অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
মহাভাষার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে (প্রথম পর্ব) - মহসীন বখত


মহাভাষার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে 
মহসীন বখত

  প্রথম পর্ব 

 প্রতিটি মানবশিশু জন্ম নেয় একজন ভাষীক প্রাণী হিসেবে। একটা সুপার বাগযন্ত্র সকল মানব সন্তানেরই আছে।বাগযন্ত্র অবশ্য পাক-পাখালি, স্থলচর, জলচর, স্তন্যপায়ী বনের সাধারণ সকল জীবজন্তুরই রয়েছে। সবাই যার যার মত করে ধ্বনি উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু শব্দ উৎপাদন করাকেই ভাষা বলেনা। তাহলে অস্ট্রেলিয়ার লিয়ার নামের রহস্যময় পাখিটাকেও ভাষীক পক্ষী বলা যেত। বুনো কুক্কুটের মত এট্রুখানি লিয়ার এহেন শব্দ নাই যা নকল করতে পারেনা। করাতকলে গাছ কাটার শব্দ, এম্বুলেন্সের সাইরেন, অট্টহাসি, গিটারের টুংটাং, শিশুর কান্না-এহেন ধ্বনি নাই পাখিটা আপন মনে আওড়ায়না। তোতাময়না, চুটিয়াশালিক ধরনের কিছু পাখিকে যেকোনো ভাষার কিছু শব্দ চাইকি ছোট ছোট কিছু বাক্য বলার তালিম দেয়া যায়। অগনিত পাখির রয়েছে দারুন সঙ্গীতের কন্ঠ।তাই বলে তারা রক বা ভাওয়াইয়া গাইতে পারেনা। ভাটিবাংলার হাওরবাওর জংলাজলায়, ধানিজমিতে বাস করে কমলা রঙের মুকুটপরা কোড়া নামের এক রাজাধিরাজ পাখি, কচুরিপানার শান্ত বাসর দাপিয়ে দরাজকন্ঠে পূর্বরাগের গান গেয়ে বর্ষার আসর উথালপাতাল করে দেয় সে। তার নিজের এলাকায় অনধিকার প্রবেশ যেন না-করে অন্য কোনো মর্দ এজন্যে গর্জমান থাকে সে দিনমান। আর থেকেথেকে যেন বহুযুগের ওপার হতে অপুর্ব মৃদঙ্গের বোল তোলে গলায়।মনে হবে মাটির গহ্বর থেকে ওঠে আসা সঙ্গীতলহরী নিসর্গ কাঁপিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু পাখিটা কি শাহ আব্দুল করিমের ‘বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে সইগো…’ গাইতে পারবে? সে কি প্রেসিডেন্ট ওবামার মত এক জাদুই ভাষার ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে বক্তৃতা করতে পারবে? কস্মিনকালেও না। গলায় বিশেষ কিছু মধুর অথবা কটু শব্দ মাহেন্দ্-মূহুর্তে উৎপাদন করে পক্ষী বা পশুরা নিজেকে জানান দিতে পারে। বনের বিহঙ্গ, অগনিত জন্তু-জানোয়ারের জীবিনাচারের সাথে সম্পর্কিত কিছু শব্দকে আমরা রূপক অর্থে পাখি অথবা পশুর ভাষা বলে থাকি। ‘পাখির ভাষা, পশুর ভাষা, ফুলের ভাষা,মৌমাছির ভাষা, সংকেতের ভাষা, দেহের ভাষা,রঙের ভাষা, গনিতের ভাষা, যন্ত্রের ভাষা, এমন কি নীরবতা বা স্তব্ধতার ভাষার কথাও ব’লে থাকি আমরা। এ-সবই জ্ঞাপন করে ‘ভাষা’র রূপকার্থ। মানব ভাষার প্রকৃতি ও ব্যাপকতা নেই পাখির, পশুর বা মৌমাছির ভাষায়; গণিত বা যন্ত্রের কৃত্রিম ভাষাও মানবভাষার স্বাভাবিক গুণ সামান্য পরিমাণেও ধারণ করে না;আর ফুলের ভাষা,রঙের ভাষা, বা স্তব্ধতার ভাষা তো পুরোপুরি কাব্যিক রূপক। ধ্বনি,রূপ বা শব্দ, বাক্য, ও অর্থের এমন এক অসামান্য সংশ্রয় স্বাভাবিকভাবেই সৃষ্টি করেছে মানুষ,যা তার জীবন ও স্বপ্নের মতোই ব্যাপক। মানুষ কিছু স্বতন্ত্র ধ্বনি সৃষ্টি করে,সেগুলোর বিন্যাসে গ’ড়ে