বাড়ির ব্যাক-ইয়ার্ডে বা আঙিনার সাতকাহন - ফজলুল হক সৈকত
প্রতি শুক্রবারে সকালে আমাদের বাড়ির বাইরের আঙিনায় জামগাছের তলায় ইট বিছিয়ে বসতেন নিরেন নাপিত। ধুতিপরা উদোম দু-হাঁটুর ভেতরে মাথা চেপে ধরে কী দারুণ যত্নেই না চুল কামাতেন তিনি! দুপুর গড়ালে শুনতে পেতাম বরফ ওয়ালার ঢোপের ঢপঢপ শব্দ। হলুদ-লাল-সবুজ রঙের চিনি-দেওয়া মিষ্টি বরফ খেতাম ৪ আনা, ৮ আনা দিয়ে। গুড় দিয়ে বানানো কটকটি কিনতাম ভাঙা হাড়ি-পাতিল, বাতিল লোহার বিনিময়ে। স্কুলের মাঠের পাশে বসতো বায়োস্কোপ। গান শুনিয়ে শুনিয়ে রাজ্যের সব নায়ক-নায়িকা আর রাজা-বাদশাদের ছবি দেখাতো বায়োস্কোপওয়ালা। বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে নদীর ধারে কালিতলায় ছিল চন্দ্রকলা হরিকালি পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কালিতলায় বটগাছের নিচে প্রায়শই দেখতাম সিঁদুর-দেওয়া পুজোর কলা। বেয়াড়া ছেলেরা ওগুলো চুরি করে খেত। স্কুল থেকে মাঝে মাঝে রিলিফের ছাতু পেতাম আমরা। একমুঠো ছাতু আর একখণ্ড গুড়ের দলা। খেতে গেলে জামা-কাপড় নোঙরা হয়ে যেত। স্কুলের সেকেন্ড মাস্টার ছিলেন খুবই ব্যক্তিত্ববান। সেকেন্দার স্যার। তাঁর চাল-চলন আর পোশাক-আশাক ছিল সবার চেয়ে আলাদা। সারাক্ষণ চোখ লাল-লাল থাকতো। ছোটবেলার শিক্ষক বলতে তাঁর কথা আবছা আবছা ছায়ার মতো খুব বেশি মনে পড়ে। আর মনে পড়ে হেড মাস্টার নারায়ণ স্যারের কথা। তিনি খুব সুন্দর বাংলা বলতেন। আমার বাবার সময়ের হেড মাস্টারকে দেখেছি ধুতি পড়ে খালি গায়ে মাথা নত করে হেঁটে যেতে। তিনি না-কি বাংলায় অনুবাদ করে কোরআন পড়তে পারতেন; একবার আমাদের মসজিদের ইমাম সাহেবের আরবি উচ্চারণের ভুল ধরেছিলেন।
ঈদের দিন এলে সারাদিন খেলতাম; খাওয়া-দাওয়ার কোনো খোঁজ থাকতো না! খেলার সাথীদের মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলাম করিম আর আমিনুল্লার সাথে। সম্পর্কে দুজনই আমার চাচা হতো। আর খেলতাম রবকাকা, রকমত (রহমত) কাকাদের সাথে। তারা আমার চেয়ে বয়সে একটু বড়ো ছিলেন। ছোট বয়সি চাচাতো ভাই মজিদ, ফুপাতো ভাই মহম্মদ, চাচাতো বোন নাসিমা-রশিদা আর পাড়ার মেয়ে রমনা-নাজুদের সাথেও খেলতাম। ওসমান কাকার ছেলে আবু কালামের কথাও মনে পড়ে। সারাবছর মারবেল খেলা, মাঠে মাঠে ঘুরে ঘুরে পাখির বাসা থেকে ডিম-ছানা সংগ্রহ করা, ঘুড়ি ওড়ানো, বিলে-নদীতে মাছ ধরা, গাবগাছ থেকে গাব পাড়া, আম চুরি করে খাওয়া, পুকুরে নদীতে ঝাপাঝাপি করা, কলা গাছের ভেলায় চড়ে হাবুডুবু খাওয়া- এইসব ছিল আমাদের খেলার তালিকায়।
