অটোয়া, মঙ্গলবার ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪
ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়াতে বেড়ানার গল্প - সুলতানা শিরীন সাজি

ত বছরের ডিসেম্বরে অস্ট্রেলিয়াতে যাবার পর জেরাল্ডটন এ বেশিরভাগ সময় থাকলেও  ঘুরতে গিয়েছিলাম Perth,Pemberton, Walpole, Albany আর Denmark নামে শহরগুলোতেও। সবগুলো শহরই ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়াতে। জেরাল্ডটন থেকে পার্থ পার হয়ে প্রায় ১০ ঘন্টার ড্রাইভ Pemberton এ যেতে। আমাদের প্রথম গন্তব্য ওখানে। এরপর আশেপাশে অনেক জায়গা ঘুরে দেখলাম।

Nannup নামে একটা ছোট্ট শহর দিয়ে যাবার সময় চোখ জুড়ালো পথের ধারের বেগুনি জাকারানডা ফুলে ভরা গাছগুলো দেখে। গাড়ি থামিয়ে ছবি তুললাম। বেগুনী ল্যাভেন্ডারের পর এই প্রথম কোন বেগুনী রং ফুলে মুগ্ধ হলাম। রাস্তার উল্টাপাশে দেখি একটা clock tower, নীচেই বিশাল একটা গিফট শপ, এত সুন্দর গোছানো গিফট শপ,  কাঠের তৈরী সব হাতে বানানো শো পিস। পুরো দোকানটা একটা গল্পের উপমা! দোতলায় স্থানীয় শিল্পীদের আঁকা ছবির গ্যালারি। একটা প্রদর্শনী চলছিল তখন। কয়েকটা স্যূভেনীর কিনলাম।

Pemberton এ beedleup এর পাশে অজস্র কারি (Karri) গাছের মধ্যে কটেজে থাকার ব্যবস্থা। পৌঁছাতে বিকাল হয়ে গেলো। মনে হচ্ছিল বুদ্ধদেব গুহ'র বই এ পড়া কোন জংগলে চলে এসেছি। গাড়ি নিয়ে আঁকাবাকা পাহাড়ী পথ দিয়ে একদম কটেজের কাছে চলে যাওয়া যায়। সুন্দর গোছানো কটেজ। বেলকোনির দরজা খুলে বসতেই কত রকম পাখি যে দেখলাম! পাখিদের কলকাকলীত মনে হচ্ছিল পাখিদের রাজ্যে চলে এসেছি। 
দোয়েল ওর মেয়েদের (জোয়া, মাতেয়া) নিয়ে গেলো লোকের পানিতে সাঁতার কাটতে। রাতে ঘরেই খেলাম। খিচুড়ি আর ডিমভাজি। টমেটো আর শসার সালাদ তো ছিলো। এমন চুপচাপ, নৈঃশব্দ্যের রাত! মনে হচ্ছিল নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ নিজে শুনতে পারছি। 

পরের দিন গেলাম হাইকিং এ। লেকের পিছনে beedleup falls। আমরা চারজন কথা বলতে বলতে কেমন করে কয়েক ঘন্টা সেই গহীন জংগল ঘুরে আসলাম, ভাবলে অবাকই লাগে। আমরা সবাই একটা করে লাঠি নিলাম। জয়া সেই লাঠিদের নাম দিলো। আমার লাঠিটার নাম টাইগার। হাইকিং এ শক্ত একটা লাঠি থাকলে উপরে উঠতে বেশ সাহায্য হয়।

কটেজের বারান্দায় বসলেই কত পাখি এসে সামনে বসতো। আমাদের সকালের নাস্তা খেতে দেখলেই একজন আরেকজনকে খবর দেওয়া শুরু করতো। হাতে খাবার ধরলে খেতো। ফেরার দিন মনটা কেমন যে লাগছিল! তিনটা দিন পাখির ডাকে সকাল। পলকেই কেটে গেলো। সারাদিন আমরা পাখিদের সাথে ওদের মতই মুখরিত থাকতাম। বুদ্ধদেব গুহ'র বই এ পড়া জংগলের কিছুটা রুপ এখানে যেনো দেখলাম!

এরপর আলবেনীতে যাবার পথে Walpole এ Nornalup National park এ কয়েক ঘন্টা সময় কাটিয়েছিলাম । প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা প্রকৃতির এত সুন্দর সব দেখার চোখ দিয়েছেন বলে! ভালোবাসা আর আদর জানাই  আমার সাথের প্রিয় তিনজন মানুষকে। যারা যে কোনভাবে চাইছিল আমাকে সবখানে জড়িয়ে নিয়ে আনন্দ করতে।

