জাহান্নামেও জান্নাতের স্নিগ্ধ সুবাস- জান্নাত মণি
চল্লিশোর্ধ আক্কাস আলী সঙ্গে আলম হোসেন শিকড় ছড়ানো বট গাছের গোঁড়ায় বসে ধোঁয়া ছড়াচ্ছেন। তাদের বন্ধুত্ব শৈশব বা কৈশোর থেকে নয়। বন্ধুত্ব হয়েছে টাকায় টাকায় খ্যাতি আর যশে। আক্কাস আলী দুই দুইবার কমিশনার হয়েছেন। আগে নাকি ছিঁচকে চোর ছিলেন, সবাই বলে কানে কানে। আর আলম হোসেন কোন এক সরকারি দপ্তরে চাকুরী করতেন। অনেক টাকা পয়সা করেছেন এদিক সেদিক করে। সমাজে দুই জনের উঠাবসা গলায় গলায় এমন কি পরিবারেও।
আলম হোসনের দুই ছেলে আমেরিকা প্রবাসী। আক্কাস আলীর এক মেয়ে প্রতিবন্ধী তবে তার নামে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে, ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা পয়সাও রয়েছে। তারা দুজনেই শুক্রবারে খুদবা শুনে নামাজ আদায় করেন, ধর্মকর্ম করে যাচ্ছেন। সামাজিক কর্মকাণ্ডে অতিথি হন। তাদের আয়েস ফরমায়েশ করার জন্য কিছু ছেলেপেলে কাজ করে সবসময়। এলাকাবাসী এদের ভয়ে সর্বদা টতস্ত্র থাকে। তারা দুইবন্ধু লোক সমাজের অগোচরে এদিক সেদিক যান মাঝে মধ্যে। শরবত সূরায় আপত্তি নেই তেমন একটা।
রেবা দেবীর বাড়িতে যান কিছুসময় জলসায় কাটান। রেবা দেবীর আগে নাম ছিল রেবেকা চৌধুরী, সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়ে ছিলেন। অত্যন্ত কঠিন বাস্তবতায় নিজের সম্পত্তি ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর বিয়ে করেন রমেশ বোস নামে এক ব্যবসায়ীকে। লোক মুখে শোনা যায় স্টেলিন নামে এক ফরাসী যুবকের সাথেও গভীর প্রেম ছিল। স্টেলিন আত্মহত্যা করে মারা যায়, তারপর কালক্রমে এখানে অবস্থান রেবা দেবীর। সুন্দরী অভিনেত্রী থেকে অভিসারিণী। রুপ লাবণ্য আবরণীয় হলেও পর্দাশীল। চোখে কাজল দামি বডিস্প্রের ঘ্রান আর বুটিদার ঢাকাইয়া শাড়ি পড়ে জলসায় বসেন। পুরুষ মহলে শুধু রেবা দেবীর রুপের বর্ণনা। যে কাউকে বশ করার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে মহিলার। হিন্দু মুসলিম খ্রিষ্টান সব উষ্ণতাই ভোগ করেছেন এক রক্তেমাংসে। কিন্তু অন্য সবার থেকে রেবা দেবীর চালচলন একেবারেই আলাদা মার্জিত। আঁচল সরিয়ে দর্শকদের লোভকে আরও উস্কে দেবার মত মেয়েলোক রেবেকা ছিলেন না। বয়সটা ফীকে হয়ে গেলেও ডাগর ডাগর মায়াবী চোখে কি জাদু নেশা লাগানো আকর্ষণীয়। বিস্ময়কর হাল্কা হাসি চোখে মুখে শুভ্রতা মায়াময় ভঙ্গিমা। তিনি সামাজিক বিত্তটাকে অমানবিক আর মনুষ্যত্বকে মিথ্যাবাদী বলেন।
কেন বলেন তিনিই জানেন?