২
আমার দাদী কেবল ঈদের দিন নতুন শাড়ি পরতেন। যতদূর মনে পড়ে, তাঁকে সোজা হয়ে হাঁটতে দেখিনি। শুনেছি কোনো এক বৃষ্টির দিনে উঁচু ল্যাট্রিনের সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পড়ে গিয়ে মাজা ভেঙেছেন তিনি। সেই থেকে কুজোঁ হয়ে হাঁটা। প্রায় সারাদিন ঘরেই বসে থাকতেন; চোখ থাকতো আঙিনা জুড়ে বিস্তৃত! শেষের দিকে চোখেও ঝাপসা দেখতে শুরু করেছিলেন। তাঁর বিছানার ডানদিকে কতগুলো টিনের কৌটো সাজানো থাকতো। কোনোটাতে মিছরি, কোনোটাতে বাতাসা-খাগড়াই-কদমা। কোনোটাতে বিস্কুট কিংবা বাদাম। নিজের হাতে কৌটা খুলে নাতি-নাতনিদের খেতে দিতেন। চোখে ভালো দেখতেন না বলে কেউ কাছে বসলে আঙুল টিপে টিপে চেনার চেষ্টা করতেন। কতক্ষণ আঙুল নাড়াচাড়া করে মৃদুম্বরে বলতেন- কে ফজলু মিয়া... মন্নান মিয়া....টুকু মিয়া? দাদি মারা গেলেন এক রবিবারের সন্ধ্যায়। সেদিন আমার আব্বা তেবাড়িয়া হাটে গিয়েছিলেন কোরবানির গরু কিনতে। তার কয়েকদিন আগে ডিফথেরিয়ায় মারা গেছে আমার ছোট বোন মুক্তা। আমার বাবা অল্পদিনের মধ্যে তাঁর ২ মাকে হারিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেলেন। তখন থেকে তাঁর রাজনীতি, ডাক্তারি আর রাইসমিলের ব্যবসায় ভাটা পড়লো। আবুল - মানে আমার বাবা আবুল ডাক্তার বাড়িতে না-আসা পর্যন্ত দাদি ওষুধ খেতেন না। রাত যত গভীর হোক রাজনীতি-ডাক্তারি আর রাইসমিলে ধান ভাঙানোর কাজ তদারকি শেষে বাড়ি ফিরে আবুল ডাক্তার সোজা চলে যেতেন মায়ের ঘরে। তারপর ঘাম-ধুলো-গন্ধভরা পাঞ্জাবি-গেঞ্জি খুলে দিতেন আমার মায়ের হাতে। কলতলায় গিয়ে পানিকাচা করে উঠানে দড়ির ওপর ঝুলিয়ে রাখতেন। সারারাত বাতাসের টানে শুকাতো ওগুলো। সেবা-স্বচ্ছতা আর সততার যে পাঠ বাবার কাছ থেকে নিয়েছিলাম, একতিল নড়তে গেলে আজও আমার গাঁ কাঁপে। বুঝতে পারি - বিশ্ববিদ্যালয়ের বড়ো বড়ো বারান্দা আর বিরাট বিরাট ডিগ্রিধারি শিক্ষকের পাশে আমার জীবনে বাবাই সবচেয়ে বড়ো শিক্ষক।
