অটোয়া, রবিবার ৪ জুন, ২০২৩
প্রতিবিম্ব - অনিরুদ্ধ আলি আকতার

    পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মে ঢোকার মুখে ভিড়ের মধ্যে এক ঝলক দেখলাম। চোখ ধাদিয়ে গেল। কাঁচা হলুদ রঙ। কালো কুচকুচে কোঁকড়ানো চুল, ঘাড় পর্যন্ত বিন্যস্ত। টোল খাওয়া চিবুক। মনে হল,ঈশ্বর তার সমস্ত সৌন্দর্য উপুড় করে দিয়েছেন ওর রূপে। দূর থেকে প্রথমেই ওর চোখ জোড়া চোখে পড়ল। সুরমা মাখা পটল চেরা চোখ! ঐ চোখের প্রেমমাখা মায়া কাজলের চুম্বকে আমার লৌহপাগল মনটা ছুট্টে আটকে গেল। আকুপাকু মনটা ছন্নছাড়া পাগলের মতো কেমন যেন ওকে জড়িয়ে ধরতে আকুলি বিকুলি করছিল।
     আপনারা বলতে পারেন, আরে, একটা শক্তসামর্থ মেয়ে হয়ে রাস্তা ঘাটে কাকে না কাকে দেখে ওসব ভাবতে তোমার লজ্জা করছে না? বলতেই পারেন, আজকালকার মেয়েগুলো সব উচ্ছন্নে গেছে। লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছে...
     সত্যিই বলছি। যদি ঐ শয় শয় লোকের মাঝে আমকে আপনারা ওকে জাপটে ধরে একটা চুমু খাওয়ার চ্যালেঞ্জ দিতেন তাহলে আমি টু হান্ড্রেড পারসেন্ট গ্যারান্টি দিয়ে বলছি... আপনার গো হারা হারতেন। আমি একটা কেন একশোটা চুমুতে লাল করে দিতাম ওর গাল। ওকে জাপটে ধরে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখতাম সবার সামনে।
     প্লাটফর্মে ঢোকার মুখে ওকে দেখে মাথাটা চমচম করছিল। ভাবছিলাম ট্রেন যায় যাক, ওকে আর একটু দেখি। কিন্তু কে কার আবেগের দাম দেয় আজকাল! হঠাৎ এক ঠেলায় সোজা এসে দাঁড়ালাম পাঁচ নম্বরে দাঁড়ানো বনগাঁ লোকালের সামনে। যে মনটা ঘুড়ির মতো উড়ছিল, সেটা হঠাৎ গোঁত্তা খেয়ে পাঁজরের নীচে এসে চিৎ হয়ে পড়ল। পয়লা বৈশাখে যে এমন একটা ঘটনা ঘটবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। অগত্যা মরা মনে ট্রেনের কামরায় উঠে জানলার ধারের সিটে বসে ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষা করতে করতে  ফেসবুকে মুখ ডুবিয়েছি। বাঁশি বাজিয়ে ট্রেনটা ছাড়বে, এমন সময় দেখি ভিড় ঠেলে আমার আগের গলির উল্টোদিকের সিটে সেই তিনি! প্রথমে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কিন্তু দেখলাম, আমার সমস্ত সংশয়ের চাদর সরিয়ে সত্যিই তিনি স্বদেহে হাজির। হাত দশেক দূরে থাকলেও আমি যেন ওর গায়ের গন্ধ পাচ্ছিলাম। দেখালাম ওর সাথে যিনি আছেন তিনি ওকে বেশ আগলেই রেখেছেন ঐ ভিড়ে। ট্রেন ছুটছিল হু হু করে। ট্রেনের সাথে ছুটছিল আমার মনও। আর ট্রেনের বাঁশির থেকেও জোরে, কেমন যেন অন্য এক সুরে আমার মনের বাঁশিটা বাজছিল।
     সামনে দেওয়ালের মতো দাঁড়ানো লোকগুলোর ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছিলাম বার বার। কিন্তু কিছুতেই মন ভরে দেখতে পাচ্ছিলাম না ওকে। বেশ কয়েকটা স্টেশন যাওয়ার পর ভালো করে দেখলাম ওকে। ক্লান্ত মুখ। লাল চিবুকটা আরো লাল হয়ে উঠেছে। চোখের ঘণ কালো পল্লবের ফাঁকে উজ্জ্বল চাহনিটা চঞ্চল হয়ে উঠেছে আরো। জানলা দিয়ে আসা মিষ্টি হাওয়ায় অবিন্যস্ত চুলগুলো মাঝে মাঝে মুখ ঢাকছে।
