অটোয়া, সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪
মহীরূহের ছায়াতলে - পুলক বড়ুয়া

ঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা সহজ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কঠিন। হিমালয়কেও তাঁর সামনে খাটো মনে হয়। হিমালয়কে জয় করা যায়, বঙ্গবন্ধুকে নয়। এখানেই তিনি সবেধন নীলমণি। একেমেবাঅদ্বিতীয়ম। এখানেই বঙ্গবন্ধুর স্বাতন্ত্র্য। বঙ্গবন্ধু অনন্য। ভেবে অবাক হই, বিস্ময়ে অভিভূত হতেই হয়: তিনি শুধু শেখ মুজিবুর রহমান নন, তিনি শুধু বঙ্গবন্ধু নন, তিনি শুধু আমাদের জাতির জনক নন। বিশ্বের চিরনিপীড়িত মুক্তিকামী মানুষের জেগে ওঠার, মুক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছেন। এক বিরল-ব্যতিক্রমী,—তাঁর সঙ্গেই একমাত্র তাঁকেই তুলনা করা যায়। আর আমাদের নবচেতনায়, নিত্য নতুন ভাবনায় ও কর্মোদ্দীপনায় তিনি বিজড়িত ও বিস্তৃত হয়ে আছেন সমগ্র জাতীয় পরিমন্ডলে। আমাদের রাজনৈতিক আকাশে তিনি উজ্জ্বল সূর্যের মতো।

কিন্তু, কী করে কেমন করে—আবির্ভাব তাঁর। রাতারাতি তো তিনি আর জ্বলে ওঠেন নি: জাগরণের সূর্যোদয় থেকে প্রজ্বলনের মধ্যগগনে যে জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন, যে ত্যাগ-তিতিক্ষা-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাঁকে গড়ে উঠতে হয়েছে—সে তো এক অনেক সুকঠিন ইতিহাস। বাংলাদেশ অর্জনের ইতিকথা—বিকাশ মানেই তো বঙ্গবন্ধুর বেড়ে ওঠার ইতিহাস, এগিয়ে যাওয়ার ইতিকথা, এক উত্থান-পতনের গাথা।  
বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন সেই রাজনৈতিক শক্তি ও রক্ষাকবচ—যা বাংলাদেশের অভ্যুদয় অনবরত সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাই, বাংলাদেশকে খুঁজতে হলে সবাইকে যেতে হবে বঙ্গবন্ধুর কাছে। তাই, বাংলাদেশকে বুঝতে হলে অবশ্যই যেতে হবে বঙ্গবন্ধুর কাছে। বাংলাদেশকে পেতে হলে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য-ভিন্ন গত্যন্তর নেই। কী করে যে তিনি মানুষের নিরঙ্কুশ ভালোবাসা পেয়েছেন, জাতির অবিসংবাদিত নেতা হয়েছেন—বঙ্গবন্ধুর সেই প্রমূর্ত পরশ-ছোঁয়া পাওয়া যাবে তাঁর স্বহস্তে বর্ণিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী-তে। এ এমন‌ই স্বচ্ছ যে, এ যেন প্রতিদিনের জীবনালেখ্য, ধ্যান-জ্ঞান-কর্মতৎপরতা— অবিশ্বাস্য বস্তনিষ্ঠতায় বাঙ্ময় হয়ে উঠছে, তাঁর নির্জন লেখনিতে— প্রাণময় অবিনশ্বর পান্ডুলিপিতে। 

রাজনীতির ছত্রছায়ায় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের জন্য দেশমাতৃকার বেদীমূলে নিবেদিত এক আপোষহীন মানুষের নিরলস-নিরন্তর অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা;  অন্যায়-অত্যাচার-নিষ্পেষণ থেকে নিজেকে নয়, বন্দী স্বজাতি-স্বদেশকে বাঁচাতে, মুক্ত করতে—অতন্দ্র-নির্ভীক হয়ে ওঠার এ আকর গ্রন্থ এক অতুল দুর্লভ মণিরত্নের সমতুল্য।

