অটোয়া, শনিবার ২০ এপ্রিল, ২০২৪
হিমেল হাওয়া - হুসাইন দিলাওয়ার

১.
এক বুক আশা নিয়ে ঢাকা শহরে  পাড়ি জমায় হিমেল৷ জাদুবাস্তবতার নিগড়ে গড়া এই ম্যাগাসিটিতে হিমেল একজন অনভিজ্ঞ অভ্যাগত। আর আটদশজন  ভর্তিচ্ছু ছাত্রের মতই টগবগে আবেগ তার। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় ভর্তি কোচিং করতে আসা ছেলে-মেয়েরা যেভাবে দলবেঁধে ধিঙ্গিপনা করে, আড্ডা দেয়, সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখে, ফাস্টফুডের টেবিলে বসে সেলফি ডুয়েলফি তুলে, হিমেল তাদের মত নয়। সে পড়ুয়াদের দলে। মফস্বল কলেজের আদর্শ ছাত্র। শিক্ষকদের স্নেহধন্য। আটপৌরে মধ্যবিত্ত অভিমান তার  শিরায় শোণিতে। দেশের সর্বউত্তরের মফস্বল শহর থেকে আসা হিমেল তার সব আহ্লাদ-অনুভূতি দমিয়ে রাখতে শিখে গেছে। তবুও তার মনের দেয়াল উপচে আবেগের ঝরঝর ঝর্ণা ঝরে। সে স্বপ্ন দেখে। ইদানীং ঘুমে-জাগরণে একই স্বপ্ন দেখে-  
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাণ্ড বারান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।  ক্যান্টিনে বসে  আড্ডা দিচ্ছে সহপাঠীদের সাথে। সাম্প্রতিক সময়ের নানা ইস্যু নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলছে। আলোচনায় মাঝখানে ছোট দাদার মত কেউ তেড়ে আসছে না। তর্কে হেরে—
"শালা তুই মোক বুঝাবার আঁইছিস। আদি  তোর ঠ্যাংখান যদি না ভাঙিচু...! বলে কেউ হম্বিতম্বি করে না।
বড় ফাইন লাগিচেরে!  বলে ঘুমের মধ্যে হা হা হা করে হেসে উঠে হিমেল৷ দিবাঘুমে হিমেলের এই অদ্ভুত আচরণে বিরক্ত হন হলের বড় ভাই। 
এ্যই হিমেল,  এ্যই!
: কি হইচে রে, পাগলের মত হাসচি কেনে? 
ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। আড়মোড়া ভেঙে জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখে এবার -আত্নীয় স্বজনহীন শহরে তার ছোট দাদুর কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে বাবা-মা আর ছোট ভাইটির স্মৃতি। তার ভাবনায় আবার ভর করে ভাবালুতা। চোখের পর্দায় ভেসে উঠে একের পর এক চিত্রপট। 
টিএসসির টং দোকানে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সে রাজু ভাস্কর্যে পাদদেশে মানুষের ছুটে চলা দেখে৷ ডিপার্টমেন্টের মেধা তালিকায় শীর্ষে তার নাম।  ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র -জুনিয়ার লাস্যময়ী নারীরা তাকে ঈর্ষার চোখে তাকায়। নিজেকে নায়ক ভাবতে বেশ লাগে তার। হিমেল দেখতে নায়কের চাইতে কোন অংশে কম নয়৷ ডাগর চোখ, ফর্সা ত্বক আর ফিনফিনে পাতলা মাথার চুল। একটু বাতাসেই চুল উড়ে এলোমেলো হয়ে  অবার ভাঁজ পড়ে সুবিন্যস্ত হয়ে যায়। এক কথায় অপছন্দ করার মত ছেলে নয় সে৷ কিন্তু খুব অভিমান তার। বাবা-মায়ের প্রতি তার দায়িত্ব জ্ঞান বেশ টনটনে। তাই আটপাঁচ কল্পনা ভুলে পড়ালেখায় মন দেয়। ঠোঁটস্থ করে ফেলে বিগত সালের প্রশ্ন ব্যাংক। মাঝেমাঝে আবছায়ার মত আরিফার চেহারাটা ভেসে উঠে অবচেতন মনে। আরিফা তার প্রথম প্রেম; প্রথম অনুভূতি। আহ্, বড় নির্দয়ভাবে আরিফা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।  প্রত্যাখ্যান উপেক্ষার দগদগে ক্ষত এখনো শুকোয়নি। তাই এত বছরেও কাউকে প্রেম নিবেদন করার সাহস পায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে সেই প্রত্যাখ্যানের প্রতিশোধ নিতে চায় হিমেল। বুঝিয়ে দিতে চায় কাকে অবহেলা করেছে আরিফা। তাই নিজের সাথেই নিজের নিয়ত যুদ্ধ চলে তার। 
কোন কোন দিন সারারাত পড়ালেখা করে।  একমাত্র আশ্রয়দাতা এলাকার বড় ভাই করিমুলের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। আচার-আচরণে উষ্মা প্রকাশ করেন তিনি। সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে করিমুল ভাইয়ের রুমে গেস্ট হিসেবে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে তার। পুরাতন একটা জাজিমে  ফ্লোরিং করে শোয়। ছারপোকার কামড় এতদিনেও সে ঠিকঠাক আন্দাজ করতে পারেনি।  হলে আসার আগে ছারপোকা দেখার সৌভাগ্যও হয়নি তার। হাতে পিষে পটপট করে মারছেও  কম না। কিন্তু ছারপোকার বংশ বলে কথা, কমার নামগন্ধ নেই। ছারপোকার কামড়,  ডাইনিংয়ের পাতলা ডালের কথা ভাবলে চলবে না তার।
সে যে তার প্রত্যাশা পূরণে দৃঢ় প্রত্যয়ী। তবুও তার সংকল্প যূথভ্রষ্ট হয় বারংবার। ফার্মগেটে এলাকায় আসলে তার মন কেমন করতে থাকে। বড় উচাটন হয়ে উঠে হিমেল৷ সুশ্রী-সুদর্শনা সহপাঠীদের দেখে তার  সংকল্পের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়। এত এত ভর্তিচ্ছু স্মার্ট ছেলের মাঝে নিজকে হীন প্রতিপন্ন করে। তার ব্যাচের হলি গার্ল খ্যাত মেয়েটার  প্রতি তার  দুর্বলতা ক্রমশ বেড়েই চলে। মেয়েটি হলিক্রস কলেজ থেকে পাস করেছে  বলে; তাকে সবাই হলিগার্ল নামে সম্বোধন করে। হিমেলের এখনো তার সাথে কথা বলার দুঃসাহস হয়ে উঠেনি,  তবুও  অর্পিতা চৌধুরীর প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে তার দমবন্ধ হওয়ার জোগার। পুরো কোচিংয়ে অর্পিতা চৌধুরীর অন্য রকম তোয়াজ। তার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র; বর্তমানে সিনিয়র সচিব। ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠানে তার বাবার শুভেচ্ছা বক্তব্য সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। আর অর্পিতা তাক লাগিয়েছে তার নিখুঁত রূপছটায় আর ক্ষুরধার মেধার জোরে।  কোচিংয়ের সব টিচারই তাকে একটু সমীহ করে।
