করলো নার্গিসকে গোরস্থানে কবর দিতে দিবে না। পরে আমাদের বাড়ির ভিতরে একপাশে কবর দিলাম নার্গিসকে। এতো বড় গ্রাম একজনও নার্গিসের দাফন-কাফনে তো আসলোই না এমন কি সাড়ে তিন হাত জমিনও নার্গিসকে দিলো না। অথচ এই নার্গিস বিনামূল্যে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি গ্রামের সবার চিকিৎসা করেছে। যেকোনো প্রয়োজনে ডাক আসলেই ছুটে গিয়েছে সবার আগে। এতোসব করেও তো প্রতিদান হিসাবে গ্রামের মানুষের কাছ থেকে কিছুই পেল না।
     নার্গিস নেই আমি কল্পনাও করতে পারছি না। কেনো জানি মনে হচ্ছে নার্গিস আমায় বলছে, বাবা আমি তো আমাদের বাড়িতেই আছি। কোথাও যায়নি তোমায় ছেড়ে। ভাবতেও পারিনি নার্গিসের দেখা এই স্বপ্নটাও সত্যি হয়ে যাবে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেনো পরপারে নার্গিসকে সুখে রাখেন।
     নার্গিস জীবন যুদ্ধে একজন সফল সৈনিক। জানি কেউ তোমাকে মনে রাখবে না, কেউ তোমার জন্য শোক দিবসও পালন করবে না। না করুক আর নাই বা মনে রাখুক। সৃষ্টিকর্তা তো ঠিকই দেখেছেন, তুমি তোমার কর্তব্য শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত পালন করে গেছো। তিনিই তোমার এই অপরিমেয় কর্মের সাক্ষী হয়ে রইলেন।

শাহজাহান। পটুয়াখালী