অটোয়া, শনিবার ১২ এপ্রিল, ২০২৫
ইলিশের ঝুড়ির বরফ - ইকবাল কবীর রনজু

মাথার উপর ঘরঘর শব্দ করে মরচে ধরা পাখাটা ঘুরছে কোন রকমে। ঘুরতে ঘুরতে যেন ক্লান্ত হয়ে গেছে। রেগুলেটরটা কাজ করে না অনেক দিন হলো। একবার পাখার দিকে তাকিয়ে চোখ ঘুড়িয়ে নেয় মৌমিতা। হাতের চামুচ দিয়ে ডিম কাটে মাঝ বরাবর।

খাবার খেতে বসে মাকে ডিম কেটে অর্ধেক করতে দেখে অবাক চোখে তার দিকে তাকায় আট বছরের মৃদুল। আগে সে মাকে ডিম কেটে ভাগ করতে দেখেনি কখনো। মৃদুলের স্কুল শিক্ষক বাবা আব্দুল লতিফ বাজারের তালিকা কাট ছাট করতে গিয়ে দুই হালির জায়গায় এক হালি ডিম এনেছেন। এ দেখে মৌমিতা স্বামীকে মুখ ফুটে কিছু না বললেও মনে মনে দুষেছেন নিজের ভাগ্যকে।

মৃদুলের মন এখনও ভাল হয়নি। মৌমিতাও লতিফের সাথে কথা বলছে না ভাল করে। হাঁপিয়ে ওঠা জীবনের একঘেয়েমী দুর করতে ক’দিনের ছুটি নিয়ে দূড়ে কোথাও বেড়াতে যাবে বলে কথা দিয়েছিল লতিফ। অন্যান্যবারের মতো কথা দিয়ে এবারও কথা রাখতে পারেননি তিনি। সকালে এ নিয়ে মৌমিতার সাথে কথা কাটা কাটি হয়ে গেল লতিফের। অভাবের সংসার, এটা বোঝার মতো বয়স ও সক্ষমতা ছেলেটার হয়নি। প্রায়শই মা-বাবার ঝগড়া বিবাদ দেখতে দেখতে বড় হতে হচ্ছে তাকে।

বাইরে কাজ না থাকলেও দুপুরের পর পরই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরলেন লতিফ। বাল্যকালের বন্ধু জলিলের সাথে দেখা করতে জাবরকোল গ্রামে গেলেন। জলিল এখন ফেরীওয়ালা। ওর স্ত্রী ঢাকায় কি একটা করে। ওদের সন্তানটা মায়ের সাথে ঢাকায়  থাকে। জলিলের সাথে সময় কাটানোর এক পর্যায়ে লতিফ দেখল, জলিল ভাত রান্না করার পর গরম ভাতের মধ্যে পানি ঢেলে দিল। হতবাক হলেও মুখে টু শব্দও করল না লতিফ।

জলিলের সাথে গল্প গুজব করে ফেরার পথে সময় কাটাতে লতিফ তার পুরনো বন্ধু জেষ্ঠ্য প্রভাষক হালিমের বালুচরের বাসায় গেল। একটা বেসরকারি আলিম মাদ্রাসায় পড়ায় হালিম। বেশ দিন পরে দুই বন্ধুর দেখা হওয়ায় গল্পের ঝুলিতে যা জমা হয়েছিল তা উগড়ে দিল হালিম। হালিমকে ঋণ, ধার-দেনা, দোকান বাঁকি করে চলতে হচ্ছে শুনে নিজের ব্যথার সাথে আরো বেশি ব্যথা যুক্ত হলো লতিফের হৃদগহীনে।

ফেরার সময় শাহী মসজিদ মোড়ে কিছু সময় দাড়ায় লতিফ। দেখা হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক খোকন মাস্টারের সাথে। তৃতীয় শ্রেণীর পদমর্যাদার খোকন মাস্টাররা দশম গ্রেডের দাবীতে আন্দোলন করছেন। দ্বিতীয় শ্রেণীর পদমর্যাদা পেতে আন্দোলন করতে হচ্ছে খোকনদের ভাবতেই অশ্বস্তি লাগে লতিফের।

