অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
বাণী বসুর সাক্ষাৎকার - ঔষ্ণীক ঘোষ সোম

সাহিত্যিক বাণী বসুর সাহিত্যকর্মের সাঙ্গে পরিচয় সেই ছোটবেলা থেকে। ব্যক্তি মানুষটির সাথে প্রথম পরিচয় হয়েছিল ২০১৮ সালের কোনো এক সন্ধ্যায়, শিল্পী কৃষ্ণেন্দু চাকীর চিত্রপ্রদর্শনীতে। তারপর ওঁর সাথে বহুবার বিভিন্ন জায়গায় নিয়মিত দেখা হয়েছে। তবে ওঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার কথা তখনও ভাবিনি। (সে বয়সে না ভেবে থাকাটাই হয়তো স্বাভাবিক!) আমার এই এতোটুকু জীবনে বহু গুণী মানুষের সান্নিধ্যে এসে তাঁদের সাথে অনেকগুলি মূল্যবান মুহূর্ত কাটানোর সুযোগ আমার হয়েছে। প্রথম প্রথম এইসব যাপনগুলিকে ক্রিয়েটিভ ভাবে সংরক্ষিত করার কথা যেহেতু ভাবিনি, অনেক কিছুই মনের ক্যানভাস থেকে আপাতত হারিয়ে গেছে। আর স্মৃতি? সে তো প্রতারক! কল্পনাবিলাসিও বটে। পরে মনে হয়েছে যে এইসব মানুষগুলির সাথে সেই সব কথোপকথন কিছুটা অন্তত  কোনভাবে ধরে রাখা প্রয়োজন। আগামীর জন্য। একান্ত ব্যক্তিগত সংলাপ বাদ দিয়ে, আপামর পাঠকের কাছে যা গ্রহণীয় হতে পারে তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তাই আমার এযাবৎ কোনো সাক্ষাৎকারই ধরা বাঁধা 'সাক্ষাৎকার' থাকেনি, তা সংলাপ হয়ে উঠেছে বলেই আমার ধারণা। এই কথোপকথনটিও তার ব্যাতিক্রম নয়। ধন্যবাদ কবি সুলতানা শিরিন সাজিকে আমায় আশ্রমিক হওয়ার নিমন্ত্রণ জানানোর জন্য। এবং অবশ্যই কৃতজ্ঞতা জানাবো শ্রীমতি বাণী বসু এবং ইলিনা মিত্রকে এই কথোপকথনটি সম্ভবপর করে তোলার জন্য।

আপনি কি মনে করেন একজন সফল লেখক হতে গেলে একজন সফল পাঠক হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ?

খুব জরুরী কথা। না পাঠ করলে লেখা যায় না। লেখার আগ্রহটাই তৈরি হয় না। আমি অন্তত পাঠ করতে করতেই লেখক হয়েছি। লেখক হয়ে যাওয়ার পরেও প্রচুর পড়তে হয় যত একজনের নানা বিষয়ে আগ্রহ হবে, ততো লেখার ইচ্ছে বাড়বে।

একজন পাঠক হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতার কথা যদি একটু বলেন?

