অটোয়া, সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪
প্রজাপতি মাস্ক - গুলজাহান রুমী

     আমরা চারজনের পরিবারে আমি হলাম সবচেয়ে ভীতু ও সংসারে দ্বিতীয় বয়োজৈষ্ট। গা'য়গতরে তেমন দশাসই না হলেও এক সময় লম্বায় ছিলাম উনার কাছাকাছি, কানের লতির সমান।আর এখন আমি সবচে বেটেখাটো হয়ে যাওয়া একজন! কীকরে যে এমন হয়ে গেলাম ভেবে পাইনা! বাচ্ছারা ছোট ছিল কিন্তু যতদিন যাচ্ছে আমি যেন বাকি তিনজনের চেয়ে ছোট হতে থাকলাম! একসময় বাচ্চাদু'টো কখনো কিছুতে ভয় পেলে আমার গায়ে লেপটে যেতো, বুকের ভেতরে যেন কাঙ্গারুর ছানার মত লুকিয়ে পড়তে চাইতো। তখন এদের নিরাপদ আশ্রয় ছিলো মা'র শরীরে ছায়ার মত লেগে থাকা। আর এখন এই সংসারে আমি সহজেই ভয়ে ভড়কে যাই, কখনো বাচ্চাদের আশ্রয় করে, কখনো ওদের বাবাকে আশ্রয় করে নিরাপত্তা তালাশ করি। উনি বলেন, বাঙ্গালি মেয়েদের জেনেটিক অসুখ এটি। আমরা নাকি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারিনা এজন্যেই এরকম হয়। কিন্তু নিজের একার জন্য নিজের পায়ে দাঁড়াতে কী এমন সুখ ভেবে পাইনা। সে জীবন হবে প্রাণহীন স্ট্যাচুর মত। একার জীবন।সকল আনন্দ বেদনা সংসারের সকলের সাথে মাখামাখি হলেইনা সুখের মূল্য থাকে, বেদনাও প্রাণ পায়। ওরা তিনজন মনের দিক দিয়ে এখন আমার চেয়ে অনেক সাহসী! আমি এত ভীতু, তারপরও অনেক কাজের কাজী একজন! ঘরের সব কাজ-কর্ম এক হাতেই সামাল দিতে হয! কখনো জলিল ড্রাইভার, কখনো কাজের বুয়া রহিমা, কখনো ধুপানি রাধা।
     দুধ-রুটি-লেবুর জন্য গৃহবন্দি অবস্থায় একদিন গেলাম বাজারে। একজন সৈনিক যেভাবে যুদ্ধে যেতে রেডী হয়, আমিও ঠিক সেভাবেই তৈরী হলাম। ড্রেসআপ হলাম, কিন্তু আমার মাক্স নেই, গ্লাভস নেই। এমনিতেই আমি ভীতু ও নরম মনের মানুষ। কি আর করা, ইয়া বড় এক ওরনা নাক ও মুখ পেচিয়ে উইনটার গ্লাভস পড়ে আল্লাহ নাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম! অনেক দিন পর খোঁয়াড় থেকে বের হয়ে বেশ ভালোই লাগছে! মনে মনে নিজেকে বহুত বড় যোদ্ধা ভেবে দোকানে গেলাম। বুকের ভিতরের ইনজিনটা বেশ সতেজভাবে কাজ করছে মনে হলো। হৃদযন্ত্রটা ধুকপুক করছেনা, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন ছন্দহীন আঁচড়ে পড়ছেনা দেহযন্ত্রের বালুকাবেলায়। মনে হল সবকিছু ঠিকঠাক আছে। প্রকৃতি তার আপন ছন্দে চলছে। দূরদেশ থেকে আসা পাখিগুলো নিজেদের ভাষায় কাকলি করছে। গাছেদের পাতাপল্লব বিকশিত হতেনা হতেই তাদের সংসারে নতুন ছানা আসবে। তারা সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়বে আরও বেশি। তারপর শীতের বার্তা পেয়ে কোথাও চলে যাবে উষ্ণ অঞ্চলে। তার আগে কত কাজ এদের। খাইয়ে দাইয়ে বাচ্ছাগুলোকে বড় করে তুলতে হবে, তারা যেন দীর্ঘ যাত্রাপথ পাড়ি দেবার উপযুক্ত হয়। এখানে পাখিদের সাথে