খোকন বিদায় নেওয়ার পর রাস্তার দিকে তাকায় লতিফ। পাকা ভাঙ্গা রাস্তায় ভ্যান, অটোভ্যান চালকদের গাড়ির চাকা আটকে যাচ্ছে গর্তে। নেমে ঠেলে ঠুলে ভাঙ্গা পার হচ্ছে কেউ কেউ। পাকা রাস্তায় পায়ে পাক কাঁদা মেখে হাঁটছে পথচারী। পথচারীর পায়ের দিকে, গাড়ির চাকার দিকে তাকিয়ে অনেকটা সময় কেটে যায় লতিফের।

সন্ধ্যা পেড়িয়ে যাওয়ার পরও পথচারীদের দিকে তাকিয়ে থাকে লতিফ। অধিকাংশের চোখেই যেন বঞ্চনা, বিষাদ আর অপ্রাপ্তির ছায়া। মানুষের চোখগুলো অনেক দিন ধরে হিমায়িত করে রাখা মরা ইলিশের ঘোলাটে, কোটরে ঢোকা চোখের মত মনে হয় তার। চোখে স্বচ্ছতা নেই, উজ্জ্বলতা নেই। ভুল দেখছে কি না এই ভেবে দুহাতে চোখ কচলে লতিফ আবার রাস্তার দিকে তাকায়। এবারও একই রকম মনে হয় তার। এই মানুষগুলোর চোখ অতি দামী ও স্বাদের ইলিশ মাছের চোখের সাথে তুলনা করা ঠিক হলো কিনা বুঝতে পারছে না লতিফ।

আবার রাস্তার দিকে তাকায় লতিফ। যে রাস্তাতে হেটেছে মানুষ। হেটেছে সাধু, চোর, বদমাশ, লুটেরারা। হেটেছে ধর্মগুরু, হেটেছে বিপ্লবীরা। এখনও হাটছে।

উন্নয়নের নামে হালিমদের মতো মানুষদের করের টাকায় নির্মিত এমন রাস্তা, স্থাপনাসহ অন্যান্য প্রকল্পের কমিশনের টাকায়, অনৈতিক ভাবে উপার্জিত টাকায় নেতা আমলা নীতিনির্ধারকেরা আয়েশী জীবন যাপন করছেন, করেন সেইসব কথিত উঁচু শেণীর মানুষেরা লতিফ, মৃদুল, মৌমিতা, জলিল, হালিম, খোকন মাস্টার, ভ্যান চালক, অটো চালক, শ্রমিক, প্রান্তিক মানুষের কথা ভাবেনি। ভাবে না। উঁচু তলার নেতা আমলাদের উপর তীব্র ক্ষোভ হয় লতিফের। এ ক্ষোভ এ শ্রেণীর মানুষ দীর্ঘদিন যাবত পুষছে মনের মধ্যেই। 

এ রাস্তায় টয়োটা, বুগাতি, মার্সিডিজ, টেসলা বা বিএমডব্লিউ কি করে চলতে পারে তার আপন গতিতে ? লতিফের মতো মানুষেরা যারা বাজার থেকে কম দামে পঁচা তিঁতপুটি মাছ কিনে ইলিশের স্বাদ পেতে তিঁতপুটি মাছে ইলিশের ঝুড়ির বরফ দিয়ে বাড়ি নিয়ে আসে তারা উন্নত ব্রান্ডের দামী গাড়ি আশা করে না। তাদের আশা অতি নগন্য হলেও, চাওয়া খুব সীমিত হলেও বারংবার অগ্রাহ্য হওয়ায় যেন চাইতেই ভুলে গেছে তারা। 

রাতে বিছানায় শুয়ে লতিফ বঞ্চিত, শোষিতদের কথা, বৈষম্যের কথা, পণ্যমূল্য সবার জন্য এক হলেও বেতন স্কেলে এত অধিক সংখ্যক গ্রেডের কথা, মুক্তির কথা ভাবছিল। তখন উল্টোদিকে মুখ করে শুয়ে ছিল অতি সাধারণ ভাবে জীবনের অর্ধেকটা কাটিয়ে আসা মৌমিতা।

ইকবাল কবীর রনজু
চাটমোহর, পাবনা।