অটোয়া, বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪
হায়ারোগ্লিফিক প্রাচীন মিসরীয় লিপি - আলম তৌহিদ

‘হায়ারোগ্লিফ’ শব্দটি গ্রীক। এর অর্থ ‘উৎকীর্ণ পবিত্র চিহ্ন’। গ্রীকরা মিসর অধিকারের পর তাদের ধারণা হল যে, যেহেতু এই লিপির লিপিকার পুরোহিত এবং মন্দিরের গায়ে তা খোদাই করে লিখা হয়েছে, সুতরাং এগুলো ধর্মীয়ভাবে পবিত্র লিপি। গ্রীক উপসর্গ ‘হায়ারোস’ অর্থ ‘পবিত্র’ এবং ‘গ্লুফি’ অর্থ ‘খোদাই করে লেখা’। ইংরেজি ‘হায়ারোগ্লিফিক’ শব্দটি এসেছে ফরাসি ‘হায়রোগ্লিফিক’ থেকে,ফরাসি শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘হায়ারোগ্লিফিকাস’ থেকে এবং ল্যাটিন শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ ‘হায়ারোগ্লুফিকোস’ থেকে।    

মিসরীয় ‘হায়ারোগ্লিফিক’ বা মিসরীয় চিত্রলিপির বহুবাচনিক শব্দ হল মিশরীয় ‘হায়ারোগ্লিফিক্স’ অর্থাৎ মিশরীয় লিপিবিশেষ। প্রাচীন মিশরে তিন ধরণের লিপির প্রচলন ছিল। লিপিগুলো হচ্ছে হায়ারোগ্লিফিক, হায়রাটিক ও ডেমোটিক। গ্রীকরাই এই নামকরণ করেছে। হায়রাটিক শব্দের অর্থ ‘পুরোহিত সম্পর্কিত’। এটি ছিল হায়ারোগ্লিফিক লিপির সরল সংকলন। এর উদ্ভবের ফলে মিসরীয় সাহিত্যের সফল সূত্রপাত ঘটে। প্যাপিরাস প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে মিসরীয়রা প্যাপিরাসকে লিখন উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করে আর প্যাপিরাসে লেখার সুবিধা থেকেই উদ্ভব হয় হায়রাটিক লিপির। 

হায়ারোগ্লিফিকের বৈশিষ্ট্য ছিল শব্দলিপি ও অক্ষরলিপি নির্ভর। উদ্ভবের কাল থেকে বিলুপ্তি পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিল। এগুলোর অক্ষরলিপি ছিল ২৪টি একক ব্যঞ্জনধ্বনি এবং তার সঙ্গে যুক্ত ছিল কোন এক স্বরধ্বনি। স্বরধ্বনিটি ছিল ঊহ্য এবং এটির আলাদা অস্তিত্ব ছিল না। তাই এর চিহ্নও ছিল উহ্য। একটি ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের জন্য যে কোন স্বরধ্বনির সাহায্যের প্রয়োজন হত। এগুলোর দ্বিব্যঞ্জনধ্বনি ছিল প্রায় ৮০টি এবং এর সঙ্গে বিভিন্ন অবস্থানে ঊহ্য থাকা যেকোন স্বরধ্বনি। দ্বিব্যঞ্জনধ্বনির চিহ্ন ছিল একটি।   

