অটোয়া, সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪
বইয়ের পাতা স্বপ্ন বলে - মহিদুর রহমান

“যে-বই জুড়ে সূর্য ওঠে/ পাতায় পাতায় গোলাপ ফোটে/সে বই তুমি পড়বে।”

হ্যাঁ, এটি সেই বই- যে বই পড়ার মতো। কেননা এর প্রতিটি পাতায় যেমন আছে লেখকের স্বপ্নের কথা তেমনই আছে গোলাপের অমিয় সুবাস। থাকবে নাইবা কেন? এর লেখক যে একাত্তরের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহেদ বখত ময়নু। তাঁর বইয়ের নাম ‘আমার মুক্তিযুদ্ধ’। নামকরণে ‘আমার’ শব্দটি ব্যবহার করে তিনি এক আমারকে বহু আমারের মধ্যে লীন করে দিয়েছেন। যেমনটি করেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। যেখানে তিনি ‘আমি’ শব্দটি ১৪৭ বার ব্যবহার করেছেন। আমির মধ্যে তিনি কখনও পুরো ভারতবর্ষকে প্রকাশ করেছেন আবার কখনও তাবৎ পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ‘আমার মুক্তিযুদ্ধ’ বইটিতে লেখক শাহেদ বখত ময়নুও ‘আমার’ শব্দের মধ্যে পুরো বাংলাদেশকে উপস্থাপন করেছেন এক অনন্য মুন্সিয়ানায়। নিজের লেখা বই প্রসঙ্গে কিছুকথা বলতে গিয়ে তিনি নিদারুণ আক্ষেপের সুরে বলেছেন, “আমার দেশের যুবসমাজ ‘মঙ্গল’ শব্দটি হিন্দু না মুসলিম এই নিয়ে বিতর্ক করে। এমন পতন আর মানসিক অবক্ষয় বাঙালির যা কল্পনা করিনি। যা আমাকে খুব পীড়া দেয়।”

তিনি আরও বলেছেন, “বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে ধর্মান্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। স্বাধীন এই রাষ্ট্রকে সমস্যার জঞ্জাল-পাহাড়ে পরিণত করা হয়েছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এসব নিয়ে ভাবতে ক্লান্তিবোধ করি।”

লেখক শায়েদ বখত ময়নু নিজের ক্লান্তির কথা অকপটে স্বীকার করলেও এর মধ্যে যে কতখানি বেদনার দীর্ঘশ্বাস মিশে আছে তা কেবল অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। একাত্তরের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোতে কোনো এক অজানা আবেগে হয়তো তাঁর মনটা চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। তিনি নিশ্চয়ই অন্তরে অনুভব করেছিলেন, “স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?” তাইতো তাঁর হৃদয়ের গভীরে যে অপূর্ব যৌবনের প্রবাহ অনুভূত হয়েছিল যা তাঁকে ঘরে থাকতে দেয়নি। বরং যুগিয়েছিল যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা। ফলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে জীবন বাজি রেখেছিলেন মুক্তির নেশায়। কিন্তু দেশ স্বাধীনের বাহান্ন বছরের মাথায় এসে যুদ্ধদিনের লোমহর্ষক নানা স্মৃতির কথা লিখতে গিয়ে আরও কঠিন বাস্তবতা তাকে বীতশ্রদ্ধ করে তুলে। এ প্রসঙ্গে তিনি অত্যন্ত হতাশার সুরে বলেছেন, “মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীশক্তি আগের তুলনায় আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছে। আগে যাদের নাম ধরে অপকর্ম তুলে ধরা যেত, আজ তাদের নাম আড়াল করে দেশের সাধারণ মানুষকে কথা বলতে বাধ্য করা হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমার কাছে এর চেয়ে বড়ো পরিতাপের বিষয় আর কী হতে পারে?” তারপরও তিনি বিগত পঞ্চাশ-বাহান্ন বছরের লালিত স্মৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা উচিত বলে মনে করেছেন।

একশ বাহান্ন পৃষ্ঠার বইটিতে লেখক ছাব্বিশটি প্রবন্ধ লিখেছেন। তন্মধ্যে আমার মুক্তিযুদ্ধ শুরু, আসামের বিলবাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ, দেরাদুনে গেরিলা ট্রেনিং, দুইজন মুক্তিযোদ্ধা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ, মামাবাড়িতে ঘাঁটি, রাজনগর মুক্ত দিবস, অনিল দেব আমার বন্ধু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

বইটিতে লেখক নিজের পরিবারের প্রসঙ্গ টেনেছেন অত্যন্ত সচেতনভাবে। তাঁর চাচা একজন ক্ষণজন্মা কৃতী পুরুষ ছিলেন। প্রথা ভেঙে ঐ সময়ে একজন বিদেশিনীকে জীবনসঙ্গী করেছিলেন- যিনি তখনকার সময়ে ঢাকার রাস্তায় গাড়ি চালাতেন। তাছাড়া তিনি ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় ব্যাংকের একজন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার ও স্ক্রিন প্রিন্টিং এক্সপার্ট। শুধু তাই নয়, এই নারী চালচলনে যেমন ছিলেন অভিজাত তেমনই ছিলেন মেধা, মনন ও মনীষায় আধুনিক। বইটিতে নিজের ফুফুর মৃত্যু গাথা যেমন এসেছে তেমনই ভাইবোনদের প্রসঙ্গও ঘুরে ফিরে এসেছে। তবে সবই এসেছে গল্পের বাস্তবতায়। কোনো কোনো ঘটনার বর্ণনায় হয়তো কিঞ্চিত রঙ ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু কোথাও অতি রঙ ব্যবহার করে অতিরঞ্জিত করা হয়নি। এখানে প্রকাশ আবশ্যক যে, লেখকের প্রকাশভঙ্গী সহজ-সরল এবং সাবলীল। ঘটনার বর্ণনা পাঠককে শেষ অবধি বিনাসুতার এক অদৃশ্য বাঁধনে আটকে রাখবে। আর এখানেই একজন লেখকের সার্থকতা। শাহেদ বখত ময়নুর ‘আমার মুক্তিযুদ্ধ’ বই প্রসঙ্গে আবারও প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের অনুকরণে বলতে চাই এটি এমন এক বই যে বইয়ের পাতায় শুধু প্রদীপই জ্বলে না- সে বইয়ের পাতা স্বপ্নও বলে।

এখানে উল্লেখ্য, মহসীন বখত একজন আপাদমস্তক স্যাকুলার ও মুক্তমনা মানুষ। তেরোশত নদীর এই গাঙেয় বদ্বীপে সাম্প্রদায়িকতার চাষবাস দেখে তিনি নিজেও হত-বিহবল। তবুও তিনি আশাবাদী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত হয়ে পরের প্রজন্মের হাতেই তৈরি হবে একটি মানবিক ও মুক্ত চিন্তার বাংলাদেশ।

বইটি প্রকাশ করেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নাগরি। দাম রাখা হয়েছে ৬৫০ টাকা। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। সম্পাদনা করেছেন মহসীন বখত। মূল্যবান এ বইটি পড়ার মতো তো অবশ্যই সংগ্রহে রাখার মতোও।

মহিদুর রহমান
পরিচিতি: লেখক ও প্রকাশক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ, মৌলভীবাজার সংসদ