অটোয়া, সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪
“স্বপ্নের অন্তরে” গানের গীতিকার কবি মহসীন বখতের সাথে একান্ত আলাপন – কবির চৌধুরী

১৬ জুলাই রবিবার বিকাল ৫-৩০ মিনিটে অটোয়াস্থ কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ের “কৈলাস মিতাল” থিয়েটারে কণ্ঠশিল্পী নাসরীন শশী’র “একক সঙ্গীতানুষ্ঠান-এ শিল্পীর মৌলিক গানের প্রথম অ্যালবাম “স্বপ্নের অন্তরে” সিডি প্রকাশ পাবে। আটটি গান নিয়ে তৈরি সিডি’র সবগুলো গানই লিখেছেন অটোয়ার তিন কবি, মহসীন বখত, শাহীনুর ইসলাম এবং শাহ বাহাউদ্দীন শিশির। বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে অনুষ্ঠানের পোস্টারের অন্যতম আকর্ষণ “স্বপ্নের অন্তরে” সিডির কভারে গানগুলোর গীতিকার হিসেবে তিনজন পরিচিত মানুষের নাম দেখে আমি খুবই আনন্দিত। বিশেষ করে সৃজনশীল বাংলা সাহিত্য পত্রিকা “আশ্রম” এর পরিচালনা বোর্ডের সদস্য বন্ধুবর, বিরলপ্রজ লেখক কবি মহসীন বখতের নাম দেখে। লেখক মহসীন বখত’র নামটি দেখার পর থেকেই ভাবছিলাম “স্বপ্নের অন্তরে” সিডিতে সংযোজিত তাঁর লেখা গানসহ প্রবাসে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিশেষ করে সঙ্গীতচর্চা নিয়ে আলাপ করবো। কিন্তু তাঁর একমাত্র ছেলের বিয়ে উপলক্ষে বাংলাদেশে থাকায় সাথে সাথে লেখক মহসীন বখত’র সাথে আলাপ করা সম্ভব হয় নি। গত সপ্তাহে দেশ থেকে আসার পর তাঁর সাথে, প্রবাসের এই বিরূপ পরিবেশে গান- সাহিত্য- সঙ্গীতচর্চা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয়। সেই আলাপের কিছু অংশ আশ্রমের পাঠক এবং সঙ্গীতপিপাসু শ্রোতাদের জন্য তুলে ধরা হলো।

কবির চৌধুরীঃ নাসরীন শশী’র গানের অ্যালবামে গীতিকার হিসেবে আপনার নাম দেখলাম। অভিনন্দন! আপনি তো আশির দশকের একজন কবি ও গল্পকার। আপনার লেখার মূল প্রতিপাদ্য বাংলার আদি সাহিত্য-সংস্কৃতি। হঠাৎ করে গান লেখার আগ্রহ হলো কেন? “স্বপ্নের অন্তরে” সিডিতে কোন গানটি আপনার লেখা? 

মহসীন বখতঃ গল্প কবিতার পাশাপাশি আমি বাঙালির লোকসংস্কৃতি ও ইতিহাসের অবিদিত অনুসঙ্গ ব্লেন্ড করে নানা ধরণের রচনা বিভিন্ন সময়ে লিখেছি। বাঙালির প্রথম প্রদীপ চর্যাপদ নিয়েও খানিক গবেষণা আমার আছে। পেশাদার গীতিকার আমি নই, তবে খেয়ালের বশে, বেশ কিছু গীতিকবিতা আমি লিখেছি বা মাঝেমধ্যে লিখি। এরমধ্যে দু’একটা গীত হয়ে বেরিয়েছে এবং শ্রোতার মনোযোগ কেড়েছে। অবশ্য প্রশংসাটা আমার একার নয়। একটা লিরিক গান হতে গেলে অনেক লোকের শ্রম ও মেধা লাগে। সুর, মিউজিক কম্পোজ ও শিল্পীর কণ্ঠের যাদু থাকে। 
   গান আমি নিত্যদিনই শুনি। কিছু কিছু গান আমার কাছে এবাদতের মত। গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়িনা। গহনগভীর রাতে গানের সুরে ভাসি, গানের ভাষায় কাঁদি। স্মৃতিতে কীর্তনীয়াদের পদাবলীর সুর জেগে আছে আজও। প্রকৃতিতে সুর ছন্দ আছে। আমাদের রয়েছে গায়েন বাউল বোষ্টমী চারণের বৈচিত্রময় সঙ্গীতের ঐতিহ্য। ব্রজবুলি বাংলায় অনেক শাস্ত্রীয় ভাবসঙ্গীত, গ্রাম্য গায়েনের বৈঠকি গান, কবিরের গজল, আমাদের রয়েছে ভজন। এর পাশে পঞ্চকবির গানের পাশাপাশি আধুনিক ও হরেক ধারার ফোক। এইসব গান শোনার ব্যাপারতো আছেই। তবে নিজের মধ্যে তাড়না বোধ করলে লিরিক রচনা করি কখনো, কখনো অলিখিতই রয়ে যায়। যেগুলো লিখা হয় সেগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটা গান হয়ে শ্রোতার কাছে পৌঁছে যায়।
   হ্যাঁ, এবারে ‘যদি স্বপ্নের অন্তরে পাখী হই আমি/ এক আকাশ দিগন্ত তুমি/ আমাকে উড়তে দেবে?/ দেবে না কি?’ গানটি লিখেছি। শিল্পী নাসরীন শশী গানটি গেয়েছেন। গানের প্রথম কলি দিয়েই তাঁর মৌলিক গানের প্রথম অ্যালবামের নামকরণ করেছেন। গানটি রোমান্টিক বলা যায়। চাঁদে পাওয়া, চৈতি পাওয়া ব্যাপারগুলো বাঙালির আবেগের পরনকথায় রয়েছে। আমি সেই বোধগুলো গানের অন্তরে ঢেলে দেবার চেষ্টা করেছি মাত্র।  

