অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
ভালোবাসা দিবস ও বাঙালী - মোবারক মন্ডল

র্তমানে ভ্যালেনটাইনস্‌ ডে বাঙালী যুবক যুবতীর কাছে একটি বিশেষ দিন। ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’ টি ক্রমশ বাঙালীরা নিজের করে নিয়েছে। প্রেমিক প্রেমিকাদের কাছে কাছে এই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম।
ভ্যালেনটাইনস্‌ ডে মানে অবুঝ দুটি মনের ভাব প্রকাশ করার দিন, অনেকদিনের জমে থাকা মান অভিমান প্রকাশ করার দিন, বন্ধুত্বের অটুট বন্ধন রক্ষা করার জন্য নতুন করে শপথ নেবার দিন, দুজন প্রেমীর মধ্যে বন্ধুত্ব বজায় রাখার দিন।

বছরজুড়ে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ দিবস পালন করতে হয়। তবে কিছু কিছু ‘আজগুবি’ দিবসও পালিত হয়। সে দিবস পালনে আমরা নামি প্রতিযোগিতার দৌড়ে। রোজ ডে, প্রপোজ ডে, হাগ ডে, কিস ডে, ভ্যালেন্টাইন ডে কত বিচিত্র নামের উৎসব করি! আহা কত্ত প্রেম!! সত্যিই কি এগুলো মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা? ভালোবাসার কি নির্দিষ্ট দিন হয়?

‘ভালবাসা দিবস’কে কেন্দ্র করে সারা পৃথিবী উন্মাতাল হয়ে উঠে। বাজার ছেয়ে যায় নানাবিধ উপহারে। পার্ক ও হোটেলগুলো সাজানো হয় নতুন সাজে। পৃথিবীর প্রায় সব বড় শহরেই ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’-কে ঘিরে পড়ে যায় সাজ সাজ রব। পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি প্রাচ্যের দেশগুলোতেও এখন ঐ অপসংস্কৃতির মাতাল ঢেউ লেগেছে। হৈ চৈ, উন্মাদনা, প্রেমিক যুগলের চোখেমুখে থাকে বিরাট উত্তেজনা। হিংসা-হানাহানির যুগে ভালবাসার এই দিনে প্রেমিক যুগল সব চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে বছরের এ দিনটিকে তারা বেছে নিয়েছে হৃদয়ের কথকতার কলি ফোটাতে।

‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’র ইতিহাস প্রাচীন। এর সূচনা প্রায় ১৭শ’ বছর আগের পৌত্তলিক রোমকদের মাঝে প্রচলিত ‘আধ্যাত্মিক ভালবাসা’র মধ্য দিয়ে। এর সাথে কিছু কল্পকাহিনী জড়িত ছিল, যা পরবর্তীতে রোমীয় খৃষ্টানদের মাঝেও প্রচলিত হয়। ভ্যালেনটাইন ডে সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন- ১. ২৬৯ সালে ইতালির রোম নগরীতে সেন্ট জুলিয়াস ভ্যালেইটাইন’স নামে একজন পাদ্রি চিকিৎসক খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারের অভিযোগে গ্রেফতার হন। বন্দী থেকেই তিনি জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। তাদের দু’জনের মধ্যে এক সময় প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। চিকিৎসক ভ্যালেইটাইন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। রাজা ঈর্ষান্বিত হয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যুদন্ড দেন। অতঃপর ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউও ১ম জুলিয়াস ভ্যালেইটাইন’স স্মরণে ‘১৪ ফেব্রুয়ারি’ ভ্যালেন্টাইন দিবস ঘোষণা করেন। ২. রোম সম্রাট ক্লডিয়াস তার বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করতে গিয়ে যখন এতে বিবাহিত পুরুষদের অনাসক্ত দেখেন, তখন তিনি পুরুষদের জন্য বিবাহ নিষিদ্ধ করে ফরমান জারি করেন। কিন্তু জনৈক রোমান বিশপ সেন্ট ভ্যালেন্টাইন এটাকে প্রত্যাখ্যান করেন ও গোপনে বিয়ে করেন। সম্রাটের কানে এ সংবাদ গেলে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং ২৬৯ খৃষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারীতে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। সেদিন থেকে দিনটি ভালবাসা দিবস হিসাবে কিংবা এ ধর্মযাজকের নামানুসারে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।

পশ্চিমা দেশগুলোর মত আমাদের দেশেও এমনকি বাঙালি সমাজে এ দিনে প্রেমিক-প্রেমীকা বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, এমনকি পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও ভালোবাসার উপহার সামগ্রী বিনিময় হয়।  উপহার সামগ্রীর মধ্যে আছে পত্র বিনিময়, খাদ্যদ্রব্য, ফুল, বই, ছবি, প্রেমের কবিতা, গান, লেখা কার্ড প্রভৃতি।
এই উপলক্ষে অনেক তরুণ দম্পতি হাযির হয় পার্ক, প্রেমকুঞ্জগুলোতে। দেশের নামী-দামী হোটেলের হলরুমে বসে তারুণ্যের মিলন মেলা। ‘ভালবাসা দিবস’-কে স্বাগত জানাতে হোটেল কর্তৃপক্ষ হলরুমকে সাজান বর্ণাঢ্য সাজে। নানা রঙের বেলুন আর অসংখ্য ফুলে স্বপ্নিল করা হয় হলরুমের অভ্যন্তর। চলে  উদ্দাম নাচ।  সবচেয়ে যে জঘন্য কাজ এ দিনে করা হয়, তা হ’ল ১৪ ফেব্রুয়ারী মিলনাকাঙ্ক্ষী অসংখ্য যুগল বেহায়াভাবে হোটেল,পার্কে চুম্বন ও ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। একদল যুবক যুবতী চরম অশ্লীলতায় মেতে ওঠে। 

