অটোয়া, শুক্রবার ২৯ মার্চ, ২০২৪
বঙ্গবন্ধু ও একটি উপলব্ধি - ড. এস এ মুতাকাব্বির মাসুদ

. জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির মুক্তির দ্যোতক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির কল্যাণে উদ্দীপিত ও নিবেদিত প্রাণপুরুষ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। খণ্ডে খণ্ডে সাজানো বিভাবিত অপেক্ষার প্রহর আজ হয়ে ওঠেছে শতবর্ষের প্রত্যাশিত দ্যোতিত দীপাবলি। তারই আলোয় আলোকিত এ জনপদ। যাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম- নেতৃত্ব আর আত্মত্যাগে মুক্তির মুকুট ওঠেছিল জাতির অবিন্যস্ত মস্তকে। তিনিইতো বাঙালির অহংকারের প্রদীপ ! তাঁর নিষ্ঠা, মেধাবী আর দ্রোহের নেতৃত্ব কিংবা কালজয়ী ঐতিাসিক সাত-ই মার্চের আগুনঝরা মহাকাব্যের অনলে পোড়া বিশ্বখ্যাত সুরধ্বনি আমাদের দিয়েছিল টিকে থেকে বেঁচে থাকার অমোঘ মন্ত্র। শোষকের বিরুদ্ধে, শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবার প্রেরণা। সাতচল্লিশ উত্তর দীর্ঘ এক প্রলম্বিত ধারায় শোষিত ও নির্যাতিত এ জনপদ ও জনপদের নির্যাতিত- নিপিড়ীত মানুষের রিক্ত হাহাকার আর বঞ্চনার ইতিহাস দ্রোহের আবরণে উচ্চকণ্ঠে তুলে দিয়ে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন- স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন একটি 'নতুন স্বপ্ন' যেখানে বাঙালির নিজস্ব আকাশ, নিজস্ব ভূখণ্ড, তার মাঝখানে স্বাধীন মুক্ত বাতাসে লাল-সবুজের অতি আরাধ্য একটি পতাকা পতপত করে ওড়বে! এমন স্বপ্নের মুক্ত আকাশে বাঙালি তার ঘুড্ডি ওড়াবে-এটি একমাত্র কোনো এক স্বপ্নদ্রষ্টাই কল্প থেকে বাস্তবে নিয়ে আসার ঐতিহাসিক দীপ্তোজ্জ্বল- দৃপ্ত পথে এ জাতিকে স্বাধীনতার উজ্জ্বল ছায়াতলে সন্নিবেশ ঘটাতে সমর্থ হয়েছিলেন। সুতরাং তিনিই-তো স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা,স্বাধীনতার রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটা আমার উপলব্ধি।

২. যাঁর জীবনের ব্যাপ্তি ছিল জাীবন কিংবা সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় কষ্ট-নির্যাতন আর নিপীড়নে সাজানো উদ্ভাসিত আলোর মশাল। সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন, বায়ান্ন থেকে ছেষট্টি ও ঊনসত্তর এরপর সত্তরের নির্বাচন ; ঐতিহাসিক সেই নির্বাচনে তাঁর নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অতঃপর বঞ্চনা আবারো ঘাত-অভিঘাতের ভেতরে নির্যাতনের কালো ইতিহাস, পঁচিশটি বছরের শোষণ আর নির্যাতনের- কঠিন যন্ত্রণার ইতিহাস! এরই ধারাবাহিকতায় একাত্তরে স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং দীর্ঘ নয়মাস পরে স্বপ্নের সেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ! যাঁর হাত ধরে এসেছিল তিনি অভীক - আত্মত্যাগী সংশপ্তক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই একজন বঙ্গবন্ধুকে চিনতে কিংবা জানতে ; অনুকরণ কিংবা অনুসরণ করতে ইতিহাসের সাথেসাথে তাঁর নিজের লেখা "অসমাপ্ত আত্মজীবনী" পর্যবেক্ষণে নিলেই যথেষ্ট বলে আমি মনে করি। এমন নেতা হাজার বছরেও পৃথিবীতে আসেনা। বিশ্বের বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিলেও বঙ্গবন্ধু যে বাঙালি জাতির একজন অনিবার্য নেতা তার উল্লেখ রয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধু শুধু স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টাই নন একজন মহান নেতা। এ প্রসঙ্গে 'ডেইলি স্টার'এ উদ্ধৃত হয়েছিল- "Since colonial times, the world has witnessed a number of revolutions and movements that brought enormous change in the social and political dynamics of the world and above all,in the life of common people. These revolutions realities of their time. Bangladesh's independence struggle was revolution that had been in the making for roughly 25 years, starting after the partition of greater India in 1947 which led to the creation of pakistan split into two wings ( east and west). For 25 years, the people of the east wings suffered, without much hope, until they stood up and fought their independence in 1971 under the leadership of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman. Without any doubt, Sheikh Mujibur Rahman is the architect of Bangladesh, the Father of the Nation." জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষে আমরা আজ তাঁরই স্বপ্নের সোনার বাংলায়-তাঁরই নির্দেশিত পথেই হাঁটছি।

