অটোয়া, বৃহস্পতিবার ২ মে, ২০২৪
রাত্রির যাত্রী - রাজিউল হোদা দীপ্ত

“আপনি কি ভূত ভালোবাসেন?”
আমি লোকটার দিকে তাকালাম। কালো রঙের প্যান্ট পরা,সাদা চেকচেক শার্ট। শার্ট প্যান্টের ভেতর গুঁজে রাখার জন্য তৈরী হয়েছে। উনি গুঁজে রাখেন নাই। গা থেকে কড়া এক সিগারেটের গন্ধ বের হচ্ছে। তবে,গন্ধটা ভালো লাগছে। উনি শ্যামলা, কিন্তু মুখে সাবান মেখে যত্ন কম নেন হয়ত।
মনে মনে ভাবতে লাগলাম,ভূতও কি ভালোবাসার জিনিস? প্লাটফর্ম এর মর্চে ধরা লাল বেঞ্চিটাতে আমার সাথেই বসা। সিলেট যাওয়ার জন্য ট্রেন এর অপেক্ষায় দেড় ঘন্টা ধরে এইখানেই বসে আছি। ইনাকে তো দেখি নি। উনি হাঁক দিয়ে উঠলেন।
“জ্বি,আপনাকেই বলছি। সিগারেট খান?”
বিস্ময় নিয়ে জবাব দিলাম
“একটু-আধটু।”
উনি একটা সিগারেট দিলেন। আমি নিচ্ছিনা। উনি আমার জবাবের অপেক্ষায় আছেন। আমি জবাব দিলাম,
“আমি দুপুরে খাওয়ার পর একটা খাই আর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে একটা খাই। এর মাঝে খাই না।”
উনি কিছুটা অবাক হলেন। মানুষকে অবাক করা জবাব দিতে ভালো লাগে। সিলেটে ফুপা মারা যাওয়ার খবরে মনটা খারাপ ছিলো এখন ভালো লাগছে। উনি বলে উঠলেন,
“আপনি সিগারেট খান,নাকি ঔষধ খান? অভ্যাস পাল্টান। ভদ্রতার খাতিরে হলেও অভ্যাস শিথিল করা উচিত।”
আমি হাতের পেপারটা গোল করে ভাঁজ করতে লাগলাম। উনি আবার বললেন,
“আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। ভূত ভালোবাসেন?”
“ভূত কি ভালোবাসার জিনিস?”
“দেখুন মানুষের ভালো লাগা অনেক ধরনের। আমার এক বন্ধু আছে। ওর প্রিয় জিনিস মরা মানুষ। লাশ বেচাকেনার ব্যবসা করে। দুইবার ধরাও খাইসে। ওরে পুলিশ পিটিয়ে লাশ বানাইতে পারে নাই। লাশ দেখে দেখে নিজে শক্ত হয়ে গেছে। অদ্ভুত কিসিম এর মানুষ। কিসিম আর কিসমিস,দুটোই আমার খুব প্রিয়।”
উনি এক নাগাড়ে বলে গেলেন,আমিও এক নাগাড়ে শুনে গেলাম।
“আপনার কেনো মনে হলো আমি ভূত পাগল মানুষ?”
“হতেই পারেন। ভালোবাসা মানে লুতুপুতু ভালোবাসা না। ভয় পাওয়ার মধ্যেও ভালোবাসা থাকে। মানুষ ভূত ভয় পায়। কেউ যদি বলে সে ভূতে ভয় পায়না,আমি এই সিগারেটের প্যাকেটের কসম খেয়ে বলতে পারি তার সামনে ভূতের কাহিনী বললে সে ভয় পাওয়ার স্বরূপ তার পায়ের বুড়ো আঙুলটা একটু হলেও নাড়াবে। আমার একটা উক্তি আছে,ভূতে ভয় করে যেইজন সেইজন সেবিছে ভূতপ্রেমিক।”
“প্যাকেটের কসম খেলেন। ঘটনা যদি মিথ্যা হয়?”