একেবারে বালক বেলায় দলবল নিয়ে তাঁর সূচনা। নিছক শিশুসুলভ। বিদ্যালয়ে। পড়াকালীন। সেই ছোট্ট কিশোর বয়সে। মানুষের তো অনেক গুণাবলী থাকে, সহজাত দিক থাকে—অলৌকিক ক্ষমতার মতো নিতান্ত শিশু-কিশোর বয়সেই তার স্ফূরণ আমরা খেয়াল করি। সেই সঙ্গে ছিল খেলাধূলা। এই যে সতীর্থদের নিয়ে মাঠে বা মাঠের বাইরে ছুটে চলা, জুটিয়ে-চুটিয়ে শৈশব মুখরিত করে তোলা—যাই-ই করেছেন—অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, বিন্দুমাত্র নীতি ও আদর্শবোধ বিসর্জন না দিয়ে। সারাজীবনই তিনি এ বিষয়ে  অটুট ও অবিচল। বিদ্যালয়-পাঠপর্বকালীন এভাবে আমরা সেই আত্মজীবনোদ্বোধন লক্ষ্য করি। তাঁর অজান্তেই তাঁর মধ্যে এসে পড়ে সাংগঠনিক ক্ষমতার বীজ। যা উত্তরকালে অঙ্কুরোদগম হয়ে বিখ্যাত মহীরূহে পরিণত হবে। স্কুলজীবনেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে প্রথম চাক্ষুষ-পরিচয় এবং পত্রালাপ। স্কুলের ছোটবেলাযর মাঠ থেকে কিভাবে রাজনীতির বৃহত্তর ময়দানে এসে পড়ছেন, সে কথা আমরা জানতে পারি: তাঁর ব্যক্তিত্ব তাঁকে সহসা সতীর্থ ও অন্যান্য শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের মাঝে  যথেষ্ট কাছের করে তুলেছে। শিক্ষকরা সবাই তাঁকে স্নেহ করতেন। এ্য‌াসেম্বলি হলের দরজা খুলে সভা করছেন। অধ্যক্ষ মহোদয়ের সস্নেহ দৃষ্টিতে তা অজানা নয়,—এমনতর অনুমতি তাঁর সবসময়ই ছিল, তিনি পেয়েছিলেন। হোস্টেল সুপার তাঁর সাথে— তিনি হোস্টেল রাজনীতি বা ইলেকশনে যোগদান না করলেও,  পরামর্শ করতেন। এভাবে একের পর এক সংহত হয়ে ওঠার কথা, অবস্থার কথা  আমরা অপলক তাকিয়ে তাকিয়ে শুনতে থাকি, জানতে পারি।

