অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
‘আমার মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক অনন্য দলিল - শংকর চৌধুরী

নেক দিন পর সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গ্রন্থ পড়ে খুব ভাল লাগল। গ্রন্থটির নাম "আমার মুক্তিযুদ্ধ"। লিখেছেন কানাডা প্রবাসী গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা শাহেদ বখত ময়নু। সম্পাদনা করেছেন লেখক  মহসীন বখত এবং গ্রন্থটির গৌরচন্দ্রিকা করেছেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, লেখক তাজুল মোহাম্মদ। অনুলেখক ছিলেন জাবেদ ভূঁইয়া। 
নাগরী প্রকাশনী, সিলেট, বাংলাদেশ থেকে ২৩মে ২০২৩ এ প্রকাশিত।  গ্রন্থটির সুন্দর প্রচ্ছদ করেছেন স্বনামধন্য প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব এষ।

লেখক শাহেদ বখত ময়নু, বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অংশ গ্রহন করেন। তিনি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি যুদ্ধে সংগঠকও ছিলেন। 
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা এ অঞ্চলকে, এ অঞ্চলের মানুষকে শোষন ও বৈষম্য করত। শোষনহীন, অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যমুক্ত দেশ গঠনের জন্যই তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছিলেন। সব মুক্তিযোদ্ধাদের মতো গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা শাহেদ বখত ময়নুর একমাত্র লক্ষ্যই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করা। যুদ্ধে পরাজিত হলে বা শত্রুর কাছে ধরা খেলে মৃত্যু নিশ্চিত।  এ কথা জেনেও তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছিলেন। অদম্য সাহসী, বিচক্ষণ শাহেদ বখত ময়নু দেশমাতৃকার ডাকে জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। পাকবাহিনীর নির্যাতন ক্যাম্প হতে ভাগ্যগুণে ফিরে আসা মুক্তিযোদ্ধা তিনি। লাল সবুজের পতাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রয়েছে তার অনন্য ভুমিকা। 
শাহেদ বখত ময়নু উত্তরাধিকার সূত্রে শিক্ষাদীক্ষা, সাহিত্যে সংস্কৃতি, স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত, প্রভাবশালী মৌলভীবাজার রাজনগরের ফকিরটিলার বখত বাড়ির সন্তান। তিনি অনায়াসেই নিশ্চিত জীবন যাপন করতে পারতেন। কিন্তু দেশমাতৃকার চরম দু:সময়ে প্রানের মায়া তুচ্ছ করে তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।  
দীর্ঘদিন যাবত কানাডায় প্রবাসী হলেও মাতৃভূমি বাংলাদেশের প্রতি, নতুন প্রজন্মের প্রতি রয়েছে গ্রন্থটির লেখক শাহেদ বখত ময়নুর দায়িত্ববোধ। স্বদেশপ্রেম এবং  দায়িত্ববোধ থেকেই তিনি, স্বাধীনতার ৫২ বছর পর প্রবাসে অবস্থান করেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে ‘আমার মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থটি রচনা করেছেন। এ গ্রন্থটি মহান মুক্তিযুদ্ধের অনন্য আঞ্চলিক দলিল হিসেবে কাজ করবে। 
মহান মুক্তিযুদ্ধের সবঘটনা বিশাল জলরাশির মত। সব গুলো একটি গ্রন্থে প্রকাশ সম্ভব নয়। ‘আমার মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থে লেখক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মৌলভীবাজার রাজনগর এলাকার আঞ্চলিক অনেক যুদ্ধকালীন ঘটনার বর্ননা করেছেন। তার বর্ননায় আলোচিত অনেক ঘটনাই জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
শোষণ বঞ্চনার চির অবসানের লক্ষ্যে অসাম্প্রদায়িক মানবিক রাস্ট্র গঠনের লক্ষ্য নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছিলেন। তবে প্রসংগকথায়,  স্বাধীনতার অর্ধশতক পর বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক বিপর্যয়, স্বাধীনতা বিরোধীদের উত্তান, ধর্মান্ধতা তাকে ব্যথিত করেছে। দেশের এ অবস্থার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে করেনি, বলে তিনি আক্ষেপ করেছেন, যা ‘আমার মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থটি পড়লে তা জানা যায়।

২৬টি প্রবন্ধ ও কিছু আলোকচিত্র নিয়ে ‘আমার মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থটি মুক্তিযুদ্ধের অনন্য ঐতিহাসিক দলিল। গ্রন্থটি পড়ে মনে হয়েছে, অকুতোভয়, বীর মুক্তিযোদ্ধা লেখক সামনে বসে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছেন। যদিও লেখক শাহেদ বখত ময়নুর সাথে ইতিপূর্বে আমার পরিচয় ছিল না। কিন্তু গ্রন্থটি পড়ে মনে হয়েছে অত্যন্ত দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসাবে তিনি এ গ্রন্থ রচনা করেছেন। 
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এদেশের সর্বস্তরের মানুষের সম্পৃক্ততার কথাও বর্ণনা দিয়েছেন ‘আমার মুক্তিযুদ্ধ’গ্রন্থে। 