মিসরীয় শব্দ শুরু হত ব্যঞ্জনধ্বনি দিয়ে। আবার কিছু কিছু শব্দের শুরুতে স্বরধ্বনি আছে। যেমন- Amon, Osiris ইত্যাদি শব্দ। কিছু কিছু ক্রিয়াপদও শুরু হয় স্বরধ্বনি দিয়ে। কিন্তু এগুলো থাকে ব্যঞ্জনধ্বনির সংক্ষিপ্ত উচ্চারণের ক্ষেত্রে এবং ঊহ্য অবস্থায়। এই পদ্ধতিতে হায়ারোগ্লিফিকের মাধ্যমে স্বরধ্বনি ঊহ্য রেখে কেবল ব্যঞ্জনধ্বনির সাহায্যে প্রকাশ পেত এক একটি পদ। শ্রুতির ঐতিহ্য অনুসরণ করে মানুষ বোঝে নিত কোথায় কোন স্বরধ্বনির সাহায্য নিতে হবে। এভাবে মানুষ হায়ারোগ্লিফিকের প্রকৃত অর্থ বোঝে নিত। একটি উদাহরণ দেয়া যায়, যেমন-নেফারতিতির নাম লেখার সময়  হায়ারোগ্লিফিকে লেখা হত nfrtt–শ্রুতির ঐতিহ্য অনুসারে মিশরীয়রা স্বরধ্বনি প্রয়োগ করে বুঝে নিত Nefertiti। 



হায়ারোগ্লিফিকে কিছু কিছু ত্রিব্যঞ্জনধ্বনি বিশিষ্ট চিহ্নেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। বড় বড় শব্দের জন্য এসব চিহ্ন ব্যবহার করা হত। মূলত এই লিখন পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করতেন মিসরীয় লিপিকারগণ। ঐতিহ্যের ধারা ঠিক রেখে তারা নিজেদের ইচ্ছে অনুযায়ী সাজাতেন অক্ষর। লিপি কোথায় লিখা হচ্ছে তার প্রেক্ষিত বিবেচনা করে লিপিকারগণ ঠিক করতেন লিপি ডান না বাম দিয়ে শুরু হবে। হায়ারোগ্লিফিক লিখনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি কখনও ডান থেকে শুরু হয়ে বামের দিকে, আবার কখনও বাম থেকে শুরু হয়ে ডানের দিকে যেত। কখনও কখনও উপর থেকে নিচে এভাবেও লিখা হত। লিখনের আরও একটি পদ্ধতি হচ্ছে ‘হলাবরত’ পদ্ধতি। এটি লিখা হত ডান থেকে বামে আবার বাম থেকে ডানে। এটি বুঝার পদ্ধতি হল মানুষ বা প্রাণীবাচক চিত্রের মুখ যে দিকে আছে অথবা হাত-পায়ের অবস্থান যে দিকটা নির্দেশ করছে সেই দিক দিয়ে পাঠ শুরু করতে হবে। তারপর যে দিকে গতি নেয় সেদিকে অগ্রসর হতে হবে।

হায়ারোগ্লিফিক লিপি ছিল চিত্র নির্ভর। বাস্তবধর্মীতা ছিল এইসব চিত্রের অনন্য বৈশিষ্ট্য। এইসব চিত্রের সাথে কিছু কিছু অলংকরণের ব্যবহারও ছিল। নির্ধারক চিহ্নের ব্যবহার ছিল হায়ারোগ্লিফিকের আরও একটি বৈশিষ্ট্য। এই চিহ্নগুলোও ছিল বাস্তবধর্মী। পৃথিবীতে সব ভাষায় কম বেশি সমস্বর শব্দ আছে। যেমন বাংলার তীর শব্দটি। এটি প্রয়োগের ক্ষেত্র বিশেষে অর্থের পরিবর্তন হয়ে যায়। ‘তীর ভাঙ্গা ঢেউ’ এবং ‘তীর বিদ্ধ পাখি’ এই পদদ্বয়ে ‘তীর’ শব্দটি ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করছে। প্রাচীন মিসরীয় ভাষায়ও সমস্বর শব্দের আধিক্য দেখা যায়। যেমন মিশরীয় ভাষায় ss শব্দ দ্বারা ‘লিপিকর’ ও ‘দলিল’ এই দ্বিত অর্থই প্রকাশ করে। নির্ধারক চিহ্ন ঠিক করে এটি কোথায় ‘লিপিকর’ ও কোথায় ‘দলিল’ বুঝাবে তা। ss – চিহ্ন এর সাথে একজন মানুষের ছবি থাকলে তা লিপিকর বুঝায় এবং লেখার ফলক বা পাতা থাকলে তখন বুঝায় দলিল। 

