ঋত্বিকা - সৌমেন দাস
...বোষ্টম ~ দরজাটা কেউ খোল' না,... আমি বাইরে যাব'... বন্ধুদের সাথে খেলতে চাই... ঘরে থেকে থেকে, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে! প্লিজ... বাবা, ও মা...,
দেবিকা তড়িঘড়ি উপরে এসে ঘরের লক্ খুলে, পূরবীকে বুকে চেপে ধরলো।
~ সোনা মেয়ে আমার, এমন করে না। আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। তারপরেই তো সেই আগের মতোই স্কুল যাবি, খেলাধূলা করবি। দেখলি না সেদিন ডাক্তার আণ্টি বললেন। তোর কাছে ননী(টিয়াপাখি)কে রেখেছি, ওর সাথে খেলা কর। তাছাড়া আমি তো আছিই তোর সাথে। ঠিক আছে, বাবাকে ব'লে আরো কয়েকটা টেডি এনে দেব। চলবে তো?
মায়ের আদর খেতে খেতেই ঘুমিয়ে পড়লো পূরবী। দেবিকার দুচোখ বেয়ে জল পড়তে লাগলো, দুধের শিশু চারিদিকে যার খেলে বেড়াবার বয়স, সেখানে এভাবে বন্দি! এই নিষ্পাপ শিশুকে কেন' এমন শাস্তি দিলো ভগবান! চোখের জল মুছতে মুছতে আবার তালা লাগিয়ে নিচে নেমে এলো দেবিকা।
ছয় বছরের পূরবীকে নিয়ে দেবিকা ও শুভায়ু মিত্রের ছিল সুখের সংসার। সমস্যাটা শুরু হলো কয়েক মাস আগে! একদিন বিকেলে, পেটে প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে, ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এলো পূরবী...
দেবিকা মেয়ের পা বেয়ে রক্ত গড়াতে দেখে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে ধুয়ে দিলো। ভাবলো, প'ড়ে গিয়ে হয়তো অস্থানে চোট লাগিয়েছে! তারপর চুপচাপ শুয়ে থাকতে বললো। কয়েক ঘণ্টা পর, আবার পূরবীকে যন্ত্রণাতে কাতরাতে দেখে, দেবিকা তাড়াতাড়ি শুভায়ুকে ডেকে ব্যাপারটা জানালো।
পূরবীর বাবা-মা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একসাথে বসে আলোচনা করে ওকে স্যানিটারি ন্যাপকিন পরিয়ে, বাড়িতেই রাখার পরিকল্পনা করল, যাতে পাঁচকান না হয়। সাথে ভালো ডাক্তারের সাথে পরামর্শ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
দিন কয়েক পর পূরবী আগের মতোই স্কুল, টিউশন যেতে শুরু করলো। কিন্তু ধীরে ধীরে ওর শরীরের গঠনের পরিবর্তন শুরু করলো। যা এই বয়সেই একদম বেমানান! কোনো কিছুই ও বুঝতে পারছে না, সারা শরীরে শুধু ব্যথা। এত কম বয়সে শরীরকে ঠিক ভাবে ঢেকে রাখাও ওর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। আশেপাশের লোক ওকে নিয়ে হাসাহাসি আরম্ভ করেছে। অনেকেই নানারকম মন্তব্য করা শুরু করেছে। পাড়ার ছেলেরা আর কেউ ওর সাথে খেলতে আসছে না। কয়েক দিন হলো, বন্ধুদের মায়েরা আর আসতে দেয় না ওর বাড়ি। ফলে প্রচণ্ড মানসিক অবসাদে ভুগছে সে। ফলস্বরূপ তার সেমিস্টারের রেজাল্টও খুব খারাপ হয়েছে!
~ মা, আমি আর স্কুলে যাবো না। স্কুলের মিস আমাকে বন্ধুদের সাথে বসতে দেয় না। পিছনের সীটে আমায় বসতে হয়। সকলে আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসে! নেহা, প্রীতি আর আমার সাথে টিফিন ভাগ করে না। ওদের মা-বাবা বারণ করেছে। আমার সাথে খাবার খেলে নাকি ওদেরও আমার মতো রোগ হবে। আমার কী হয়েছে মা? আমি কি আর বাঁচবো না!