আজকের আসরটা বেশি রাত হয়েছিল আর দুইবন্ধুর পানের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে। বিয়ারে পানি না মিশিয়ে দু-পেগ বেশি গিলেছেন। আশেপাশে সুন্দরী তরুণীদের সানিধ্য থাকলেও ইদানিং রেবেকার সঙ্গ তাদের বেশি পছন্দ। দীর্ঘক্ষণ গল্পের এক পর্যায়ে আক্কাস সাহেব বললেন নারীরা ছলনাময়ী! রেবা দেবী এটা কিছুতেই মেনে নিলেন না।
রেবা দেবীর দৃষ্টিতে পুরুষরা কিছুটা ভারসম্যহীন। নারী অস্তিত্বকে ঘিরেই তাদের বিপর্যয়।
একে ফাঁদ বলতে তিনি নারাজ।
অনেকটাই চুম্বকশক্তি বা মানবিকপ্রেম। পুরুষরা সবল বীর্যবান, অর্থ মুল্যে নয় স্বভাব মূল্যে মেয়েদের জয় করতে চায়। রেবা দেবী আরও বললেন যারা দেহ কিনতে আসে তাদের আমি ভিক্ষুক বলি ।
এই যুক্তিতর্ক নিয়ে আলম সাহেব কিছুটা উৎসুক। মাঝে মাঝে পর্দার ফাঁকে উঁকি ঝুকি দেন, কিছু একটা নেবার বাহানায় বাসার ভিতরে যেতে চান। আক্কাস আলীও তাই করেন মাঝে মধ্যে। আলম সাহেব একদিন রুটিন মাফিক না যেয়ে হঠাৎ এসে পড়লেন রেবা দেবীর জলসায়। তাকে দেখতে না পেয়ে একটু ভিতরে গেলেন। দেখলেন রেবাদেবী অসুস্থ স্বামীর ফেলে দেয়া ময়লা পরিস্কার করছেন। মুখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানি আঁচল দিয়ে মুছে দিলেন। কপালের ঘাম মুছে দিলেন পরম তৃপ্তি নিয়ে ভালোবাসার ছোঁয়ায়। আলমসাহেব এমন একটা দৃশ্য দেখবেন, কল্পনাও করেননি কখনো, পূর্ণ ভালোবাসাময় একটা হৃদয়। পাশ কাটিয়ে অন্য রুমের দিকে খেয়াল করে দেখলেন, কিছু ষোড়শী বালিকা লেখাপড়া করছে আরবি হবে আন্দাজ করলেন। যিনি পড়াচ্ছেন তিনি একজন মাদ্রাসার হুজুর। আলম সাহেব ফিরে এলেন কিছুতেই প্রশ্নের উত্তর মিলাতে পারছেন না। ঘন ঘন জলসায় যেতে লাগলেন।
রেবাদেবী বললেন কর্তব্যরত সুন্দর একটা মন অন্ধকারে আলোর মত। সময়ের জালে যদিও আমরা বন্দি, নিজের অস্তিত্বের আলোতে কীর্তিমান থাকতে চাই।
মানুষের কল্যাণে নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দেয়া মানুষটির স্কুলের ছাত্র হবার ইচ্ছা পোষণ করলেন আলম সাহেব। তিনি মনে মনে ভাবলেন তার মানুষ হবার সময় হয়েছে। এখন আর দেরি নয়। আলমসাহেব বিভিন্ন অজুহাতে নানা কারনে অকারণে রেবা দেবীর জলসায় সময় কাটাতে লাগলেন। এবং মন্ত্রমুগ্ধ ভাবে বেরা দেবীর যুক্তিবাদ বুঝবার চেষ্টা করেন। অনেকটাই কথার প্রেমে পড়েছেন গেছেন দুই বন্ধু। রেবা দেবীর মতে মনের কলুষতাই মানুষের আত্না ও দৃষ্টিকে কদর্যতা দান করে। এবং সেই পাপ নিজের এবং পরিবারের লোকদের জীবনকে বিভীষিকাময় করে তোলে। রেবা দেবী বলেন সাধারণভাবে মানুষ নিজের সন্তানকেই শুধু সন্তান বলে মনে করে। আর ওই মানুষগুলি চারপাশের সবার সন্তানকে নিজের সন্তান মনে করে না। তাই কেবল নিজের সন্তানের না, সবার সন্তানের জন্য তিনি কাজ করছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষ তার আচরণকে উদ্ভট বলে মনে করে। তাদের মাথায় আসে না অন্যের সন্তান আবার কী করে নিজের সন্তান হয়! জৈবিকতার বাইরের আত্মিক সন্তানকে তারা চেনে না।
এটা বলার একটাই কারণ, অন্যের সন্তানকে যখন কেউ নিজের সন্তান বলে ভাবতে পারে। পৃথিবীর সব মানুষকে ‘আমি’ হিসেবে ভাবতে শিখে, তখন তাদের দুঃখ কমানোর জন্য তার মধ্যে একটা প্রণোদনা তৈরি হয়।
একদিন সময় বুঝে আলম সাহেব রেবা দেবীকে প্রশ্ন করলেন। উত্তরে রেবা দেবী বললেন আমি কেউ না, উৎসর্গের আসল অর্থ আনন্দ। বললেন নষ্টদের হাত থেকে ওদের দূরে রাখি। আলোকিত জীবন দিতে চাই। যেন ওরাও ডানা মেলে আকাশকে উপভোগ করতে পারে। মনুষ্যত্ব কিংবা অমানবিকতা কি? যেন বুঝতে পারে। রেবা দেবীর দায়িত্ববোধ দেখে লজ্জা পেলেন তিনি।
মনে মনে আলম সাহেব স্বীকার করে নিলেন, আমরা সহমর্মিতার ঐতিহ্য ভুলতে বসেছি। যদি আমরা মাথার উপরে বিশাল ঐ আকাশের দিকে তাকাই তাহলে কি শিক্ষা পাই?