কবির চৌধুরীঃ  এর আগেও তো আপনি “একটা জানালার গল্প বলি শোন” গান লিখেছেন যা নাসরীন শশী তাঁর প্রথম মৌলিক গান হিসেবে “আশ্রম একক সঙ্গীতসন্ধ্যায়” পরিবেশন করেছিলেন। একই শিল্পীকে দিয়ে দুটো গান করাবার কারণ কি? নাসরীন শশীকে শিল্পী হিসেবে কেন পছন্দ করলেন?

মহসীন বখতঃ “একটা জানালার গল্প” আমার নবীন যৌবনে লেখা সেই আশির দশকে একটি কবিতা। গীতি কবিতা এটি নয়। পরে গান করতে গিয়ে খানিক রূপান্তর করা হয়েছে। আমার পাতালকক্ষে লাইব্রেরীতে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। শাহীনুরের নানা প্রতিভা, গানও লিখে, সুরও করতে পারে। সে বলে এই কবিতাটা দিয়ে গান করা যায়। বলেই সে দু’ছত্রের সুর তুলে গলায়। বোন নাসরীন শশীও আড্ডায় ছিলেন। শশীর ভীষণ পছন্দ হয় গানের কথা ও শাহীনের দেওয়া সুর। এই হল ‘একটি জানালার গল্পে’র অন্তরালের গল্প। তারপর নাসরীন শশী এই লিরিকটা দিয়েই তাঁর প্রথম মৌলিক গানে কণ্ঠ দেন। গানটার দু’টি ভিডিও ভার্সন ইউটিউবে আছে। আদনান রুশদীর কম্পোজ। আমার কাছে দারুণ লেগেছে। গানটি অগণিত শ্রোতারাও বিপুল উৎসাহে নিয়েছেন। শশীর গায়কীও অপূর্ব। আর নাসরীন শশীকে দু’টি কেন, ডজন ডজন লিরিক লাগলে আমি দেব। কারণ, আমার লিরিকে এই শিল্পীর আগ্রহ আছে। এই বিষয়টার মূল্য আমার কাছে অনেক। গানের লিরিকের অন্তরে অধরা একটা গল্প থাকে। হর্ষ, বেদনা ও বোধের গল্প। নাসরীন শশী আমার লিরিকের সেই গল্পটা সুখের যাদু মাখিয়ে শ্রোতার কাছে নিয়ে যান। এখানে গীতিকারের আর কী পাওয়ার থাকে। শশীর কণ্ঠে একের পর এক গান তুলে দেওয়ার এটাই কারণ। আসল কথা হচ্ছে এই শিল্পী দরদ ঢেলে গাইতে পারেন, তাঁর কণ্ঠে সুরের ইন্দ্রজাল রচিত হয়, শ্রোতাকে আবিষ্ট করে। 

কবির চৌধুরীঃ  হালের ইউটিউব ভিডিও বা স্পটিফাই জামানায় গানের সিডি বের করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? নাসরীন শশীর সিডিতে আপনার গানের অন্তর্ভুক্তিকে আপনি কিভাবে দেখেন?