এজন্য হিমেলের দ্বিধা আরো বাড়ে। বাংলা চলচ্চিত্রে অসম প্রেমের যে পরিণতি মনে গেঁথে আছে- তাতে সে হতাশই হয়। এভাবেই স্বপ্নাবিষ্ট সময় কেটে যায়।  ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়ে যায় পুরোদস্তুর৷  প্রথমে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কমার্সের ছাত্র হয়েও বি- ইউনিটে পরীক্ষা দিয়ে ১২ তম অপেক্ষমাণ তালিকায় হিমেল। কোমর বেঁধে প্রস্তুতি নিতে থাকে ঢাবির সি-ইউনিটের জন্য। হিমেলের বরাত মন্দ নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে চান্স হয়ে যায় তার। কিন্তু এখনো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেয়া বাকি।  যদিও সেগুলোতে পরীক্ষা দেয়ার প্রয়োজন নেই তার।  কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছে হিমেল।  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়ি ক্যাম্পাস দৃষ্টিনন্দন  অনিন্দ্য প্রকৃতির বর্ণনা পড়ে দৈনিক প্রথম আলোর ক্যাম্পাস কলামে। চবি দেখার আগ্রহ বাড়ে তার৷ 


পান্থপথ থেকে গাড়ি ছাড়বে রাত আটটায়।
যথাসময়ে ব্যাকপ্যাক নিয়ে কাউন্টারে পৌঁছায় হিমেল। কোচিং থেকে গাড়ি রিজার্ভ করা হয়েছে। ব্যাচমেটদের  সাথে ওটা ওটা নিয়ে খোশগল্প করতে চায়। কিন্তু অনেকেরই এখনো কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয়নি, তাই ঢাবিতে চান্স পাওয়া হিমেলের মত ওরা নির্ভার নয়। তাদের কাছে কালকের পরীক্ষা অতীব গুরুত্বপূর্ন। ইতোমধ্যে  সময়ের ফের পাল্টে গেছে। 
অর্পিতার বদলে এখন হিমেলকে সবাই সমীহ করা শুরু করেছে। ছেলে মেয়ে নির্নিমেষে লোভাতুর চোখে তাকায়। ব্যাচের বিশিষ্ট হয়ে উঠে সে। কারণ সি-ইউনিটে চান্স পাওয়া হাতেগোনা কয়েকজনের মধ্যে হিমেল একজন।  ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে তাকে নিয়ে  প্রশংসার ফোয়ারা ছোটে। অনেকে লাস্যময়ীর ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্টও পাচ্ছে ইদানীং। 
রিজার্ভ কোচের নির্ধারিত সিটে বসতে গিয়ে আরেক দফা ভড়কে যায় হিমেল। তার পাশের সিটেই বসে আছে কাঙ্ক্ষিত সেই নারী। সব কিছু স্বপ্নের মতো মনে হয়। হাত-পা কাঁপা শুরু করে। গুটিসুটি পায়ে কোন রকম সিটে দপ করে বসে পড়ে। তার নার্ভাসনেস আঁচ করতে পারে অর্পিতা।  