মিশরীয় লিখন পদ্ধতি চিত্রলিপি ও ভাবলিপির স্তর পেরিয়ে শব্দ ও অক্ষরলিপিতে প্রবর্তিত হয়েছে। কিন্তু সংখ্যালিপির বেলায় তা ভাবলিপির স্তরেই রয়ে গেছে। এই অবস্থাটি রোমান সংখ্যাচিহ্নেও দেখা যায় যেমন- I, II, III, IV, V ইত্যাদি। বড় সংখ্যা বুঝাতে ব্যবহার করা হত জ্যামিতিক ধরণের চিহ্ন। 

ফারাও রাজা মেনেসের রাজত্বকালে হায়ারোগ্লিফিক লিপির উৎপত্তি হয়। সম্পূর্ণ চিত্রলিপি না হলেও মিসরীয় হায়ারোগ্লিফিক লিপি ছিল চিত্ররূপময়। এই লিপি সর্বশেষ উৎকীর্ণ হয় ৩৯৪ খৃষ্টাব্দে ফিলিতে অবস্থিত দেবী আইসিসের মন্দিরে। ষষ্ট শতকে দেবী আইসিসের মন্দির বন্ধ করে দেয়ার মধ্য দিয়ে হায়ারোগ্লিফিক লিপির চর্চার সমাপ্তি ঘটে। 

গ্রীকরা মিসর দখল করলে তাদের বিশ্বাস ছিল হায়ারোগ্লিফিক পবিত্র লিপি। যতদিন পর্যন্ত এই বিশ্বাস গবেষকদের মাথায় ছিল, ততদিন এই লিপির পাঠোদ্ধারে কোন না কোন ভুল-ভ্রান্তিও ছিল। গ্রীক ঐতিহাসিক প্লুতার্ক (খৃষ্টপূর্ব ১২০-৪৬) মিসরীয় লিপিকে ধর্মীয় পবিত্র বিষয়াদি লিখার লিপি মনে করেছিলেন। তাঁর সমসাময়িক ইহুদি ঐতিহাসিক যোসেফাস মনে করতেন, এই লিপিতে লিখিত বিষয়াদি ধর্মীয় ব্যাপার নয় এবং এর মধ্যে ছোট বড় ঐতিহাসিক যুদ্ধ-অবরোধের বর্ণনা রয়েছে। এই লিপি সম্পর্কে আরও একটি ভ্রান্ত ধারণার উল্লেখ পাওয়া যায় ঐতিহাসিক হোরোপোল্লো রচিত ‘হায়ারোগ্লিফিক’ বইতে। হোরোপোল্লো জাতিতে মিসরীয় ছিলেন বিধায় সেই সময়কার ইউরোপীয় গবেষকগণ অন্ধের মত তাঁর ঐতিহাসিক বিবরণ ও হায়ারোগ্লিফিকের ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করেছিলেন। তিনি তাঁর বইতে অনেকগুলো হায়ারোগ্লিফিকের গ্রীক অনুবাদ দিয়েছিলেন। আঠারো শ বছর পর সত্যিকারের পাঠোদ্ধারের পর তাঁর ভুলগুলো ধরা পড়ে। তাঁর ভুলের কারণ ছিল তিনি তথ্যের সাথে নিজের কল্পনা মিশিয়ে দিয়েছিলেন।

পরবর্তীতে গণিত ও প্রাচ্যভাষার অধ্যাপক আথানিয়াস কির্শার এই লিপির পাঠোদ্ধারে এগিয়ে আসেন। তিনি কপ্টিক ও গ্রীক ভাষা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন যে, কপ্টিক ভাষা আসলে হায়ারোগ্লিফিকেরই বিবর্তিত রূপ। তাই তিনি কপ্টিক ভাষার মাধ্যমে হায়ারোগ্লিফিকের অনুবাদ করেছিলেন। তিনিও বিশ্বাস করতেন এই লিপি পবিত্র। ফলে তাঁর অনুবাদও ভুল পথে চালিত হয়েছিল। তিনি শব্দলিপিকে ভাবলিপি ধরে ধর্মসংশ্লিষ্ট অনুবাদ দাঁড় করালেন একটি স্মৃতিস্তম্ভের গায়ে উৎকীর্ণ সাতটি লিপিকে।

অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে হায়ারোগ্লিফিক সহ অন্যান্য মিসরীয় লিখন পদ্ধতি সম্পর্কে ভুল ধারণাগুলো ভাঙ্গতে শুরু করে। তখন থেকে অনেক গবেষক হায়ারোগ্লিফিককে শব্দলিপি বলে সন্দেহ করতে শুরু করে। সেই সময়ে গবেষকদের হাতে এলো উপবৃত্তাকার এক প্রকারের ফ্রেম। ফরাসি ভাষায় একে বলা হয় কার্তুশ। তাঁরা মনে করলেন এইগুলোতে ফারাও রাজা বা তাদের পত্নীদের নাম লেখা থাকতে পারে। ১৭৯৭ খৃষ্টাব্দে যোহান গেয়রগ তাঁর একটি বইতে এরকম অনেকগুলো কার্তুশের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেন সাদৃশ্য কার্তুশগুলো একই ব্যক্তির নাম এবং বৈসাদৃশ্য কার্তুশগুলো ভিন্ন ভিন্ন নাম। 

এরপর নেপোলিয়ন ১৭৯৮ খৃষ্টাব্দে মিসর আক্রমণ করেন। তাঁর সৈন্যরা ১৭৯৯ খৃষ্টাব্দে বিখ্যাত রোসেটা কৃষ্ণশিলাপট উদ্ধার করেন। রোসেটা কৃষ্ণশিলাপট ছিল আসলে একটি শিলালিপি। এতে একই সাথে রয়েছে তিনটি স্তর ও তিন স্তরে তিনটি লিপি। প্রথম স্তরে ছিল মিসরীয় হায়ারোগ্লিফিক লিপি, দ্বিতীয় স্তরে হায়ারাটিক লিপি ও তৃতীয় স্তরে গ্রীক লিপি। কিন্তু এগুলো রচিত হয়েছিল মিসরীয় এবং গ্রীক ভাষায়। ১৯৬ খৃষ্টপূর্বাব্দে টলেমি রাজবংশের রাজা পঞ্চম টলেমি এপিফানেস এক ফরমান জারী করেন, যা মিসরীয় পুরোহিতদের তত্ত্বাবধানে রোসেটা কৃষ্ণশিলাপটে উৎকীর্ণ হয়। এই দ্বিভাষিক ত্রিলিপি অংকিত শিলালিপিটিই খুলে দিয়েছিল মিসরীয় লিপি ও ভাষা পঠনের দুয়ার। পরবর্তীতে ফরাসি জা ফ্রাসোয়া শাপোলিয় এবং বৃটিশ পদার্থবিদ টমাস ইয়ং হায়ারোগ্লিফিক লিপির পাঠোদ্ধার করেন। 

সময়ে সময়ে হায়ারোগ্লিফিক লিপির বিবর্তন ঘটেছে। এটি বিবর্তিত হয়ে খৃষ্টপূর্ব ২৭০০ অব্দে হায়রাটিক লিপির রূপ পরিগ্রহ করে, পরে খৃষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দে এসে ডেমোটিক লিপির রূপ ধারণ করে। ডেমোটিক লিপি হল হায়ারোগ্লিফিক লিপির বিবর্তনের সর্বশেষ রূপ। এই লিপি চিত্রনির্ভর হায়ারোগ্লিফিক থেকে ধীরে ধীরে টানা টানা হাতের লেখার মত রূপ ধারণ করে। পূর্বের দু’টি লিপির চেয়ে ডেমোটিক লিপিতে দ্রুত লিখা যেত। 

আলম তৌহিদ । বাংলাদেশ