আমার দাদা হাজি আনোয়ার আলীর প্রাইভেট ল্যাট্রিন ছিল আঙিনা পেরিয়ে রাস্তার ওপারে নদীর ধারে বাঁশঝাড়ের কাছে। সকালে-বিকালে পিতলের বদনা হাতে তিনি যেতেন ওই ল্যাট্রিনে। কোমরে কালো দাগায় বাঁধা থাকতো ছোট্ট চাবি। ল্যাট্টিনে টিপতালা লাগানো থাকতো কাঠের দু-পাল্লার বালায়। শেষ বয়সেও ঘাড়ের গামছা দিয়ে মাপতেন জমির সীমানা। পাট-চৈতালির ব্যবসা করে কিনেছিলেন প্রায় ১২০ বিঘা জমি। দাদির কাছে শুনেছি বড়ো নৌকা নিয়ে বের হতেন তিনি - কলকাতা, বম্বে হয়ে ফিরতেন ৪/৫ মাস পরে পরে। শেষ বয়সে প্রতি রমযানে মসজিদে এতেকাফে বসতেন। ডাবল পাঞ্জাবির ভেতরেরটায় বুকপকেটে রাখতেন টিপ ঘড়ি। শাদা রঙের ঝকঝকে ঘড়ি। টিপ দিয়ে ঢাকনা খুলে টাইম দেখে আবার ঢুকিয়ে রাখতেন সাবধানে। চেনের এক প্রান্ত আঁটকে রাখতেন পাঞ্জাবির বোতামের ঘাটে। মধুখালি গ্রামে প্রথম মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আমার দাদা; প্রথম পারিবারিক গোরস্থান করেছিলেন নিজের জমিতে। তখনও গ্রামে গ্রামে বাঁশঝাড়ে-জঙ্গলে কবর দেওয়ার রেওয়াজ চলছে - যেখানে দিনের বেলায়ও যেতে ভয় করতো। ইমাম সাহেবের জন্য বাড়িতেই করেছিলেন সপরিবারে থাকবার ব্যবস্থা। মসজিদের পাশে গড়ে তুলেছিলেন মক্তব। ইমাম সাহেবের কাছে আমরা গ্রামের সব ছেলেমেয়েরা ফজরের পরে আবরি পড়া শিখতাম। তাঁর বেতন-ভাতাও দিতেন দাদা। আমাদের গ্রামে পাঁচিল-দেওয়া ঈদগা তাঁর উদ্যোগেই তৈরি হয়েছিল। ভোরবেলা দড়িতে রঙিন কাগজ লাগিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো চারপাশে ও ময়দানের ওপরে। আব্বা কায়দা করে চোখে সুরমা লাগিয়ে জিন্না টুপি পরে ঈদগা যেতেন। কয়লাচালিত ইস্ত্রীতে টানটান করতেন পুরনো পাঞ্জাবি।
৩
হিল্লা হুজুর নামে এক মৌলবী আমাদের বাড়িতে লজিং থাকতেন। আঙিনার লাগোয়া টিনের ছাপড়া করা হয়েছিল তাঁর জন্য। আমাদেরকে সকালবেলা মসজিদে আরবি পড়াতেন। তিনি নোয়াখালী অঞ্চল থেকে এক ২০-২২ বছর বয়সী যুবতীকে হিল্লা বিয়ে করে চলে এসেছিলেন রাজশাহীর এই অজপাড়া গাঁ- মধুখালীতে। লোকটির বয়স আনুমানিক ৮০। আমরা খুব হাসাহাসি করতাম তাকে নিয়ে। সকাল থেকে জোহরের আগ পর্যন্ত তিনি দরোজা বন্ধ করে বউকে নিয়ে ঘরের ভেতরে থাকতেন। আমরা - ছোটরা, বাঁশের ঘারের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতাম। আবার ভয়ে দৌড়ও দিতাম। কিন্তু খুব মজা পেতাম আমরা। উনি না-কি হিল্লা বিয়ে করে পরে আর বউ ফেরত দেয়নি। সুন্দরী ছিল বউটি। গ্রামের অনেক যুবকের চোখ ছিল ওই হিল্লা বউটির দিকে!
