অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
ভিন্ন জীবন (পর্ব-চৌদ্দ) - সুফিয়া ফারজানা

সারা রাত ঘুমাতে পারেনি সালমা। ফজরের নামাজ পড়ে একটু ঘুমিয়ে পরেছিল বোধ হয়। চোখ খুলে দেখে, রোদ উঠে গেছে। মতিন ঘরে নেই। ময়না বিছানায় বসে খেলা করছে একা একা। দরজা খোলা রেখে কোথায় গেল মতিন? নাস্তা করে গিয়েছে তো? ফোন দিলো সালমা, ফোন অফ। ঘরটা একটু গুছিয়ে ময়নাকে নাস্তা খাইয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই মতিন ফিরলো একগাদা বাজার নিয়ে। মাছ, মুরগী, আলু, বেগুন, লাউ, ময়নার জন্য কত রকম ফলমূল। বাজার টা বুঝিয়ে দিয়েই কারখানায় চলে গেলো সে। বললো,"ফিরতে রাত হবে।" সালমাকে আর কিছু বলার সুযোগই দিলো না।

মতিন আজ কারখানায় গেল না। সোজা গেল লিলির বস্তির বাসায়। লিলি তখন রেডী হচ্ছিলো গার্মেন্টসে যাওয়ার জন্য। মতিন সোজা গিয়ে ঢুকলো লিলির ঘরে। লিলির হাত ধরে টেনে নিয়ে আসলো বাইরে। লিলি জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিলো,"কি করেন? কি হইলো?"
"চলো, আমার লগে।"
"কই যামু?"
"কাজী অফিসে। আইজকাই বিয়া করমু আমরা।"
লিলি হতভম্ব হয়ে যায় মতিনের এই আচরণে। তবু সামলে নিয়ে বলে, "যদি না করি?"
"রাজী না হইলে তোমারে চাকরি করতে দিমু না।"
"মানে?"
"বড় স্যারের কাছে রিপোর্ট দিমু যে, তুমি খারাপ মাইয়া। বস্তিতে একা থাকো, আর অবৈধ কাজ করো।"
"আপনের কথা বড় স্যার শুনবো?"
"অবশ্যই শুনবো। তবে আমি এইসব করতে চাই না, লিলি। তুমি রাজী হও। চলো, আমরা কাজী অফিসে গিয়া বিয়া করি আইজকাই।"

চেঁচামেচি শুনে লিলির মা রান্না ফেলে এসে দাঁড়ান লিলির কাছে। মতিনকে বলেন,"যাও বাবা, তুমি চইলা যাও অহন। আমার মাইয়া রাজী না। তাই আমিও রাজী না। তোমার লগে লিলির বিয়া আমি দিমু না। লিলির মত নাই, ও আর বিয়াশাদী করতে চায় না। আমিও ওরে জোর করমু না আর।"
"আমি যাইতাছি, তবে আমি আবার আসমু। লিলি, তুমি ভাইবা দেখো। আমারে বিয়া না করলে তোমার চাকরি থাকবো না। এই এলাকায় থাকতেও পারবা না তুমি।
কথাগুলো বলেই চলে যায় মতিন। লিলি আর গার্মেন্টসে যায় না সেদিন। আলিফকে নিয়ে শুয়ে থাকে সারাদিন। তার মা রান্না করে খেতে ডাকলে উঠে ভাত খায়, আবার শুয়ে পরে। মনে হয়, কত বছর ধরে যেন ঘুমায় না সে! কতই না ক্লান্তি তার শরীর জুড়ে!!