৩. বস্তুত বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশ এবং স্বাধীনতা সমার্থক। তিনি বাঙালি জাতির জনক। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের দীপ্ত চেতনা বিকাশের মহান স্থপতি এবং স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর জীবনাদর্শের মূল লক্ষ্য ছিল শোসিতের গণতন্ত্র ও একটি বিশুদ্ধ মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা।

৪. এই অবিসংবাদিত নেতার রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত ত্যাগের কাহিনী সমকালীন বৈশ্বিক রাজনীতির প্রতর্ক্য বিবেচনায় রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক প্রলম্বিত ধারায় সর্বোচ্চ বন্ধুরপথটি-ই তাঁকে একজন নিবেদিত নিষ্ঠাবান নেতার মতোই পাড়ি দিতে হয়েছে।যা এ প্রজন্ম হয়তো জানেই না। কেনো তিনি বঙ্গবন্ধু? কেন তিনি অবিসংবাদিত নেতা? কেন তিনি জাতির পিতা? কেন তিনি স্বাধীনতার স্থপতি? কেন তিনি একটি স্বাধীন সোনার বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা ? এতগুলো প্রশ্নের যোগফল ইতিহাস অশ্রু জলে- সোনার অক্ষরে লিপিবদ্ধ করে রেখেছে। অন্যদিকে তাঁর নিজের কণ্ঠ ও কলমে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বস্তুনিষ্ঠ সংগ্রামী পথ পরিক্রমার ধারাবর্ণনা দ্রোহের চেতনায় তাঁর সংশপ্তক রাজনৈতিক জীবন ও আপোষহীন সংগ্রামের করুণ ইতিহাস-অভিপ্রায় জেলের নিঃসঙ্গ ১৪ফিট দেয়ালের বন্দিজীবনে প্রজ্ঞার আলোয় তুলে ধরেছেন তাঁরই লেখা কালজয়ী " অসমাপ্ত আত্মজীবনী" গ্রন্থে। এটি পর্যবেক্ষণে নিলেই উপরে উদ্ধৃত সবকটি প্রশ্নের উত্তর পেতে কষ্ট হবে না। তার আগে তাঁর জীবনের করুণ অধ্যায়ের চুম্বকাংশ তুলে ধরার প্রয়াস অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলে মনে করি। দীর্ঘ ২৫ বছর জাতীয় আবমাননা এবং প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানী শাসক চক্রের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সুসংগঠিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের পর বাঙালি জাতির অকুতোভয় মুক্তির দ্যোতক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাঙালি জাতি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে এ দেশ স্বাধীন করেছিলো। এক কঠিন জীবন বাস্তবতায় শোষিত বাঙালি তাঁরই নেতৃত্বে ও সময়োপযোগী প্রাজ্ঞ নির্দেশনায় নিজেকে ও দেশকে নির্যাতন - নিপীড়নের হাত থেকে মুক্ত করার শপথ নিয়েছিল ; আর তারই উদ্দীপিত আলোর দৃশ্যমান ছায়াটি সাতকোটি জনতার চোখেই প্রতিবিম্বিত হয়েছিল এবং এক অন্যরকম স্বপ্নের ঘুড়ি স্বদেশের মুক্ত আকাশে উড়াতে ছেয়েছিলো। আর সেখানে এই স্বপ্নকে তরান্বিত করার লক্ষ্যে যুক্ত হয়েছিলো ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, অপরাপর সমাজতান্ত্রিক দেশ ও বিশ্বের যত প্রগতিশীল শক্তি। যাদের সহায়তায় নয় মাস মরণ জয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ এ ১৬ই ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি গৌরবের সাথে বিশ্ব মানচিত্রে নিজের আসনটি সদম্ভে আলোকিত করে। গণতন্ত্রের আবরণে পুঁজিবাদী ধনতন্ত্রে বিশ্বাসী বিশ্ব পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তারই দোসর মাওপন্থী চিন ও অন্যান্য জোটবদ্ধ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি- দখলকারী পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে নিরঙ্কুশ- সক্রিয় সমর্থন ক্রমাগত দিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা সত্ত্বেও সাতকোটি বাঙালির দুর্বার- দীপ্ত প্রত্যয় ও ইস্পাত প্রতিজ্ঞ সংগ্রামের পদতলে মাথা নত করতে বাধ্য করা হয়। অতঃপর এ দীর্ঘ সংগ্রামের রক্তাক্ত পথে তিরিশ লক্ষ শহিদের আত্মত্যাগে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জিত হয়। এ মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বাঙালি জনতার জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন বাস্তবের লাল-সবুজের আঙিনায় নবধারায় উদ্ভাসিত হয় এরই সাথে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রে নব উদ্যমে প্রগতিশীল সামাজিক বহুমুখী উন্নয়নের ক্ষেত্র তৈরি হয়।