“মিথ্যা হলে এই রাতে একটু পর বৃষ্টি নামবে,আমি ভিজে যাবো। তার সাথে আমার সিগারেটের প্যাকেট টাও বিড়াল-কুকুরের মতো ভিজবে।”
উনি হয়ত “It is raining cats and dogs” বাক্যটা কোথাও শুনেছেন। বাক্যের সাথে মানের মিল না খুঁজে পাওয়ায় উনি বিস্মিত। তাই নিজের মতো করে বিড়াল-কুকুর বলে চালিয়ে দিলেন।
আবারো উনার আওয়াজ শুনলাম,
“সিলেটের ট্রেন তো লেইট? আমি মোতালেব। বালুর ব্যবসা করি। ব্যবসা করি আর জোঁকের কামড় খাই। হে হে।”
উনার হাসিটা অদ্ভুত রকমের খারাপ। বালুর ব্যবসার সাথে জোঁকের কামড় কিছুটা মিলাতে পারছি। আমি বললাম,
“আমিতো আপনাকে বলি নাই আমি সিলেট যাবো।”
“এই স্টেশনে রাতের শেষ ট্রেন সিলেট এর। আপনাকে বেঞ্চে শুয়ে থাকা মানুষ এর মতো মনে হয় না। তারমানে আপনি যাত্রা করবেন। আর,যাত্রা করলে সিলেট এই যাবেন।”
মেঘ ডাকছে। আমি মনে মনে ভাবছি বৃষ্টি আসলে,ভালো হবে। তাড়াহুড়ো করতে যেয়ে গোসলটা করা হয়নি। বৃষ্টি পরিবেশ ঠান্ডা করে। সারাদিন গোসল না করা মানুষ সেই ঠান্ডা পরিবেশ উপভোগ করে। যদিও মাথা ব্যথা শুরু হয়। তার পরেও উপভোগ যোগ্য। উনি আবার সাড়া দিলেন,
“বৃষ্টি আসবে না। আমি বাজি ধরতে পারি।”
“যদি আসে?”
“আসলে আপনাকে একটা কেরামতি দেখাবো। বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে ভেজা ম্যাচ দিয়ে একটা ভেজা সিগারেট জালিয়ে খাবো। দুই টানে শেষ করবো। দুইটানে সিগারেট শেষ করলে,মাথা চিনচিন করে। এমন অনুভূতি আছে?”
“আমি তৃপ্তি নিয়ে সিগারেট খাই। এমন অনুভূতি নেই।”
“আজকে তাহলে দেখবেন কেরামতি। বৃষ্টি আসলেই দেখতে পাবেন।”
বৃষ্টি নয়,ট্রেন আসছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। ব্যাগটা নিলাম। উনিও উঠে দাঁড়ালেন।
“আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো। যাত্রা শুভ হোক। ট্রেনে যাত্রার আগে কলা খাওয়া উচিত। যাত্রা শুভ আর অতি দ্রুত হয়। একটাও দোকান খোলা নাই,নাহলে কলা খেতে বলতাম।”
আমি জবাব দিলাম,
“জ্বি,ধন্যবাদ।”
ট্রেনের আলো স্টেশনের পিলার গুলোতে বাড়ি খাচ্ছে। ট্রেনটা প্রায় চলে এসেছে। এইসময় হঠাত বৃষ্টি শুরু। আমি পাশে তাকালাম। দেখলাম লোকটা নাই। ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমি প্রায় ভিজে যাচ্ছি। নিচে তাকিয়ে দেখি সিগারেটের প্যাকেট আর ম্যাচের বাক্স পড়ে আছে। সেগুলো অসহায়ের মতো ভিজছে। বৃষ্টিতে বিড়াল-কুকুর ভিজলে যেমনটা লাগে,সেরকম লাগছে।
আমি ছুটে ট্রেনে উঠলাম। আর ভেজা যাবে না। সিটটা খুঁজে বসে পড়লাম। রুমালটা খুঁজে পেলাম না। ট্রেন চলা শুরু করলো। জানালা দিয়ে চোখটা বাইরে গেলো। মোতালেব সাহেব মেঝেতে বসা। তিনিও ভিজছেন। হাতে একটা সিগারেট। তিনি ভিজছেন আর সিগারেট খাচ্ছেন। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কাউকে সিগারেট খেতে প্রথম দেখছি। দূর থেকে আগুনের শিখা বেশী লাল মনে হচ্ছে। আমার পায়ের বুড়ো আঙুলটা অনবরত নড়ছে।

রাজিউল হোদা দীপ্ত
ঢাকা, বাংলাদেশ।