এইভাবে বঙ্গবন্ধু যখন শৈশব-কৈশোর ছাড়িয়ে তারুণ্যে নীতি হিসেবে রাজনীতিকে বরণ করলেন, পরিবার থেকে কিন্তু কোনো বাধাই পাননি, তাঁর প্রথম প্রকাশ্য সমর্থক ছিলেন তাঁর পিতা,—এ বিষয়ে তিনি বরাবরই তাঁর সপক্ষে পিতৃসুলভ সরব ছিলেন। স্নেহময়ী মা-ও কখনো বিন্দুমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বলে আমরা কখনো শুনিনি: নিশ্চয়ই তাঁকে সারাজীবনই সাহসী করে তুলেছিল জননীর  মৌন অথচ মনে মনে আশু সম্মতি। আর সর্বংসহা মমতাময়ী স্ত্রী নেপথ্যে  থেকে সংসার ও সহিষ্ণু-ইন্ধন যুগিয়ে গেছেন সতত। বোনও এগিয়ে আসতে কসুর করেননি। পরবর্তীকালে সবই এক কালজয়ী ইতিহাস। অর্থ-বিষয়ক একটা চাহিদার ব্যাপারে তিনি সকলকে যেভাবে পেয়েছেন, একেবারে অকপটে বলেছেন:  টাকার বেশী প্রয়োজন হলে আমি আমার বোনের কাছ থেকে আনতাম। বোন আব্বার কাছ থেকে নিত। আব্বা বলে দিয়েছিলেন তাকে, আমার দরকার হলে টাকা দিতে। আব্বা ছাড়াও মায়ের কাছ থেকেও আমি টাকা নিতে পারতাম। আর সময় সময় রেণুও আমাকে কিছু টাকা দিতে পারত। রেণু যা কিছু জোগাড় করত বাড়ি গেলে এবং দরকার হলে আমাকেই দিত। কোনো দিন আপত্তি করে নাই, নিজে মোটেই খরচ করত না। গ্রামে থাকত, আমার জন্য‌ই রাখত।
এই সময়েই একটি শিখরস্পর্শী রাজনৈতিক আত্মোপলব্ধি তাঁর মধ্যে সঞ্চার হতে দেখি, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে হলেও, যা পরবর্তীতে তাঁর নিজের ক্ষেত্রেও আরও বড় পরিসরে, মর্মান্তিকভাবে—জাতীয়ভাবে, সত্য হতে দেখি। উক্তিটি উদ্ধৃত করা প্রয়োজন: উদারতা দরকার, কিন্তু নীচ অন্তকরণের ব্যাক্তিদের সাথে উদারতা দেখালে ভবিষ্যতে ভালর থেকে মন্দই বেশি হয়, দেশের ও জনগণের ক্ষতি হয়। এবং একথাও বলেছেন: পরশ্রীকাতরতা ও বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। এ সময়ে তিনি বলছেন: আমাদের বাঙালিদের মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল ‘আমরা মুসলমান, আর একটা হল, আমরা বাঙালি।'  এজন্যে তিনি অবিভক্ত ভারতবর্ষে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে পৃথক রাষ্ট্রের সপক্ষে যেমন ছিলেন, তেমনি  বিভাগোত্তর কালে বাঙালিদের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে অকুতোভয় সেনানী হয়ে উঠেছিলেন। এই দুটি সত্তাকেই তিনি আজীবন অন্তরে ধারণ করেছিলেন, লালন করেছিলেন এবং এ সুন্দর প্রেক্ষাপটে, একদিন এ বৃহত্তর বাঙালি জাতি সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, এটাই তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, উপলব্ধি করেছিলেন।

দেশভাগ নিয়ে যে স্বপ্নভঙ্গ—বঙ্গভঙ্গ, তারও স্বরূপ তিনি নির্দ্বিধায় উন্মোচন করে গেছেন; এতদসঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন মুসলিম লীগের কাছ থেকে; যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীত্বের প্রতিও নেই তাঁর কোনো মোহ। সাংগঠনিকভাবে লাগাতার পরিশ্রম করে চলেছেন। ছাত্রজীবন থেকেই ছাত্ররাজনীতির চেয়ে জাতীয় রাজনীতিই  বেশি আকর্ষণ করতো। কখনো গ্রেফতার-কারাবরণকে ভয় করেন নাই: এ প্রসঙ্গে তাঁর পষ্ট কথা: আমি পালিয়ে থাকার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। পালিয়ে না-গিয়ে শেষ কারাবরণ করলেন: ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে। এই শেষপরিচয়-প্রত্যয় ১৫ আগষ্ট কালরাত্রিতেও রেখেছিলেন। এত দুঃসাহসী-সিংহপুরুষ ছিলেন তিনি।

কোনোদিন তাঁর এতটুকু ব্যত্যয় হয় নাই। কেননা, নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে কখনোই তিনি আপোষ করেন নাই। এ বিষয়ে তিনি অত্যন্ত সংহত ছিলেন। দৃঢ়চিত্ত তাঁর  মাঝে সেদিন অনেক দূরদর্শী ধারণাও  জন্ম নিয়েছিল। তিনি বলছিলেন: দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগ‌ও হতে পারে। তাঁর দূরদর্শিতার অনেক নজির সেই সময়ের তাঁর এই রাজনৈতিক ভাষ্যে আমরা পাই। সেই পঞ্চাশের দশকে,পাঁচ যুগেরও অর্থাৎ অর্ধশতাব্দীর‌ও  অধিককাল আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিহত হলে, এ অন্যায় ঘটনায় তিনি যেমন দুঃখ পেয়েছিলেন,তেমনি এ শংকাও ব্যক্ত করেছিলেন: পাকিস্তানে যে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে, তাতেই আমাদের ভয় হল। এবং অবলীলায় তাঁর ঘৃণার অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছিল: রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে গুলি করে হত্যা করা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা ভাষায় প্রকাশ করা কষ্টকর। আমরা যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তারা এই সমস্ত জঘন্য কাজকে ঘৃণা করি।