তোলে অর্থজ্ঞাপক শব্দ, সে-শব্দগুলোকে নানাভাবে সংগঠিত ক’রে সৃষ্টি করে বাক্য;এবং বাক্যের সাহায্যে প্রকাশ করে এমন কিছু,যাকে কোনো উপযুক্ত শব্দের অভাবে বলতে পারি ‘বক্তব্য’। ভাষার সাহায্যে মানুষ শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে,অভিশাপ দেয়; আদেশ দেয় ও অনুরোধ জানায়; নিবেদন করে প্রেম, প্রকাশ করে ঘৃণা; সত্য কথা বলে,মিথ্যাও বলে নিয়মিত; বাস্তবসন্মত কথা যেমন বলে তেমনি বলে ও বলতে পারে পুরোপুরি অবাস্তব কথা।ভাষার সাহায্যে মানুষ শ্রোতাকে মুগ্ধ, বিচলিত,উত্তেজিত করে; রচনা করে এমন তত্ত্ব ও শিল্পকর্ম, যা ভাষা ছাড়া সম্ভব হতো না অন্য কোনো উপায়ে। মানবজাতির সৃষ্টিশীলতার,ও তার আন্তর বাহ্যজীবনের সমগ্ররূপ ধরা পড়ে ভাষায়।’ ভাষা দিয়ে মানুষকে মানুষ পাগল করে তুলতে পারে।ভাষা কখনো তীক্ষ্ণ চাবুকের মত প্রহার করতে পারে মানুষেরই অস্তিত্বকে। আবার প্রেমাতুর করতে পারে,ক্রোধান্বিতও। ভাষার দম্ভেই একদিন  মানুষ নিজেকে অভিষিক্ত করেছে অমৃতের বরপুত্র অভিধায়।মানুষের মানুষ হবার প্রথম আত্মঘোষণা এই ভাষা, প্রথম স্বাধীনতা।যুগেযুগে, স্থানেস্থানে ভাষাই একেকটা মানবগোষ্ঠীর সংস্কৃতির জগৎ নির্মাণ করেছে, বুনেছে আবহমানকালের জ্ঞান ভান্ডার। মানুষ অপরকে করে যত প্রশংসা, বলে যত স্তুতিবাক্য,করে যত নিন্দাপাঠ সকলই ভাষায়। এই ভাষার সাহায্যেই মানুষ ঈশ্বরের নামে বাণী প্রচার দিয়ে নিজেই হয়েছে ঈশ্বর। ভাষা মানব অস্তিত্বের এক অলৌকিক রসায়ণ যেন। কথার সাহায্যেই মানুষ হতে পেরেছে সমাজবদ্ধ, তৈরি করতে পেরেছে বহুধারার চিন্তা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন। বংশপরম্পরায় চারিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে আপন জ্ঞানের  ঐশ্বর্যভান্ডার, তার সকল কৃতি,সংস্কৃতি। মানবশিশু জন্ম নিয়ে মায়ের কাছ থেকে মায়ের ভাষাটা অধিগত করে জন্মাবধি। মানুষ তার সাধণযন্ত্র এই কন্ঠটা বেঁচে থাকার জীয়নমন্ত্র হিসেবেই কাজে লাগিয়ে পশু-প্রকৃতিটা শাসন করতে পেরেছিল বলেই আজ গোলকায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত, আর মহাশুন্যের গ্রহান্তরে সংসার রচনার স্বপ্ন দেখছে। আদিম অসহায় নরবানরকল্প মানুষের দল পশুদশার নিয়তি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল অনেকখানি ভাষার গুনেই। মানুষ আজ ইতিরজাত প্রাণী নয়,মানুষ আপন কন্ঠের যাদুই সৃষ্টি দিয়ে ভাষীক, সংস্কৃত, মননশীল। ভাষার কল্যানে মানুষ অনন্য অদ্বিতীয়।

   একদিন মানুষ অবাক বিষ্ময়ের পথে বাস্তুত্যাগ করে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রায় ৭০হাজার বছর আগে আদি  ভিটা আফ্রিকা ছেড়ে যায় গোটা কতেক খাদ্যসন্ধানী মানুষ। বিজ্ঞানীরা বলছেন গৃহত্যাগের দ্বিতীয় তরঙ্গ এটা মানুষের। মানুষ আদি ভাষাটি সঙ্গে নিয়ে যায় কিন্তু ক্রমে তা ছিন্নবিছিন্ন হয়ে যায় নানা শাখায়। আদি  ভাষাটাও নানা পরিবেশে ছিটকে পড়ে আর নতুন নতুন ভাষাগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। আবার ভাষা দিয়েই ভূখন্ডে ভূখন্ডে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া