একটা ফাজলামো হাসির হল্লা উঠে। উৎসুক কয়েকজন আড়চোখে দেখে তাদের। সেদিনের সেই দীর্ঘ যাত্রা এবং বন-পাহাড়ের উঁচুনিচু ক্যাম্পেই তাদের প্রেম হয়ে যায়। অবশ্য অর্পিতা এডভান্স না হলে হিমেলের পক্ষে সম্ভব হতো না; তাকে প্রোপোজ করা। অর্পিতাও চান্স পায় ডি-ইউনিটে। পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হয়ে যায় একই ক্যাম্পাসে। ভার্সিটির  অনেক যুগলের মধ্যে  তারা জনপ্রিয় হয়ে উঠে। দিওয়ানা দুই প্রেমিক মজে থাকে একে অপরে। ফেইসবুকে ঘন্টার পর ঘন্টা চ্যাটিং আর ক্যাম্পাসের গাছ তলায় বট তলায় বাদাম-বুট  চিবুতে চিবুতেও তাদের নৈসর্গিক প্রণয় কলহ চলে। টিউশনি করিয়ে  বেশ চলে যাচ্ছিল হিমেলের। ইতোমধ্যে তারা ক্যাম্পাসে হিমেল-হাওয়া নামে পরিচিতি লাভ করে।


হেমন্তের মৃদুমন্দ বাতাস আর সোনাঝরা রোদে কলা ভবনের বট গাছের ছায়ায় বসে খুনসুটিতে ব্যস্ত ছিল হিমেল-হাওয়া। হৈমন্তী উৎসব চলছে। কলা ভবনের পুরো চত্বর সাজানো হয়েছে পল্লীর চিরায়ত আদলে। চিরকাল গ্রামের প্রতি অমোঘ আকর্ষণ হিমেলের । নিশিপাওয়া কবির মত শান্ত চোখে  হিমেল বলে-
:এই শোন,  আমরা পড়ালেখা শেষ করে গ্রামে গিয়ে একটা মনের মত বাড়ি বানাবো। আমি সারাদিন মাঠে খেতি করে সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফিরবো, তুমি আঁচল দিয়ে আমার কপালের ঘাম মুছে দিবে। আমি হবো চাষা আর তুমি চাষার বউ...। 
এই কথা শুনে নাক সিটকায় অর্পিতা। টিপ্পনী কেটে বলে--
:এহ, শখ কত!  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিংয়ের স্টুডেন্ট,  কোথায় স্বপ্ন দেখবে ইউরোপ আমেরিকায় থিতু গাড়ার তা নয় গ্রামে যাবে। গাঁইয়া কোথাকার...। 
:এতই যদি ইউরোপ আমেরিকা যাবার শখ তো আমার মত গেঁয়ো ভূতের সাথে কেন প্রেম করতে আসলে শুনি?
:ওলে, আমার বাবুটা রাগ করেছে!  বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় অর্পিতা। 
:জানো অর্পি আমার গ্রাম খুব ভালো লাগে, অথচ তুমি...। 
কথা শেষ করতে না দিয়েই খলবল করে হেসে উঠে অর্পিতা।  আলোচনার বিষয় অন্য দিকে মোড় নেয়। 
এভাবেই মৃদু অভিমানে আকাঙ্ক্ষার চলাঞ্জলি দেয়া না দেয়ার সুরহা হয়েই তাদের দিন কাটে। ক্যাম্পাসে, করিডোরে,  টিএসসি, মধুর ক্যান্টিনে হিমেল-হাওয়ার প্রেম একটি পরিণতির দিকেই যাচ্ছিল। অর্পিই একদিন হিমেলের জন্য  নতুন একটা টিউশনের অফার নিয়ে আসে।  ছাত্রী আর কেউ নয়। তার মামাতো বোন। এইচএসসি পড়ুয়া ফাইজার  ইংলিশ টিউটর হিসেবে নিয়োগ পায় হিমেল। 
কয়েক মাস পর রেষ্টুরেন্টে কোল্ড কফির স্ট্র মুখে প্রসঙ্গটা তোলে হিমেল নিজেই-
:তোমার মামাতো বোনের ভাব গতিক তো সুবিধার মনে হচ্ছে না অর্পি! আমার প্রতি কেমন ফ্যাসিনেটেড চোখে তাকায়। প্রেমে পড়ে গেছে কি'না আল্লাই জানে! 
