রবীন্দ্রনাথের রাগাশ্রিত গান - ঝন্টু চন্দ্র ওঝা
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পরিণত বয়সে তাঁর গানের মধ্যে রাগরাগিণীর বিষয়কে তেমন গুরুত্ব দেননি। তবে গান রচনার প্রথমভাগে ভারতীয় ঐতিহ্যমণ্ডিত রাগাশ্রিত গানের প্রতি রবীন্দ্রনাথের যে দুর্বলতা ছিল তা তাঁর সুরারোপিত বিভিন্ন গানে লক্ষ্যণীয়। পরে পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে তাঁর নিজস্ব একটা অবকাঠামো তৈরী হয়েছে, যা তিনি নিজেও স্বীকার করে গেছেন। প্রথমত, তিনি বলেছেন স্বরলিপির বইগুলিতে রাগরাগিণীর নির্দেশ না থাকাই ভালো। দ্বিতীয়ত, তিনি স্বীকার করেছেন রাগরাগিণী ভুলতে ভুলতেই তিনি গান বাঁধতে পেরেছেন।
যে স্বরসমষ্টি শ্রবণ করলে মানুষের মনোরঞ্জন হয় সাধারণভাবে তাকেই ‘রাগ’ বলা হয়। ‘রাগ’- এর সাধারণ বর্ণনার সাথে সাথে বিভিন্ন পণ্ডিতগণ ‘স্বরবর্ণ - বিভূষিত ধ্বনিবিশেষ’ - এর কথা উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীতে রাগের বর্ণনার কথাই শুধু বলা হয়নি ‘জাতি’ লক্ষণ এর মত ‘রাগ’ লক্ষণগুলো সম্পর্কেও পরিস্কার ধারণা অর্জনের কথাও বলা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের রাগাশ্রিত গান নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেন অরুণ ভট্টাচার্য মহাশয়। এক পর্যায়ে ভট্টাচার্য মহাশয় রবীন্দ্রনাথের রাগাশ্রিত গানগুলিকে বিশ্লেষণ করে কিছু ধারণা বর্ণনা করেন। ‘রবীন্দ্রসংগীতে রাগ মিশ্রণের ইতিহাস‘ নামক প্রবন্ধে তিনি তাঁর এ সকল ধারণা ব্যক্ত করেনঃ
০১.রবীন্দ্রনাথ রাগ বিষয়টি নিয়ে যা ভেবেছেন তাতে রাগের আনন্দদায়িনী এবং রঞ্জনা করবার শক্তিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন এবং সেই সঙ্গেই স্বীকার করেছেন বিশেষ বিশেষ অনুভাব মানবের বিশেষ বিশেষ ভাবপ্রকাশেরই প্রতিরূপ সাংগীতিক স্বরসমাহারের একটি পদ্ধতি।
০২.রবীন্দ্রনাথ যখন কোনো গানে একাধিক রাগ মিশ্রণ করেছেন তখন বিশেষ বিশেষ রাগগুলিকে পৃথকভাবে বিশ্লিষ্ট না করে তাদের মিশ্রণগত একটা যৌগিক রূপ আমাদের সামনে যাতে ধরা দেয় তারই চেষ্টা করেছেন।
০৩.মিশ্রণ সম্বন্ধে রাগসংগীতের ব্যাকরণ যে কথা বলে রবীন্দ্রনাথ সে ব্যাকরণ মানেননি। সমপ্রকৃতিক রাগের মিলনকে যেমন স্বীকার করেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের রাগগুলির একত্র সমাহারের মূল্যও ততোধিক স্বীকার করেছেন। তাঁর সৃষ্টি নিবন্ধ ছিল সব সময়েই একটি “aesthetic effect’ এর দিকে।
০৪.এই তত্ত্বের প্রকাশ দেখি তাঁর অসংখ্য গানে যখন তিনি কবিতার মূলভাবকে আশ্রয় করেই সুর রচনা করেছেন। ভাবকে সুর যোজনার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। সম্ভবত সে কারণেই বলেছিলেন ভাব থেকে রূপে উত্তরণের প্রচেষ্টাই ছিল তাঁর সাংগীতিক আদর্শ।