ভাষা আন্দোলন নিয়ে, তিনি জেলে হলেও, নীরব নন, রীতিমতো খবর রাখছেন, সরব—তাঁর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে আমরা তাঁর অবরুদ্ধ-প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করি: বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে উপায় নাই। এই আন্দোলনে দেশের লোক সাড়া দিয়েছে ও এগিয়ে এসেছে। দেশের মাটি ও মানুষের এত গভীরে প্রোথিত ছিল তাঁর শেকড় যে, তাদের নাড়ীর টান ও স্পন্দন আর তাঁর স্বকন্ঠ হয়ে উঠেছিল দোসর। দেশের সমস্ত সংকট ও সম্ভাবনা এবং পরিণাম এভাবেই তাঁর মধ্যে ঘনীভূত হয়ে উঠছিল। ফলে, রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় তিনি অভ্রান্ত এগিয়ে গেছেন। আত্মজীবনীর এক জায়গায়  তিনি দ্ব্যর্থ কন্ঠে বলছেন: আমি মুখে যা বলি, তাই বিশ্বাস করি। এই যে সহজে-সজোরে আত্মবিশ্বাসী কথাটি  উচ্চারণ করলেন, তাতে ফাঁক নেই। মনের জোর না থাকলে আর হৃদয় স্বচ্ছ না-হলে, এটা অসম্ভব।  কিভাবে যে তিনি হয়ে উঠছেন, আত্মজীবনীর পরতে পরতে তা পরিস্ফুট। 

চিনে শান্তি সম্মেলনে বাংলায় বক্তৃতা করছেন। যা অনেক  পরে,  স্বাধীনতা-উত্তরকালে, সরকার   প্রধান হিসেবে জাতিসংঘে তিনি প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেছেন।  তাঁর কথা এবং বিশ্বাস পূর্বাপর একই দেখেছি। অতুলনীয় অকৃত্রিম এবং আন্তরিক গঠনের এক খাঁটি দেশপ্রেমিক মানুষ ছিলেন তিনি। অসমাপ্ত আত্মজীবনী-তে তাঁর এই নিখাদ গড়ে ওঠার ভিতটিকে আমরা সরাসরি  প্রত্যক্ষ করি। '৫৪র যুক্তফ্রন্ট ইলেকশনে-অভিজ্ঞতায় কিভাবে গণমানুষের ভালবাসাকে তিনি ধারণ করেছেন, দেখুন, তাঁর মনের রেখাপাত: আমি ইলেকশনে নামার পূর্বেই জানতাম না, এ দেশের লোক আমাকে কত ভালোবাসে। আমার মনের একটা বিরাট পরিবর্তন এই সময় হয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই তিনি মানুষকে ভালোবেসেছেন এবং সকলের ভালোবাসা পেয়েই তিনি বড় হয়েছেন। সহপাঠি শিক্ষার্থী ছাত্রসমাজ, শিক্ষকমন্ডলী, মাতাপিতা, পরিবার, জনতা—সর্বত্র তিনি ভালোবাসা পেয়েছেন অকাতরে। এ ভালোবাসা এমনিতেই অর্জিত হয়নি। তিনি ছিলেন সংগ্রামী, সাহসী ও নিবেদিত প্রাণ। আপোষহীন, নির্লোভ, উদার, মহৎ ও হৃদয়বান। 

