অটোয়া, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল, ২০২৪
বীরাঙ্গনাদের পিতা শেখ মুজিবুর রহমান - মানসী সাহা

    বীরাঙ্গনা শব্দের অর্থ হলো বীর নারী। বাংলার ধর্ষিতা নারীদের যাদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হল তাঁদের “বীরাঙ্গনা” উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী 'আপারেশন সার্চ লাইট' নামে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানের বিভিন্ন শহরে, গ্রামে গঞ্জে শুরু করে গণহত্যা, অগ্নি সংযোগ, ও লুট-পাট। সবচেয়ে নিকৃষ্ট যে কাজটি পাকিস্তানি বাহিনী করে সেটি হল নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশের বিশ্বাসঘাতক পাকিস্তানিদের সহযোগী যারা রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামে পরিচিত তারা নিজেদের স্বার্থে বাংলার নিরপরাধী মা বোনদের তুলে দেয় পাক সেনাদের হাতে। গাড়ি ভর্তি করে মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্থানিদের ক্যাম্পে। একেকজন মেয়েকে প্রতিরাতে ৭-৮ বার করে ধর্ষণ করে পালাক্রমে। বীভৎসভাবে ক্ষত বিক্ষত করতো তাদের শরীর। শকুনেরা ক্ষত বিক্ষত করে নারী দেহ, মিটায় তাদের পাশবিক লালসা। ধারালো দাঁত দিয়ে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলে কোমল গালের মাংস, রক্তাক্ত করে স্তনের বোঁটা। এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অনেকেই বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। মরে গিয়ে বেঁচে যাওয়ার পথ খুঁজে তাঁরা। একটি পরিসংখানে জানা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় চার থেকে সাড়ে দুই লক্ষ নারী লাঞ্ছনার শিকার হয়। 
     যুদ্ধ থামে। বাংলার আকাশে জ্বল জ্বল করে উঠে স্বাধীনতার লাল সূর্য। স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকায় লেগে থাকে লাখো বীরাঙ্গনাদের রক্ত। ধর্ষিতা নারীদের অনেকেই ফিরে আসে, অনেকেই ফিরে আসেনি ঘরে। মানসিক ভারসাম্য হারায় অনেকে। যারা ফিরে এসেছে তাঁদের অধিকাংশই সমাজে পায়নি উপযুক্ত সম্মান, সংসারে পায়নি গ্রহণযোগ্যতা। সমাজের কাছে তারা হয় ঘৃণ্য ও নিন্দিত। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অবকাঠামো বাংলাদেশের নয় মাস ধ্বংস যজ্ঞে সবার নজর আসে লাশের স্তূপ, আহত মানুষ, অগ্নিকাণ্ডের ধ্বংসস্তূপ কিন্তু যে ক্ষত চোখে দেখা যায় না তা হল যৌন অত্যাচার। সেই অত্যাচার ততটা আঁচড় কাটেনি বাংলার জনসাধারণের মনে। কেউ কেউ এই নিরপরাধী মা-বোনদের সহানুভূতি দেখালেও অধিকাংশ সময়েই তাঁরা সমাজে অবহেলা আর অপমানের গঞ্জনা শুনেছেন। সুনামগঞ্জ জেলার পেরুয়া গ্রামের কুলসুম বিবির মতো অনেক নারীকেই 'নটি বেটি' ডাক শুনতে হয়েছে। কোন অপরাধ না করেও অত্যাচারিত হওয়া মেয়েরা 'খারাপ মেয়ে মানুষ' দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। পাকবাহিনী ও রাজকার বাহিনী দ্বারা ধর্ষিত বাঙ্গালি নারীদের শ্রদ্ধার চোখে দেখতে ভুলে যায় জরাব্যাধিগ্রস্ত সমাজের মানুষ। করুণার পাত্র হয়ে সে সব বিধ্বস্ত নারীরা ভাসতে থাকে জলে ভাষা পদ্মের মতো। যাদের ঘর, মানুষ, মাটি  সবই ছিল একদিন কিন্তু স্বাধীনতার জন্য বলি দিতে হল সব। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের রক্ষণশীল মানুষগুলো মাঝে যিনি কুপমুণ্ডুকতার অন্ধকার জাল ভেদ করে সেই মহীয়সী নারীদের আলোর পথ দেখান তিনি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান।  
     ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার বসন্তপুর গ্রামে যান বন্যা প্রতিরোধক বাঁধ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করতে। যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত ও ধর্ষিতা কয়েকজন নারী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন এবং বর্ণনা করেন তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া সেই সব কালো দিনরাতের ঘটনা। বঙ্গবন্ধু নিবিড়ভাবে তাঁদের কথা শুনে মর্মাহত হন, ভেসে উঠে বর্বরতার ছবি আর চোখ ভরে যায় জলে। তিনি তাদের পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন এবং বাঁধ নির্মাণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় বলেন, “আজ থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিতা মহিলারা সাধারণ মহিলা নয়, তারা এখন থেকে ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবে ভূষিত। কেননা দেশের জন্যই তারা ইজ্জত দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে তাদের অবদান কম নয় বরং কয়েক ধাপ উপরে, যা আপনারা সবাই জানেন, বুঝিয়ে বলতে হবে না। তাই তাদের বীরাঙ্গনার মর্যাদা দিতে হবে এবং যথারীতি সম্মান দেখাতে হবে। আর সেই সব স্বামী বা পিতাদের উদ্দেশ্যে আমি বলছি যে, আপনারাও ধন্য। কেননা এ ধরনের ত্যাগী ও মহৎ স্ত্রীর স্বামী বা পিতা হয়েছেন। তোমরা বীরাঙ্গনা, তোমরা আমাদের মা।” 
     ১৯৭২ সালে তিনি বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের জন্য "ন্যাশানাল বোর্ড অফ বাংলাদেশ উইমেন্স রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম" নামে একটি বোর্ড স্থাপন করেন। ধর্ষণের শিকার ও অন্যান্য কারণে ভাগ্য-বিড়ম্বিত মেয়েদের সহায়তা করা ছিল এই বোর্ডের দায়িত্ব। অনেক নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে আশ্রয় নেন এবং সেখানে থেকে কেউ কেউ লেখাপড়া করে, কেউ কেউ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে যোগ দিয়ে নিজেদের স্বনির্ভর করেন। অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম ছিলেন এই নারী পুনর্বাসন বোর্ডের একজন সদস্য। তিনি তাঁর লেখনিতে স্থান দেন সাতজন অপরাধশূন্য বীরাঙ্গনাদের যারা কোন অপরাধ না করেও অত্যাচারিত হন। তাঁদের একজন হলেন বীরাঙ্গনা তারা ব্যানার্জি যিনি ধানমণ্ডি পুনর্বাসন কেন্দ্রে আশ্রিত থাকাকালীন সময় পরিচিত হন অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিমের সাথে। তাঁর আমি বীরাঙ্গনা বলছি বই থেকে জানা যায় বীরাঙ্গনা তারা ব্যানার্জি যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গণভবনে যান তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "তোরা আমার মা, জীবনের শ্রেষ্ঠ ধন স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছিস। তোরা শ্রেষ্ঠ বীরাঙ্গনা। আমি আছি, তোদের চিন্তা কি?" 
     তারা ব্যানার্জির জন্মদাতা পিতা তাঁর ধর্ষিতা মেয়েকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাননি সমাজের ভয়ে। নিজের মেয়েকে মেয়ে হিসেবে পরিচয় দিতে দ্বিধা বোধ করেন কিন্তু জাতির পিতা নির্দ্বিধায় সেই মহীয়সীদের  নিজের কন্যা হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি বলেন, "কেউ যদি বীরাঙ্গনাদের পিতার নাম জিজ্ঞেস করে তবে বলে দিও তাদের পিতা শেখ মুজিবুর রহমান আর তাদের ঠিকানার স্থানে লিখে দিও ধানমন্ডি ৩২ নম্বর।" 
     সেই অসহায় বীরাঙ্গনাদের পিতাকে বাঁচতে দেয়া হল না স্বাধীন বাংলায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পিতা স্বাধীনতাবিরোধী কতিপয় সেনাসদস্য কর্তৃক সপরিবারে মর্মান্তিকভাবে নিহত হন। বীরাঙ্গনাদের ঠিকানা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সিঁড়িতে পড়ে থাকে পিতার নিথর দেহ। পিতৃহীন হয় বীরাঙ্গনারা, পিতৃহীন হয় জাতি।   

তথ্যসুত্র- 
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান 
আমি বীরাঙ্গনা বলছি, নীলিমা ইব্রাহিম 

মানসী সাহা, কিংস্টন, কানাডা