০৫.এই মিশ্রণ ব্যাপারটির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে একটি নির্দিষ্ট ক্রম অনুযায়ী তা যেন সাজানো রয়েছে। প্রথম যুগে যখন শিক্ষানবিশীর কাল ছিল তখন অবিকৃতভাবেই রাগ-রাগিণীতে গান বেঁধেছেন। পরবর্তীকালে সেই সমস্ত রাগের স্বরগুলিকে কিছু কিছু পরিবর্তন করে দেখতে চেয়েছেন গানটি পরিবর্তিত রাগ রূপে কেমন শোনায়। এ পর্যন্ত তিনি সচেতন মনে এ সমস্ত প্রক্রিয়াগুলি লক্ষ্য করে চলেছিলেন। মধ্য ও শেষ জীবনে তিনি কিন্তু রাগগুলির মিশ্রণজনিত ‘effect’ এর ওপরেই সম্পূর্ণ নির্ভর করেছেন; এক একটি গানে একাধিক রাগমিশ্রণ ঘটলেও আমার ধারণায়, তা সচেতন মনে সবসময় হয় নি। তাঁর কাছে সুর সমাহারের একটি পূর্ণাঙ্গ চেহারা ‘integrated pattern’ ধরা পড়েছিল - সেই প্যাটার্নকে রূপ দিতে গিয়ে নানা রাগ-রাগিণী একই গানে এদিক-সেদিক থেকে এসে গিয়েছে।
০৬.ফলত, তাঁর এ সমস্ত গানে একাধিক রাগ মিশ্রণের ঘটনাটি বড়ো হয়ে দেখা দেয় নি বরং সুরের একটি বিশেষ ভাবরূপ তাঁর গানে গড়ে উঠেছে যে, ভাবরূপ, আমাদের নান্দনিক বিচারে, রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত অন্বিষ্ট ছিল।
০৭.শেষ বিচারে এমত বলা যায় যে, রাগমিশ্রণতজাত গানগুলি রাগ নামক অভিধানজাত সংজ্ঞাকে ছাড়িয়ে এক নতুন ‘melodic extension’ - এ পর্যবসিত হয়েছে, যখন আর রাগ-নির্দেশক সংজ্ঞা দ্বারা তাকে চিহ্নিত করবার প্রয়োজন হয় না। থাকে শুধু ‘গান’। রবীন্দ্রনাথ বোধহয় এ কথা গভীরভাবে হৃদয়ংগম করতে পেরেছিলেন বলেই দুটি জরুরী কথা আমাদের শুনিয়েছেন যে, রাগরাগিণী ভুলতে ভুলতেই তিনি গান বেঁধেছেন এবং গানের স্বরলিপিতে রাগরাগিণীর নির্দেশ না থাকাই ভালো। তিনি শুধু ছন্দের ক্ষেত্রে সংগীতের মুক্তি চাননি; চেয়েছিলেন সুরের দিক থেকেও। একটি রাগ রূপায়ণে যতই স্বাধীনতা থাক্ - একটি জায়গায় গিয়ে সেই বিশিষ্ট রাগের লক্ষণ মিলিয়ে তাকে প্রকাশ করতেই হয় - সেই লক্ষণগুলির মধ্য দিয়েই একটি বন্ধনের ইঙ্গিত থাকে। বন্ধন মোচনের জন্য কবি সুরের নির্দিষ্ট বন্ধনকেও স্বীকার করেন নি। এই প্রসঙ্গে তিনি এমন মন্তব্যও করেছেন যার অর্থ, তিনি রাগ সংগীতের রচয়িতা হতে চান নি, তিনি ‘গান’ অর্থাৎ কাব্যসংগীত রচনা করতেই চেয়েছেন, প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন কথা ও সুরের অর্ধনারীশ্বর রূপ, যেমন অদ্বৈত দেখি শরীর ও আত্মাকে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রৌঢ় বয়সে এসে তাঁর গানগুলিকে রাগরাগিণী থেকে অনেকটা মুক্তি দিয়েছিলেন। আবার কখনও কখনও তাঁর গান এক রাগ থেকে অন্য রাগে জায়গা পেয়েছে। ‘ঝরঝর বরিষে বারিধারা’ কিংবা ‘কোথা যে উধাও হল মোর প্রাণ উদাসী’ গান দু’টির সুর প্রয়োগে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট মুনশিয়ানার পরিচয় প্রদান করেছেন। আবার ইমন রাগে ‘হে মোর দেবতা’ কিংবা বেহাগ রাগে ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে’ গান দুটিতে আত্মনিবেদনের রূপ যেন ধীরে ধীরে ফুটে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ বহু গানের রাগ-রাগিণীর কতিপয় পরিবর্তন সাধন করে বাণীর অর্ন্তগত ভাবটি আরও উজ্জ্বল করতে চেয়েছেন। মিঞা-কি-মল্লার রাগে ‘কোথা যে উধাও হল মোর প্রাণ উদাসী’ গানটি বাঁধা থাকলেও রবীন্দ্রনাথ এখানে কোমল ধৈবতের ব্যবহার ঘটিয়েছেন একাধিকবার এবং তিনি এক্ষেত্রে অমৃতের মধ্যে যেন আরও নবরস দান করলেন অতি স্বচ্ছন্দে। শাস্ত্র উপেক্ষা করলেন বটে, তবে তিনি নতুন আরেকটি মাত্রা যোগ করে গানটিতে অনবদ্য রূপ দান করলেন। সংগীতপ্রেমীদের এ ধরনের প্রাপ্তি যেন অমরাবতীর সুধা সঞ্জীবনীর মতই।
হিন্দুস্তানী সংগীতে দশটি ঠাট প্রচলিত রয়েছে। এ গুলোর নাম - কল্যাণ, বিলাবল, কাফি, খাম্বাজ, ভৈরব, আশাবরী, টোড়ি, পূরবী, মারবা ও ভৈরবী। শুভ গুইঠাকুরতা এই দশটি ঠাটকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথের রাগাশ্রিত গানের একটি তালিকা তৈরী করেছেন। এক্ষেত্রে ঠাটের অন্তর্গত রাগে রচিত একটি করে গানের প্রথম লাইন উল্লেখ করা হলঃ
কল্যাণ ঠাটঃ
ইমন - সুন্দর বহে আনন্দ
ভূপালী - প্রচণ্ড গর্জনে আসিল
কামোদ - যতবার আলো জ্বালাতে চাই
কেদার - ডাকে বার বার ডাকে
হাম্বীর - আনন্দ রয়েছে জাগি
শ্যাম - নয়ান ভাসিল জলে
ছায়ানট - ভক্ত হৃদ্বিকাশ
গৌড় সারং - পেয়েছি সন্ধান তব
বিলাবল ঠাটঃ
আলাহিয়া - তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা
দেশকার - কামনা করি একান্তে
লচ্ছাসার - বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দ
কুকুভ - কোথায় তুমি আমি কোথায়
সরফর্দা - জগতে আনন্দ যজ্ঞে
দেবগিরি - দেবাদিদের মহাদেব
বেলাবলী - হে মন তাঁরে দেখ
বিহগড়া - মনে রয়ে গেল মনের কথা
শঙ্করাভরণ - বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে
বেহাগ - জাগে নাথ জোৎস্না রাতে
হেমখেম - সবে মিলি গাওরে
খম্ভার - নিত্য নব সত্য তব
বিভাস - আজি প্রণমি তোমারে চলিব নাথ
শঙ্করা - আমারে করো জীবনদান
কাফি ঠাটঃ
কাফি - মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
বাহার - আজি কমল মকুলদল খুলিল
বাগেশ্রী - নিশীথশয়নে ভেবে রাখি মনে
বড়হংসসারং - তাঁহারে আরতি করে
সাহানা - নিবিড় ঘন আঁধারে
সুহা কানাড়া - নাথ হে প্রেমপথে
বৃন্দাবনী সারং - জয় তব বিচিত্র আনন্দ
মেঘ - তিমিরময় নিবিড় নেশা
গৌড় মল্লার - আজি শ্রাবণঘন গহন মোহে
মিঞা মল্লার - ঝর ঝর বরিষে বারিধারা
নায়কী কানাড়া - সুধাসাগর তীরে
পিলু - এসেছি গো এসেছি
ভীমপলশ্রী - বিপুল তরঙ্গ রে