৪
গ্রামের নাম মধুখালী। পশ্চিম পাড়ায় রাজশাহীর আদিবাসী স্থানীয়, পূর্বপাশে রিফিউজি পাড়া, মাঝখানে ২/৩ ঘর হিন্দুবাড়ি আর ২০/২৫ ঘর কুমিল্লা থেকে আসা পরিবারের হাজিপাড়া। আমার দাদা মো. আনোয়ার আলী ও তাঁর ছোটভাই ওয়াহেদ আলী হজ পালন করে আসার পর থেকে এই পাড়ার নাম হয়েছে হাজিপাড়া। তার আগে সম্ভবত কুমিল্লা পাড়া বলতো লোকেরা। আনোয়ার আলী প্রথম হজ করেছেন ১৯৬৯ সালে। ১৯৭৮ সালে করেছেন দ্বিতীয় বার। ১৯৪১ সালের দিকে তিনি আরো কয়েক পরিবারসহ চাঁদপুরের মতলব থেকে এসে এই অঞ্চলে বসতি গড়েন। দাদা বলতেন নৌকায় করে তাঁর বাবার সাথে কলকাতা, রেঙ্গুন না-কি গিয়েছেন। নৌকা থেকে দেখেছেন পাকশিতে পদ্মানদীর ওপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ তৈরি হতে। তখন তাঁর বয়স ছিল ১০/১১ বছর। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণ শুরু হয়েছে ১৯১১ সালে। তো, এই হাজি পাড়াতেই আমার বেড়ে ওঠা। জীবনের প্রথম ১৪ বছর পার করেছি এখানে। ঘর থেকে বেরিয়েছি সেই কবেকার কৈশোরে। আজো ঘরে ফেরা হয়নি। প্রথমে লেখাপড়া করার জন্য শহরে স্কুলে ভর্তি হয়ে নাটোর শহরে চাচার বাড়িতে। তারপর উচ্চশিক্ষার জন্য রাজশাহী। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমানো।
মধুখালী রাজশাহী জেলার পুঠিয়া থানার সর্বশেষ গ্রাম। পূর্বদিকে বালিয়াডাঙ্গা থেকে শুরু নাটোর জেলা (১৯৮৪-র আগে মহকুমা) গ্রামের পাশ দিয়ে বয়া চলা ছোট্ট নদী হোজা। ওপারে চাঁই পাড়া। পালতোলা নৌকা, জাল ফেলে মাছ ধরা, গরু-মহিষের সাথে মানুষের গোসল করা এসব ছিল শৈশব-কৈশোরের দেখা প্রতিদিনের দৃশ্য। নদীর ধার দিয়ে গ্রামের গা ছুঁয়ে যে সরু মাটির রাস্তা চলে গেছে পূর্ব-পশ্চিমে তার পাশে আম-কাঁঠালের গাছের ছায়ায় বসতো তাসের আড্ডা। কখনো কখনো দিনভর চলতো কেরামবোর্ড খেলা। তাস খেলা তখনো আমার শেখা হয়নি। তবে কেরাম খেলেছি প্রচুর। মারবেল খেলেছি এপাড়া-ওপাড়া ঘুরে ঘুরে। মাটির হাড়িভাঙা চাকতি দিয়ে ভেরেন্ডা খেলেছি। গাছ থেকে জাম্বুরা পেরে পাড়ার ছেলেরা মিলে খেলেছি ফুটবল। কখনো কখনো ফুটবল হয়েছে খড়-বিচালির গোলা। লুডু খেলার চল ছিল আমাদের বাড়িতে। মেয়েরা খুব খেলতো। যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, তখন প্রথম দাবা কিনেছিলাম। আঙিনায় হাডুডু, বদনখেলা ছিল আমাদের গ্রামের খুব পরিচিত খেলা। পাটখড়ির আড়ালে কিংবা ঘরের চৌকির নিচে সন্ধ্যার অন্ধকারে কত যে টুকটুক খেলেছি সে সব ভাবলে আজও মন কেমন করে! বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ডাঙগুলি খেলা, চোখ বেঁধে কানামাছি ছোঁ ছোঁ, কাঠ-বাঁশ দিয়ে নিজেদের বানানো বিয়ারিঙের গাড়ি চালানো আর ছিপ নিয়ে নদীতে পুঁটি মাছ ধরার দিনগুলো কী করে যে পিছনে ফেলে এলাম, আজ আর মনে করতে পারি না!