মানুষ আন্তঃসম্পর্কের ঐক্যতান পুনরায় বাঁধতে পেরেছে। পৃথিবীজোড়া হরেক ভাষা দিয়ে মানুষ গড়ে তুলেছে সমুদ্রসমান শব্দের ভান্ডার। কখনো অর্থময়, কখনো প্রতীকী এইসব রহস্যময় শব্দবাহিনীর হিমালয় গড়ে তুলেছে মানুষ। মানব সমাজের সমস্ত রসায়ণ এখন ভাষার মালিকায় গাঁথা। ভাষায় মানুষ নিজেকে করেছে নির্মাণ। বেঁচে থাকার জন্যে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মত মানুষের ভাষাটাও যেন সহজাত। দুইলক্ষ বছর ধরে ভাষার চর্চা করে যাচ্ছে  মানুষ। দিনমান এই ভাষাটাই এখন মানুষের কন্ঠলগ্ন,আজন্ম সঙ্গী। ভাষা দিয়ে মানুষ পৌঁছে দেয় আপন ইচ্ছের ইঙ্গিত অপরের অন্তরে।কন্ঠবাহিত শব্দগুলোকে কালেকালে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে মানুষ তার ভাষাকে করে তুলেছে আজ আনবিক বোমার চেয়েও শক্তিময়, জ্যোতিময়, অর্থময়, দুর্মর। অপ্রতিরোধ্য এই ভাষার জয়যাত্রা। এই ভাষা হয়েছে কখনও বর্ণবাদী, কখনও আঞ্চলিকতায় দুষ্ট,কখনও মধুর মহিমায় শ্রুতিময়। ভাষার রয়েছে যাদুময় ক্ষমতা। মানুষ রাজনীতি করে ভাষার গুণে, মানুষ মানুষকে শাসন করে, জ্ঞান বিস্তার করে, দর্শন বানায়, কাহন লিখে ভাষার সাহায্যে।ভাষা মানুষের বশে এসেছে।আবার ভাষাই বশ করেছে তাবৎ মানবসমাজ, তার সংস্কৃতি, জীবনাচার। এই ভুবনের সকল কর্মকান্ডের মোক্ষম অস্ত্রের নাম ভাষা। এই অস্ত্রবাণ দিয়ে মানুষ আজ হয়েছে মানুষের মত। অবশ্য মানুষকে মানুষ হবার পেছনে বহুতর শর্ত কাজ করেছে। সেই হরেক শর্তের মধ্যে ভাষা অনন্য।ভাষা তুলনাহীন। আদিতে বন্যদশার মানুষ ভাষার শক্তিতেই করেছে প্রকৃতি জয়।অজানার টানে ছুটে চলেছে এক গোলার্ধ থেকে অন্য গোলার্ধে।ছয়লক্ষ বছর আগে সেই বন্যদশায় একটা শারীরবৃত্তীয় সামান্য মহার্ঘ যোগ হয় মানুষের কন্ঠযন্ত্রে যা জীববিজ্ঞানের ভাষায় মিউটেশন বলে।তারপর অতি ধীর-মন্থর গতিতে বাগযন্ত্রটা পরিণত হয়। আজকের মত মানুষ কুশলী কারিগর হয়ে জন্মায়নি আদিতে। অপরিনত হস্তপদ, মস্তিষ্ক, দেহদেউল নিয়ে বুনোবাসী, শাখাবাসী প্রাইমেট পূর্বপুরুষ থেকে একদিন খানিক ভিন্ন হয়ে যাওয়া মানুষ দু’পায়ে ভর করে দাঁড়াতে পারতো কেবল। বৃক্ষশাখের বাসর ছেড়ে শাপদসংকুল তৃণভূমে যুগ-যুগান্তর লক্ষযোজন বৈরী পথ পাড়ি দিতে হয়েছে এভাবেই। চকমকি পাথর ঘষেঘষে হাজার হাজার বছর বানিয়েছে কুঠার, বল্লম। বংশপরম্পরায় ক্রমাগত চেষ্টার ফলে একদিন তার হাতের আঙ্গুলগুলো যাদুর কাঠি হয়ে যায়, ক্ষিপ্র ও নিপুন। সেই আঙ্গুলের মহিমায় বানিয়ে নেয় টানটান ধনুকের ছিলা,আর তাতে বসায় বিষ্ণুচক্রের মত তূণ নামের কালজয়ী অস্ত্রটি। শিকার করে অতিকায় ম্যামথ, বন্য বরাহ। আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে যে, জীবের বিবর্তন একটি বিক্ষিপ্ত প্রক্রিয়া। খালি চোখে তা দেখা যায়না, ছোঁয়া যায়না। এই প্রক্রিয়া এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে জীবের বৈশিষ্টের পরিবর্তন ঘটে।সেটা উন্নতি আথবা অবনতি অথবা নিরপেক্ষ হতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্যান্সার নামের যে মিউটেশন জীবের দেহে ঘটে তা অকালমৃত্যু ঘটিয়ে দেয়। অনেক সময় মিউটেশন নিরপেক্ষও হতে পারে।  