:কি বল!  তুমি তাকে ইম্প্রেস করার জন্য কিছু কর নাই তো। তোমার তো আবার প্রেমে পড়ার রোগ আছে। 
:আরেহ্,  না। 
:শোন হিম, তুমি এই টিউশনিটা ছেড়ে দাও। প্লিজ। আমার মন কেন যেন  কু-ডাকছে। 
:ছেড়ে দেবো?  পাগল নাকি। এই সিলি ব্যাপারটা নিয়ে তুমি মাথা ঘামিয়ো নাতো। আমি ঠিক সামলে নেবো দেখ৷ 
অর্পিতার ডান হাতটা দু'হাতের মুটোয় রেখে আলতো চাপ দেয় হিমেল। আর কিছু বলার থাকে না অর্পিতার। তাকে বেশ প্রসন্ন দেখায়। 
সেদিনের পর বিষয়টা নিয়ে আর কথা হয় না। কিন্তু ফাইজার প্রতি ধীরে ধীরে হিমেল কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়ে। ফাইজার উঠতি বয়সের উচ্ছ্বাস আবেগের বাতি দপ করে নিভিয়ে দিতে মন সায় দেয় না তার। আস্তেধীরে বিষয়টা হ্যান্ডেল করতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলে হিমেল। এদিকে হিমেলকে নিয়ে মনে হজারো স্বপ্ন ডালপালা মেলে ফাইজার। মিড এক্সামের জন্য ব্যস্ত থাকায় হিমেলের সাথে  অনেকদিন দেখা হয়নি অর্পিতার। অনেকদিন পর রবীন্দ্র সরোবরের বাঁধানো ঘাটে লেকের পানিতে পা ঝুলিয়ে বসে তারা। এটা সেটা কতকথার পর কী ভেবে যেন হিমেলের ফোনটা হাতে নেয় অর্পিতা। হিমেলকে প্যাটার্ন খুলে দিতে বলে। গেমস খেলতে থাকে টিনেজ খুকির মত। হটাত  টুং টুং করে একটার পর একটা লাভ ইমোজি আসতে থাকে ফাইজা তারান্নুম নামের আইডি থেকে। ম্যাসেঞ্জার ঘাটতে গিয়ে অর্পির চক্ষু চড়কগাছ। ফাইজার ও হিমেলের আবেগী কথোপকথন পড়তে থাকে তন্ময় হয়ে। চোখ ফেটে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা জল সরোবরের নোংরা পানিতে মিশে একাকার হয়ে যায়। একদলা বিবমিষায় ভিতরটা রিরি করতে থাকে তার। নিজের অতি পরিচিত মানুষটাকে ভীষণ ঘেন্না লাগে। অশ্রু ঝরা চোখে অদ্ভুত গলায় অর্পি গোঙানোর মত করে বলে-
তুমি আমাকে এভাবে ধোঁকা দিতে পারলে?  মিথ্যুক, ভণ্ড, প্রতারক। তুই প্রেমিক নামে কলঙ্ক!  খবরদার আর আমার কোন খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করবি না। আজ থেকে সব শেষ, সব। গজগজ করতে করতে উঠে চলে যায় অর্পিতা। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় হিমেল।  কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকে অনেকক্ষণ। রাত আটটায় ডিউটিরত আনসার সদস্যদের বাঁশি আর লেক ছেড়ে বের হয়ে যাওয়ার তাগাদা শোনে সম্বিত ফিরে পায়। হলের উদ্দেশ্য হাঁটা দেয়। কিছুই ভালো লাগে না তার। পৃথিবীর সব মেয়ে যদি তাকে প্রেম নিবেদন করে কাউকেও প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না সে। কারণ ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার বেদনাভূতি তার চেয়ে কেউ তেমনভাবে অনুভব করেনি। একি মহার্ঘ কোন পাপ? 