~ চোপ! ওমন কথা বলতে নেই। কদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।
প্রতিবেশীরা ভীষণ ভাবে উঠেপড়ে লেগেছে, তাঁরা পূরবীকে বাইরে বেরোতে দিতে মানা করেছে। সোসাইটির নাকি বদনাম ছড়িয়ে পড়বে। একটু আগেই স্কুলের ম্যাম এসে, পূরবীকে আর স্কুল পাঠাতে বারণ করে বললেন- "বেসিকেলি্ উই হ্যাভ্ নো প্রবলেম! কিন্তু বুঝতেই পারছেন সব গার্জেনরা এসে নালিশ করেছেন। তাই ওকে বাড়িতে রাখলেই ভালো হয় কিছু মাইণ্ড করবেন না, প্লিজ!"
~ ম্যাম, ও বাচ্চা মেয়ে, ও কী জানে বলুন তো? স্কুল বন্ধ করে দিলে ওর ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে। ওর জীবন এভাবে শেষ হতে দেবেন না!
~ মিসেস মিত্র, উই্ আর রিয়ালি হেল্পলেস্।
ক্রমশঃ পূরবী আরো বিমর্ষ হয়ে পড়ছে। খাবার খাচ্ছে না ঠিক করে! জেদি হয়ে যাচ্ছে। আগের মতো সে আর বাবাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে পারছে না। যতটুকু কথাবার্তা শুধু মায়ের সাথেই। তাই এইরকম বন্দিদশা পূরবীর।
অনেক খোঁজ খবর নিয়ে শিশু বিশেষজ্ঞ ও মনস্তাত্ত্বিক বিশারদ ড: নবনীতা রায়ের কাছে পূরবীকে নিয়ে যাওয়া হল। ডা: রায় পূরবীর, কিছু টেস্টের রিপোর্ট দেখে শুভায়ুকে ডেকে ...
~ দেখুন, পূরবীর ব্যাপারটা ভয়ের তেমন কিছু নেই। এই রোগটি Precocious Puberty বা অপরিণত বয়ঃসন্ধি নামে পরিচিত। সাধারণত হরমোনের অনিয়মিত ক্ষরণের ফলে হয়ে থাকে। ঠিকঠিক মেডিসিন চললে সেরে উঠবে। তবে একটু সময়সাপক্ষ। ততদিন ওকে নজরে রাখাই ভালো। এসময় ওর মেজাজ বা ব্যবহার পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। কিন্তু আপনাদের ধৈর্য্য রাখতে হবে, এবং ওকে আরো মনের জোর দিতে হবে। মেডিসিন চালিয়ে যান, সেরকম অসুবিধা বুঝলে ফোন করবেন।
~ ধন্যবাদ ম্যাম, সেরকম কিছু হলে অবশ্যই জানাবো।
ছয় মাস হয়ে গেলো। পূরবী আগের থেকে অনেক সুস্থ। এই পরিবর্তনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু সামাজিক সমস্যা এখনও আছে। পাড়াতে এখনও বের হতে পারছে না, স্কুলেও আর ভর্তি নিতে চাইছে না ওকে। এই সমস্যার কথা শুভায়ু জানালেন ডা: রায়কে। ডা: রায়, শুভায়ুকে পাড়ার কিছু গণ্যমান্য লোক ও স্কুলের টিচারদের বাড়িতে ডাকবার জন্য বললেন এবং নিজেও এলেন ওদের বাড়ি!
