অটোয়া, মঙ্গলবার ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪
অপরাধী - সুফিয়া ফারজানা টুম্পা

রাত সাড়ে বারোটায় চালের আড়ত থেকে ফিরে দরজা নক করছিল জয়নাল আজ অনেকটা সময় ধরে। দরজা খুলছে না কেন জয়নাব? আজও ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি বউটা? এত ঘুম তার! নেশার ঘোরে হঠাৎ মনে পড়ে যায়, জয়নাব তো তার ঘরে নেই। তিন মাস আগে তার ছোটবেলার বন্ধু কুদ্দুসের হাত ধরে চলে গেছে জয়নাব।

চোখে পানি আসে নেশার ঘোরেও। পাখি তো উড়ে গেছে তাকে ফেলে। শূন্য ঘরে ফিরতে মন চায় না তার। কিন্তু ঘরে যে ফিরতেই হবে! না ফিরে উপায় কি? সব পাখিই তো ঘরে ফেরে দিন শেষে। তালা খুলে শূন্য ঘরে ঢুকেই শুয়ে পড়ে জয়নাল। আর কি হবে এই ঘরবাড়ি দিয়ে? সংসারই তো উঠে গেল। কি অপরাধ ছিল তার? কেন এমন করলো জয়নাব?

সুখেই ছিল জয়নাল। জয়নাবকে বিয়ে করার পর দশ বছর কেটে গেছে বেশ সুখেই। সন্তানাদি হয়নি অবশ্য। তবে সেটা নিয়ে তেমন দুঃখ ছিল না তাদের। খুব সংসারী মেয়ে জয়নাব। আদর-যত্নে বেশ সুখেই রেখেছিল, আরামে রেখেছিল সে জয়নালকে। ইদানিং একটু সমস্যা দেখা দিয়েছিল অবশ্য। 

বছর দুয়েক আগে চুরির দায়ে ব্যাংকের সিকিউরিটি গার্ডের চাকরিটা চলে যায় জয়নালের। জেলও খাটতে হয়েছিল তিন মাস। তারপর ছাড়া পেয়ে আর কাজও পেল না কোথাও। শেষ পর্যন্ত নিজেই চালের ব্যবসা শুরু করে দিলো। বেশ ভালোই জমে উঠেছিল ব্যবসাটা। এই ব্যবসারই অংশীদার ছিল কুদ্দুস। 

বেশ অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে কুদ্দুস। তার নিজেরও আয়-রোজগার ভালো। শহরে নিজেদের বাড়ি, নিজের বাইক চালায়। চেহারা ভালো, কিছুটা লেখাপড়াও জানে। বেশ চালাক-চতুর কুদ্দুস জয়নাল জেলে যাওয়ার পর থেকেই বেশি বেশি আসা-যাওয়া শুরু করেছিল জয়নালের বাড়িতে। তার সহযোগিতায় উকিল নিয়োগ করে জয়নালের পক্ষে মামলা চালায় জয়নাব। এক সময় ছাড়াও পায় জয়নাল। কিন্তু ততদিনে কেমন যেন বদলে গেছে জয়নাব! আগের মত হাসি নেই তার মুখে। কথায় কথায় ঝগড়া করে, খিটমিট করে। জয়নালও রেগে যায় ইদানিং একটুতেই। মাঝে মাঝে গায়েও হাত তোলে জয়নাবের।

জয়নাল জেলে যাওয়ার আগেই গর্ভধারণ করেছিল জয়নাব, অনেক চিকিৎসার পরে। কিন্তু সন্তানটি পেটেই নষ্ট হয়ে যায়। তাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারেনি জয়নাব। তারপর থেকেই সব সময় বিষণ্ন থাকতো সে। জয়নাল ফিরে আসার পর সংসারে অভাবও দেখা দেয়। বলতে গেলে তখন কুদ্দুসের সাহায্যেই চলছিল সংসার। তারপর কুদ্দুসের পরামর্শেই চালের ব্যবসা শুরু করে জয়নাল। গ্রামে তার পৈতৃক ভিটা বিক্রি করে দেয় সে কুদ্দুসের কাছেই। তার সাথেই ব্যবসা শুরু করে জয়নাল। খুব বিশ্বাস করেছিল সে তার ছোটবেলার বন্ধুকে। ভালোই চলছিল সবকিছু। 

একদিন ব্যবসার কাজে ঢাকায় যায় জয়নাল। কয়েক দিন পর ফিরে এসে আর জয়নাবকে পায় না সে। অদ্ভুত কিছু কথা শুনতে পায় সে আশপাশের লোকজনের মুখে। জয়নাল জেলে যাওয়ার পরেই নাকি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার বন্ধু কুদ্দুসের সাথে জয়নাবের। কুদ্দুস এত বয়সেও বিয়েশাদি করেনি কেন, জয়নাল জানতো না। সে কি মনে মনে জয়নাবকেই ভালবাসতো তাহলে? কিন্তু কোথায় গেল তারা? আজ তিন মাস হয়ে গেল, কোন খোঁজ পাওয়া গেল না জয়নাব আর কুদ্দুসের। অনেকে বলছে, তারা নাকি সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে গেছে। 

ঘুমের ঘোরেই শুনতে পায় জয়নাল। দরজায় শব্দ হচ্ছে, কে যেন এসেছে! কে? জয়নাব? সে কি স্বপ্ন দেখছে? চোখ কচলে উঠে বসে জয়নাল। দরজা খুলে দেখে, খাকি পোশাক পরা পুলিশের লোক দাঁড়িয়ে আছে কয়েক জন।
"আপনিই জয়নাল?"
"জ্বি।"
"আপনাকে থানায় আসতে হবে একটু।"
"কেন?"
"পুরান পাড়ার একটি বাসায় আপনার বন্ধু কুদ্দুস মিয়ার লাশ পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, তাকে অপহরণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ আপনাকেই প্রথম সন্দেহভাজন বলে মনে করছে।" 
"জয়নাব কোথায়?" অজান্তেই জয়নালের মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়।
"তিনি আমাদের হেফাজতে আছেন। তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আপনাকে এক্ষুনি থানায় যেতে হবে। আসুন আমাদের সাথে।"

মসজিদে মসজিদে ফজরের আজান হচ্ছে তখন। হতবিহ্বল জয়নাল বোধশক্তি হারিয়ে ফেলে কেন জানি! চুপচাপ হাঁটতে থাকে সে পুলিশের গাড়ির দিকে। আনন্দ, দুঃখ, বেদনা, বিষাদ কোন কিছুই অনুভব করে না সে আর।(সমাপ্ত)

সুফিয়া ফারজানা টুম্পা
ঢাকা, বাংলাদেশ