হিসেব মিলাতে কষ্ট হয় তার। ঘুমহীন রাত কাটে। রোজই অর্পিতাকে হন্নে হয়ে ফোন দেয়। কিন্তু অর্পিতার ফোন বন্ধ। তার বাড়ির আশেপাশে  ঘুরঘুর করেও সুবিধা করতে পারে না। এমন সময় মহামারি করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশেও। বন্ধ হয়ে যায় ক্লাস, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব। টিউশনিগুলো একে একে ছেড়ে দিতে হয় তাকে। লকডাউন পরিস্থিতিতে তিষ্ঠাতে না পেরে গ্রামের বাড়ি চলে যায় হিমেল। বাবার সাথে  কৃষি খামারে কাজে  মনোনিবেশ করে। ভুলে থাকতে প্রাণপণ চেষ্টা করে অর্পিতা, ফাইজার আরো কতগুলো  মুখাবয়ব। তার বয়ঃসন্ধির প্রথম ভালোলাগা  আরিফার সাথে দেখা হয়৷  আরিফা এখন তেঁতুলিয়া প্রাইমারি স্কুলের টিচার। ইদানীং সে গায়ে পড়ে গল্প করতে আসে।  এটা সেটা নিয়ে ঠাট্টা করে। আড়চোখে তাকায়।  অকারণে হাসে। 

৪ 
গ্রামের আলো বাতাস আর নির্মল প্রকৃতিতে প্রাণ  ফিরে পায় হিমেল। আস্তে আস্তে ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে তার উৎসাহ উদ্দীপনায় ভাটা পড়ে যেন। তথাপি শরতের শুভ্র মেঘের শ্বেত আবির রাঙানো অলস দুপুরগুলোতে কার মুখ যেন তার চোখে ভেসে আসে। ফাইজা, অর্পিতা নাকি আরিফার? বড্ড ঘোলাটে সে মুখ। নাকি তিনজনের আদলে গড়া অন্য কোন কাল্পনিক চরিত্র ? আজকাল বাউণ্ডুলেপনা করে বেড়ায়। একদিন আরিফা  এসে সারাসরি নির্লজ্জের মত প্রেম নিবেদন করে তাকে। যে হিমেল আরিফার জন্য পাগলপারা ছিল, যার প্রেমের জন্য চাতক পাখির মত  কেটেছে দুর্বিষহ সময়; সেই মানুষটিই তাকে প্রেম নিবেদন করেছে। তার জীবনে সব কাঙ্ক্ষিত বস্তুই কেন যেন অসময়ে আসে। যখন আর তা গ্রহণ করার উপায় থাকে না তার। 
অর্পি ঐদিন থেকেই ফেইসবুকে,  ম্যাসেঞ্জারে ব্লক করে রেখেছে হিমেলকে। ভাগ্যিস মেইল এড্রেসেটা তার জানাই ছিল। অর্পিকে  দীর্ঘ একটা মেইল লিখে সে। সব কিছু খুলে বলে। বলে তার দুর্বোধ্য মনের গোপন গহীন কথাটিও৷ তার বোহেমিয়ান মনস্তত্ত্ব, আটপৌরে জীবনের যাঁতাকলে পিষ্ট জীবন, প্রত্যাখ্যাত প্রেমের কাহিনী। সে অনেক কথার একটা চিঠি লিখে মেইল করে অর্পিকে। ওদিক থেকে কোন রিপ্লাই আসে না।  হতোদ্যম হয় হিমেল। চোখের সামনে বিয়ে হয়ে গেল আরিফার ।  করোনা পরিস্থিতি স্বল্প পরিসরে অল্প আয়োজনে বিয়েটা হয়ে গেল। আরিফার বিয়ে হয়ে যাওয়ায়  বিচিত্র কারণে ভালো লাগতে থাকে তার। ইদানীং সে কবিতা লেখা শুরু করেছে। সাহিত্য পাঠ শুরু করে নিবিষ্ট চিত্তে । শরৎ শেষে হেমন্তের ডাক আসে প্রকৃতিতে। এদিকটায় শরতের শেষাশেষিতে শীতের তীব্রতা জেঁকে বসে। দীঘির পাড়ে বসে পাকা ধানের বিস্তৃত খেত দেখে আর আবছায়ার মত দেখে অনির্বচনীয় কাঞ্চনজঙ্ঘা রূপ। 

৫.