জীবের জীবকোষ এক আজব কারখানা। মানুষ সেই গোপন কারখানার অনেকখানি বিজ্ঞানের কল্যাণে জানতে পেরেছে। যেসব ক্ষমতার কারনে মানুষ এখন বিশ্বপ্রকৃতি শাসন করছে তা হল এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা চারিয়ে দিতে পারা। মানুষ তার চারটি আঙ্গুলকে বৃদ্ধাঙ্গুলের বিপরীতে বাঁকাতে পারে যার ফলে হাতিয়ার বানানো বা ব্যবহার সহজতর হয়েছিল মানুষের জন্য। এরকম করে কিছুকিছু মিউটেশন মানুষকে পশুর স্তর থেকে উন্নত স্তরে পৌঁছে দেয়, যার সময়সীমা হাজার অথবা লক্ষ বছর পরিধি। নরবানরের দেহখাঁচা থেকে উত্তীর্ণ হোমোবর্গভূক্ত প্রাণীগুলো ৭০লক্ষ বছর আগেই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে।এই সময়ের পরিসীমায় হোমো-গনভূক্ত অনেকগুলো প্রজাতির উদ্ভব হতে দেখা যায়। হোমো-হেবিলিস, হোমো-ইরেক্টাস, হোমো-ফ্লুরোরেন্সিস, হোমো-নিয়ান্ডার্তাল প্রভৃতি। এছাড়া নতুন নতুন হোমোবর্গের ফসিল আজও আবিষ্কার হচ্ছে। সম্প্রতি জীবাষ্মবিজ্ঞানীরা সনাক্ত করেছেন সম্পূর্ণ অজানা হোমোবর্গের এক মানবকন্যার করোটির দু’টি ছোট্ট টুকরো, পরিক্ষা-নিরিক্ষা করে বিজ্ঞানীরা এই প্রজাতিকে নাম দিয়েছেন ডেনিসোবান। শুধু তাই নয়, হিমালয় ফুটহিলের কিছু জনজাতির জীনে এই প্রজাতির ডিএনএ-এর মিল পাওয়া গেছে বলেও চাঞ্চল্যকর খবর জানা গেছে। মিলেনেশিয়ান দীপের প্রগাঢ় নীলাক্ষী কালো মানুষের ডিএনএ-তে সম্পূর্ণ অজানা বা নাম নাজানা হোমোবর্গের ডিএনএ-বাহিত হবার সংবাদ জীববিদ্যা-গবেষণাপত্রের বরাত দিয়ে প্রচারিত হয়েছে। মানুষের আপন দেহভান্ডের সোনার খনিটার মধ্যে যে সাধারণ স্বরযন্ত্রটা,সেটাতে মিউটেশন নামের যে মহার্ঘ যোগ হয় ছয়লক্ষ বছর আগে সেই বাগযন্ত্রটা খনন করতে করতে শব্দ উৎপাদন করে সেইসব শব্দের অর্থ ও ক্রিয়ার ধারণা কল্পনা করে মানুষ একদিন শিখে যায় ভাষার শক্তি। পদেপদে বিঘ্নসংকুল প্রকৃতির কোলে অসহায় সেই মানুষের দল অর্থহীন স্বর-প্রক্ষেপণ করে ও শরীরের ভঙ্গীমা দিয়ে নানা কায়দা কসরত করে একে অপরের সাথে মনের বাঞ্চা প্রকাশ করত আদিতে। এযুগের বিজ্ঞানীরা জীবাষ্ম পরীক্ষা করে রায় দিয়েছেন যে,আমরা হোমোসেপিয়ানদের আগের প্রজাতি নিয়ান্ডার্থাল মানবদের চোয়াল বা থুতনি কথা বলার জন্য যথেষ্ট উন্নত ছিলনা। অল্পবিস্তর শব্দযোগে তারা মূলত মনের ভাব অন্যকে বোঝাতো আকারে-ইঙ্গিতে,হাত নেড়ে,দেহ ঝাকিয়ে।আজকের আধুনিক মানুষেরা আমরা কি কেবল নিস্তরঙ্গ কথা বলে যাই শুধু?মোটেও না। কথার সাথে নিজের অজান্তেই যোগ করি চোখের ইশারা, হাতের সরস ইঙ্গিত, পুরো দেহের চাঞ্চল্য যোগ করি শ্রোতার মনোযোগ কাড়তে।ভাব প্রকাশ কেবল শব্দের জাল বুনেই নয়, দেহ-ভঙ্গিমারও শিল্পিত প্রকাশ দিয়ে। আপন দেহ-দেউলে যে নির্বাক ভাষার প্রকাশ তা আজও আমরা ধরে রেখেছি আদ্যিকালের স্মৃতি মাখিয়ে। মূখাভিনয়, দেহাভিনয়কে শিল্পের নাম দিয়ে আমরা আমাদের সংস্কৃতির যাদুঘরে ঠাঁই দিয়েছি। আসলে সেসব আমাদেরই অস্তিত্বের স্মৃতি।