আমাদের কত মিল। ঘরে বাচ্ছাদের খাবারের ডিম-দুধ নাই সে জন্য বাইরে করোনার ভয়কে জয় করে আমি উড়াল দিয়েছি খাবারের খোঁজে। প্রকৃতির বাসরে পাখিদের কোনো ভয় নাই। তারা দিব্যি পূর্বরাগের গান করছে, বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করছে, পোকামাকড় ধরে খাচ্ছে। কিন্তু আমাদের জন্য ঘরের বাইরে খোলা পরিবেশে অদেখা এক ঘাতকের সন্ত্রাস। ভাবতে ভাবতে দোকানে পৌঁছে গেলাম। গাড়ি বন্ধ করে যখন নামবো তখন আবার মনে হলো হৃদপিন্ডে হাতুড়ি পেটার শব্দ। তবুও অনেক সাহস নিয়ে দোকানে ঢুকলাম। দোকানে ঢুকে আমি ভুলেই গেলাম করোনায় অবরুদ্ধ জীবনের কথা। এক অপূর্ব অনুভূতি হলো। অবাক বিস্মযে অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখলাম চারদিক, হাটবাজার করতে আসা বিচিত্র মানুষগুলোর দিকে বারবার তাকালাম,  দেখতে চেষ্টা করলাম তাদের মধ্যে কোনো তরাস কাজ করছে কিনা। না, তেমন ভাবান্তর নেই কারও চেহারায়। নিরাপদ দূরত্ব রেখেই যার যার সওদাপাতি ট্রলিতে তুলছে সবাই। কিন্তু যেটা চোখে পড়লো,  সকলের মুখেই নানাবিধ ডিজাইনের মাস্ক। প্রজাপতির পাখনার মত ডিজাইন, রংচংয়ের বাহারও সেরকমই। হঠাৎ দেখলে ভ্রম হবে মানুষগুলোর নাকের উপর অতিকায় প্রজাপতি বসে আছে কিনা। এরই মধ্যে হরেক প্যাটার্নের সুরক্ষা-মাস্ক বাজারে এসে গেছে নাকি?  অনেকের আবার জামা-কাপড়ের সাথে মেচিং এক চিলতে মাস্কটাও। দেখে মনে হচ্ছে রঙবেরঙের প্রজাতি উড়ছে মানুষের মুখের উপর! এত এত বাহারের মাস্ক দেখতে দেখতে আমার উড়না প্যাঁচানো মাস্ক ততক্ষণে 'হাওয়ামে উড়তা যায়ে'। আবার ঠিকঠাক করে গিট্টি দেই তো অন্যপাশ আলগা হয়ে যায়। আবার ঠিক করি তো ওদিক খোলে।আমার এই এক স্বভাব। মনে হয় এরকম প্রজাপতি মাস্ক আমি সেলাই করে বানাতে পারি।
     আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে, করোনার জন্য বেশিক্ষণ বাজারে থাকা উচিত নয়। তাড়াহুড়ো করে চলে আসবো ঠিক সেই মুহূর্তে এক রূপসী চাইনিজের সামনে পড়ে যাই। খুব সুন্দর এক বিচিত্র রকম মাস্ক পরে এসেছে সে। মেজাজটা খুব বিগড়ে গেলো, মনে মনে একখান খারাপ গালি দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। ছয় ফিট দূরত্ব বজায় রেখে পাশ কাটিয়ে রাগে টাস টাস করে জোরে হেঁটে চলে আসলাম! মনে হলো চিনেদের দেমাগের উপর টাসটাস আঘাতগুলো বিঁধিয়ে দিলাম খুব। আজ ওদের জন্য সম্পূর্ণ বিশ্ব অচল, কিনা কি খায় তারা, কুত্তা-মেকুর সবকিছু। কতগুলো তরতাজা প্রান চলে যাচ্ছে, কত কত শিশু বাবা হারা মা হারা আজ, কত কত স্ত্রী হচ্ছে স্বামী হারা, স্বামী হচ্ছে স্ত্রী হারা। আরো কতগুলো প্রাণ যে যাবে, তারও কোন নির্দিষ্ট কেউ বলতে পারেনা। চিং-চাং-চুনং করে উনারা সূপ খায়। সাপের, ব্যাঙের, বাদুরের, কুকুরের আরও কত কি। এসব অখাদ্য খেয়ে এদের গায়ের রঙ এত হলদে