কিছু প্রবন্ধ আমাকে বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট করেছে। তার মধ্যে অন্যতম বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষন, আসামের বিলবাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ, কেসরিরকোল ব্রিজ উড়িয়ে দেয়া, দেরাদূনে গেরিলা ট্রেইনিং, দুই মুক্তিযোদ্ধার হত্যার প্রতিশোধ, কুকুরের মুখে মানুষের মাথার খুলি, সুনিতী ধরের বাড়ি ও হিন্দু ভীতি, বৈদ্যরূপে ভগবান (ডা:যামিনী মোহন দেব), পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন সেলিমের টর্চারসেল, মুক্তিযুদ্ধে এক অসহায় মায়ের আত্নত্যাগ।
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবর্ননীয় কষ্ট করে ট্রেইনিং নেয়া, জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করা, নির্মম টর্চারের পর ও মুক্তিযোদ্ধারা কোন তথ্য পাকিস্তানীদের কাছে দেয়নি। পাখির মত নিরিহ মানুষকে হত্যা করেছে, আর মুক্তিযোদ্ধা ধরা পড়লে চলত ভয়াবহ নির্যাতন। তবুও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড মানসিকশক্তি এবং স্বদেশপ্রেম। আসামের বিলবাড়িতে প্রশিক্ষণের প্রথম দিন গ্লাস ও প্লেটের অভাবে ব্যবহার্য কাপড়েই অত্যন্ত নিম্নমানের চাউলে তৈরী খিচুড়ি সংগ্রহ করে খেতে হয়েছে।  পরবর্তীতে বাঁশের খাঁপে খাবার গ্রহন, বাঁশের চোঁংগায় পানি খাওয়া আমাকে বিস্মিত  করেছে। এছাড়াও দেরাদূনের গেরিলা প্রশিক্ষণের সময় পানির অভাবে সপ্তাহে একদিন দূরবর্তী নদীতে স্নান করতে হয়েছে। এ গ্রন্থ পড়ে মুক্তিযোদ্ধারের যুদ্ধকালীন কষ্ট জেনে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেডে গেল। কত কষ্ট করে তারা এ যুদ্ধ করেছেন। আর কত মানুষ যে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছিল তা  কুত্তার মুখে মানুষের মাথার খুলি প্রবন্ধ পড়লে কিছুটা বুঝা যায়।  মানুষের অসংখ্য লাশ কুকুর শেয়াল খেয়েছে। আলবদর রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকবাহিনীর নির্বিচারে এদেশে গনহত্যা চালিয়ে ছিল। তা এ গ্রন্থে বিভিন্ন ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন হিন্দুনিধন যজ্ঞ চলছিল। শুধু মাত্র হিন্দু হবার কারণে তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা, তাদের সম্পদ লুল্টন, বাড়িঘর দখল এসব বিষয়ও উঠে এসেছে। সুনিতী ধরের বাড়িতে নির্বিচারে হত্যা এবং বৈদ্যরূপে ভগবান ডা. যামিনী মোহন দেবের হত্যা, ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হত্যাকান্ডের বিষয়টিও নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে। ’ আমার মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক অনন্য দলিল। 
এ গ্রন্থে বিভিন্ন প্রবন্ধে কিছু রাজাকারের নাম এসেছে। এজন্য লেখককে সাধুবাদ জানাই।  রাজাকাররা বর্তমানে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অনেক শক্তিশালী। তাদের নাম নিতেও অনেকে ভয় পায়।  এ গ্রন্থের প্রবন্ধে যুদ্ধ অপরাধে সংশ্লিষ্ট অন্য রাজাকারদের নাম উল্লেখ করলে আরো ভাল হত।
‘আমার মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থে কিছু প্রবন্ধ খুব ছোট করে লিখার কারনে প্রাসঙ্গিক অনেক কিছুই জানা যায়নি। ভবিষ্যতে মুক্তিযোদ্ধাদের পাওয়া যাবে না। তাই তাদের নিকট হতে এখনই সব তথ্য জানা খুব প্রয়োজন।  আশাকরি, পরবর্তী প্রকাশনায় লেখক আরো তথ্য দিয়ে এসব প্রবন্ধের আকার বৃদ্ধি করবেন। যা বর্তমান এবং আগামী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভালভাবে জানতে পারবে।  আমার মুক্তিযুদ্ধ গ্রন্থে, দুইজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতিশোধ নিতে চুংগা হাজির মৃত্যুতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিশোধের কিছুটা চিত্র পাওয়া যায়। তবে যুদ্ধ পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধারা, স্বাধীনতা বিরোধীদের অনেক ক্ষেত্রে ছাড় দেবার কারনেই বোধ হয় বাংলাদেশ আজ উল্টো পথে যাত্রা শুরু করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী আলবদর রাজাকাররা এদেশের অনেক মা বোনদের পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল। এ গ্রন্থে এক অসহায় মায়ের কন্যার ইজ্জত রক্ষা করতে গিয়ে আত্নত্যাগের কথা জেনে খুব খারাপ লাগল।
দেশে বর্তমানে  স্বাধীনতা বিরোধীদের উত্থান, আস্ফালন, প্রভাব, প্রতিপত্তি দেখে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা শাহেদ বখত ময়নু ব্যথিত হয়েছেন।  দেশ, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হতে অনেক দূরে চলে গেছে।  দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যতম দার্শনিক শহীদ বুদ্ধিজীবি ড. জিসি দেবের বাড়ি বর্তমানে হাক্কানী পীরের খানকা শরীফে পরিনত হয়েছে যা খুবই বেদনাদায়ক। এ বিষয়েও তিনি আলোকপাত করেছেন। ’আমার মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থটিতে অন্যান্য বিষয়ের সাথে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক  চেতনা থেকে সরে আসা বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থা নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। সত্য নিরপেক্ষতা বজায় রেখে লেখক গ্রন্থটি লিখেছেন। সব মিলিয়েই গ্রন্থটি পড়লে পাঠকদের ভাল লাগবে। আগামী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারবে। গ্রন্থটির সাথে সংস্লিষ্টদের সাধুবাদ জানাই। গ্রন্থটির বহুল প্রচার ও প্রসার কামনা করি। 

শংকর চৌধুরী
 ( প্রাক্তন অধ্যাপক, মদন মোহন কলেজ, সিলেট)
অটোয়া, কানাডা