জমকালো মঞ্চে,সিনে-পর্দায় সংলাপ আওড়ানোর জন্য ডাক পড়ে তুখোড় অভিনয়-শিল্পীর। স্বরযন্ত্রে নিখুঁত ধ্বনি সৃষ্টির পাশাপাশি দেহ-সঙ্কেত ঢেলে সরস প্রকাশের নাম অভিনয়কলা। তা না-হলে আমিও মঞ্চ দাপাতে পারতাম,সাজুগুজু করে ক্যামেরায় দাঁড়িয়ে নগদনারায়ণ কামাতে পারতাম। কাড়িকাড়ি টাকা পায়ে ছুঁড়ে অমিতাভ বচ্চন, ওমপুরি, হুমায়ুন ফরিদীর মত আমারও কদর করতো প্রডিউসাররা। তাই বলে আমি ও আপনি কি কেবল নিরস কতক বানানো শব্দ আওড়াই কথা বলতে?না, তা নয় কিন্তু। আপনি আমি সকলেই কন্ঠভাষার সাথে যোগ করি দেহভাষার সেই প্রাচীন কসরতটিও। আমরা নিজের অজান্তেই যোগ করি।নির্বাক এই ভাষাটি আমরা আমাদের আদি-অনাদি জীনের মাধ্যমেই বহন করছি বলেই মনে হয়। দেহাভিনয়ের এই অনুসঙ্গটা কন্ঠধ্বনির সঙ্গ নাদিলে আমাদের ভাষা হত মরা নদীর টাঙনের মত কোলাহলহীন। কবিতা আবৃত্তি করার সময় আমরা বিশেষ বিশেষ শব্দের আর্ত-অভিঘাত ফুটিয়ে তুলি চোখের তারায়। একে আমরা চোখের ভাষা বলতে পারি। মূখ ও জন্মবধির মানুষের সাথে কথা বলার জন্য সাইন-ল্যাংগুয়েজ সৃষ্টি করা হয়েছে যাদিয়ে এদের সাথে দিব্যি কথা বলা যাচ্ছে আজ। কিন্তু ভাষা বলতে আজ আমরা যা বুঝি তা হচ্ছে,কন্ঠযন্ত্রে একেকটা শব্দ উৎপাদন করা আর সেই শব্দযোগে একেকটা বিশেষ ধারণার বাহক বানিয়ে ফেলাতে। তা নাহলে মানুষের গলার স্বর ইতরজাত পশুর চিৎকারের মতই অর্থহীন হত। ‘মানুষের বুদ্ধিমত্তার অন্যতম প্রমাণ হল ভাষা- ধ্বনি বা শব্দ থেকে নির্দিষ্ট ব্যাকরণ সন্মতভাবে বাক্য গঠন করা। জীবজগতে অনেক প্রাণীও বিভিন্ন ধ্বনি ব্যবহার করে, কিন্তু ব্যাকরণ ব্যবহার করার নির্দশন অনন্য। শিম্পাঞ্জীরা প্রায় বারো ধরণের ধ্বনি ব্যবহার করে তথ্য আদানপ্রদানের জন্য-প্রতিটি ধ্বনি আবার বিভিন্ন প্রাবল্যে উচ্চারণ করে তাদের অনুভূতিও জানিয়ে দেয়। মানুষও মাত্র ত্রিশ-চল্লিশটি বিভিন্ন মৌলিক ধ্বনি ব্যবহার করেই ভাষা গঠন করেছে। কিন্তু মানুষ একই ধ্বনি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করতে পারে, এভাবে সে তার ভাষার পরিধি বিস্তৃত করেছে’। মানুষ এমন উদ্ভাবনী ক্ষমতা কোথা থেকে পেল?বা মানুষের বুদ্ধির রহস্যটা কি? বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের মস্তিষ্কের অনন্য বৈশিষ্টের কথা।আর তা হচ্ছে, মস্তিষ্ককোঠরে ভাজ হয়ে থাকা সেরিব্রাল করটেক্স। নিকটতম প্রাণীদের চেয়ে মানুষের মস্তিষ্কে সেরিব্রাল করটেক্স অনেক অনেক বিস্তৃত। এই অনন্য বৈশিষ্টটি মানুষকে বসিয়েছে জীবজগতের চালকের আসনে। বেঁছে থাকার ক্রমাগত প্রণোদনা তিলতিল  বিবর্তনের বাঁকে বাঁকে মানুষকে করেছে আজ উন্নত শির। হাজার, লক্ষ বছরে ধীর-মন্থরলয়ে বিকশিত এই মস্তিষ্কজাত চিন্তার তোলপাড় শব্দের বাহনে অপরের কাছে পৌঁছে দেবার প্রবল ইচ্ছাশক্তি মানুষের ভাষা সৃষ্টিতে নিয়ামক হয়েছে। মানুষের মস্তিষ্কের উন্নতির সাথে আত্মপ্রকাশের চিন্তা ও কন্ঠের অপূর্ব মিতষ্ক্রীয়া এই ভাষা। গলায় বিশেষ বিশেষ শব্দ উৎপাদন করে, দেহের ভঙ্গীমার সাহায্যে একে অপরের সাথে যোগাযোগ সৃষ্টি করতে থাকে আদি মানবেরা। কিন্তু রাতারাতি মানুষের আয়ত্তে চলে আসেনি বিরূপ প্রকৃতি ও জীবনজয়ের অপার শক্তিময় ভাষা নামের এই শ্রেষ্ঠ হাতিয়ারটি।বিবর্তনের ধারায় মানুষের রত্নগর্ভা শ্রেষ্ঠ অর্জন সে তো ভাষা ছাড়া আর কিছু নয়। বানরসদৃশ্য বন্যজীবের থেকে জীববিবর্তনের ধারাশ্রোতে মানুষ তার কন্ঠের শব্দশুদ্ধিতে আজ নিচ্ছে জীবিনদায়ী ভাষার আস্বাদ। 