আমি খুব ছোটবেলা থেকে পড়তে শুরু করেছি। একটা ছোট্ট মেয়ে ধরো মেঝের উপরে উপুড় হয়ে শুয়ে পা দুটো উপরে তুলে সামনে ঠাকুরমার ঝুলি খুলে বসে পড়ছে ‘ক রাজা’। এমন ভাবে যেই পড়ছে কিছুক্ষণ শোনার পর বড় দিদি বলল কী পড়ছিস রে? ‘ক রাজা’ আবার কী?  আমি বললাম : এইতো লেখা আছে। তারপরে দিদি আমাকে দেখিয়ে দিল ওটা আসলে ‘এক’। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে পাঠিকা, সে না বুঝেও পড়ে (হাসি)। তখন যে সমস্ত পত্রিকা বের হতো তাদের মধ্যে শরৎ সাহিত্য ভবন আর দেব সাহিত্য কুটির শারদীয়া প্রকাশ করত, সেটার জন্য আমাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যেতে। তারপরে উঁচু ক্লাসে যখন উঠলাম তখন বোধ হয় সন্দেশ আবার বেরোলো। মানে সত্যজিৎ রায় আর লীলা মজুমদার আরম্ভ করলেন। ছোড়দি (গৌরী ধর্মপাল) আমাদের পঞ্চতন্ত্রের গল্প লিখে, পড়ে শোনাত। মালশ্রীর পঞ্চতন্ত্র বলে একটা লেখা লিখেছিল। সেগুলো সবই আমাদের পড়ে শোনাত। আমরা তিন ছোট ভাই বোন। তখন আমি ওঁকে বলেছিলাম লেখাগুলো সন্দেশে পাঠাতে। খুব আদরের সঙ্গেই সম্পাদকেরা লেখাগুলো নিয়েছিলেন। অনেকদিন ধরে ছাপা হয় সেগুলো। আমরা ছোড়দির কাছে মাঝে মাঝেই পড়তাম। কোন স্কুলের টেক্স্ট বই পড়াত না। গল্প উপন্যাস পড়ে শোনাত। মনে আছে বিভূতিভূষণের ইছামতি পড়ে শুনিয়েছিল আমাদের। তখন যাদের যাদের লেখা পড়তাম তাদের মধ্যে ছিলেন মৌমাছি, সুনির্মল বসু, শিবরাম চক্রবর্তী, ক্ষিতিন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য, বুদ্ধদেব বসু, প্রতিভা বসু, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা দেবী আরো অনেকে। গোগ্রাসে পড়তাম আমরা এঁদের বই। আমাদের স্কুল জীবনে শরৎচন্দ্র পড়া বারণ ছিল। প্রাইজ পেয়েছি শরৎচন্দ্রের বই, কিন্তু সেটা পড়তে না দিয়ে রেখে দিত। ছোটদের বঙ্কিমচন্দ্র পড়তে হত। কলেজে উঠে যাওয়ার পর একেবারে লাগাম ছাড়া পড়া শুরু হল। তার আগেও যে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়িনি তা নয়। খাটের তলায় ঢুকে যেতাম বই নিয়ে। আর আমাদের সময় ছোটদের মনোরঞ্জন বলতে খেলাধুলো আর বই পড়া, এই দুটোই ছিল। তখন অনেক অনুবাদের বই বার হত। ভিক্টর হুগো, আলেকজান্ডার ডুমাস এদের সব বই। বড়দের বইও ছোটদের জন্য অনুবাদ করা হত। সেই রকম বই আমরা প্রচুর পড়েছি। এই বইগুলো পড়ার স্বাদটা সম্পূর্ণ আলাদা ছিল।

আপনি গৌরী ধর্মপালের কথা বলছিলেন। আপনার লেখক জীবনে তাঁর প্রভাব কীভাবে পড়েছিল?

ঠিক ওভাবে বলাটা মুশকিল কারণ বাড়ির আবহাওয়াটাই অন্যরকম ছিল। আমার বড় দুই দিদিকে ছোট থেকে দেখতাম ভোরবেলা স্নান টান করে চৌকি পেতে বই নিয়ে বসে যেত। অদ্ভুত ধরনের ছাত্রী ছিল। মুক্তোর মত হাতের লেখা কোথাও কোন কাটাকুটি নেই। এটা দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। দাদা-দিদিরা যে বইটা পড়তো নিজেদের মধ্যে তা নিয়ে আলোচনা করত। এই অ্যাটমস্ফিয়রে বড় হয়েছি। It was conducive to a creative life। তখন আমরা ছোটরা মিলে একটা হিপো নামের হাতে লেখা পত্রিকা বার করতাম। সেখানে আমরা ভাই-বোনেরা সকলেই কনট্রিবিউট করতাম। সেটা নিয়ে মাঝে মাঝে আবার আসর বসত, সেখানে হয়তো কখনো বাবা-মাও থাকতেন। একজন যখন পড়ে তাকে অক্ষর ডিকোড করতে হয়, তার জন্য মস্তিষ্ক সঞ্চালনের প্রয়োজন হয়। পড়ার মাধ্যমে এই যে মস্তিষ্ক সঞ্চালনের কাজ হচ্ছে তা ভবিষ্যতে আরো অন্যান্য কাজে লাগে।

আপনি মৌলিক সাহিত্য রচনার পাশাপাশি বেশ কিছু বিদেশি সাহিত্যের এবং শ্রীঅরবিন্দের কবিতার অনুবাদ করেছেন। অনুবাদক হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? 

