বেলাসাঁঝের পাণ্ডুলিপি (আট) – দীপিকা ঘোষ
পরের দিন জগদীশ স্যারকে সঙ্গে নিয়ে যথাসময়েই প্রতাপের বাড়িতে এলেন মনীশ ত্রিবেদী। গম্ভীর মুখে দিলদারের স্ত্রীর অসুস্থতার বিষয়ে কালকের মতোই মন্তব্য করলেন –
মেডিক্যাল সায়েন্সের ব্যাখ্যায় এ হলো ‘সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার’ দাদা! সাদা কথায়, মনোবিকার! তবে কাল আপনার সঙ্গে কথা বলার পরে মনে হলো, এসব বিষয় নিয়ে দিলদার সাহেবকে কিছু না বলাই ভালো! তিনি নিজের থেকে যদি বলতে না চান .... !
জগদীশ শান্ত গলায় বললেন –
সেই ভালো মনীশ স্যার! তিনি আমাদের বন্ধু হলেও বেশি পার্সোন্যাল বিষয় নিয়ে কারুর সঙ্গেই কথা বলতে নেই! তাতে হিতের চেয়ে অহিত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়! দিলদার নিজে তো কোনো ওপিনিয়ন নিতে চাননি আমাদের কাছে! তাহলে? ওঁর আত্মীয়স্বজনরা যেটা ভালো বুঝেছেন, করেছেন!
ঠিক বলেছেন! সেধে কারুর উপকার করতে নেই!
সেটাও সব সময় ঠিক নয়। জগদীশ সরাসরি তাকালেন ত্রিবেদীর মুখে। একটু থেমে থেকে বললেন –
আসলে হিত অহিতের ধারণা সবার এক রকম থাকে না। অযাচিতভাবে সেই জন্যই সব ক্ষেত্রে যেতে নেই! আপনি যাকে হিত হবে বলে ভাববেন, অন্যের তাতে বিশ্বাস নাও থাকতে পারে! তাছাড়া এর আগে কিছু কিছু কথায় আমার মনে হয়েছে, দিলদারের স্ত্রী আর তার পরিবার খুব গোড়া বিশ্বাসের মানুষ। সেখানে দিলদারের মতামত সব সময় টেকে না।
দিলদারের স্ত্রী মনিরা বেগমের অসুখ সাধারণ দৃষ্টিতে বড় অদ্ভুত। তার অসুস্থতার কারণ নিয়ে কৌতূহল আর আলোচনার ঝড় তাই প্রতিবেশীদের বাড়িতেও উঠেছিল। তার অসুস্থতার সূত্রপাত তিন সপ্তাহ আগে এক মৃত প্রতিবেশীর অভাবনীয় উপস্থিতিতে। সন্ধ্যার পরে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়িতে পা রেখে হঠাৎ মনিরা দেখেছিলেন, পাশের বাড়ির লোকমান মিঞা শূন্য ফুঁড়ে সহসা তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। এই ঘটনার সাতদিন আগে লোকমান দেত্যাগ করেছিলেন। তার গায়ে ছিল ধবধবে দুধসাদা পাঞ্জাবি। পরনে ঢিলেঢালা পরিচিত পাজামা। যেমন নিত্যদিন পরতে অভ্যস্ত ছিলেন। মাথার ফেজ টুপির পাশ দিয়ে পুঞ্জীভূত সাদা দাড়ি আগের মতোই কানের দু’পাশ থেকে বুকের ওপর ছড়ানো।
নব্বই পেরুনো লোকমান মিঞা মুখের ওপর তর্জনী তুলে অদ্ভুত ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলেছিলেন –
নামাজ আদায় করে এলাম মনিরা বেগম! দিলদারকে দেখলাম না কেন আজ? সে কি বিধানমতো মসজিদে যায় না নাকি? তাকে বলো, এ কথা আমি বলেছি!
লোকমানের গলার আওয়াজ এতটাই অপ্রাকৃত শুনিয়েছিল যে মনিরা প্রায় আর্তনাদ করে উঠেছিলেন। টেলিভিশনে সংবাদ শুনতে শুনতে সেই চিৎকারে সামনের ঘর ছেড়ে সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে এসেছিলেন দিলদার। মনিরা ক্ষীণস্বরে অস্পষ্টভাবে কাঁপাকাঁপা গলায় বলেছিলেন -
লোকমান চাচা এসেছিলেন! বললেন, দিলদার রোজ নামাজে যায় না কেন?
লোকমান চাচা? তিনি কী করে আসবেন? তিনি তো বেঁচে নেই!
হ্যাঁ এসেছিলেন! ওইখানে দাঁড়িয়েছিলেন! ঠিক সেই রকমই পাঞ্জাবি আর ফেজটুপি পরে!
না,না এ হতেই পারে না মনিরা! ওসব তোমার চোখের ভুল!
আমি স্পষ্ট দেখেছি তাকে! তার কথাও শুনেছি স্পষ্ট!
ঝড়ে ওড়া শুকনো কুটোর মতো দিলদারের হাতের বন্ধনে মনিরার শীর্ণ শরীরটা তখন কাঁপছিল। একটু পরেই চেতনা হারিয়েছিল তার কম্পিত দেহ। পুরো ব্যাপারটা তখনো স্পষ্ট হয়নি দিলদারের কাছে। স্ত্রীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েই প্রতিবেশি বাড়ির ডাক্তারকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছিলেন। সৌভাগ্যবশত ডাক্তার তখন বাড়িতেই ছিলেন। স্যারের স্ত্রীর চেতনা হারানোর সংবাদে ছুটে এসেছিলেন তাড়াতাড়ি। কিন্তু বহু চেষ্টাতেও জ্ঞান ফেরাতে পারেননি। পরদিন সকাল হতে না হতেই পড়শীদের সমাগম শুরু হলো। কেউ এলো কৌতূহলী হয়ে। কেউ বা সমবেদনার দুঃখ বয়ে।
চেতনা হারানোর আগে মনিরা কথা বলেছিলেন সামান্যই। কিন্তু সেই সামান্য কথা অসামান্য হয়ে উঠেছিল মানুষের মুখে মুখে অজস্র ডালপালা ছড়িয়ে। কল্পনার স্তরে স্তরে মিলেমিশে হয়ে উঠেছিল এক রূপকথার গল্প। তার বাঁকে বাঁকে লোমহর্ষক ঘটনার এতটাই বাড়াবাড়ি, অজানিত ঘটনার এতটাই ঘনঘটা যে পড়শী মানুষগুলো কিছুকাল ধরে রাত নামলেই শিহরিত হতো। বলা তো যায় না, কখন কার বাড়িতে সন্ধ্যা নামলে হানা দেবেন প্রতিবেশি লোকামান মিঞা।
দুদিন পরেও ডাক্তারি চিকিৎসায় অবস্থার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন না হওয়ায় স্ত্রীর আরোগ্যলাভের অনিশ্চয়তা অস্থির করে তুলেছিল দিলদারকে। শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় কুটুম্বরা খবর পেয়ে এসেছিলেন। চিকিৎসার ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে যথারীতি সমালোচনা করেছিলেন। বিশেষত মনিরার ভাই ঘটনার অর্ধেকটা শুনেই ক্ষুব্ধভাবে বলেছিলেন –
এইসব ডাক্তার দিয়ে এমন অসুখের কখনো চিকিচ্ছে হয় দুলাভাই? বুবুর তো দেখছি মরার হাল করেছেন আপনি! ডাক্তারের বাপের সাধ্যি নেই, তাকে সুস্থ করে!
তাহলে এর ট্রিটমেন্ট আর কিভাবে করা যায়? ডাক্তার তো বললেন ‘সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার’!
ওসব শক্ত শক্ত কথা আমরা বুঝি না! ঘটনা যা বললেন তাতে এটুকু বুঝেছি, ডাক্তারের কম্ম নয় এ রোগের চিকিচ্ছে করে! যতসব আজে বাজে কথা বলে মানুষকে ভিড়মি খাওয়ানোর মতলব তাই! অশরীরী ওই সবরা ভর করলেই না মানুষ এমন পাথর হয়ে যায়! বলছি তো, ডজন ডজন ডাক্তারের বাপের সাধ্যি নেই বুবুর ঘাড় থেকে নামায়!
তুমি কিসের কথা বলছো মাহিন?
মাহিন এবার ভারি বিরক্ত হলেন। অসংযত হয়ে বললেন –
ওই জন্যই বুবুর এমন অবস্থা দুলাভাই! সবটা নিজের চোখে দেখার পরেও ব্যাপারটা আপনার মাথায় ঢোকেনি! বড় দেরি করে ফেলেছেন! আমি ফোন করে কালই নিয়াজ ফকিরকে এখানে নিয়ে আসতে বলছি! ফকিরের মুখ থেকে সবটা শুনলেই বুঝতে পারবেন, এই অসুখ সারানো কার কাজ!
ফকির দিয়ে ট্রিটমেন্ট?
হ্যাঁ! আপনার মেডিক্যাল ডাক্তার দিয়ে বুবুকে সুস্থ করা যাবে না, দেখলেন তো তিন দিন ধরে! তিন দিনে তার জ্ঞান পর্যন্ত ফেরাতে পারলেন না!
পরের দিন দুপুরের পরেই নিয়াজ ফকির এলেন। দস্তুরমতো বয়স হয়েছে নিয়াজের। মাথার লম্বা চুল কাঁধ ছাড়িয়ে ছড়িয়েছে। সম্ভবত যত্নের অভাবেই জটা পড়েছে দু’চারটি। কিন্তু ফকিরের মুখের চেহারায় পবিত্রতার প্রশান্ত ছাপ। দু’চোখে শান্ত সাগরের গভীরতা। দু মিনিট অপলক মনিরার মুখে তাকিয়ে থেকে বললেন –
আম্মিজানের বিমার বড় কঠিন আছে বাপজান! তবে মেহেরবান খুদাতালা চাইলে সমুদ্দুরেও তো পাথর ভাসে! বিবির জন্য আল্লার কাছে রহমত চান!
দিলদার আস্থাহীনতায় জিজ্ঞেস করলেন –
সুস্থ করতে পারবেন তো?
নিয়াজ হাসলেন –
আমি কি কাউরে সুস্থ করার মালিক বাপজান? আমার সে সাধ্যি আছে? তবে যিনি দুনিয়ার মালিক, তিনি চাইলে সবই করতে পারেন! কী, পারেন না?
ফকিরের কথায় দিলদারের সংশয়ের দোলাচল বেড়ে গেলো। অদৃশ্য আল্লাহর ওপর নির্ভর করে তিনি কিছুতেই স্ত্রীর আরোগ্যলাভের সম্ভাবনায় আশ্বস্ত হতে পারলেন না। ফকির অচেনা দৃষ্টির ঝলক ছুঁড়ে বললেন –
শুধু কিতাব পড়লেই কি তামাম দুনিয়ার সব জানা যায় গো বাপজান? খুদার তৈরি জগৎ আপনাদের জানার জগতের চাইতেও অনেক বড় যে! সেখানে জানার চেয়ে অজানাই বেশি! কে তার নাগাল পায়?
ফকিরের কথায় চমকে উঠেছিলেন দিলদার। চোখে দেখা খুব সাধারণ মানুষটিকে এরপর আর অবহেলা করতে মন চায়নি। বরং মনে হয়েছিল, নিয়াজ খুব সহজ কথায় পৃথিবীর জটিলতম কথাই বলেছেন। কে বলতে পারে, এমনও তো হতেই পারে যে কাজ ডাক্তারের ট্রিটমেন্টে সফলতা পায়নি, নিয়াজ তাকেই সফল করে তুলবেন! সত্যিই তো দুনিয়ার কাছে বিশ্বসত্যের বিরাট অংশ আজও তো রহস্যের অন্তরালে ঢাকা। পৃথিবীর তাবড় তাবড় জ্ঞানী মহাজ্ঞানীরা মেধা দিয়ে, পরিশ্রম দিয়ে কতটুকুই বা আবিষ্কার করতে পেরেছেন তার? কতটুকু জেনেছেন বিরাট বিশ্বের? ইংরেজ গণিতজ্ঞ আইজ্যাক নিউটন, তাঁর বিস্ময়কর আবিষ্কারে বিজ্ঞানের সীমাহীন দিগন্তকে উন্মোচন করার পরেও জীবনের সাঁঝবেলায় তাই ঈশ্বরেই আত্মসমর্পণ করেছিলেন। জগতকে বলেছিলেন –
আমি জানি না পৃথিবী আমায় কিভাবে দেখছে। কিন্তু মহাবিশ্বের মাঝখানে আমার নিজেকে এক জ্ঞানহীন বালক বলেই মনে হয়। যে বালক অনন্ত সাগরতীরে দাঁড়িয়ে এতকাল কেবল নানা রঙের নুড়িপাথরই কুড়িয়েছে। সীমাহীন মহাসাগরের অতলজুড়ে যে চিরসত্য, তা চিরকাল অনাবিষ্কৃতই থেকে গেছে তাঁর কাছে!
কিন্তু দিলদারের প্রত্যাশা সত্ত্বেও মনিরার অসুখ অনাবিষ্কৃতই থেকে গেলো। নিয়াজ ফকির চেষ্টা করে তার চেতনা ফেরাতে পারলেও সম্পূর্ণ আরোগ্য করে তুলতে পারলেন না। মনিরার জীবনস্রোত হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। কথা বলা পুরোপুরি বন্ধ করেছেন। নীরবতার কারণ নিয়ে প্রশ্ন করলে কখনো কোনো উত্তর মেলে না। বরং জবাবে মাথা নিচু করে আরও বেশি পাথরের মতো শক্ত হয়ে ওঠেন। কখনো অদ্ভুত দৃষ্টি ছুড়ে শুধুই চেয়ে থাকেন নিষ্পলক। সে দৃষ্টি এতটাই অর্থহীন শূন্যতায় ভরা, এতটাই অসঙ্গত আর ভাবলেশহীন যে, জবাবের কোনো নিশানাই তাতে থাকে না। ক্রমশ নিস্তেজ হতে হতে মনিরার দেহজুড়ে নিস্তব্ধতার নির্জনতা দেখা দিলো। তার হৃৎপিণ্ড কাঁপতে লাগলো তিরিতিরি বয়ে যাওয়া নদীর স্রোত হয়ে। একসময় চেতনার স্ফুলিঙ্গগুলোও নিভতে লাগলো একে একে। নিয়াজের চিকিৎসা শুরুতে যে আশা জাগিয়েছিল, নিশ্চিত মৃত্যুর থাবা লক্ষ্য করে তার শেষ রশ্মিটুকু নিভে গেলো দিলদারের প্রত্যাশা থেকে। তিনি নতুন করে মেডিক্যাল ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন।
ডাক্তার বড় বিরক্ত হয়েছিলেন বিলম্বের কারণে। শুরুতেই বলেছিলেন –
এ ধরনের পেশেন্টকে কেউ এতদিন আনট্রিটেড অবস্থায় রাখে স্যার?
দিলদার অপ্রস্তুত হতে হতে বলেছিলেন –
ট্রিটমেন্ট তো কখনো থেমে থাকেনি ডাক্তার! গোড়া থেকেই চলছিল! কিন্তু …!
কিন্তু কাজ হয়নি? হবে কী করে? অসুখটা যে কী সেটাই তো জানা যায়নি কখনো! মেডিক্যাল ডায়াগনোসিস ছাড়া এসব জটিল অসুখের কারণ উদ্ধার করা যায়?
দিলদার অপরাধের অনুশোচনা নিয়ে মুখ খুলেছিলেন –
আর কি কোনোভাবেই কোনো আশা নেই ডাক্তার? আমি শুরু থেকেই চেষ্টা করেছিলাম …! অশ্রুর চাপে দিলদার পরের কথাগুলো অসমাপ্তই রেখে দিয়েছিলেন।
দরদী চোখে এরপরে তাকিয়েছিলেন ডাক্তার। তার গলায় সান্ত্বনার সুর বেজেছিল –
মানুষ সাধ্যাতীত চেষ্টা করেও কি সবকিছু সাকসেসফুল করতে পারে স্যার? জীবনের অনেক কিছু নাগালের বাইরেই থেকে যায়! তবুও চেষ্টা তো করতেই হবে! এই মেডিক্যাল ডায়াগনোসিসগুলো আজই করিয়ে আনুন। দেখা যাক! বলেই একটি প্রেসক্রিপশনের কাগজ ধরিয়ে দিয়েছিলেন দিলদারের হাতে ।
মনিরার অবশ্য সময় ছিল না অপেক্ষা করার। ডাক্তার বিদায় নেবার ঘন্টাখানিক পরেই শেষ নিঃশ্বাসে তার হৃৎপিণ্ডের ঝিরিঝিরি স্পন্দনটুকু চিরতরে থেমেছিল। আজ প্রতাপের বাড়িতে বসে পুরো ঘটনার আপাদমস্তক বর্ণনা শোনালেন জগদীশ। মনীশের মুখে সংবাদ পেয়ে তিনিও একবার গিয়েছিলেন দিলদারের বাড়িতে। সেখানে স্যারের প্রতিবেশির মুখ থেকেই সবটা শোনা তাঁর। কথা শেষ করে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছড়ালেন জগদীশ। ঘটনার বিষয়বৃত্তান্ত জানলেও মনীশ যেন সবিস্তারে জগদীশের মুখ থেকে নতুনভাবে সেই কথা শুনছেন, তাঁর চেহারা দেখে এমনটাই মনে হলো। বলতে বলতে, শুনতে শুনতে অন্যদের মুখের পরেও বিষাদ ছায়া ছড়ালো। মৃত্যুই জীবনের অনিবার্য পরিণতি। চিরকাল ধরেই হয়ে আসছে। তবুও তার উপস্থিতি অপরিচিত। রহস্যের অবগুণ্ঠনে ঢাকা। অনন্তকাল ধরে হৃদয় দীর্ণ করার সীমাহীন শক্তিও অটুট তার। মনীশ বহু সময় ইতস্তত করে মুখ খুললেন –
আমার কিন্তু লোকমান মিঞার ব্যাপারটা নিয়ে ধন্দ কাটছে না দাদা! শোনা অবধি ভাবছি! জগদীশ স্যারের মুখেও একই রকম শুনলাম! কিন্তু একজন মৃত মানুষকে মানুষের চেহারায় দেখা কি সম্ভব হয় কখনো?
প্রতাপ তাঁর স্বাভাবিক স্বভাবে বললেন –
কী করে বলি বলুন? আমি তো নিজে কখনো দেখিনি!
তবুও! আপনার কাছে অনেক প্রশ্নেরই তো জবাব পাই!
এখানেও তো পেয়েছেন! দিলদারের স্ত্রী নিজের মুখেই তো বলে গেছেন সে কথা!
না, না দাদা, তার কথা আমার কিছু বিশ্বাস হয় না! নইলে ডাক্তার আর কেন বলেছেন, ওটা ছিল ‘সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার’!
ডাক্তারই যে ঠিক কথা বলেছেন, আর মনিরা বলেননি, সেটা বিচার করবেন কিভাবে?
তার মানে আপনি মনিরা বেগমের কথা বিশ্বাস করেছেন?
আমি তা বলিনি মনীশবাবু। আমি বলছি, জগতে এমন অনেক অভাবনীয় বিস্ময় রয়েছে যেগুলো আমাদের সাধারণ বুদ্ধি স্বীকার করে নিতে পারে না। কারণ মানুষের বুদ্ধির জগত সীমিত। তার কল্পনা, পার্থিব চেতনার বাইরে পৌঁছুতে অক্ষম। সে জন্যই যে অভিজ্ঞতা আমাদের হয়নি তাকে আমাদের সত্য বলে মেনে নিতে দ্বিধা হয়।
আমি অবশ্য কথাটা ওভাবে ভেবে দেখিনি দাদা! কিন্তু তারপরও …!
হ্যাঁ তারপরেও ব্যাপারটা অমীমাংসিত থেকেই যায়। তার কারণ আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বাইরে যে বিষয়গুলো রয়েছে, তার সম্পর্কে মনের সংশয় কোনো যুক্তিতেই কাটতে চায় না।
আজকের দিনটা চমৎকার। শীতের উপস্থিতিতে পরিবেশে উষ্ণতার প্রাবল্য কম। ঝিরিঝিরি বাতাসে সামনের ফুলের বাগানে তন্বী নতর্কীর লীলায়িত দেহ হয়ে ছোট ছোট গাছগুলি নাচছে। বিষাদের, শোকের, বেদনার বিন্দুমাত্র আভাস কোত্থাও ছড়িয়ে নেই। পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের ছলকে পরা প্লাবনে পুরো দিগন্ত উদ্ভাসিত। আকাশজুড়ে নীলের সমুদ্র আরও বেশি সুগভীর। মনিরার পৃথিবী ছাড়ার কারণে প্রকৃতির কোথাও কোনো ঘাটতি নেই। যদিও দিলদারের বেদনায় তাঁর বন্ধুরা বেদনার্ত। সবার মনের আকাশেই বিষাদের অন্ধকার।
করুণাময়ী জীবনের বহুতর কর্তব্যের মধ্যেও বড়দাদাবাবুর বন্ধুদের আপ্যায়ন করতে অবহেলা করেনি কখনো। আজও প্রতাপ না বললেও যথাসময়ে চা এলো টেবিলে। সঙ্গে মুখরোচক খাদ্য। নিঃশব্দে পরিবেশন করে নিঃশব্দেই সে চলে গেলো আজ। জগদীশ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মাথা নাড়লেন –
সত্যিই তাই! কোনো যুক্তিতেই মনের সংশয় কাটতে চায় না। অথচ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও জগতের বহু বিষয় আমরা নিঃসংশয়ে মেনেও নিই। এই যেমন ধরুন, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। কিংবা ধরুন, পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটের বাউণ্ডারি সম্পর্কে যেমনটা বলা হচ্ছে। কিংবা …।
মনীশ বাধা দিয়ে বললেন –
না না আপনার এই উদাহরণগুলো ঠিক হচ্ছে না স্যার! আমাদের সামনে এসব বিষয়ের এমন সব সায়েন্টিফিক প্রমাণ উপস্থিত রয়েছে, যাতে সংশয় হওয়ার কোনো প্রশ্ন থাকে না! কিন্তু ...!
জগদীশ নিরুত্তাপ গলায় মনীশকে থামিয়ে প্রতাপকে উদ্দেশ্য করে বললেন –
আমার নিজের জীবনে একটা ঘটনা ঘটেছিল স্যার! আজও তার ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি। ঘটনাটা জ্যাঠামশায়ের মৃত্যুর কদিন আগে! তখন ফাইন্যাল পরীক্ষা শেষ হওয়ায় আমার স্কুল বন্ধ। আমার জ্যাঠামশায় নিঃসন্তান ছিলেন। কারণ, বিয়ের এক বছর পরেই জ্যেঠিমা হঠাৎ মারা গেলে ঠাকুমার অনেক জোরাজুরিতেও তিনি আর বিয়ে করেননি। আমি ছিলাম তাঁর অত্যন্ত স্নেহের ধন। তাঁকে ছেড়ে আমিও থাকতে পারতাম না। যাইহোক, আমি সে বছর ক্লাশ সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছি। কাজেই যথেষ্ট বড়ো। বারো পেরিয়ে তেরো তে পা দিয়েছি।
রহস্যময়তার গন্ধ পেয়ে মনীশ ততোক্ষণে নড়েচড়ে বসেছেন। তাঁর আগ্রহ উত্তেজিত। কৌতূহল টানটান। জগদীশ বললেন –
আমি আর জ্যাঠামশায় যে ঘরে থাকতাম সেই ঘরে প্রভু যিশাসের একটা বড় পোর্ট্রেইট ছিল। একবার এক বড়দিনের অনুষ্ঠানে তাঁর এক বন্ধু উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। প্রতি রোববার জ্যাঠমশায়ের সঙ্গে আমিও সেই ফটোর সামনে গিয়ে প্রার্থনায় বসতাম। সেদিন সকালে জ্যাঠমশায়ের একটু আগেই গিয়েছি। হঠাৎ দেখি, সারা ঘরটা এক অদ্ভুত স্নিগ্ধ আলোয় ভরে উঠলো। তারপর দেখি, আলোর ভেতর থেকে একজন বেরিয়ে এলেন। তাঁর দু চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছিল। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন –
এবার জ্যাঠামশায়কে ছেড়ে দাও বিলু! তাঁর পৃথিবীর জীবন শেষ হয়েছে! আর তিন দিন পরে তাঁকে আমাদের কাছে চলে আসতে হবে!
এটুকু বলেই তিনি আমার গায়ে হাত রাখলেন। আর এক অবাক প্রশান্তিতে আমি সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঠিক তিন দিন পরে জ্যাঠামশায় সত্যি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। প্রায় সজ্ঞানে। এই ঘটনাকে আপনি কী বলবেন মনীশ স্যার? বিশ্বাস করতে পারবেন নিঃসংশয়ে?
উত্তরে মনীশ একেবারে নীরব হয়ে গেলেন। প্রতাপ দু’পাশে মাথা দোলালেন নিঃশব্দে। মুখে না বললেও অলকার হঠাৎ চলে যাওয়ার রাতটি তাঁরও মনে পড়ে গেলো। সেই ঘটনাও তো বড় কম বিস্ময়ের ছিল না। তার আলোড়ন আজও প্রতাপের বুকের ভেতর একই সঙ্গে রহস্য আর বেদনার ঢেউ ভাঙে। তখন সবে সন্ধ্যার শান্ত ছায়া চারপাশে ছড়াচ্ছে । একে একে নিয়নবাতির প্রখর আলোয় অচেনা হয়ে উঠেছে শহরের দিনের রূপ। প্রতাপ কলেজ থেকে ফিরে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে অফিসের কিছু কাজকর্ম নিয়ে বসেছেন। ঠিক তখনই একটি লাল রঙের কুকুর বারান্দার সিঁড়িতে বসে আর্তনাদের মতো ডেকে উঠলো প্রথমবার। তারপর বিরামহীন একইভাবে ডেকে চললো বিউগলের সকরুণ সুর হয়ে। প্রতাপ প্রথমবারেই চমকে উঠে করুণাকে ডেকেছিলেন –
করুণা, বেরিয়ে দ্যাখ না কুকুরটা ওভাবে কাঁদছে কেন?
একটু পরেই সাড়া পাওয়া গিয়েছিল করুণার –
বড়দাদাবাবু, এ তো আমাদের পাড়ার কুকুর নয় গো!
না হোক, কিছু খেতে দে। ক্ষিধে পেয়েছে বোধহয়।
করুণার বিশ্লেষণ তখনো শেষ হয়নি। বলেছিল –
এ পাড়ার সব কুকুরই আমার মোটামুটি চেনা! তবে এ কুকুর রাস্তার নয়! দিব্যি মোটাতাজা! কী নাদুস নুদুস দেখতে! প্রতাপ বিরক্ত হয়েছিলেন উত্তরে –
কে ওসব শুনতে চাইছে করুণা! আগে কিছু খেতে দে! ওর কান্নাটা বড় বিশ্রী লাগছে শুনতে!
এরপর থেকেই রহস্যপর্বের শুরু। করুণা কাগজ পেতে যত্ন করে অনেকটা খাবার এনে দিলেও কুকুরটার সিঁড়ির গোড়া থেকে নড়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না। বরং তার আর্তনাদ করুণতায় বিহ্বল হয়ে প্রতাপের কান থেকে অন্তরের স্তরে স্তরে আরও প্রবলভাবে ছড়াতে লাগলো। অলকা রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন। তিনিও সরাতে ব্যর্থ হলেন। তবে আশ্চর্য ব্যাপার হলো, অলকাকে দেখে কুকুরটা তার পায়ে হঠাৎই মাথা রেখে আরও জোরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। ভয় পেয়ে দ্রুত ওপরে উঠে এলেন অলকা। কিন্তু অনেক চেষ্টাতেও তাকে না পারলেন খাওয়াতে। না পারলেন তার কান্না প্রতিরোধ করতে। প্রতাপ অনেক ভয় দেখিয়ে তাকে বাড়ি ছাড়াও করতে পারলেন না। লাল কুকুর অবশ্য রাত বাড়ার পরে একনাগাড়ে নয়, থেমে থেমে কাঁদতে লাগলো। সময় পেরিয়ে রাত গভীর হলো। অস্বস্তি সত্ত্বেও এক সময় রোজকার মতো ঘুম নামলো সবার চোখে। কিন্তু কিছু সময় পরেই হঠাৎ অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে গেলো অলকার। তার বুকের ওপর একটা ভারি পাথর কেউ যেন চেপে ধরে রয়েছে। নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে ফুসফুস। প্রতাপ জেগে ঊঠে কিছু করার আগেই চলে গেলেন অলকা।
সম্ভবত ওই সময়ে সেই কুকুরটারও মৃত্যু হয়েছিল। অলকার দেহটা বারান্দায় নামাতে গিয়ে সবারই চোখে পড়লো, সেই নির্দিষ্ট সিঁড়ির ওপর মাথা রেখেই নিঃশব্দে পড়ে রয়েছে লাল কুকুর। সন্ধ্যাবেলার সমস্ত বিকার উড়ে গিয়েছে তার দেহ থেকে। তার শরীর জুড়ে তখন ছড়িয়ে রয়েছে নিঃস্তব্ধ সুখের নীরব প্রশান্তি।
দীপিকা ঘোষ। যুক্তরাষ্ট্র
-
গল্প//উপন্যাস
-
04-01-2022
-
-