মহসীন বখতঃ সিডি রিলিজ করার তাসির অবশ্যই রয়েছে। অনেকে গান সংগ্রহে রাখেন, তাদের জন্যে সিডি সুবিধাই বটে। ইউটিউবে তালাশ করলে দেখবেন, অনেকে পুরো সিডি ইউটিউবে আপলোড করে রেখে দেন, এতে শিল্পীর একাধিক গান শ্রোতারা সহজে পেতে পারেন। শশীর এ্যালবামে আমার লিরিক আমার জন্য আনন্দের। গান রচনাই করা হয় শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য। তবে শিল্পীর প্রথম সিডিতে প্রথম মৌলিক গান 'একটি জানালার গল্প' অন্তর্ভুক্ত না হওয়া আমার কাছে বোধগম্য নয়। বিষয়টা আমাকে আহত করেছে। গানটা ইউটিউবে গিয়ে আমি মাঝেমধ্যে শুনি। এই গানটি সহজ কথা আর সরল সুরে নয়। এজন্য এটি গাওয়া বেশ কঠিন বটে। শিল্পী নাসরীন শশীর কন্ঠে গানটি অগণিত শ্রোতাকে আবিষ্ট করেছে। গায়কীতে মেলোডির যাদু না থাকলে এই গান গাওয়া সহজসাধ্য নয়।

কবির চৌধুরীঃ নাসরীন শশী ১৬ জুলাই “স্বপ্নের অন্তরে” সিডি প্রকাশ উপলক্ষে ‘একক সঙ্গীতসন্ধ্যা’তে গান পরিবেশন করবেন। একজন গীতিকার হিসেবে প্রবাসে শিল্পীর এই প্রচেষ্টাকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন? 

মহসীন বখতঃ আজকের দিনে দেশ আর প্রবাসের ব্যবধান ঘুছে যাচ্ছে। এখানে জীবন কঠিন। কিন্তু শিল্পচর্চার অন্তরায় আর আগের মত নয়। দেশের সাথে যোগাযোগ সহজতর হয়েছে। বিদেশে বাসকরা প্রবাসী শিল্পীরা দেশে গিয়ে সিনেমার গানেও কন্ঠ দিয়ে আসতে দেখেছি। অটোয়ায় এখানকার পরিযায়ী একাধিক শিল্পীদের একক গানের আসর হয়েছে। শিল্পীদের সলো প্রোগ্রাম শ্রোতাদের সাথে সংযোগ সাধণে সহায়ক। শশী এই নগরের জমকালো মঞ্চে আরও একক অনুষ্ঠান করেছেন। উপছে পড়া শ্রোতার ভিড় হয়েছে। এটিও সেরকমই হবে আমার ধারণা। একজন শিল্পী নিবেদিত না হলে একক কন্ঠের অনুষ্ঠান করা যায়না। কৈলাস মিতাল থিয়েটার ছয়লাভ হয়ে যাবার মত বাঙালি জনসংখ্যা এখন অটোয়ায়। নাসরীন শশী এই বিভূঁই নগরে পরিযায়ী বাঙালি সমাজের মেলোডিকন্যা। অনুষ্ঠান উপভোগ্য হবে। 

কবির চৌধুরীঃ আমাকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

মহসীন বখতঃ আপনাকেও ধন্যবাদ। ১৬ তারিখ অনুষ্ঠানে দেখা হবে। 

শেষ কথাঃ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়, “গান শুধু গান নয়; এটি একটি উপাসনাও”। অটোয়ার সঙ্গীতপিপাসু শ্রোতামাত্রই জানেন, নাসরীন শশী সঙ্গীতকে তার জীবনে আরাধনা হিসেবে নিয়েছেন। স্থানীয় গীতিকারদের লেখা গান দিয়ে একটি সিডি বের করেছেন যা আগামী সপ্তাহে প্রকাশিত হবে। একজন শিল্পী যেভাবে অপেক্ষা করেন ভাল এবং সুন্দর কথা দিয়ে রচিত গান করবেন তেমনি একজন গীতিকারের ও আজীবনের স্বপ্ন থাকে তাঁর লেখা গান কোন শিল্পীর সুমধুর কণ্ঠে হাজার লাখো সঙ্গীতপিপাসু শ্রোতামণ্ডলীর কর্ণে বর্ষিত হবে। আমি আশা করবো আগামী ১৬ তারিখ নাসরীন শশীর সুমধুর কণ্ঠ আর মহসীন বখতের রোমান্টিক শব্দগুলোর মিলিত সুরঝংকার অটোয়ার সঙ্গীতপিপাসু শ্রোতাদেরকে আনন্দ দান করবে। 

কবির চৌধুরী
প্রকাশক, আশ্রমবিডিডটকম
অটোয়া, কানাডা