এই আত্মজীবনীটিতে তাঁকে আমরা পাই-  একটি বৃহত্তর লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মানস। একটি বৃহত্তর লক্ষ্যের দিকে তাঁর অভিষ্ট যাত্রা। একটি বৃহত্তর স্বপ্নের দিকে তাঁর দৃষ্টি। এ পর্যায়ে লক্ষ্য করুন, এই প্রথম পাকিস্তানে আনুষ্ঠানিকভাবে বাঙালিদের ক্ষমতায় যাওয়ার ইতিহাসে— কি নির্মোহভাবে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিত্বের চেয়েও যে দল মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করে, তাকে বড় করে দেখলেন। যা আমরা ৭ মার্চের ভাষণেও তাকে বলতে দেখি: আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমি এদেশের মানুষের অধিকার চাই। তিনি লিখছেন: শহীদ সাহেব আমাকে একাকী ডেকে বললেন, “তুমি মন্ত্রিত্ব নেবা কি না?” আমি বললাম, “আমি মন্ত্রিত্ব চাই না। পার্টির অনেক কাজ আছে, বহু প্রার্থী আছে দেখে শুনে তাদের করে দেন।” সরকারে যোগদান করার চেয়ে, সরকারি কাজের চেয়ে—জনগণের কর্মপরিধির দলীয় ব্যস্ততা তাঁকে টানছে,  প্রাধান্য পাচ্ছে।  তাঁর কাছে  মন্ত্রীত্বের পদ বেশি লোভনীয় বা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি।   

আজকে যারা রাজনীতি করছেন বা রাজনীতিতে আসছেন, তাদের এই আত্মজীবনী পড়তে হবে। যাদের প্রকৃত রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছে, বলা বাহুল্য, তারা যে এটা লুফে নেবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 

ব‌ইটি পড়ে শেষ করে ওঠার পর মনে হবে, তিনি আরও কেন লেখেননি; এখানেই বঙ্গবন্ধুর আত্মচরিত্রটি এক অর্থে শেষ হয়েও, অন্য অনেক অর্থে এক অশেষ আবেদন জাগায়। আমাদের আরও জানার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। স্বয়ং  মহানায়কের হাতে এক মহাজীবন সংগ্রামের এ মহার্ঘ-কাহিনী সত্যি তুলনারহিত—অসামান্য-অসাধারণ। এ কথা ভাবলে, মনে হলে, তখন মনে হয় না কোনো কিছুই পুস্তকটিতে অতৃপ্ত-অসম্পূর্ণ! যে পর্যন্ত আমরা পাঠ করার সৌভাগ্যলাভ করেছি, এতে আমরা স্নাত হ‌ই। হ্যাঁ, আমাদের আরও তৃষ্ণা পায়। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের কোনোরূপ অতৃপ্তি বোধ থেকে নয়— তিনি লিখে যেতে পারেন নি বলে, একেবারেই কোনোরূপ প্রতীকী অর্থে নয়—সরাসরি আক্ষরিক অর্থে— এই বইয়ের যথার্থ শিরোনাম: নামকরণ করা হয়েছে শুধুমাত্র: অসমাপ্ত আত্মজীবনী। এই শীর্ষ-নামটিও তাঁর জীবন ও কর্মের মতোই সীমানা ছাড়িয়ে যায়,—হয়ে ওঠে এক অপূর্ব ব্যঞ্জনাধর্মী— কাব্যিক শিরোপা-অভিধা। যথার্থই তিনি রাজনীতির কবি। 

কী নেই এতে? এই বাংলার মতো তাঁর এই বইয়ে আমাদের ফিরে ফিরে আসতেই হবে বারবার। এই চিরঞ্জীব পুস্তকটি—তাঁর রাজনৈতিক-কোষ, তাঁর রাজনৈতিক-অভিধান, এক অমর মহামানবের  অতুলনীয় মহার্ঘ-রাজনৈতিক-চরিত। এক চিরঅসমাপ্ত হয়েও জীবন্ত মহাকাব্য। আমাদের পরম পাওয়া। রাজনীতির ভেতরে-বাইরে অবশ্য পাঠ্য শুধু নয়, আমরা পাঠ করতে বাধ্য। এক অদ্বিতীয় গ্রন্থ।

পুলক বড়ুয়া । বাংলাদেশ