    দুর্নিবার হোমোসেপিয়ান আমরা, কমসে কম শত্তুরহাজার বছর পূর্বে দ্বিতীয়বার আদি ভিটামাটি ছেড়ে আসি কোন সে অজানার নেশায় বা খাদ্যান্বেষণের তাগিদে। খড়বিচালির জলযান বা পাথরের কুড়ুল দিয়ে বৃক্ষ খোদাই করে বানিয়েছি তালডিঙ্গি; আর তাই দিয়েই গিরিনদীতে ঝাপিয়ে পড়েছি, পাড়ি দিয়েছি উর্মিমূখর ভয়াল সমুদ্র। যেখানেই গিয়েছি সঙ্গে কিছু নিতে পারিনি। নিয়েছি কেবল মমতাময়ী মায়ের মত ভাষাটা সাথি করে। পেছনে পড়ে আছে সেই কামোটকুম্ভির-অধ্যুষিত ‘অমো’ নামের নদীটির অববাহিকায় ‘কিবিস’ ও অন্যঅন্য নামের গ্রামগুচ্ছ।হ্যাঁ,আদি মানবের বাস্তু এটি। জীবাষ্মবিজ্ঞানীরা এই অবাক তথ্যটা গবেষণা করে বের করেছেন। এখানেই আবিষ্কৃত হয়েছে আধুনিক হোমসেপিয়ান মানুষের প্রায় দুইলক্ষ বছরের আদিমতম ফসিলটি। আফ্রিকার গ্রেট-রিফট ভ্যালীর ইথিওপিয়া, অমো নদীর উপত্যকা। ছোট বড় শৈলশ্রেণীতে ঘেরা কিবিস ও অপরাপর জনবসতিগুলো। আদিম আদলের পর্ণকুটিরের সারি যেন সেই আদি মানবভিটার জানান দিচ্ছে আজও। এখনও সেখানে বাস করে অসংস্কৃত আদিম মানুষের দল। মুরসি, তুর্কানা,সুরমা ইত্যাকার নৃজাতি। ভয়ঙ্কর সুন্দর ও সরল মুরসিরা সম্পূর্ণ দিগম্বর হয়ে দলবেঁধে লাটিখেলার উৎসব করে। হিংস্র খেলা। দশফুটেরও অধিক লম্বা বংশীদন্ড দিয়ে একে অপরকে বেধড়ক পেটাতে থাকে নৃত্যছন্দে। শরীর বেয়ে খুন ঝরে কিন্তু লাঠির প্রক্ষেপণ থামতে চায়না। ইউ-টিউবে এদের লাঠিখেলা দেখে আমার মনে পড়ে যায় ছোটবেলা নানা পার্বণে দেখা লাঠিবাজদের লাঠিখেলার দৃশ্য। আমাদের লাঠিখেলুড়েরা প্রতীকী লাঠিখেলা দেখিয়ে থাকেন। কিন্তু ইথিওপিয়ার মুরসিরা খে্লে এখনও প্রাগৈতিহাসিক ভয়ঙ্কর খেলা।তাহলে কি লাঠিখেলাটা মানুষের জেনেটিক রেলগাড়িতে চড়ে ভুবনময় ছড়িয়ে পড়েছিল? নাহলে সেই লাঠি সেই ছন্দ-কেউ খেলে মরনপণ আর কেউ খেলে প্রতীকী। জেনেটিক রেলগাড়িতে চড়ে ভাষাও একদিন ভুবনজয়ে বেরিয়ে পড়ে মানুষের নিত্যসঙ্গী হয়ে। মানুষ যেমন বদলালো ভাষাও বদলে গেল স্থানকালে। মানুষের মতই ভাষারও হল নতুন নতুন সন্তানাদি, নাতিপুতি। আদিতে মানুষ ছিল এক, ভাষাও। আজকের বিজ্ঞান-জীনতত্ত্ব, জীবাষ্মতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব সে কথাই বলছে। ধর্মগ্রন্থগুলোও কাড়িকাড়ি মিথ্যে কথার মহাজাল বিস্তার করলেও কিছুকিছু তথ্য দিয়েছে মীথবাহিত ইতিহাসের স্মৃতি থেকে। মানুষকে শৃঙ্খলিত করার চেষ্টা করেছে ধর্মগুলো ভাষা দিয়েই মুক্তির মুলো ঝুলিয়ে। বলেছে মহামুক্তি ঘটবে তোমার, নির্বাণ লাভ করবে, জাতিস্বর হবে, প্রজাপতি জন্ম হবে তোমার। বলেছে, ওপারে তোমার জন্য ডাগরনয়না, চিরযৌবনারা আহাজারী করছে-সেখানে কাটাবে তুমি অনন্ত বসন্তের কাল। পাশ দিয়ে বয়ে যাবে দুধের নহর, শরাবনতহুরার ঝরণা, তোমার জন্যে বাঙলার কোকিল গান করবে গিয়ে মিশরদেশ-সদৃশ্য খর্জ্জুরবীথিতে বসে। কোনোদিন যদি আয়তনয়না দেখতেদেখতে বিষদৃশ মনে হয় তাহলে রয়েছে পানপাত্র হাতে স্ফটিকস্বচ্ছ বালকের দল। বেহেস্তের হুরীরা গাইবে আরবি লবজে সুমধুর গান। ধর্ম বলেছে তোমার জন্যে দিলাম স্বর্গের ভাষা।