ঢাকা থেকে সাকিলদের ফোন আসে। পঞ্চগড় থেকে ভারতের অপরূপ কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য উপভোগ করা যায় এই খবর চাউর হয়ে গেছে দেশময়। কয়েকজন বন্ধু মিলে পরশু আসছে তারা। 
সকালের তীব্র শীতে বাঁশের কঞ্চি হাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে  যায় হিমেল। ধানের শীষে শিশিরবিন্দু জমে থাকে। আলপথে চলতে গেলে কোমর পর্যন্ত ভিজে  যায়। কঞ্চি দিয়ে ধানের শীষে আলতো করে বাড়ি মেরে শিশির ঝড়িয়ে তারপর পথ চলতে হয় । আলপথে হাঁটতে হাঁটতে তাকে জীবনানন্দ ভর করে। অস্ফুট স্বরে আবৃত্তি করে-
হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো:
চারিদিকে পিরামিড— কাফনের ঘ্রাণ;
বালির উপরে জ্যোৎস্না— খেজুর-ছায়ারা ইতস্তত
বিচূর্ণ থামের মতো: এশিরিয়— দাঁড়ায়ে রয়েছে মৃত, ম্লান।
শরীরে মমির ঘ্রাণ আমাদের— ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন;
‘মনে আছে?’ সুধালো সে— সুধালাম আমি শুধু, ‘বনলতা সেন।’

সকাল থেকে  ডাহুক নদীর পাড়ে বসে থাকে হিমেল। লোকেরা টিউবে বাতাস ভরে নদীতে ভাসায়,  তার ওপর প্লাস্টিক দিয়ে পাথর তোলে জমা করে। ঢুবে ঢুবে একমুঠো দুমুঠো করে পাথর তুলে আনে। জমতে জমতে ভাসামান পাথরের টিবি হয়ে যায়। কাজ না থাকলে নদীর পাড়ের ঘুন্টি দোকানে চা-বিস্কুট খেয়ে দিন গুজরান হয় তার। বেশ ভালোই লাগে সকল অতীত আশা আকাঙ্ক্ষার দোলাচল ভুলে পালিয়ে থাকতে। তবুও বুকের বা পাশটা চিনচিন করে। অর্পিতার কথা খুব মনে পড়ে। ইচ্ছে হয় প্রেমের অমোঘ টানে ছুটে যেতে। কিন্তু সে যদি আবার তাকে উপেক্ষা করে। উপেক্ষা সহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই মন চাইলেও প্রিয় মানুষটির কাছে যেতে পারে না। তখন সে নদীর কথা ভাবে, গরীব মানুষের যাপিত জীবনের কথা ভাবে। ভাবনার জগতে হারিয়ে যায়। বিকেলে বাড়ি ফিরে বাহির বারান্দায় শাকিলদের টয়োটা হাইসটা দেখতে পায়। ঢাকা থেকে তার বন্ধুদের আসার কথা মনে হতেই নিজেকে অপরাধী মনে হয় তার। আহা মোবাইল না নিয়ে বের হওয়া উচিত হয়নি। না জানি বাড়ি খুঁজে পেতে কত ধকল সইতে হয়েছে তাদের।  বাড়িতে ঢুকেই সাকিল, শরীফ, আম্মারের সাথে দেখা। তারা রীতিমতো ফ্রেস ট্রেস হয়ে বারান্দায় বসে তার বাবা মায়ের সাথে চুটিয়ে গল্প করছে। তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় হিমেল। অনেকদিন পর ইয়ার দোস্তদের দেখে যারপরনাই আপ্লুত হয়। কুশলাদি বিনিময়ের পর গায়ের কাপড় ছাড়তে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু  দরজা ভিতর থেকে লাগানো। কয়েবার কড়া নাড়তেই দরজা খুলে যায়। ভিতরের মানুষটাকে দেখে তার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা মৃদু কম্পন ছড়িয়ে যায় সারা শরীরে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না যেন। অকস্মাৎ হিমেলের কলার ধরে ভিতরে টেনে আনে। কিছু  বলার সুযোগ না দিয়েই তাকে জড়িয়ে ধরে অর্পিতা।  মনের মানুষটাকে ভালোবাসার তীব্র আবেগে আলিঙ্গন করে রাখে অনেকক্ষণ৷ 
তাদের অভিমানের পাহাড় গলেগলে যায়- হিমালয়ের জমাট বাঁধা হিমের মতো।

হুসাইন দিলাওয়ার 
মোহাম্মদপুর, ঢাকা