সালমা সারাদিন ধরে রান্না করে, মুরগীর মাংস, পুঁটি মাছের চচ্চড়ি, শোলমাছ দিয়ে লাউ, বেগুন ভর্তা, আলু ভাজি, ডাল। ঘর পরিস্কার করে গোছায়, সব থালাবাসন মেজে চকচকে করে, সমস্ত ময়লা কাপড় সাবান দিয়ে ধুয়ে রোদে দেয়। কাজ করতে করতে সে ভাবে, পুরুষ মানুষ একা থাকে, আসলেই তো কষ্ট হয়। হোটেলে খেয়ে কি চেহারা হয়েছে মানুষটার! মতিন যদি একবার বলতো, সে ঢাকায় থেকে যেতো ময়নাকে নিয়ে। দরকার হলে মুন্নী আর শ্বশুরকেও নিয়ে আসতো। কিন্তু গ্রামের বাড়িঘর, জমিজমা, গরু-ছাগল সেসব কি হবে? কে দেখবে? মতিন তাহলে চাকরি ছেড়ে চলে যাক গ্রামে। তাদের তো অনেক আছে। কি হবে এত টাকা দিয়ে? কিন্তু মতিন কি রাজী হবে? ভেবে কোন কূল-কিনারা পায় না সালমা।

সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরে আসে মতিন। আজ ঘরে ঢুকেই তার মন ভালো হয়ে যায়। কী সুন্দর ঝকঝক করছে সবকিছু। সালমা আসলেই কাজের, অনেক গুণ আছে তার। হবে না কেন? সে তো ভালো বংশের মেয়ে। মতিনের বাবা অনেক দেখেশুনে অনেক বড় ঘর থেকে মেয়ে এনেছিলেন তার একমাত্র পুত্রের জন্য। বিয়ের সময় দেখতে-শুনতেও ভালো ছিল সালমা। ক্লাস টেনে পড়ার সময় বিয়ে হয়। বিয়ের পর এসএসসি পাস করে সালমা। তারপর আর পড়তে দেয়নি মতিন। মেয়েমানুষ এত পড়াশোনা করে কি হবে?

ময়নার জন্য অনেক খেলনা, জামা, জুতা আর সালমার জন্য বেশ দামী একটা শাড়ি এনেছে মতিন। আজ সে  ময়নাকে কোলে নিয়ে অনেক আদর করে, অনেক খেলা করে, গল্প করে। খাওয়া-দাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক কথা বলে সালমার সাথেও। বলে, "অনেক দিন পর এত শান্তি কইরা খাইলাম। রান্না খুব মজা হইছে, সালমা।"

খাওয়া দাওয়া শেষ করে শুয়ে পরে তারা। ময়না ঘুমিয়ে পরেছে অনেক আগেই। লাইট অফ করে দিয়ে মতিন বলে, "তোমার লগে কিছু কথা আছে, সালমা।"

বুক কেঁপে ওঠে সালমার। কি বলতে চায় মতিন?

তারপর মতিন বলে। সব খুলে বলে সালমাকে, লিলিকে সে বিয়ে করতে চায়। শহরে একা একা মতিনের খুব কষ্ট হয়। কিন্তু গ্রামের বাড়িঘর ছেড়ে, তার বৃদ্ধ বাবাকে একা রেখে সালমাকে সে নিয়ে আসতে পারবে না শহরে। এটা কখনোই  সম্ভব নয়, যেহেতু সে একমাত্র ছেলে বাড়ির। খুব নরম গলায় কথাগুলো বলে মতিন। সালমাকে কাছে টেনে নেয় সে, "আসল বউ তো তুমিই। আমার ময়না বড় হইবো, মানুষ হইবো। আরও পোলাপান হইবো তোমার। আমি বাড়ি যামু প্রতি মাসেই, তোমারে কথা দিলাম। লিলিরে আমি বাড়ি নিয়া যামু না জীবনেও। বাড়িঘর, জমিজমা, সব তোমার। তুমি অনুমতি দাও, ময়নার মা।"

রাতের অন্ধকারে স্বামীর আদরমাখা স্বরে বলা এই নিষ্ঠুর কথাগুলোর কোন জবাব সালমা খুঁজে পায় না। বাড়িঘর, জমিজমা দিয়ে সে কি করবে, মানুষটাই যদি তার না থাকে? মানুষটাকেই যদি হারিয়ে ফেলে সে? মানুষটাই যদি অন্য কারও হয়ে যায়?? (চলবে)

সুফিয়া ফারজানা
ঢাকা,বাংলাদেশ