মাতেয়া আর জোয়ার সাথে তাল মিলিয়ে এবার উঠেছি  mount Frankland hilltop lookout এ। অনেক উঁচু তবে মাঝেমাঝে সিঁড়ি থাকাতে ওঠা সহজ হয়!  পাহাড়ে ওঠার  সেই অনুভবের বর্ণনার ভাষা এ মুহূর্তে আমার জানা নেই। অপার্থিব এক অনুভূতি। Hilltop এর উপর বসে থাকলাম অনেক সময়। দৃষ্টিসীমা জুড়ে সবুজ গাছ আর নীল আকাশ। মনে হচ্ছিল এই পৃথিবীতে আপাতত আমরা চারটা মানুষ আর সামনে পিছনে অবারিত সবুজ আর মাথার উপর নীল সামিয়ানার মত আকাশ! এমন সুন্দর এর সামনে দাঁড়ালে চোখ ভেসে যায় অপার্থিব আনন্দে। কত কিছু মনে হয়! মনেহয় জীবনের এমন দিন তো বারবার আসেনা। যখন আসে তখন চোখ ভরে দেখতে হয়, মন ভরে নিতে হয় এই পথ চলার আনন্দ।

এখানেই দেখলাম giant tingle tree,আগুনে পুড়ে গুহার মত গর্ত হবার পরেও উপরে দিব্যি বেঁচে আছে ৪০০ বছর বয়সী ইউক্যালিপটাসে গাছটা। আগুনে পোড়া গাছটা দেখতেই কত মানুষ আজো এখানে আসে। ইউক্যালিপটাসের ভীড়ে হাঁটতে হাঁটতে এ আমার জীবনের প্রথম চেনা লালমনিরহাটের সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের পাশের কয়েকটা ইউক্যালিপটাস গাছ মনে পড়ছিলো। ছোটবেলা প্রতিদিন মিশন স্কুলে আসা যাওয়ার পথে দেখা গাছগুলো অনেক ভাবাতো!

আলবেনীতে একদিন windmills দেখতে গেলাম। পাহাড়ের উপর থেকে  নীল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেই অপরুপ সৌন্দর্যর সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদেরকে মনে হচ্ছিল বিন্দুর মত। একদিকে বিশাল সমুদ্র আর অন্যদিকে  সবুজ গাছ। যতদূর চোখ যায় শুধু প্রকৃতি রুপ মেলে আছে। আলবেনীতে GAP(Natural bridge)দেখলাম। পাথরের এক ব্রীজ। মনেকরা হয় এটা এক সময় এনটার্কটিকার অংশ ছিল এটা। কারন এমন পাথর ওখানেও পাওয়া গেছে। পাথরের উপরে দাঁড়ালে মনেহয় সমুদ্র এখানে বারবার আছড়ে পড়ে কত কথা বলে যাচ্ছে! সমুদ্র সৈকত দেখার সময় আলবেনীর সমুদ্র সৈকতে অজস্র ঝিনুক কুড়ালাম। নেশা হয়ে যায় ঝিনুক কুড়াতে শুরু করলে। ঝিনুকের মধ্যে মুক্তা খোঁজে যারা। সেও এক নেশা!

Denmark এ সমুদ্র সৈকত ছিল দেখার মত। বিশাল বিশাল পাথরের পাশে নীল সমুদ্র। পাথরগুলো কোথাও কোথাও হাতির দলের মত। মেঘলা দিন হওয়াতে সমুদ্রের পানি বেশ ঠান্ডা  মনে হচ্ছিল। জোয়া আর আমি পাথরের উপর হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রের বিভিন্ন  সীমানায় গেলাম।

দোয়েলের ওখানে বেড়াতে যাবার আগে মনস্থির করতে পারছিলাম না। ঘরে বসে থাকতে থাকতে শিকড় হয়ে যাচ্ছিল। বেড়াতে যেয়ে প্রতিদিন নিজেকে নিজেই পিঠ চাপড়ে দিতাম, পারছি তো! ঘুরছি, হাঁটছি কিলোমিটারের পর কিলোমিটার। নির্ঘুম রাতগুলোতে যখন পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে নামি, মনেহয় সাহারার তপ্ত বালুতে হাঁটছি! দোয়েল আর মাতেয়া, জয়া’র সাথে ঘুরতে ঘুরতে মনেহয়, আছে তো, এখনো জীবন আছে!
অজস্র গাছে ভরা karri forest এ ঘুরতে ঘুরতে মনেহয় গাছের জীবন নেহাতই মন্দ না। যদিও পথের পাশে দাবানলে পোড়া গভীর বনের দিকে তাকিয়ে মন কেমন করছিল! পুড়ে যাওয়া কালো কালো গাছ আবারো বাঁচার আশায়! বেঁচে থাকাটাও আসলে নেশা।

জীবনের আজকের দিনে এসে মনে হয়, আছে তো জীবন আছে। যেতে হবে আরো পথ!  কবি গুরুকে মনে পড়ে।
“আমরা যাব যেখানে কোনো
  যায় নি নেয়ে সাহস করি।
  ডুবি যদি তো ডুবি-না কেন—
     ডুবুক সবই, ডুবুক তরী।”
বেঁচে থাকা দারুণ ব্যাপার। শুধুমাত্র বেঁচে থাকলে কত কী যে সম্ভব!

সুলতানা শিরীন সাজি
অটোয়া,কানাডা