মানুষ এসব শুনে বেতসলতার মত আবেগে আর কৃতজ্ঞতায় হয়েছে প্রণত। তাহলে স্বর্গের ভাষা কোনটি-হিব্রু, আরবি, সংস্কৃত? জার্মানদের দাবী ছিল, স্বর্গের ভাষা আদতে জার্মান ভাষা। মুসলমানদের দাবী আরবি, সনাতনীরা বলে সংস্কৃত, ইহুদিরা নিশ্চিত জানে স্বর্গের ভাষা হিব্রু। প্রাচীনকালের লেখাপড়া না-জানা ভূমিপুত্রের দল পৃথিবীর পাঠশালা থেকেই প্রাণবৈচিত্র্য আর বিবর্তনের মহিমা জেনে যায়। কৃত্তিম নির্বাচনের মাধ্যমে তারা হরেক ফসলের নতুন নতুন উচ্চফলনশীল ও উন্নত জাত বা বংশের উদ্ভব ঘটায়, গৃহপালিত ছাগল, গরু, মোষ, ঘোড়া, মোরগ, ভেড়া, বনেলা হাঁস, কবুতর, মরুচারী উট প্রভৃতি পশুগুলোর উন্নত জাতের বংশবিস্তার করে বিচিত্র গৃহপালিত পশুর মেলা বসিয়ে দেয় তারা। ফসিল গবেষকরা ৩০হাজার বছর আগেই গুহাবাসী বন্য মানুষেরা বনের শৃগাল ও উল্ফকে পোষতে শুরু করে বলে উল্লেখ করেছেন। আজ নানা বর্ণ ও নানা জাতের কুকুরের বিচিত্র মেলা মানুষেরাই সাধন করেছে। এইসব কৃষাণ ও পশুচরানো আদিম মানুষেরা কেউ ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনতত্ত্ব পড়েনি,প্রজাতির উৎপত্তি নিয়ে কোনো গ্রন্থ দেখেনি কোনোদিন। একবার মক্কাবিজয়ের পর ইসলামের নবী তায়েফ সফরে গিয়ে দেখলেন সেখানকার খেজুরচাষীরা কৃত্তিম পরাগায়ণ করছে তাদের খর্জ্জূরবীথিতে। তাঁর কাছে মনে হল,এটা করবে মৌমাছি বাতাস বা ভ্রমরের দল। তিনি এটা করতে বারন করে আসেন। পরের বছর দেখা গেল তায়েফের খেজুরচাষীর প্রতিনিধিরা অভিযোগ নিয়ে আসে যে,তারা পথে বসেছে, ফলন হয়নি মোটেই। নবী তাদেরকে রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে ভূর্তকি দিয়ে বিদায় করলেন আর বললেন, দেখ প্রিয় উম্মতেরা,আমি যখন ওহীর মাধ্যমে কথা বলি তখন মাবুদের পক্ষ থেকেই কথা বলি-এতে কোনো ভুল নাই, কিন্তু যখন নিজের থেকে কথা বলি তখন একজন সাধারণ মানুষের মতই বলি; অতএব তোমরা তোমাদের অভিজ্ঞতা দিয়েই খেজুর চাষ করতে থাকো। কথাটা উল্লেখ করলাম এজন্যে যে,প্রকৃতির পাঠশালায় শেখা বাস্তব জ্ঞানের থেকে বড় কিছু নাই।এই চাষারা পৃথিবীর আদি বিজ্ঞানি। নীলনদের অববাহিকায় যেদিন কৃষি সভ্যতার উদ্ভব হয়,ঠিক সেই সময়টাতেই মানুষ ভাষার সমূহ উন্নতি সাধন করে। কৃষি বিদ্যার হাত ধরেই ভাষার বিস্তার বলে সাম্প্রতিক ভাষা-গবেষকরা বলছেন।ভাষার উদ্ভব স্বর্গ থেকে আসা কোনো আষাঢ়ে গল্প বা গোলকধাঁধা নয়।মানুষের ভাষা নিয়ে ধর্মের ফতোয়াটা তাহলে জেনে নেয়া যাক। ‘সমস্ত পৃথিবীতে এক ভাষা ও একরূপ কথা ছিল। পরে লোকেরা পূর্বদিকে ভ্রমণ করিতে করিতে শিনিয়র দেশে এক সমস্থলী পাইয়া সেই স্থানে বসতি করিল; আর তারপর কহিল, আইস, আমরা ইস্টক নির্ম্মাণ করিয়া অগ্নিতে দগ্ধ করি; তাহাতে ইস্টক তাহাদের প্রস্তুত ও মেটিয়া তৈল চূণ হইল। পরে তাহারা কহিল, আইস, আমরা নিজেদের নিমিত্ত এক নগর ও গগনস্পর্শী উচ্চ গৃহ নির্ম্মাণ করিয়া নিজেদের নাম বিখ্যাত