দহন - পারভীন আকতার
বাহ! অসাধারণ আয়োজন।কিভাবে এতো অল্প সময়ে করলে ঠিকঠাক মতো ঐন্দ্রিলা?দীপ্ত একেবারে হতবাক।
আজ তাদের সপ্তম বিবাহবার্ষিকী। পাশে দাঁড়িয়ে নওশিন। একমাত্র মেয়ের আবদার উপেক্ষা করতে পারেনি ঐন্দ্রিলা। মেয়ের দিকে তাকালেই চোখের জল ধরে রাখা যায় না। কী সুন্দর নিষ্পাপ চোখ দুটি! গোলগাল মুখের একটিও কালো তিল নেই! একেবারেই পবিত্রতায় ছুঁয়ে যায় যে কারো নওশিনকে দেখলেই। তবে নিজের হুইল চেয়ার ছাড়া হাঁটার ক্ষমতা নেই। জন্ম থেকেই এভাবেই চলছে দিন তার। মা বাবার একমাত্র সন্তান নওশিন। বয়স ছয় বছর। তবে চালচলন, জ্ঞান প্রতিভা বড়দেরকেও হার মানায়। মা বাবার বিবাহবার্ষিকী সে নিজেই পালন করতে মরিয়া। অথচ দীপ্ত গতকাল রাতে ঐন্দ্রিলাকে রাজিই করাতে পারল না।
মা, কয়েকটা গোলাপ আনতে বলো বাবাকে। বাবা মায়ের দিকে তাকায়। নওশিন মুচকি হাসে।
গোলাপ কেন আবার? ঐন্দ্রিলা বেশ বিরক্ত। দীপ্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে,মনে হলো উপর থেকে কেউ এখনই অজস্র গোলাপ ছড়িয়ে দেবে মেয়ের কথায়।
মা, তোমার খোঁপায় দেবে। বাবা তুমি মাকে গুঁজে দেবে লাল গোলাপ, আমি তখন ছবি তুলবো। নওশিনের পাগলামি একটু বেশিই আজ।
মুচকি হেসে দীপ্ত বলল, ভালই তো! ছবি তুলিস তবে তোর মা দেখ আবার অনুষ্ঠান ছেড়ে চলে না যায়।
কী যে বলো, সারাদিন অফিস করে এসব ভালো লাগে না। এসেই তো মেয়ের কাজ, সংসারের সবকিছু করতে করতে কাহিল হয়ে যায়। মেয়ে জোর করাতে সামান্য আয়োজনের ব্যবস্থা করলাম।
রাতটা আজ বেশ! পূর্ণিমায় ঝলমলে খেলা করছে চাঁদের চিরচেনা স্নিগ্ধ রূপ। হাত দিয়ে যেন জোৎস্না আঁচল ভরে নেয়া যায়! সামনের বিরাট বারান্দা। পরিবারের সবাই উপস্থিত। কেক কাটা হবে। নওশিন নতুন জামা পরে হাজির। দীপ্ত অতিথিদের সাথে কথা বলছে, বেয়ারা খাবার পরিবেশন করছে।
বাবা এদিকে এসো। নওশিনের ডাকে দীপ্ত দ্রুত এলো।
কী হলো মা? আবার কী করতে বলবি? দীপ্ত মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
না, তোমরা দু'জনেই একই কালার জামা পরতে বলেছি, তুমি শার্টটা পাল্টে এসো। তোমার বিছানায় আমি রেখে এসেছি। মাকেও নিয়ে এসো।
হুম, খেয়াল করিনি। যাচ্ছি। তুই মেহমানদের সাথে কথা বল। আসছি।
এই মেয়ে আবার একই কালার বাহানা ধরলো কেন? দীপ্ত হাসছে। ঐন্দ্রিলার মেকআপ করা শেষের দিকে। খুব মনোযোগ।
মেয়ে যখন চায়, পরো। ওর যেটাতে খুশি আমরাতো তাই করি সবসময়।
হুম, চলো। অনুষ্ঠান শেষ করে রেষ্ট করবো। আজ অফিসে প্রচুর কাজ করেছি। ঘুম পাচ্ছে খুব।
দীপ্ত আর ঐন্দ্রিলা সেজেগুজে সবার সামনে উপস্থিত। মাঝখানে নওশিন। কেক কাটলো বেশ মজা করেই।মেয়েকেই আগে কেক খাইয়ে দিল দীপ্ত। নওশিন মাকে খাইয়ে দিল। সবার হাততালি।
ভিতরে কে যেন বিড়বিড় করে বলে উঠলো লুলা পঙ্গু মেয়েকে নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি ভালো নয়।সেজো চাচী মারুফার আম্মু মুখ ভার করে কথাগুলো বলেই চলে গেল।