৫
ঈদের দিন এলে সকালের সব রান্না শেষ করে বাড়ির ব্যাক-ইয়ার্ড খালি পায়ে মাড়িয়ে পুকুরে গোসল করতে যেতেন আমার মা মমতাজ বেগম। তারপর করতেন সাজগোজ। মানে গামছা দিয়ে চটাং চটাং শব্দ করে চুল ঝাড়া, তেল-স্নো মাখা, নতুন শাড়ি পরা - এইসব আর কি! বাপের বাড়ির লোকেরা খুকি বলে ডাকে। নানিবাড়িতে গেলে এখনও সবাই আমাকে বলে খুকির ছেলে। ছোটবেলায় দেখেছি আমার মায়ের গাঁয়ের রঙ কাঁচা হলুদের মতো। আজ আর সে রঙ তার শরীরে নেই। তিনি বিধবা হয়েছেন ২০১১ সালে। মৃত্যুর মুখ থেকে ২ বার ফিরে এসেছেন মা আমার। আমি যখন খুব ছোট, মনে আছে, এক সন্ধ্যায় ঘরে চাউল রাখার মাটির মটকির পিছনে ওত পেতে থাকা সাপ কাপড়ে দিল তাঁকে। প্রায় সাতদিন জ্ঞান ছিল না। মানে একবার চোখ খোলেন তো আমার চোখ বোজেন সারাদিনের জন্য- এরকম অবস্থা। সেজ মামা ইসলাম খাঁ সাইকেলে করে ধোপাপাড়া না বিলমাড়িয়া থেকে ওঝা নিয়ে এসেছিলেন। পাড়ার অবিবাহিত ৭ জন মেয়েকে বলা হয়েছিল মাটির কলসিতে করে পুকুর থেকে পানি আনতে। একটা বড়ো চাড়িতে পানি রাখছে তারা। ওঝারা সমবেত কণ্ঠে কী যেন আওড়াচ্ছে আর মাথার ওপরে পানি ঢালছে। কী যে দমবন্ধ-করা সময় কেটেছিল তখন! আরেকবার কী যেন এক মেয়েলি রোগে - শরীর থেকে না-কি প্রচুর রক্ত বেরিয়ে গিয়েছিল, প্রায় মরণদশা হয়েছিল আমার মায়ের। মেজমামি পারুল ছিল আমার মায়ের বান্ধবী। মামির ভাই মন্টু ডাক্তার সিডি ফিফটি মোটর সাইকেল নিয়ে প্রায় ৭ মাইল পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন এসে চিকিৎসা করতেন। সম্ভবত সেই প্রথম আমাদের গ্রামে মোটর সাইকেলের প্রবেশ। আমি ছিলাম মায়ের দুরন্ত ছেলে। সকাল থেকে মা আমার রান্না ঘরে ব্যস্ত। বাইরে গরু-মহিষের দেখাশোনায় ক্লান্ত। দুপুরের রান্না শেষ করে চুলায় চাপিয়ে রাখতেন হাড়িভর্তি গরুর দুধ। রান্নাঘরের শেকল এঁটে যেতেন পুকুরে গোসল করতে। আর আমি সুযোগসন্ধানির মতো ছোট্ট কাঠের টুল এনে শেকল খুলে চুপ করে ঢুকে দুধের ওপরে জমে থাকা ভারি সর খেয়ে ফেলতাম মাঝে মধ্যে। আমার মায়ের ঘি-তোলার সর খেয়ে তখন খুব মাজাই পেতাম। আজ অবশ্য মনে পড়লে খারাপ লাগে। ঘরে কাঠের তাকে কাঁচের বয়ামে মা সাজিয়ে রাখতেন বড়ই-এর আচার, তেতুলের আচার। লুকিয়ে লুকিয়ে কাগজে পেঁচিয়ে হাফপ্যান্টের পকেটে রেখে কত যে আচার খেয়েছি। হয়তো কাপড় কাঁচতে গিয়ে মা আমার প্যান্টে লেগে-থাকা আচার দেখে মনে মনে হেসেছেন - কখনো এসব কথা জিজ্ঞেস করা হয়নি।
৬