দেখো আমি লিখতাম চিরকালই। কবিতা ছড়া ইত্যাদি। কিন্তু কোন কিছু কমপ্লিট করতাম না। এত পড়তাম সেখান থেকে হয়তো কোনোভাবে মাথায় একটা মডেল তৈরি হয়ে গেছিল যে এটা ঠিক হচ্ছে কি হচ্ছে না, ভালো হচ্ছে কিনা, সন্তুষ্ট হতে পারতাম না নিজের লেখা নিয়ে। খুবই লাজুক ছিলাম। কী পারি আর কী পারি না সেটা কেউ জানতো না। কলেজে যখন পড়াতে গেলাম এখানকার পত্রিকায় লেখা দিতেই হত। এগুলো দেখে হয়তো কলিগদের কিছু মনে হত। আমাদের যিনি হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট ছিলেন তিনি আমাকে বললেন তুমি লেখ না কেন? আমি মনে মনে হাসতাম, কারণ আমি তো লিখিই। প্রকাশ করছিলাম না এই পর্যন্ত। আমার শ্বশুর বাড়ির সবাই শ্রী অরবিন্দের খুব ভক্ত। আমার দাদাশ্বশুরের বন্ধু চারুচন্দ্র ঘোষ অরবিন্দের একেবারে প্রথম দিকের শিষ্য ছিলেন তার একটি লেখা আমাকে অনুবাদ করতে হয়েছিল। সেটা অনেকের ভালো লাগে এবং আমাকে শ্রীঅরবিন্দের কবিতা অনুবাদ করতে বলা হয়। তারপর সেগুলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপরে সুযোগ আসে সমারসেট মম-এর গল্প অনুবাদ করার।

এরপরে আপনার নিজের মৌলিক লেখায় কিভাবে এলেন?

তিনটি অনুবাদের বই হয়ে গেল। কবিতা লিখতাম। ধরো কোথাও বাইরে বেড়াতে গেছি কবিতা লিখেছি। শেখর বসু, রমানাথ রায় এদের একটা গ্রুপ ছিল। আমার হাজবেন্ডের বন্ধুর পরিচিত ছিল। তাঁর একটা পত্রিকা প্রকাশ করত। আমার হাজব্যান্ড আমার কিছু কবিতা নিয়ে তাঁর বন্ধুর কাছে দিয়েছিল। সে নিলো না শুধু বলে দিল দেখিস তোর বউকে যেন আবার আনন্দবাজারে পাঠাস না! এই শুনে আমার খুব রাগ হয়ে গেল। আমি কোথায় যাবো না যাবো সেটা কি ঠিক করে দেবে? তখন আমি আনন্দমেলার জন্য নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে কিছু কবিতা পাঠালাম। উনি আমাকে যেতে বললেন। তারপর বললেন কবিতা বা ছড়া আমরা তো পাই কিন্তু ভালো ছোটদের গল্প একদম পাই না। সেই প্রথম ছোটদের গল্প লেখা শুরু। এর ঠিক উল্টোদিকেই দেশ-এর অফিস সেখানে চলে গেলাম একদিন। এক দিকে বসে আছে সাগরময় ঘোষ অন্যদিকে আনন্দ বাগচি, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুনীলদা এবং শীর্ষেন্দু দা। আমি গিয়ে আমার লেখা আনন্দ বাগচীর হাতে দিলাম। তারপরে একদিন জিজ্ঞেস করতে গেছি লেখাটার কী হল। উনি বললেন লেখাটা আমার খুবই ভালো লাগছিল কিন্তু শেষটা ঠিক পছন্দ হল না। আমি অন্য আরেকটা গল্প দিলাম। আমি মনে মনে ভাবলাম এই গল্পটা যদি না নেয় তাহলে নেবে না বলেই নিচ্ছে না। আমি এতদিন ধরে এত সাহিত্য পড়েছি আমার তখন একটা তৈরি মস্তিষ্ক হয়ে গেছে। আমি নিজেরটা দেখেও তার ভালো-মন্দ বিচার করতে পারি। ধরো যারা আরম্ভ করে ছোটবেলায় তখন একটা আবেগ আসে ভেতর থেকে তখন সেই লেখার আবেগে উচ্ছ্বাসে প্রচুর লিখে ফেলে বিশেষ করে কবিতা। এই প্রথম লেখাটা ফ্রেশ অ্যাপ্রোচ টু লাইফ বলা যেতে পারে। কিন্তু অনেক সময় বয়সটা অল্প হওয়ার দরুন লেখা সেন্টিমেন্টাল হয়ে যায়। কখনো হয়তো অবজারভেশনে অনেক ভুল থাকে। এমনটা হবেই তা বলছি না তবে হতেই পারে। এই জিনিসগুলো একটু বয়স হওয়ার পরে লিখলে আর হয় না। তখন চোখে পড়ে আমি এখানে এই ভুলটা করেছি। কাজেই যখন আমি বেহুলার ভেলা গল্পটা দিলাম তখন আমার মনে হয়েছিল এই গল্পটা যদি না নেয় নেবে না বলেই নিচ্ছে না। তারপর গল্পটা ছাপা হল। সাগরদা ডেকে আলাপ করলেন। সঞ্জীবদা ডেকে আলাপ করলেন। সাগরদা বললেন তুমি একে দিয়ে লেখাও। সেই থেকে আমার লেখালেখির ক্যারিয়ার শুরু।