সিন্ধুড়া - জরজর প্রাণে নাথ
নটমল্লার - মোরে বারে বারে ফিরালে
সিন্ধু - প্রেমানন্দে রাখো পূর্ণ
গৌড় - হে নিখিল ভারধারণ
খাম্বাজ ঠাটঃ
খাম্বাজ - রূপসাগরে ডুব দিয়েছি
ঝিঁঝিট - তোমারি মধুর রূপে
সুরট - এ ভারতে রাখো আজি
সুরট মল্লার - দুয়ারে দাও মোরে রাখিয়া
দেশ - জাগ জাগরে জাগ সংগীত
জয়জয়ন্তী - জীবন যখন শুকায়ে যায়
তিলক কামোদ - শান্তি কর বরিষণ
ভৈরব ঠাটঃ
ভৈরব - শুভ্র আসনে বিরাজ
রামকেলি - আঁখিজল মুছাইলে জননী
যোগিয়া - নিশিদিন চাহো রে
কালাংড়া - ভালবাসিলে যদি
জিলফ - প্রেমের ফাঁদ পাতা
গুণকেলি - জননী তোমার করুণ চরণখানি
ললিতা গৌরী - হৃদয় নন্দন বনে
আশাবরী ঠাটঃ
আশাবরী - মনোমোহন গহন যামিনী শেষে
দরবারী কানাড়া - শুনি ঐ রুনু ঝুনু পায়ে
আড়ানা - মন্দিরে মম কে
খট - সদা থাক আনন্দে
কানাড়া - এবার নীরব করে
সিন্ধু ভৈরবী - যদি এ আমার হৃদয় দুয়ার
গান্ধারী - বিমল আনন্দে জাগোরে
টোড়ি ঠাটঃ
টোড়ি - রজনীর শেষ তারা
মুলতান - বুঝি বেলা বয়ে যায়
গুর্জরী টোড়ি - প্রভাতে বিমল আনন্দে
পূরবী ঠাটঃ
পূরবী - বীণা বাজাও হে
পরজ - ডাকো মোরে আজি এ নিশীথে
পরজ বসন্ত - গভীর রজনী নামিল হৃদয়ে
গৌড়-পূরবী - ঘাটে বসে আছি আনমনা
শ্রী - কার মিলন চাও বিরহী
মারবা ঠাটঃ
ললিত - পান্থ তখনো কেন
দীপক পঞ্চম - প্রথম আদি তব শক্তি
পূর্ব কল্যাণী - বাসন্তী হে ভুবনমোহিনী
ভৈরবী ঠাটঃ
ভৈরবী - আনন্দ তুমি স্বামী
মালকোষ - আনন্দধারা বহিছে ভুবনে
খট ভৈরবী - আমাদের যাত্রা হলো শুরু
নাচারী টোড়ি - নূতন প্রাণ দাও
দুই রাগের সমন্বয়ে রবীন্দ্রনাথ অনেক গানের সুর করেছেন। ললিত, কালাংড়া কিংবা যোগিয়া বিভাসের মিশ্রণ রীতিসিদ্ধ হলেও ‘আজি শরত তপনে’ কিংবা ‘পুষ্পবনে পুষ্প নাহি’ - এ ধরনের গানের প্রত্যেকটিতে রাগের মিশ্ররূপের পরিবর্তে যেন বেশী করে যৌগিক রূপই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একজন খেয়ালী যখন ভৈরব-বাহার রাগে সংগীত পরিবেশন করেন তখন শ্রোতার কাছে আরোহীতে ভৈরব এবং অবরোহীতে বাহার রাগের স্বরমালিকাই স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে, তখন যেন এই দুই রাগরূপের আরোহী-অবরোহী ভিন্ন অন্য কিছু কল্পনায় আসে না।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর অত্যন্ত সুনিপুণ সংগীত প্রতিভার গুণে আপন খেয়াল-খুশীমত রাগরাগিণীর টুকরো টুকরো আভা গানের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন। খুব অনায়াসেই তিনি একটি বিশেষ রাগকে অবলম্বন করে আরো নানান ধরনের রাগের আগমন ঘটাতে পারতেন। শাস্ত্রীয় মতে, এ রকম সৃষ্ট রাগকে বলা হয় ‘ছায়ালগ’ আর একাধিক রাগের মিশ্রণজনিত ফসল হিসেবে কোনো রাগকে ‘সংকীর্ণ’ বলা হয়। রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গানে এ রীতি লক্ষ্য