রেবেকা বললেন আমার মনই আমার ধর্মশালা। আর দায়িত্ববোধের মাঝেই আমি সেটা খুঁজে পাই।
আলম সাহেব বললেন যে বৃক্ষ অঙ্কুরোদগমের পর থেকে শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে বেড়ে ওঠে আর ফলসহ বিনয়ের সঙ্গে নিজেকে নুইয়ে দেয় তেমনি।
ঠিক ধরেছেন’
রেবা দেবী মুস্কি হেসে জলাসার ইতি টানলেন।
জাহান্নামেও জান্নাতের স্নিগ্ধ সুবাস পাচ্ছেন আলম সাহেব। স্বপ্নের ভেতর দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন আলম সাহেব। চোখের কোনায় জল গড়িয়ে পরল ক’ফোঁটা। এতদিন তিনি চোখহীন ছিলেন? মনে পরে গেল তার প্রথম পরিবারের কথা। হয়ত তার ফেলে আসা ছোট মেয়ে দুটি এখন ষোড়শী। হাঁটতে থাকেন অন্ধকার পথে ধরে। ইতিমধ্যে উগ্র দাবানলের মত ফুঁসে উঠল বুকের ভিতরটা। আলম সাহেব দ্রুত ফিরে এলেন বাড়িতে। পুরনো কাগজপত্র ডায়েরিতে খোঁজার চেষ্টা করলেন আপনজনের ঠিকানা। যেন নদীতে রক্তস্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। বেড়িয়ে পড়লেন পথে। অনেক খুঁজে মতিঝিলের রাস্তা পেরিয়ে টিকাটলির হাটখোলায় এসে পৌঁছালেন, ওনার প্রথম স্ত্রীর ফুপাতো বোনের বাসায়। তৃতীয় তলায় উঠে কলিং বেলে হাত চেপে দাঁড়িয়ে থাকেন আলম সাহেব।
-কে এত রাতে?
-আমি
দরোজা খুলে যায়।
কি ব্যাপার অনেক দিন পর আলম ভাই এসেছেন !
কিছুটা দ্বিধান্বিত হলেন, ভেতরে আসুন বলে বসতে দিলেন।
ওই আত্মীয়ের কাছে জানতে পারলেন, অভাব অনটনে বিধ্বস্ত পরিবারের কথা। দু-বেলা খাবার বাঁচাতে তারা নাকি রোজা রাখে, পোশাকের অভাবে বোরখা পরে! একমেয়ে টিউশনি করে সংসারের হাল ধরেছে। অন্য মেয়েটি দুটো বাচ্চা নিয়ে মায়ের সংসারে। অভিভাবকহীন একটি পরিবার। রেবাদেবী যেন আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিলেন তার মনুষ্যত্ব। লজ্জা অপমান ঘৃণায় আলম সাহেব নীলবর্ণ! এই পাপ থেকে মুক্তির পথ কোথায়? আবেগে আপ্লুত আলম সাহেব হাত দিয়ে বুকটা চেপে ধরলেন। মসজিদ মন্দির গির্জা! হায় ঈশ্বর তোমার কাছ থেকে আমি কি শিক্ষা নিতে পেরেছি? আমার প্রার্থনালয় আজ পতিতালয়ে।
জান্নাত মণি। ঢাকা
-
গল্প//উপন্যাস
-
09-11-2020
-
-