করি, পাছে সমস্ত ভূমন্ডলে ছিন্নভিন্ন হই। পরে মনুষ্য সন্তানেরা যে নগর ও উচ্চ গৃহ নির্ম্মাণ করিতেছিল, তাহা দেখিতে সদাপ্রভূ নামিয়া আসিলেন। আর সদাপ্রভূ কহিলেন, দেখ, তাহারা সকলে এক জাতি ও এক ভাষাবাদী, এখন এই কর্ম্মে প্রদত্ত হইল; ইহার পরে যেকিছু করিতে সঙ্কল্প করিবে, তাহা হইতে নিবারিত হইবেনা। আইস, আমরা নীচে গিয়া সেই স্থানে তাহাদের ভাষার ভেদ জন্মাই, যেন তাহারা একজন অন্যের ভাষা বুঝিতে না পারে। আর সদাপ্রভূ তথা হইতে সমস্ত ভূমন্ডলে তাহাদিগকে ছিন্নবিছিন্ন করিলেন, এবং তাহারা নগর পত্তন হইতে নিবৃত্ত হইল। এই জন্য সেই নগরের নাম বাবিল(ভেদ)থাকিল; কেননা সেইস্থানে সদাপ্রভূ সমস্ত পৃথিবীর ভাষার ভেদ জন্মাইয়াছিলেন, এবং তথা হইতে সদাপ্রভূ তাহাদিগকে সমস্ত ভূমন্ডলে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিয়াছিলেন।’ ভাষার উৎপত্তি নিয়ে আড়াই হাজার বছর ধরে বাহাস চলে আসছে। ‘ক্রাইস্টের জন্মের আগে থেকেই গ্রিক ও পুরোনো ভারতের দার্শনিকেরা ও ব্যাকরণবিদেরা ভাষার উৎপত্তি ও স্বভাব নিয়ে বিপুল তর্কবিতর্ক ক’রে এসেছেন। পুরোনো গ্রিসে একদল দার্শনিক মনে করতেন ভাষা প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক, তার উৎপত্তি হয়েছে কোনো অমোঘ বিধানের ফলে। আরেক দল মনে করতেন,ভাষা কোনো ঐশী উপহার নয়; তা সামাজিক প্রথামাত্র- মানুষ যেমন অন্যান্য প্রথা সৃষ্টি করেছে, তেমনি সৃষ্টি করেছে ভাষা প্রথাটি। প্লাতোর ক্রাতিলুস সংলাপে এ নিয়ে চমৎকার বিতর্ক রয়েছে; তবে শেষে সক্রেটিস সিদ্ধান্তে পৌঁচেছেন যে ভাষা প্রথামাত্র, কোনো ঐশী বিধানের ফল নয়।যদি ভাষা ঐশী হতো, তবে তার সবকিছু হতো সুসৃঙ্খল,তার ঘটতো না কোনো পরিবর্তন; কিন্তু ভাষায় বিসৃঙ্খলা অনেক, তার পরিবর্তন ঘটে চলছে হেরাক্লিতাসের নদীরই মতো। ভারতেও স্বভাববাদী ও প্রথাবাদীদের বিতর্ক হয়েছে। যেমন, কালিদাসের মতে বাক্য ও অর্থের সম্পর্ক হরগৌরীর সম্পর্কের মতো শাশ্বত; কিন্তু প্রথাবাদীরা দেখিয়েছেন ভাষার কোনো কিছুই শাশ্বত নয়। ধ্বনি বদলে যায়, শব্দের অর্থ বদলে যায়, বদলে যায় সব কিছু। তাই ভাষা মানুষেরই সৃষ্টি;ভাষা মানুষেরই একটি সামাজিক চুক্তি। আঠারো শতকের ইউরোপি দার্শনিকেরাও ভাষার উৎপত্তি অনুমানের পর অনুমান ক’রে চলেছেন। জন লক বিশ্বাস করতেন যে বিধাতা চেয়েছিলো মানুষ সমাজে বাস করবে, তাই তার ভাষার দরকার হবে; এজন্যে বিধাতাই মানুষকে ভাষা দান করে। লাইবনিৎসের ধারণা ছিলো এর বিপরীত। তার মতে, মানুষ নিজেকে অপরের কাছে প্রকাশ ও বোধগম্য করার বাসনা থেকেই বিকাশ ঘটায় ভাষার।

    মানুষ তার ভাষা নিয়ে মেঠোপথেই এগুতে শুরু করে একদিন। জানা যায়, সেই আদ্যিকালের তেত্রিশজন আদি মাতা বা ঠাকুর্মা রয়েছেন আমাদের। আদি জননী বা আব্রাহামিক ধর্মের ভাষায় আমরা তাদের ডাকতে পারি ঈভ নামে। আপনি আমি মর্দ অথবা নারী, কিবলিঙ্গ, উভলিঙ্গ সকলেই সেই আদি জননীদেরই কারও না কারও সন্তান। আপনার শরীরের একফোঁটা রক্তের ডিএনএ বলে দিতে পারে কোন সে জননীর বংশলতিকার প্রশাখা আপনি।                                            
চলবে.......


অটোয়া, কানাডা