করা যায়। ‘দুঃখরাতে হে নাথ, কে ডাকিলে’ গানটি সম্ভবত ১৩০৯ বঙ্গাব্দে রচিত; মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু উপলক্ষে এটি রচিত হতে পারে। এ গানে সরফর্দা রাগ চিহ্নিত। সরফর্দা বিলাবল অঙ্গের রাগ হলেও এক্ষেত্রে একাধিক বার তীব্র মধ্যমের ব্যবহারে বিলাবলের স্বাতন্ত্র্য পুরোপুরি রক্ষিত হয়নি। এ ছাড়া গানটিতে স্থায়ী অংশের দ্বিতীয় চরণে ‘জাগি হেরিনু’ ইত্যাদিতে কেদার রাগের লক্ষণ স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। এ কারণেই গানটি দারুণভাবে রসসিক্ত হয়েছে এবং বিলাবল, ইমন ও কেদার রাগের ভাবরূপ একটি সুসংগত ঐক্যে এসে মিলিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গানে দেখা যায় সুর একই রকম থাকলেও তাল ভিন্ন ভিন্ন। এ রকম কিছু গান, যেমনঃ
(১) পূর্ণ চাঁদের মায়ায় - দাদরা ও কার্ফা
(২) জীবনে যত পূজা - তেওরা ও রূপকড়া
(৩) বিনা সাজে সাজি - দাদরা ও ষষ্ঠী
(৪) যেতে যেতে একলা পথে - ঝম্পক ও দাদরা
(৫) হেরি অহরহ তোমারি বিরহ - একতাল ও চৌতাল
(৬) যে কাঁদনে হিয়া কাঁদিছে - নবতাল ও একতাল
রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের ভিন্ন ভিন্ন স্তবকে ভিন্ন ভিন্ন তাল ব্যবহার করে বৈচিত্র্য এনেছেন। এ ধরনের গান ফেরতা তালে গাওয়া হয়। যেমনঃ -
(১) আজি শুভদিনে পিতার ভবনে
(২) ঐ আসে ঐ অতি
(৩) নৃত্যের তালে তালে
(৪) শুধু যাওয়া আসা
(৫) কালী কালী বলরে আজ
(৬) প্রভাত হইল নিশি
রবীন্দ্রনাথের কিছু লয় ফেরতা গান আছে। এসব গানের মধ্যে একই তালের ব্যবহার থাকলেও ভিন্ন ভিন্ন কলিতে ভিন্ন ভিন্ন লয় পরিলক্ষিত হয়। এমন কিছু গান, যেমনঃ -
(১) মরণ রে তুহুঁ মম শ্যাম সমান
(২) বঁধূ কোন আলো লাগল চোখে
(৩) আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায়
(৪) এস এস বসন্ত ধরা তলে
রবীন্দ্রনাথ প্রথম জীবনে রাগ-রাগিণীর আদলে গান রচনায় ব্রতী হলেও, শেষ জীবনে গিয়ে তিনি সে গণ্ডী ক্রমশই ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছেন স্বেচ্ছায়। কবিগুরু তাঁর সৃষ্ট গানে অসংখ্য রাগ-রাগিণীর ব্যবহার ও মিশ্রণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে এমন এক শীর্ষস্তরে পৌঁছেছিলেন যেখানে অন্যদের আরোহণ করা প্রায় সাধ্যাতীত বলেই মনে হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও তাঁর অমিয় সংগীত নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে যে গ্রন্থসমূহ আমার লেখাগুলোকে সমৃদ্ধ করেছে, সেই সহায়ক গ্রন্থসমূহের নাম এখানে উল্লেখ করা হলঃ
সহায়ক গ্রন্থাবলীঃ
০১.সুচিত্রা মিত্র ও সুভাষ চৌধুরী সম্পাদিত রবীন্দ্রসংগীতায়ন- ১, সেপ্টেম্বর ১৯৮২, প্যাপিরাস, কলিকাতা