দূর থেকে সবাই তার যাওয়ার পথ আটকাতে না পারলেও বাড়ীর দারোয়ান মজিদ কাকা ঠিকই মারুফার আম্মুকে থামালেন।
কী রে তালা খোল।
আমার কাছে চাবি নেই, আপা।নওশিন মায়ের কাছে চাবি থাকে।আজও সে নিয়ে নিল।
কী যে বলো, ঐ আতুর মেয়েকে এতো প্রশ্রয় কেন দেয় বাবা জানি না। ছোট মানুষ ওর কী দরকার এসব করার।
আমি জানি না। আপনি নিয়ে আসেন।
নওশিন চাবি দে। দরজার চাবিও তোর কাছে থাকে কেন জানি না বাবু। তোর বয়সের তুলনায় তুই বেশি পেঁকে গেছিস। ঐন্দ্রিলা মেয়েকে বেশি লাই দিয়ে দিয়েছো।
তো কী হয়েছে? আপনার সমস্যা কোথায়? ঘর ওর, সে যা বুঝবে তাই করছে। ভাবী, আপনি ওর মেধা সম্পর্কে জানেন। তবুও ওকে আপনি বারবার কষ্ট দেন আজেবাজে কথা বলে। কেন করেন এসব? আজ এমন আনন্দের দিনে এসব কথা না বল্লেই আপনার চলেনি?
চাচী, আমি আপনার কি কোন ক্ষতি করেছি? আপনি আমার জন্ম অসুখ নিয়ে কথা বলেন কেন বারবার? আমি তো অসুস্থ। আর এতে আমার দোষ কোথায়? আমাকে কেন এতো কথা শোনান?
তোমরা সবসময় অতিরিক্ত বুঝ, কথা বলো। চাবি দাও।
দেব না। আপনি আগে জবাব দিন। নওশিন বেজায় ক্ষেপেছে মনে হলো।
জবাব না দিলে কী করবে? মারুফার আম্মু বেশ বাড়াবাড়ি করছে দেখে সাদিল ডাক দিল।
এই তুমি কী করছো? খোঁচা না মারলে তোমার চলে না বুঝি। ক্ষমা চাও। এই মেয়ের কারণে আজ আমাদের ভাগ্যে সৌভাগ্য তারা উঠেছে। খবরদার ওকে আর একটা কথাও বলবে না। সেজো চাচার ধমকে অনেকটা বিড়াল বনে গেল সেজো চাচীকে দেখে বেশ মজা পেলো নওশিন। বেশ হয়েছে আচ্ছা ধোলাই হলো।
ভাবী আমার মেয়ে আমাদের কাছে ঐশ্বর্য। তোমার কাছে হয়তো সে মূল্যহীন। আমাদের কাছে জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দের স্থান। দীপ্তের দু'চোখ জলে ভরে গেল। ঐন্দ্রিলা নিজের কর্মফলের দোষ ভেবে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে।
মনের কষ্ট এতোই গভীর দহনের পর আরো কোন অবশিষ্ট থাকে না। তবুও মেয়েটা তাদের স্বপ্নের পাখা উড়ায়। ভিতরের জ্বালাকে প্রশমিত করে তার গান, কবিতা আবৃত্তি আর নতুন নতুন চিন্তারাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার অদম্য শক্তি দেখে।
দীপ্ত, ঐন্দ্রিলার চোখের মণি নওশিন। তারা বিশ্বাস করে চেষ্টা ও ভালোবাসার জোরে একদিন নওশিন নিজের পায়ে দাঁড়াবে, বিশ্বকে নিজেই হেঁটে হেঁটে দেখবে। মারুফার আম্মুদের মতো মায়েদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করবে। প্রতিবন্ধীদের জন্য তৈরি করবে সারল্য মাখা জীবনযাপনের উপযুক্ত পরিবেশ। নওশিন দহনের পরে আলোর মতো বিচ্ছুরিত হবে দুনিয়া রৌশন করবেই।
পারভীন আকতার
শিক্ষক, কবি ও গল্পকার
রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম
-
গল্প//উপন্যাস
-
26-11-2020
-
-