আপনি আপনার প্রথম উপন্যাস জন্মভূমি মাতৃভূমির বিষয় হিসেবে অত্যন্ত জটিল একটি পটভূমি বেছে নিয়েছিলেন...

হ্যাঁ ওটা বলা যেতে পারে প্রথম প্রবাসীদের নিয়ে লেখা উপন্যাস। যখন আমাকে বলা হল উপন্যাস লিখতে আমার মনটা তো পুরো ছোট গল্পের ধার দিয়ে তৈরি ছিল উপন্যাস কী নিয়ে লিখব? তখন সদ্য আমার দাদা বৌদি ফিলাডেলফিয়া থেকে ফিরেছে তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে। যারা এসে খুব বিপদে পড়েছিল। ছেলে স্কুলে ভর্তি হতে পারছিল না মেয়ে কলেজের পরীক্ষায় খুবই কম নম্বর পেয়েছিল ভালো পরীক্ষা দেওয়া সত্ত্বেও। সেটা নকশাল পিরিয়েড ছিল। তারপর ওদের মেয়ে ফেরত চলে গেল। দাদা এসেছিল পরিবারের সঙ্গে থাকার জন্য কিন্তু এমন প্রতিকূল অবস্থায় পড়তে হবে ভাবেনি। তো এইসব ব্যাপার ঘটছিল। ডায়েসপোরা নিয়ে বাংলায় সেই প্রথম লেখা।

আপনি অষ্টম গর্ভে  ন্যারেটিভ নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন সেটা নিয়ে কিছু যদি বলেন?

আমি সব সময়ই নতুন কিছু করতে চেয়েছি। নতুন কিছু না করে প্রচলিত পথে আমি লিখব এটা আমার একদম পছন্দ ছিল না। রবীন্দ্রনাথের কিছু পিকুলিয়ার স্টাইল আমি ছোট থেকেই বর্জন করেছিলাম। তার লেখার আমি খুব ভক্ত। উনি নৌকাডুবির মতো একটা উপন্যাসকে যেভাবে শুধু ভাষার উপরে ভর করে কোনখানে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছেন ভাবা যায় না। কিন্তু সেটা ব্যাপার নয়। কিন্তু আমার মাথায় ছিল ওঁর মত আমি লিখব না। ম্যানারিজম আমি একদম পছন্দ করতাম না। তাই আমার লেখার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কোন ছায়া থাকবে না। অষ্টম গর্ভের ওই ন্যারেটিভ এর লেখা আমার ভেতর থেকে এসেছিল। সেখান থেকে সময়টাকে ধরা হয়েছিল তাতে মন্বন্তর দেশভাগ দাঙ্গা সবই ছিল। সবই আমি ছোটবেলায় দেখেছি। কিছু কিছু মনেও ছিল। কিছুটা রূপকথার আদলে আমি গল্পটাকে ফেলেছি। খুব হালকাভাবে আমি ভাগবতের স্টাইল নিয়েছি: একটা স্কন্দ হবে তারপর সেখানে কতগুলো জেনারেল জিনিস বলা হবে তারপরের অংশটায় থাকবে কৃষ্ণের আরাধনা, এই আর কি। স্কন্দগুলোতে অন্য কথা বলা হয় আর অধ্যায়গুলোতে দাদা দিদিদের কথা রূপকথার ছলে এসেছে।

তারপর আপনি সদ্যজাতকের চোখ দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখাচ্ছেন...