০২.করুণাময় গোস্বামী, রবীন্দ্র সংগীত পরিক্রমা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ফেব্রুয়ারী ১৯৯৩
০৩.অরুণ ভট্টাচার্য, সংগীত চিন্তা, কলকাতা, সংগীত পরিষদ, ১৯৬৬
০৪.রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সংগীত চিন্তা, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলিকাতা, বৈশাখ ১৩৭৩
০৫.কে. এম. লিয়াকত আলী, সংগীত শিক্ষার সহজ পাঠ, সূচয়নী পাবলিশার্স, ১৯৯৭
০৬.সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রথম আলো, প্রথম পর্ব, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৯৬
০৭.কামাল উদ্দিন হোসেন, রবীন্দ্রনাথ ও মোগল সংস্কৃতি, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৯৮
০৮.শঙ্খ ঘোষ, কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক, ১৯৭৮
০৯.রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গীতবিতান (অখণ্ড), নওরোজ সাহিত্য সংসদ, ঢাকা, ১৯৯৫
১০.সুবিনয় রায়, রবীন্দ্র সংগীত সাধনা, কলিকাতা, ১৩৬৯
১১.শান্তিদেব ঘোষ, রবীন্দ্রসংগীত বিচিত্রা, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৯৩
১২.ওয়াহিদুল হক, চেতনা ধারায় এসো, মুক্তধারা, ঢাকা, ১৯৮৫
১৩.মৈত্রেয়ী দেবী, রবীন্দ্রনাথ গৃহে ও বিশ্বে
১৪.আবদুশ শাকুর, সঙ্গীত সংবিৎ, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ১৯৯৭
১৫. শৈলজারঞ্জন মজুমদার, রবীন্দ্রসংগীত প্রসঙ্গ, ছায়ানট, ঢাকা, ১৯৭৬
১৬.ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী, রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতন, মুক্তধারা, জুন ১৯৮১
১৭.মোবাশ্বের আলী, শিল্পীর ভূবন, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৫
১৮.সন্জীদা খাতুন, রবীন্দ্রনাথঃ বিবিধ সন্ধান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, জুন ১৯৯৪
১৯.ম ন মুস্তাফা, আমাদের সঙ্গীত ইতিহাসের আলোকে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ঢাকা ১৯৮১
২০.হায়াৎ মামুদ, রবীন্দ্রনাথ, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, ১৯৭৩
২১.রবীন্দ্র সমীক্ষণ, রবীন্দ্র পরিষদ, পাটনা, ১৩৭৯
২২.রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও বাঙলাদেশ, সম্পাদনা - রঘুবীর চক্রবর্তী
২৩.আ. ন. ম. বজলুর রশীদ, জীবনবাদী রবীন্দ্রনাথ, ঢাকা, ১৯৭২
২৪.রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী, রবীন্দ্র তরুমূলে, ১৯৮৮
২৫.গোবিন্দ চন্দ্র মণ্ডল, রবীন্দ্রসংগীতমানস, কলকাতা, প্যাপিরাস, ১৯৯১
২৬.সন্জীদা খাতুন, রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ, মুক্তধারা, ১৯৮১
ঝন্টু চন্দ্র ওঝা
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
ঢাকা, বাংলাদেশ।
-
নিবন্ধ // মতামত
-
22-01-2021
-
-