     হঠাৎ চোখ পড়লো চোখে। এতক্ষণ আমি নিস্পলক নয়নে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এবার ও। অনুপম। অসহ্য। চেয়েই রইল ও আমার দিকে। মনে হল ও শোধ নিচ্ছে। পাশের কারোর দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। শুধু আমি, আমি আর কেবল আমি। ওর ঐ যাদুচোখের স্বর্গোদ্যানে আমি ফুল খেলে বেড়াতে লাগলাম । কতক্ষণ তা মনে নেই। আচমকা ট্রেনের দোলায় সম্বিত ফিরল। দেখি, ও ফিকফিক করে হাসছে। আমার অবস্থা যে তখন কি রকম তা কি করে বলি! আমার মনে হচ্ছিল- ঝাঁপিয়ে পড়ি ওর কাছে। আদরে আদরে পাগল করে তুলি নিজেকে।
     দেখতে দেখতে দু' ঘন্টার সফয় কখন যে শেষ হল বুঝতে পারি নি। ট্রেনের ভেতরে লাগানো শব্দ যন্ত্রে ভেসে এল -আগলা স্টেশন রূপসী বাইপাস হ্যায়। পরবর্তী স্টেশন রূপসী বাইপাস। নামতে হবে। একবার ভাবছি নামার আগে ভয়ের মাথা খেয়ে হাতটা বাড়িয়ে দি ও দিকে। ওকে একবার ছুঁই। আর একবার ভাবছি, না ওসবের দরকার নেই। কে আবার কি মনে করে। শেষ মেষ গুটিগুটি পায় যখন ঐ গলির মুখে এলাম তখন আর দু’জন বসে আছে ওর পাশের সিটে। পায়ে পায়ে আমি সামনে গেটের দিকে এগলেও চোখটা ছিল ওরই দিকে। তখনও ওর নজর কাড়া হাসিটা আমাকে অনবরত ওর দিকে টানে চলেছে।
     গেটের কাছাকাছি আসতেই পিছন থেকে কথাটা কানে এলো- এই যে শুনছেন, আপনাকে বলছি। এই যে-
     কথাটা যে আমার উদ্দেশ্যেই বলা হচ্ছিল তা আমি বুঝিনি। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন আমাকে বললেন-এই যে দিদি আপনাকে বোধহয় ডাকছে।
     হতবাক হয়ে বললাম-আমাকে! কে?
     -ঐ যে উনি।
     পিছন ফিরতেই দেখলাম হাতের ইশারায় উল্টো দিকে বসা সেই ভদ্রমহিলাটি আমাকেই ডাকছেন।
     -হ্যাঁ, আপনাকেই ডাকছি। ভিড় ছিল বলে কথা বলতে পারিনি। কিছু মনে না করলে একটা কথা জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। 
     -বলুন।
     গম্ভীর গলায় তিনি বললেন- ট্রেনে ওঠার পর থেকেই আমি খেয়াল করলাম আপনি আমাদের দিকে বারবার তাকাচ্ছেন। অমন হাঁ করে কি দেখছিলেন বলুন তো? প্রায় সারা রাস্তাটাই অমন করে তাকাচ্ছিলেন কেন?
     -না, আসলে আমি- বলেই আমি থেমে গেলাম।
     -কি হল থামলেন যে?
     শেষ পর্যন্ত ভদ্রমহিলার তাড়নায় আমাকে আসল কারণটা বলতেই হল।
     আমি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম,
     -ওকে দেখার পর থেকে কি জানি আমার কি হল। আমি শত চেষ্টা করেও আমার চোখ অন্য দিকে ফেরাতে পারছিলাম না। ওকে আমার কোলে একটু দেবেন? আমি একটু আদর করবো। ওর মতোই আমার একটা মেয়ে…

অনিরুদ্ধ আলি আকতার 
শিক্ষক, চন্দ্রকেতুগড় শহীদুল্লাহ্ স্মৃতি মহাবিদ্যালয়
বাংলা বিভাগ
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত