প্রথম চশমা - ইকবাল কবীর রনজু
আজ বাজার থেকে ফেরার পর বাড়ির সদর দড়জা বন্ধ করার কথা মনে ছিল না আমার। রেফ্রিজারেটর না থাকায় প্রায়শই বাজারে যেতে হয়। একা মানুষ, মাছ মাংস তেমন কিনিনা। সবজি গুলো দু-তিন দিনের বেশি রাখা যায় না। তাই মাঝে মধ্যেই বাজারে যেতে হয়। আজ মাছ কিনে বাজার থেকে কেটে নিয়ে এসেছিলাম। মাছ গুলো ধুয়ে শেভ করার জন্য মুখে শেভিং ফোম লাগাচ্ছি এমন সময় সদর দরজা ফাঁকা পেয়ে একজন মেয়ে মানুষ সরাসরি বাড়ির ভেতরে চলে এসেছে। অনুমিত হলো মধ্য বয়স পেড়িয়ে গেছে তার। অনাকাঙ্খিত ভাবে একজন মেয়ে মানুষ বাড়িতে প্রবেশ করায় আমি অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পরি। ইশারায় অদূরের কাঠের চেয়ারটিতে বসতে বলে আমি কোন মতো শেভ করে ফ্রেশ হই।
চেনা চেনা মনে হলেও ঠিক চিনে উঠতে পারছিলাম না মেয়েটাকে। এমন আজকাল আমার হর হামেশাই হচ্ছে। মনে হয় বয়সের দোষ। আগে ও হতো তবে তা কখনো কখনো। যখন বাইরে বেরুতাম কাউকে পরিচিত মনে হলে বারবার তার দিকে তাকাতাম। চেনার চেষ্টা করতাম। সে বা তারাও সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় কালে জানাতো, স্যার আমি আপনার ছাত্র, অমুক ব্যাচের। তখন হয়তো বিষয়টা পরিষ্কার হতো। অনেক সময় পরিষ্কার মনে না থাকলেও হায়..হ্যালো..ও..হ্যাঁ এ ধরণের শব্দ ব্যবহার করে তাকে চিনেছি এমন ভান করে সৌজন্যমূলক কথা বার্তা বলে, কিছু উপদেশ দিয়ে চলে আসতাম। এ মেয়েটি আমার কোন ব্যাচের ছাত্রী অথবা আদৌ ছাত্রী কিনা এখন মনে করতে পারছি না আমি।
মনে হচ্ছে আমায় চিনতেই পারোনি? অনেক দিন দেখা নেই তো। আমি সুরভী। সুরভী নামটি শুনে আমার মনে পরে একজন মাত্র সুরভীকেই তো আমি চিনতাম। দ্বিতীয় কোন সুরভীর সাথে জীবনে কখনো পরিচয় বা ঘনিষ্ঠতা আমার হয়নি। যে সুরভীকে আমি চিনতাম তার সাথেও দেখা নেই অনেক বছর। এই সময়ে চোখের দেখার সক্ষমতা যেমন কমেছে তেমনি সুরভী নামক চেনা মানুষটাকেও ভুলতে চেষ্টা করেছি। আমি তখন চল্লিশের কোঠায়। দূরে দেখতে সমস্যা না হলেও ছোট ছোট হরফের লেখা নিকট থেকে পড়তে অসুবিধা হতো। দেখার জন্য এরি মধ্যে আমাকে চশমা পাল্টাতে হয়েছে কয়েকবার। মাঝে কেনা অনেকগুলো চশমা এখন আর আমার সংগ্রহে না থাকলেও সুরভীর কিনে দেওয়া সেই প্রথম চশমাটা সযত্নে আগলে রেখেছি।
দেশ বিদেশের কাগজের সাহিত্য পাতায় হর হামেশা আমার লেখা ছাপা হয়। কাছের দুচারজন লেখক বন্ধু আমার লেখার ধরণ নিয়ে সমালোচনাও লিখেন। তাদের কারো কারো মতে আমার লেখা উঁচু মানের ও গবেষণার যোগ্য। কেউ কেউ বিরুপ মন্তব্যও করেন। তাদের মতে আমার লেখায় নাকি কোন না কোন ভাবে আমার ব্যক্তিগত বিষয় প্রাধান্য পায়। আমার সমালোচকদের লেখা মন দিয়ে পড়ি আর ভাবি কেন যে লেখার নেশাটা মাথায় ঢুকেছিল? কেবল পাঠকের ভাল লাগার জন্য? লেখকের পেটের চিন্তা কি কাগজের মালিকেরা করেন? করেন না। খুব উঁচু মানের লেখক ছাড়া কজন লেখক লেখার জন্য সম্মানী পান? যদিও সম্মানী পাওয়ার আশায় লিখি না তার পরও কখনও কখনও মনে হয়েছে লেখার পেছনে যে সময় ব্যয় করি সে সময়ের কি কোনই মূল্য নেই। আমার লেখা কি মান সম্মত নয়? লেখা মান সম্মত না হলে কাগজের মালিকেরা তা ছাপেই বা কেন?
সুরভী আমার লেখার একজন অন্ধ ভক্ত ছিল। ও নিজেও টুক টাক লিখতো। ওর কবিতা গুলো স্থানীয় কাগজে পাঠানোর আগে আমাকে একবার দেখিয়ে নিত। পল্লবী ও সমীর যখন বাড়িতে থাকতো না বিশেষত তখন ও কবিতা গুলো ঠিক করে নিত। সুরভী আমাকে না কি আমার মুন্সিয়ানাকে পছন্দ করতো ঠিক জানি না আমি, তবে তখন আমি এটুকু বুঝেছিলাম আমার সান্নিধ্য ওর ভাল লাগতো। আমারও যে ওর সান্নিধ্য ভাল লাগতো না তা কিন্তু নয়। খুব বেশি কাটা চেড়া না করে ওর লেখা ঠিক ঠাক করে দিতাম। স্থানীয় কাগজ গুলোতে ওর লেখা ছাপা হতো। এতেই ও মহা খুশি।
আমার ব্যাংকার স্ত্রী পল্লবী কখনোই আমার লেখার ভক্ত ছিল না। ওর মতে, লেখা লেখি করে যেহেতু কোন টাকা পয়সা পাই না তাই এটা চালিয়ে যাওয়ার কোন মানে হয় না। শিক্ষকতা করে যে বেতন ভাতা পেতাম তাতে সংসার চালানো আমার জন্য খুব কঠিন হয়ে পরেছিল। মাঝে মধ্যেই এর ওর কাছে টাকা ধার করতে হতো। বেতন পেয়ে ধারের টাকা শোধ করতে হতো আবার সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় সব কিছুর যোগান ও দিতে হতো। এভাবে দিনের পর দিন চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পরেছিলাম আমি।
পল্লবী শুরুতে আমার সমান মাইনে পেত। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমার উপার্জনকে ছাড়িয়ে যায় পল্লবীর রোজগার। আমি পুরুষ হওয়ায় পুরুষ শাসিত সমাজে পরিবারের ব্যয় ভার বহনের দায়িত্ব, সন্তান সন্ততির লেখাপড়ার দায়িত্ব কেবলি আমার; এমন বিশ্বাস থেকে আত্মকেন্দ্রিক পল্লবী কেবল ওর কথাটাই ভেবেছে। টাকা জমিয়েছে; যেটা ওর নিজের, যেখানে আমার কোন অধিকার নেই।
ধীরে ধীরে পরিবার বড় হয়েছে। ছেলে মেয়েদের লেখা পড়ার খরচ বেড়েছে। দুজনেরই বেতন বেড়েছে। বেতন যেমন বেড়েছে তার চেয়ে দ্রুত গতিতে পণ্য মূল্য বাড়ায় পরিবারের ব্যয় ভার বহনে আমি যখন গলদঘর্ম তখন পল্লবীর সঞ্চয় বেশ ভারি হলেও ও কোনরকমে আমার প্রতি সহায়তার হাত বাড়ায়নি। আমি কখনো কখনো প্রতিবাদ করলে অশান্তি হয়েছে। অশান্তি না চাওয়ায় এসব কিছু আমাকেই বহন করতে হয়েছে। ফলে পল্লবীর সাথে আমার দীর্ঘ কাল কেটেছে ঠিকই কিন্তু মানসিক দূরত্ব বেড়েছে অনেক। যতটা ভালবেসে ও আমায় বিয়ে করেছিল এখন হয়তো তার চেয়ে ঢেড় বেশি ঘৃণা করে, তেমনি আমিও।
পল্লবী ও আমি এক সাথে বসবাস করলেও দুজনের মধ্যে মানসিক দূরত্ব ছিল অনেক বেশি। ওর মুখে কোন লাগাম ছিল না। তীর্যক ভাষায় ও ভঙ্গীতে কুরুচীপূর্ণ কথা বলা ওর কাছে মামুলী ব্যাপার হলেও এগুলো হজম করা আমার জন্য কষ্টসাধ্য হলেও হজম করতে হয়েছে। খুব অল্পতেই হুট করে রেগে যেত। দূরত্বের কারণগুলোর মধ্যে এগুলোও ছিল। হতে পারে এই দূরত্বের কারণেই সুরভী আমার খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল।
সমীরের সাথেও সুরভীর ভাল যাচ্ছিল না। তখন আমরা এক সাথে ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। সমীর কোথায় কি একটা চাকুরী করতো। চাল চলন দেখে বোঁঝা যেত বোধ হয় ভালই বেতন পায়। মাসের ক’দিন ধুম ধারাক্কা চলার পর শেষ দিকে এসে হাতে কোন টাকাই অবশিষ্ট থাকত না। মাসের শুরুতেই সুরভীর বেতনের টাকা নিয়ে নিত ও। এসময় খুব কাছে থেকে আমার দেখার সুযোগ হয় কিভাবে একটা মেয়ে তার উপার্জনের সবটাই স্বামীর হাতে তুলে দেয়। ইচ্ছে করে না বাধ্য হয়ে? ঠিক তখন এ প্রশ্নের জবাব না পেলেও পরে জেনেছি। একই বাড়িতে ভাড়া থাকার সুবাদে এবং সমবয়সী হওয়ায় সমীরের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। আমি যখন জানতে পারলাম সমীর রীতিমতো জুয়া ও নেশায় আসক্ত তখন থেকে আমি ওর সঙ্গ পরিত্যাগ করি। কখনো কখনো ভেবেছি সমীরের সাথে আমার কত তফাৎ। ও সংসারের চিন্তা না করে মদ, জুয়ায় আসক্ত হয়েও কত সুখী অথচ আমি জীবনে কখনো জুয়া খেলিনি, মদ স্পর্শ করিনি তার পরও নিজেকে কখনো সুখী দাবী করার সাহস পাইনি। মূলত আমার পকেটে কখনো মদ জুয়ার টাকা থাকেনি। পল্লবীর মতে, পুরুষ মানুষ মদ খাবে এতে দোষের কিছু নাই কিন্তু তার পকেটে সব সময় অঢেল টাকা থাকা চাই। এখানেও পল্লবীর সাথে আমার দ্বিমত হতো। কিছু দিন পর সমীররা অন্যত্র কোথাও চলে যায়। এর পর এতো বছর চলে গেলেও সুরভী ও সমীরের সাথে আর কখনো দেখা হয়নি আমার।
সুরভীকে সাথে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকি আমি। পল্লবীর সাথে আমার মানসিক দূরত্ব এবং সুরভীদের সাথে পাশাপাশি থাকায় ও সুরভীর লেখা লেখির আগ্রহের জায়গাটা সুরভী এবং আমাকে সেসময় মানসিক ভাবে কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল। সুরভী আমাকে যেভাবে কাছে পেতে চাইতো তাতে আমার সায় ছিল না। সুরভীর প্রশ্রয় থাকলেও নৈতিকতার প্রশ্নে সুরভীকে কখনো আমি ছুইনি পর্যন্ত। আজ অনেক বছর পরে আমি আর সুরভী আবার মুখোমুখি বসে। ওর মুখটা এখন আর আমি স্পষ্ট দেখতে পারছিনা। বিষয়টি বুঝতে পেরে ও টেবিলের উপরে রাখা চশমাটা পড়িয়ে দেয়। ঝাপসা চোখ পরিষ্কার হয়ে আসে। যে সুরভীকে আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, অনেক চেষ্টা করেও যখন ঠিকমত মনে করতে পারছিলাম না, এমন সময় শেষে কেনা চশমাটা পড়তেই ওর চোয়ালের কাটা দাগের দিকে আমার নজর পরে। মাইনের টাকা হাতে দেয়নি বলে সেদিন সাংঘাতিক ভাবে সুরভীকে পিটিয়েছিল সমীর। সেদিন পল্লবী আর আমিই সুরভীকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। তিনটে সেলাই পরেছিল সুরভীর চোয়ালে। মেয়ে মানুষ প্রতিবাদী হবে এমটা ভাবতেই পারতোনা সমীর।
সেদিনের সেই স্কুল শিক্ষিকা, আমার কিছু কালের বন্ধু সমীরের বউ, আমার বা আমার লেখার ভক্ত সুরভীকে চিনতে পারি আমি। আমার অজ্ঞাত বাসের তিন বছর হতে চললো। এ সময়টাতে কোন আপনজন আমার খোঁজ নিতে আসেনি। ওরা সবাই ওয়েল সেটেলড। হয়তো ওরা জানেই না আমি এখানে আছি। এমনও হতে পারে ওরা হয়তো আমার খোঁজ করছে কিন্তু সন্ধান পাচ্ছে না। নিজে থেকে যদি কেউ হারিয়ে থাকতে চায় তাকে খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন বৈকি। আজ কাল সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন থাকলেও আমি ইচ্ছা করেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করিনা। কার খোঁজ নেব আমি? কেনই বা খোঁজ নেব? সংসারের সুখের কথা ভেবে স্বার্থপরের মতো বউ ছেলে মেয়ে ছাড়া জীবনে যখন আর কারো খোঁজ নিতে পারিনি, প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াতে পারিনি সেই আমার আজ আর কোন পিছু টান নেই। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নেওয়ার পর শিক্ষা জীবন শেষ হলেও সংসার জীবনের পুরোটা সময়ই আমাকে শিক্ষানবীসের মতো কাটাতে হয়েছে। এটা এভাবে কর, ওটা ওভাবে কর, এটা এভাবে করোনা এমন অনেক নির্দেশনায় শিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করলেও পাস করতে পারিনি আমি। সেই শিক্ষাজীবনের গন্ডি পেরিয়ে এখন অজ্ঞাতবাস জীবন ভালই লাগছে। কারো কাছে কৈফিয়ত দিতে হয় না। শিখতে হয় না। দীর্ঘ দিনের পরাধীন জীবন যাপন শেষে যেন স্বাধীনতার সুখ ভোগ করছি।
পাশাপাশি বসলেও কিছুক্ষণ পিন পতন নিরবতায় কেটে যায়। সমীরের কথা জিজ্ঞেস করতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সুরভী। জানায়, ও আর নেই। কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। সাড়িয়ে তোলার জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটি করিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওকে বাঁচাতে পারিনি আমি।
আমার খোঁজ কি করে পেলে? আর এখানে এত দূরে এলেই বা কেন? আমার এমন প্রশ্নের জবাবে সুরভী জানায়, ও মারা যাবার পর আমার বাবা মা চেয়েছিলেন আমি তাদের সাথে থাকি। কিন্তু সম্পর্ক করে বিয়ে করায় যে বাবা মা অভিমান করে বিয়ের পর আমার কোন খোঁজ নেয়নি, সমীরকেও কখনো মেনে নেয় নি সেই সমীরই যখন নেই তখন আর বাবা মায়ের কাছে ফিরে যাইনি। আমার বান্ধবী এখনকার এক বিধবাশ্রমে সেটেল করেছে আমাকে। ভাবছি বাঁকি জীবনটা এখানেই কাটিয়ে দেব। তিন মাস হলো এখানে এসেছি আমি। আজ সদর থেকে ফেরার পথে তোমাকে এ বাড়িতে ঢুকতে দেখে কৌতুহল নিবৃত করতে না পেরে তোমার এ বাড়িতে ঢুকে পরি। তুমি এভাবে, এখানে? আর পল্লবী?
আমি নিরুত্তর থাকি। এরি মধ্যে আমার এলোমেলো ঘরটি সাজাতে গোছাতে থাকে সুরভী। আমি নিষ্পলক তাকিয়ে থাকি সুরভীর দিকে। ময়লার ঝুড়িতে এটা ওটা ফেলতে থাকে সুরভী। সুরভীর কিনে দেওয়া আমার সেই প্রথম চশমাটা হাতে নিয়ে ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে দেখে সুরভী। কি যেন ভাবে কিছুক্ষণ। এটাতো এখন নিষ্প্রোয়জন বলেই ময়লার ঝুড়িতে চশমাটি ফেলে দিতে উদ্যত হলে আমি সুরভীর হাত চেপে ধরি, বলি এটা ফেলোনা। এটা এখনো খুব কাজ দেয়। সুরভী বিস্মিত হয়। ও হয়তো ভাবে ওর স্মৃতি মনে রাখতেই এটা আমি এখনো আগলে রেখেছি সযতনে।
অতীতের দিন গুলোর কথা যখন আমার মনে পরে; বিশেষত পল্লবীর কথা তখন এ প্রথম চশমাটা পরি আমি। যখন আমি কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করি তখন নানা ঘাত প্রতিঘাতের ছবি মনে স্পষ্ট হতে থাকে তখন এ চশমাটা পরি আমি। পান থেকে চুন খসলে ও যখন আমার উপর বিরক্ত হতো তখন ওর মুখাবয়ব ভয়ঙ্কর ভাবে বদলে যেত। সেই ভয়ঙ্কর মুখাবয়ব মনে পরলে চশমাটা আমি দ্রুত পরে নেই। যেন পরিষ্কার না দেখি। ঐ মুখটা যে আমার আর দেখতে ইচ্ছে করে না। আমি কখনো কর্কশ ভাষার চর্চা না করলেও এটা ওর কাছে ডাল ভাতের মতো ছিল। ও যখন আমার সাথে কর্কশ ভাষায় কথা বলতো তখন আমার পৃথিবী পাল্টে যেত। অপরিচিত লাগতো। সাংসারিক শিক্ষা জীবনে এটা হজম করলেও আমি ঐ ভাষা রপ্ত করতে পারিনি। এটাকে ফেল বলব নাকি পাস বলবো তা জানিনা, তবে এটুকু বুঝি মানুষ সুখের জন্য সংসারমুখী হয় আর আমাকে সুখের জন্য প্রায়শই বহির্গামী হতে হয়েছে। ওর কাছে ও বা ওরাই শ্রেষ্ঠ আমি বা আমরা কখনোই ওদের সমকক্ষ নই। সত্যি আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম এবং তার শেষ পরিণতি আমার এ অজ্ঞাত বাস। অনেক দিনের সংসার। ভুলতে চাইলেও পল্লবীকে ভুলতে পারি না। আবার মন থেকে ভাল ও বাসতে পারিনা। এই দোলাচলের মধ্যে যখনি ওর কথা মনে হয় তখনি এই প্রথম চশমাটা পরি আমি। যেন ফেলে আসা দিন গুলো পরিষ্কার দেখতে না পাই। তাই এ চশমাটা না ফেলে সযতনে রেখেছি।
আমার কথা শুনতে শুনতে কখন যে সুরভীর দু’চোখ জলে ভরে গেছে খেয়াল করিনি। ওর চোখের ক’ফোটা জল গড়িয়ে পরে মেঝেতে। একবার ইচ্ছে করে ওকে ছুয়ে দেখি। চোখ থেকে উপচে পরা জলের কনা গুলো মুছে দেই। মুছতে উদ্যত ও হই। প্রথমত অধিকার না থাকায় দ্বিতীয়ত মোহ মায়ায় নিজেকে আর জড়াবোনা এমনটা ভেবে নিজেকে সংযত করি আমি। ওর চোখের অতি নিকট থেকে সন্তর্পণে হাত সড়িয়ে নেই।
সুরভী আমায় জাপটে ধরে। বলে, তুমি ভিরু, তুমি কাপুরুষ। মন যেটা চায়না বাধ্য হয়ে সেটা হজম কর। মন মননে একটুও পাল্টাওনি নিজেকে। আগে যেমন ছিলে এখনও তেমনই রয়ে গেছ। নৈতিকতার প্রশ্নে আমি যখন হেরে গেছি তখনও তুমি সগৌরবে মাথা উঁচু করে থেকেছো। তোমার এমন ব্যক্তিত্বই আমাকে মুগ্ধ করতো। কাছে টানতো। এখনো টানে। টানছে।
শেষে কেনা বেশি পাওয়ারের চশমাটা খুলে সুরভীর হাত থেকে নেওয়া প্রথম চশমাটা পরে নেই আমি। অস্পষ্ট হলেও পল্লবীকে দেখতে পাই। ভালবেসেই তো ওকে বিয়ে করেছিলাম। ও আমাকে না বুঝলেও ওকে তো আমি ঠকাতে পারি না। ওর শিক্ষা, বেড়ে ওঠা, মতাদর্শের সাথে আমার শিক্ষা, বেড়ে ওঠা, মতাদর্শের যতই ফারাক থাকুক না কেন ও আমার বিবাহিত স্ত্রী। হয়তো বিয়ের আগে ওকে চিনতে, জানতে আমি ভুল করেছিলাম। ওখানেও ফেল করেছিলাম। ফেল করলে তার মাশুল তো দিতেই হয়, সেটাই দিচ্ছি আমি। নয়তো বিয়ের পর পাল্টে গেছে ও। তাই চেনা পল্লবীকে পরে আমার অচেনা, অজানা লেগেছে।
আমি নিজেকে সুরভীর থেকে আলাদা করতে পারি না। আমার রিপু গুলো যেন একে অপরকে পরাজিত করে, সুরভীকে আঁকড়ে ধরতে বাধ্য করে। আমার সারা পেয়ে নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পরে সুরভী। বর্তমানে আমার মতো সুরভীও তো একা। প্রস্ফুটিত ফুল ব্যতীত কলিতে মধুমক্ষিকা বিচরণ করতে পারে না, কিন্তু পৌঢ় সুরভী তো পরিণত ফুল। অতএব মধুমক্ষিকা অবলীলায় প্রস্ফুটিত ফুলে বিচরণ করতে থাকে এই পূর্ব মধ্যাহ্নের জৌলুস হীন কক্ষে। হঠাৎ কক্ষের নিরবতা ভেদ করে প্রগৌতিহাসিক কালের কোন এক ধ্বনি ও শব্দ যেন একাকার হয়ে যায় নিরব কক্ষটিতে। ঝড় থেমে গেলে প্রকৃতি যেমন শান্ত ও নিরব অবয়ব প্রকাশ করে তেমনি আমাদের মাঝেও বিরাজ করে শুনশান নিরবতা। বাইরে শিকারী বাজ পাখির ডাকে সজাগ হই দুজনে। বিছানা থেকে উঠে দ্রুত নিজেকে পরিপাটি করে সুরভী। আজ আসি-বলেই কক্ষের বাইরে বেড়িয়ে যায়। আলোর গতিকেও অতিক্রম করে যেন দ্বৈত ভাবনা তাড়িত করে আমাকে। আমি কি সুরভী কে যেতে বাঁধা দেব? নাকি সুরভীর মোহই আমাকে সুরভীর সঙ্গে নিরুদ্দেশ হতে তাড়িত করবে? হঠাৎই তাকিয়ে দেখি সুরভী নেই। ভাবনা গুলো জল ঢেলে দেওয়া আগুনের মতো দপ করে নিভে যায়। সুরভীর দেওয়া প্রথম চশমাটা খুঁজতে থাকি। বিছানার উপর থেকে চশমাটা হাতে নিয়ে দেখি তার বাম পাশের লাগোয়াটা ভেঙ্গে গেছে। তাতে কি, এটাই যে আমাকে নতুন করে দৃষ্টি দেয়, নতুন করে জীবনের স্বাদ উপভোগ করায়।
আমি চশমাটি হাতে নিয়ে সুরভীকে জানাতে কক্ষের বাইরে আসি। কই, কোথাও তো সুরভী নেই। ওকি চলে গেছে? সুরভীর দেওয়া চশমাটা যে ভেঙ্গে গেছে এটি ওকে জানাতে হবে তো-।
ইকবাল কবীর রনজু
চাটমোহর, পাবনা
-
গল্প//উপন্যাস
-
08-08-2022
-
-