~ নমস্কার, আমি ডা: নবনীতা রায়। পূরবী আমারই চিকিৎসাধীন। ও এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। একটা কথা প্রথমেই বলে রাখি এই রোগটি কোনরকম ছোঁয়াচে নয়। হরমোনের অনিয়মতার জন্য হয়ে থাকে। এই ঘটনাটি, সকলের সাথেই হতে পারে। তাই বলে আমরা অসামাজিক হয়ে যাবো? একটা অসুস্থ শিশুকে নিয়ে কুটিল মন্তব্য করতে থাকবো? এগুলো হলো আমাদের তথা পুরো সমাজের এক অসচেতনতা, এক ধরণের মানসিক বিকৃতি! একজন নারী, সে যে বয়সেরই হোক না, কেন' তাকে মানুষের চোখেই দেখি না। ও তো নিতান্তই শিশু।শিশুর শিক্ষা ও বিকাশের জন্য সবচাইতে প্রয়োজন একটা সুষ্ঠ শিক্ষায়তন, যেখানে সে অন্যদের সাথে মেলামেশা শিখবে, জ্ঞান অর্জন করবে। সেখানে যদি ওর স্কুল যাওয়ায় বন্ধ করে দেওয়া হয়, শিশুর উপর কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হবে ভেবে দেখেছেন কখনো? শিক্ষক সমাজের মেরুদণ্ড! সেই মেরুদণ্ডই যদি ভেঙে যায় সমাজ তো অটোমেটিক পঙ্গু হয়ে পড়বে! তাই এদের পাশে থাকুন, মুক্ত শিক্ষা দিন, আগামীদিনে এরাই সমাজকে নেতৃত্ব দেবে।এরপর আসি মা বাবার ভূমিকায়, দেখুন মিঃ এবং মিসেস মিত্র আপনাদের প্রথম কাজ ছিল ওকে ভয় না দেখানোর। খুব সাধারণ ভাবেই ওকে বোঝান, যে বয়ঃসন্ধি সকলেরই হয়, ওর একটু কম বয়সে হয়েছে এতে ভীত হবার কিছু নেই। মিঃ মিত্র, আপনি তো ওর বাবা, যদি ওর কিছু শারীরিক পরিবর্তন হয়েছেই , তো কী অসুবিধা? আপনি যেমন ওর সাথে মেলামেশা করতেন তেমনই থাকতেন, তাহলে ও আরো মানসিক বল পেতো। হয়তো এরপরেও কিছু দিন ওর রেজাল্ট খারাপ হতে পারে, কোনো অসুবিধা নেই, ওর অন্য কিছু নিয়ে প্রশংসা করুন। দেখবেন ও সমস্ত বিপত্তি কাটিয়ে উঠেছে।
সব গার্জিয়ান আর টিচার যদি ছেলে মেয়ে পার্থক্য না করে এটাকে স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া বলে শিক্ষা দেন, ছেলেদেরও বোঝান, এমন হলে বন্ধু হিসেবে, দাদা হিসেবে, ভাই হিসেবে মেয়েদের পাশে থেকে মনের জোর বাড়াতে, তবে তারাও মানুষের মত মানুষ হবে। আপনাদের সকলের উচিত ওর পাশে দাঁড়ানো।তাই সকলকেই আমার অনুরোধ ,আসুন সকলে মিলে পূরবীকে আবার ওর সুস্থ জীবন ফিরিয়ে দিই।
সকলেই নিজের ভুল বুঝে ডা: রায়ের সাথে সকলেই একমত হলেন। স্কুলের প্রিন্সিপালও স্কুলে যোগ দেবার ছাড়পত্র দিলেন।
প্রায় এক বছর বন্দিদশা থেকে পূরবী মুক্তি। পাড়ার ও স্কুলের বন্ধুরা ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির ওকে স্বাগতম্ জানানোর জন্য। নতুন স্কুলের ড্রেস পরে মায়ের হাত ধরে সেই অন্ধকূপ থেকে বের হতেই, সকলে হাততালি দিয়ে ওকে স্বাগত জানাচ্ছে।
সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা নামার পর পূরবীর কী মনে হল', এক ছুটে রুমে গিয়ে খাঁচার দরজাটা খুলে, ননীকে আকাশে উড়িয়ে দিলো।
সৌমেন দাস
বালসী, বাঁকুড়া
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
-
গল্প//উপন্যাস
-
05-05-2023
-
-