বর্তমান অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে স্যাটেলাইটের কল্যাণে বাঙালী সমাজ পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুসরণ করছে। নিজেদের স্বকীয়তা-স্বাতন্ত্র্যকে ভুলে গিয়ে, ধর্মীয় অনুশাসনকে উপেক্ষা করে তারা আজকে প্রগতিশীল হওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে তাদের কর্মকান্ডে বাঙালী  জাতির উঁচু শির নত হচ্ছে। এ দিনটি উদ্যাপন কোন স্বভাব সিদ্ধ ব্যাপার নয়। বরং একজন ছেলেকে একজন মেয়ের সাথে সম্পর্ক জুড়ে দেয়ার পাশ্চাত্য কালচার আমদানিকরণ। আমরা জানি, তারা সমাজকে চারিত্রিক পদস্খলন ও বিপর্যয় হ’তে রক্ষা করার জন্য কোন নিয়ম-নীতির ধার ধারে না। যার কুৎসিত চেহারা আজ আমাদের সামনে স্পষ্ট। তাদের অশালীন কালচারের বিপরীতে আমাদের অনেক সুষ্ঠু-শালীন আচার-অনুষ্ঠান রয়েছে।

বাঙালী সমাজে এক সময় নীতি-নৈতিকতার মূল্য ছিল সীমাহীন। লজ্জাশীলতা ও শুদ্ধতা ছিল এ সমাজের অলংকার। কোন অপরিচিত মেয়ের সাথে রাস্তায় বের হবার চেয়ে পিঠে বিশাল ভার বহন করা একটা ছেলের জন্য ছিল অধিকতর সহজ। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে তা চিন্তা করারও অবকাশ ছিল না। অথচ সেই অবস্থা থেকে আজ আমরা কোথায় এসে পৌঁছেছি! এটা হচ্ছে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’-র মত বেলেল্লাপনার কুফল। এসবের দ্বারা সরল, পুণ্যবান, নিষ্কলঙ্ক মানুষ বিপথগামী হচ্ছে।
লোক দেখানো ভালোবাসার নামে যে বেলেল্লাপনা দেখা যাচ্ছে , তাতে কি ভালোবাসা আছে? ভালোবাসা ছাড়া সমাজ অচল। বাবা-মা, ভাইবোন, প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসা আদিযুগ থেকেই। মানুষের ধর্ম মানুষকে ভালোবাসা। মা-বাবা-ভাই-বোন-ছেলে মেয়ে-স্ত্রী-স্বামী-ছাত্র-শিক্ষক-প্রতিবেশী-আত্মীয়স্বজন একে অপরকে ভালোবাসবেন- সেটাই স্বাভাবিক। স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্ক কী, সেটাও সবার জানা। কিন্তু পশ্চিমাদের অপসংস্কৃতি চর্চার নামে তথাকথিত ভালোবাসা দিবস! অদ্ভুত আমাদের ভাবনার জগৎ। উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েরা পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি চর্চার নামে স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছে, নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে প্রতারণা করছে।

পরিশেষ, যখন এ পৃথিবীর বিপুল সংখ্যক মানুষ না খেয়ে থাকে, যখন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কান্ডারী শিশুরা ক্ষুধায়, অপুষ্টিতে ভুগে মারা যায়, তখন আমরা অবৈধ বিনোদনের নামে নোংরামী করে অযস্র অর্থ নষ্ট করি কোন্ মানবিকতায়?  পশ্চিমা বিশ্বকে অন্ধভাবে অনুসরণ করতে গিয়ে আমাদের ‘ভ্যালেনটাইন ডে’ এর হাওয়া লেগেছে। দেশের অনেক তরুণ-তরুণীও এ ফাঁদে পা দিয়ে অর্থ, শ্রম সময় নষ্টের সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে অপসংস্কৃতির অন্ধকারে। অতএব যেকোন মূল্যে এসমস্ত অপসংস্কৃতি থেকে বেঁচে থাকা জরুরী। ভ্যালেনটাইনস ডে’ সার্বজনীন উদযাপনযোগ্য কোনো বিষয় নয়। ৩৬৫ দিনই ভালোবাসার দিন, একটি বিশেষ দিনকে ভালোবাসার জন্য নির্দিষ্ট করে বাকিদিনগুলি ভালবাসাহীন করা যুক্তিসঙ্গত নয়।  প্রতিটা মূহুর্ত ভালোবাসায় ভরে ওঠুক। ভালোবাসার নির্দিষ্ট কোন দিন হয় না। আসুন এই অপসংস্কৃতিকে বর্জন করে সুস্থ, সুশীল সমাজ গড়ে তুলি।

মোবারক মন্ডল
নদীয়, পশ্চিমবঙ্গ