৫. জনগণের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করেই গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, এবং সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রের মূলনীতি বলে ঘোষণার পাশাপাশি একটি প্রগতিশীল আধুনিক সংবিধান প্রণয়ন করেন। তাঁর প্রাজ্ঞ ও গতিশীল নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক- একটি বৈশ্বিক নীতির -প্রগতির ধারা অতি বিচক্ষণতায় বাস্তবায়নের বীক্ষিত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর সরকার দু'শ বছরের নিপীড়ন -নির্যাতন ও ঔপনিবেশিক শোষণ-লুণ্ঠনে বিত্তহীন এদেশ একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন মাত্র ; তার পুনর্গঠনে ও একটি অধনতান্ত্রিক উন্নয়নের ধারায় দেশকে তুলে আনার যুগান্তকারী নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন। জনগণের জননন্দিত বঙ্গবন্ধুর সরকার কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাবনায় ওঠে আসে শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য এবং অর্থ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণ; গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ভূমি ব্যবস্থা প্রবর্তন ও এর ক্রমধারায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্রাম-ভিত্তিক বহুমুখী সমবায় প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং সমাজ ও শাসন ব্যবস্থার গণতন্ত্রায়ন - সাথে প্রগতিশীল শক্তিগুলোর ঐক্যবদ্ধ সংশ্লেষ তৈরি করে সংঘবদ্ধ শক্তিতে রূপান্তরের মহৎ পরিকল্পনা। যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরই অনিবার্য নেতৃত্ব ও মেধাবী অনুধ্যানের ফলশ্রুতিতে স্বাধীন বাংলাদেশে 'বিপ্লবী উৎপাদন পদ্ধতির গোড়াপত্তন' নিশ্চিত করা হয়। অতঃপর বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় সামাজিক পরিবর্তনের পথটি বাধাহীন আলোকিত আগামীর পথে বিরামহীন অগ্রসরমাণ হতে দেখা যায় যা আজো তাঁর নির্দেশিত দ্যোতিত পথে দীপ্ত দীপাবলি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্বদেশ হাঁটছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ড. এস এ মুতাকাব্বির মাসুদ । শ্রীমঙ্গল, বাংলাদেশ