হয় কেমনে বুঝিনা। চিনেরা সুপ বানাতে লাগে সাপ-বেং। আর আমরা বানাই নানান সবজি দিয়ে। করোনার বন্দিকালে বেশি বেশি করে সুপ খাওয়া হচ্ছে! এতে অনেক সুবিধা হলো বাচছারা কোন সব্জি খেতে চায়না! তাই এখন বড় এক হাড়ির ভেতর গরম পানিতে নানা জাতের সব্জি সেদ্ধ দিয়ে নুডুলস কিছু ছেড়ে দিয়ে মজাদার এক সুপ বানাই ইদানিং আমি! কি কি দেই, কতটুকুন দেই, কিছু ঠিক মতন জানিনা। তবে খেতে বেশ মুখরোচক লাগে বটে! আর ওরাও সবাই ফুৎফুৎ, সুৎসুৎ, করে খেয়ে ফেলে। কোনো কো্নো দিন আবার মজা একটু কম হলে দুইজন মহা বিরক্ত, মাম আজ কি দিয়েছ? এরকম লাল কেন?  ছেলে আমার, বলে, মাম তোমার সুপ এরকম কালার কেন? একদিন রেড, একদিন গ্রীন, একদিন ইয়োলো, একদিন অরেঞ্জ,কেন, মাম?  আমি ওর কথা শুনে হাসি! বলি মাম তো বুড়ো হযে যাচ্ছি! বুঝিনা বাবা, কখন কি দিয়ে ফেলি! আর এরকম বিভিন্ন কালার হয়ে যায়। আছা, মাম,  ঐদিন গ্রিন মতন করেছিলে, একটু মনে করে ওটা করিও! আমি বলি, ঠিক আছে বাবা!
     নেহাত জরুরী কিছুর প্রয়োজনে যদি বাহিরে যাওয়া লাগে, তাহলে তো মাস্ক লাগবেই। তাই ঘরে এসে কাপড় বের করে মাস্ক বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সেজো আপা ফোন দিলেন,  ভালোমন্দ এটা ওটা জিজ্ঞেস করে বললাম, আপা,  দেখেছেন বাজারে মাস্ক পাওয়া যাচ্ছেনা আজকাল। একটা মাস্ক বানাবো কতটুকুন কাপড় লাগবে,জানেন?
     ওমা, আমি কিভাবে বলব! তুই না সেলাই করিস কতকিছু? ঠিক আছে, আজ বানাবো একখান। স্কাইপে দেখাবো বিকেল বেলা।
     আমি বিকালে আবার ফোন দিলাম, আপা বানিয়েছেন?
     হ্যাঁ, বানিয়েছি।
     আমাকে প্লিজ ছবি পাঠান আপা।
     পাঠাচ্ছি।
     আপারটা দেখে মোটামুটি আমিও বানালাম একটা। সেখানটাতেও ছেলে এসে বাগড়া বসায়। মাম, এটা হয়নি। এই দেখো তোমার নাকের উপর দিয়ে ফাঁক রয়েছে, নীচের দিকও খোলা, তাছাড়া এইটা ফেব্রীকের। জার্ম ঢুকবে। আরে বেটা সবজান্তা মহাপুরুষ আমার। মুখ ঝামটা দিয়ে বললাম ছেলেকে।আর মনে মনে বললাম, চিন্তা করে দেখেছিস তোর বয়েসের ছেলেমেয়েগুলো যারা ইন্টারনেশনেল ষ্টুডেন্ট এদেশে এসেছে তাদের বিপদ? অল্প বয়স, অনেক কষ্টে যব করে পড়াশোনা চালায়। এই কোয়ারেন্টাইনের সময় ওরা কি খাচ্ছে, টাকা পয়সা আছে কিনা? কত দুর্দিন এদের। আর তুই এতবড় ছেলে এক প্যাঁক মাস্ক বাজার থেকে আনতে পারলিনা? কবে তুমি আর বড় হবে শুনি? আমার তেতো মেজাজ দেখে ছেলে কিছু বলেনা,মুচকি হাসে। কিন্তু পিচ্চিটা এসে বলে, মাম, সব মানুষের মাস্ক দরকার নাই, ডাক্তারদের দরকার। বাজারের মাস্ক সবগুলা কিনে লোকেরা নিয়ে গেছে। এখন ডাক্তাররা মাস্ক পাচ্ছেনা। মেয়ের বাচলামোতে চোখ রাঙালাম ওর দিকে। ওরা আমার কান্ড দেখে হাসে। তারা বুঝতে পেরেছে ঠিকমত কায়দা করে মাস্ক বানাতে নাপেরে মার এই কপট রাগ।

গুলজাহান রুমী। অটোয়া,কানাডা