ঠিক তাই। আমায় সব সময় ভাবাতো এই যে ভ্রুণটা থাকে মাতৃগর্ভের মধ্যে কখন তার মধ্যে চেতনা দেখা দেয়? হয়তো সে সেখানে স্বপ্নের ঘোরে থাকে। হতেই পারে, জানিনা তো কোনটাই। তারপর সে যখন বাইরে এল যতক্ষণ না তার কথা ফুটছে সে পৃথিবীটাকে কিরকম ভাবে দেখে? গন্ধ এবং দৃশ্য দিয়ে যে একটা জগত সেই জগতটাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

আপনি মৈত্রেয় জাতক লিখেছিলেন একটা অন্যরকম ভাষায়। তো আপনি এই বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট যখন করছিলেন তখন কি আপনার মনে কোথাও সংশয় ছিল যে পাঠকরা এ ধরনের কাজ নিতে পারবে কি পারবে না এমন কিছু?

দেখো সত্যি কথা বলতে কি আমি জীবনে কোনদিনও পাঠকের কথা ভেবে লিখিনি। পাঠক কী পড়তে চায়, তার কী ভালো লাগবে এগুলো ভাবিনি। আমার কী ভালো লাগে, আমি কী পড়তে চাই সেটাই লিখেছি। যখন প্রথম মৈত্রেয় জাতক লিখতে যাই তখন মনে হয়েছে এত বড় উপন্যাস কিভাবে লিখবো! কী নিয়েই বা লিখব? তারপরে মনে হলো বুদ্ধ সম্পর্কে আমার বেশ কিছু প্রশ্ন রয়েছে। সেই প্রশ্নগুলোর কেউ উত্তর দিতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধকে একেবারে করুণার অবতার হিসেবে দেখিয়েছেন। সকলেই মোটামুটি তাই দেখিয়েছেন। সেটা কি সত্যি? আরে তিনি যখন জীবিত ছিলেন তখন আরও তো লোকজন ছিল। যেমন আজকে কোন সাধু-টাধু হঠাৎ উদয় হলে আমরা তাকে নানাভাবে সমালোচনা করি। তো তখন অন্যান্য লোকেরা কি বলত? একজন রাজপুত্র হঠাৎ করে সন্ন্যাসী হয়ে গেলেন এটাকে কিভাবে সবাই নিয়েছিল? এই যে বলা হয়েছে তিনি বেরিয়ে একদিন জরা দেখলেন, একদিন মৃত্যু দেখলেন এগুলো কী? আর ওতে কোনো মানে আছে? এটা নিয়ে অনেক চিন্তা করেছি। গল্পটা কিন্তু অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত কাব্যে রয়েছে। উনি সংক্ষেপ করতে চেয়েছেন আর লোকে সেটাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে। জিনিসটাকে  এলিগোরিক্যালি লিখেছেন। আরো অনেক প্রশ্ন আমার কাছে আসতে লাগলো। তিনি রাজপুত্র ছিলেন সন্ন্যাসী হলেন আবার লোকালয়ে ফিরে এলেন এবং সারা জীবন তিনি রাজাদের সঙ্গে কাটালেন। কেন? তক্ষশীলা তখনকার দিনে মস্ত বড় ইউনিভার্সিটি ছিল। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। সেখানে পড়ানো হতো না এমন জিনিস নেই। রাজনীতি পড়ানো হতো কিন্তু তার তেমন কোনো ভালো টেক্সট ছিল না। তক্ষশীলার থেকেই চাণক্য এসেছিলেন। কিন্তু তার আগে কি কেউ ছিল না? নিশ্চয়ই ছিলেন। তো আমার গল্পে চণকের হাত দিয়ে রাজশাস্ত্র লেখা হচ্ছে। আর তিনি শুধু বাড়িতে বসে লেখেন না তিনি পরিব্রাজক। তিনি দেখলেন অনবরত পারস্য থেকে আক্রমণ আসছে। তাদের লক্ষ্য সিন্ধু নদের আশেপাশে যেসব সোনা ছড়িয়ে রয়েছে সেগুলো। তারা জানত এটা সোনার দেশ। কিন্তু তাদের আটকাবার মতন কোন বড় রাজা নেই। যদি এই ফরেন ইনভেশন কে ঠেকাতে হয় তাহলে ভারতবর্ষের সব রাজাদের একত্র করতে হবে। তার দুটো উপায় আছে এক হচ্ছে রীতিমত ভালো করে একটা জোরালো ফেডারেশন তৈরি করা। ফেডারেশন বলতে সম্মিলিত রাজণ্যবর্গ। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে চক্রবর্ত্তী সম্রাটের অধীন সাম্রাজ্য। আমি একে বুদ্ধের বিপরীতে দাঁড় করাতে চেয়েছিলাম। বুদ্ধ চেয়েছেন ধর্ম দিয়ে বাঁধতে। চনক চাইছে রাজনৈতিকভাবে বাঁধতে। আর আমি সেই যুগটা নিয়ে অনেক পড়াশুনা করছিলাম। একেবারে অন্যরকম একটা যুগ। আমার লেখায় কোথাও কোন অলৌকিককে আমি প্রশ্রয় দিইনি। যেমন ধরা যাক এই যে বুদ্ধের পেছনে থেকে সূর্যের ছটা বেরিয়ে আসছে মনে হচ্ছে যেন দেবতা, আমার ধারণা এটা উনি জ্ঞাতসারে করতেন। ওঁর কাজ হলো সাধারণ মানুষকে ট্রান্সফর্ম করা। আর সেটা এমনি এমনি হবে না, তোমার কিছু ক্যারিশমা থাকতে হবে। যত তোমার ক্যিরিশমা থাকবে তত তুমি সফল হবে ততই জনগণকে আকর্ষণ করতে পারবে। এটা গান্ধী সুভাষ বসু সবার মধ্যেই ছিল। এরা এসে দাঁড়ালে এবং কিছু বললেই তা মিনিংফুল হয়ে ওঠে। সারা পৃথিবীতে যত এই ধরনের নেতৃবৃন্দ আছেন রাজনীতিতেই হোক কিংবা ধর্মেই হোক এই ক্যারিশমার ব্যবহার করে থাকেন। আর ভাষার কথা যদি বলো, সে ক্ষেত্রে আমি চেষ্টা করেছি যাতে কোনো বিদেশী শব্দ ব্যবহার না করা হয়। একমাত্র পার্সী এবং কিছু গ্রিক শব্দ ছাড়া। আর পালি ব্যবহার করেছি।