হাইস্কুলে যখন উঠলাম, তখন প্রথম জুতো পড়তে শুরু করেছি। পায়ে নতুন জুতো, মাথায় রঙিন ছাতা নিয়ে আঙিনা পেরোনোর সে কী আনন্দ! আমরা ৩ ভাই বোন- আমি, আমার বোন রেখা আর জ্যাঠাতো বোন লাভলী - এক ক্লাসে পড়তাম। ১৯৮২ সালে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হলাম চন্দ্রকলা গ্রামে প্রতিষ্ঠিত নতুন স্কুলে। চন্দ্রকলা এস. আই হাইস্কুল। দক্ষিণ-পশ্চিমের গ্রামে প্রতিষ্ঠিত সরিষাবাড়ি স্কুলে না দিয়ে আমার বাবা কী ভেবে যে উত্তর-পূর্ব গ্রামের এই নতুর স্কুলে ভর্তি করলেন আমাদেরকে, কী রকম চ্যালেঞ্জ তিনি মাথা পেতে গ্রহণ করেছিলেন, তা ভেবে পাই না। অবশ্য মাঝে মাঝে মনে হয় ওই চ্যালেঞ্জটিই হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। কারণ সেখানে আমি পেয়েছি আমার জীবনের ৩ জন দার্শনিক শিক্ষকের সাক্ষাৎ; মনির স্যার - আমাদের সমাজবিজ্ঞান আর বাংলা পড়াতেন। যতটা না তিনি সমাজ আর বাংলা পড়িয়েছেন, তার চেয়ে বেশি শিখিয়েছেন জীবনের পাঠ। আমি এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরি আর লেকচার দিয়ে খাই। সত্যিকথা বলতে কী - আমি কিছুই পড়াই না, কেবল মনির স্যারের লেকচারকে নকল করে কী সব যেন আওড়িয়ে যাই! তিনি আমার চেতনার ভেতরে কখন যে প্রবেশ করেছেন, স্থায়ী একটা জায়গা করে নিয়েছেন, বুঝতেই পারিনি। আর ছিলেন তাহের স্যার। পড়াতেন ইংরেজি গ্রামার। কেবল তাঁকেই দেখেছি ইংরেজিভীতি ছাড়া ইংরেজি পড়াতে। আর আমাদের বিএসসি স্যার - সামছুল স্যার, বড়ো রোমান্টিক লোক ছিলেন তিনি। জীবনে চ্যালেঞ্জ নিতে জানতেন। প্রতিষ্ঠিত নামকরা ছাতনী স্কুলের চাকুরি ছেড়ে আমাদের স্কুলে এসেছিলেন। প্রেম করে এক ছাত্রীকে বিয়ে করে পরে চাকুরিও হারিয়েছেন। হিন্দুপাড়া, রিফিউজি পাড়া (মুর্শিদাবাদ থেকে ১৯৪৭ সালে এখানে আসা পরিবার নিয়ে গড়েওঠা ছোট্ট দুটি পাড়া ছিল এখানে - একটি রাজশাহী জেলার শেষ গ্রাম আমাদের মধুখালীতে, অন্যটি নাটোর জেলার শুরুর গ্রাম বালিয়াডাঙ্গার পর চন্দ্রকলার হিন্দুপাড়া সংলগ্ন), বালিয়াডাঙা, কামারপাড়া - এসব পার হয়ে আমরা যেতাম স্কুলে। চন্দ্রকলা রিফিউজি পাড়ায় প্রবেশের আগে পধের দুধারে দেখতাম খোলা জায়গায় মলমূত্র। মেয়েরা পর্যন্ত প্রকাশ্য দিবালোকে ছোট্ট গাছের ছোপের আড়ালে বসে পায়খানা করতো। কী যে অসভ্য ছিল ওরা! আর তখনো সেনেটারি পায়খানা গ্রামে গ্রামে তেমন একটা যায়নি। কামার পাড়া পার হতে হতে দেখতাম তালে তালে লাল তাতানো লোহার গায়ে হাতুরি মারার দৃশ্য।
হাওয়া নামের একটা মেয়ে পড়তো আমাদের ক্লাসে। ওর শাদা পায়ে কালো কালো ঘন লোম ছিল। চোখের ভ্রু ছিল টানা - ঘন পশমও ছিল। সবচেয়ে সরল ছেলে ছিল জমির। সবাই ওকে বোকা বলতো। তাহের স্যারের একটা ওপেন চ্যালেঞ্জ ছিল জমিরের কাছে - যদি সে কোনোদিন পড়া করে এসে মুখস্ত বলতে পারে, তাহলে তাকে সাথে সাথে ৫ টাকা বকশিস দেওয়া হবে। জমির যে চেষ্টা করেনি, তা নয়। কিন্তু পারেনি। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পেরছিল জমির। প্রাইমারি স্কুলে আমাদের ক্লাসে বরাবর যে ফার্স্ট হতো নরশেদ, পরিবারের দারিদ্র্যের কারণে হাইস্কুলে পড়তে পারেনি। বাবার সাথে ছুতার মিস্ত্রির কাজে নাম লিখিয়েছিল। অনেক পরে তাকে নাটোরের সদর সড়কে ভ্যান চালাতে দেখেছি। আমাকে দেখলে দাঁড়িয়ে পড়তো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেকদিন গল্প করেছি আমরা। নরশেদের চোখে লেগে-থাকা কী এক কষ্ট আমি কখনো ভুলতে পারি না। জয়িতা ছিল সবচেয়ে সুন্দরী। বছরের মাঝখানে জয়িতা স্কুলে আসা বন্ধ কওে দিল। শোনা গেল - এক রাতে তাকে আর তার বড়বোনকে কতগুলো মুসলমান ছেলে বাড়ি থেকে তুলে মাঠে নিয়ে ধর্ষণ করেছে। তারা না-কি ইন্ডিয়া চলে যাবে; এমন সময় আমরা বন্ধুরা দলবেঁধে দেখা করতে গেলে জয়িতা ঘর থেকে বের হয়নি। ওর মা আমাদেরকে নাড়ু খাইয়েছিল। তখন, হিন্দু-মুসলমান, অসাম্প্রদায়িকতা বুঝতাম না; পরে শুনেছি - জয়িতা এখানে থাকতে পারেনি।
সুভাষ ছিল আমার ঘনিষ্ট। ওকে সহপাঠী হিশেবে পেয়েছি ক্লাস নাইনে - বেলঘরিয়া শ. র হাইস্কুলে। চন্দ্রকলা স্কুলে ক্লাস এইটের বেশি অ্যাকাডেমিক পারমিশান না থাকায় আমরা ছড়িয়ে পড়েছিলাম বিভিন্ন দিকে। আমি আর আসলাম গিয়েছিলাম শহরতলীতে বেলঘড়িয়া স্কুলে। সুভাষরা সবজির চাষ করতো নিজের বাড়ির আঙিনায়। বাড়ির আঙিনা নয় - পরে জেনেছি, ওটুকুই ছিল ওদের চাষাবাদের জমি। সাইকেলে করে সবজি নিয়ে যেত নাটোরের স্টেশন বাজারে। সকালের হাটে ওসব বেচে তারপর আসতো স্কুলে ক্লাস করতে। চাঁইপাড়া ছেড়ে ওরা কবে যে পরিবারসমেত ইন্ডিয়া চলে গেল জানতে পারিনি। ওদের পাড়ায় রমেশ মাঝি ছিল। ফারাক্কা বাঁধ দেওয়ার পর যখন রাজশাহী অঞ্চলের সব নদী শুকিয়ে গেল, তখন রমেশ মাঝি রাতারাতি ডাক্তার বনে গেলেন। নৌকা ছেড়ে সাইকেলের পিছনের ক্যারিয়ারে দড়ি দিয়ে ওষুধের ব্যাগ শক্ত করে বেঁধে এগ্রাম-ওগ্রামে ডাক্তারি শুরু করে দিলেন। কিছুটা লেখাপড়া ছিল তার। তাই বাঁচবার জন্য হয়তো ডাক্তারি পেশাকেই রমেশ মাঝি সম্মানের মনে করেছিলেন। রমেশ মাঝিরাও চলে গেছে ইন্ডিয়া। চাঁইপাড়া পরে হয়েছে মুসলমান পাড়া। অবশ্য কেবল ছিদাম কাকা রয়ে গেছেন; ওই একটা পরিবার! কাঠের ব্যবসা ছেড়ে পরে মুদির দোকান দিয়েছেন বালিয়াডাঙা মসজিদের পাশে গড়েওঠা ছোট্ট বাজারে।
৭
এরশাদের প্রবল শাসনের সময়ে আমরা হাইস্কুলে। একদিন হঠাৎ দেখি আকাশ থেকে কাগজ বাতাসে ভেসে ভেসে মাটিতে পড়ছে; আমাদের বাড়ির ব্যাক-ইয়ার্ডও জুড়ে কাগজের ছড়াছড়ি! পাড়ার কত লোক যে দৌড়াচ্ছে ওই কাগজ ধরার জন্য। টাকা ভেবে লোকে প্রায় পাগলের মতো ছুটেছিল। মাটিতে যখন এক এক করে পড়তে থাকলো হেলিকপ্টার থেকে আসা কাগজ, তখন দেখা গেল - ওগুলোতে কী কী সব লেখা। আসলে ওগুলো লিফলেট ছিল। লিফলেটে কী লেখা ছিল? - ভাতের পরিবর্তে আলু খাওয়ার কথা? আজ আর মনে নেই!
ফজলুল হক সৈকত
ঢাকা, বাংলাদেশ
-
গাল-গল্প//সাক্ষাৎকার
-
09-06-2024
-
-