সবশেষে আপনার মহাভারত নিয়ে কাজের কথায় আসি আপনি প্রায় ৪৫ বছর হতে চলল লেখালেখির জগতে রয়েছেন। হঠাৎ আপনি মহাভারত কে কেন বেছে নিলেন আপনার কাজের ক্ষেত্র হিসেবে?

মহাভারতের গল্পের কোনো তুলনা হয় না। আমি একা বলে নয় সব লেখকেরই একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে মহাভারত নিয়ে কাজ করার। ছোট থেকে মহাভারত পড়ছি। অনেকগুলি প্রশ্ন জাগতো আমার মনে যে এগুলো তো সম্ভব নয়, এগুলো আন সায়েন্টিফিক তাহলে অ্যাকচুয়াল ব্যাপারটা কী হতে পারে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর করতে গিয়ে আমি সত্যবতী থেকে আরম্ভ করে একেবারেই যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত নিয়ে গেছি। এবং এর জন্য যে যে চরিত্রগুলোকে বিশেষ ভাবে স্টাডি করা দরকার সেগুলোকেই বেছে নিয়েছি। অর্জুন কিংবা কর্ণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলেও তাদের টাইটেল হিসেবে বেছে নিইনি কারণ ওদের নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। অলৌকিক ঘটনাগুলোকে রেশনালাইজ করতে চেয়েছি। আমি এখনকার ব্যবহৃত শব্দও ব্যবহার করেছি বর্তমান সময়ে ফেলে মেন্ স্টোরি লাইনটাকে দেখবার জন্য। এটা নিয়ে নিন্দা ও কিছু রটেছে। আমি চিরকালীন পটভূমিতে গল্পটাকে দেখতে চেয়েছি।

ধন্যবাদ 

ঔষ্ণীক ঘোষ সোম
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