ল্যাম্পপোষ্ট - জাকির সোহান
কলকাতার যাদবপুর রেল স্টেশন এলাকায় বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো ছেলেদের একটা দল ছিল। সকলেই ভবঘুরে । সেই দলে ছিল রুস্তম মোল্লা- নামে যার জাতের পরিচয়। কায়স্ত ছেলে গনেশ। বড় গোপাল বাগদী, ছোট গোপাল কাওরা। কালচাঁদ সেও বাগদী। নারায়ণ আচার্য ব্রাক্ষ্মণ। ভীম পরামানিক- নাপিত। খ্রিস্টান ছিল দুই ভাই জহর, মিহির । অমল আর দুই বিমল ছিল। কালিয়া, ভোলা, বাঙাল নারাণ, ঘটি নারাণসহ আরো অনেকে ছিল সেই দলে। দল নেতা হচ্ছে মনো। যে একবারে আদি ও আসল চন্ডাল। তারা সবাই এক ঘাটে জল খেত। কার কি জাত তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি কখনো। সুখ তো নেই তাই সবাই ছিল সবার দুঃখে দুঃখী।
ভাবুক টাইপের মনো যখন যেটা পারে সেটা করে জীবিকা নির্বাহ করে। কখনো রিক্সা চালাত কখনো পাচকের কাজ করত। পাচকের কাজ করার সময় ছদ্মনাম ব্যবহার করত-মদন দত্ত। নইলে কাজ জুটত না। ইদানিং সে শ্রেণি সংগ্রামের বুলিও আওড়ায়। ছাব্বিশ বছর বয়সে জেলে যায় জঙ্গীবাদের অভিযোগে। নকশালদের পথে পা বাড়িয়েছে সে। বোমা, বুলেট, অস্ত্র তার নিত্য সঙ্গী। জেলবাস তার জন্য শাপেবর হয়ে আসে। এর আগে অ, আ-কিছুই শেখেনি। কিন্তু দু’বছর জেলে বসে শুধু অ, আ-ই নয় পেয়ে গেল জীবনের দীক্ষা।
দুই
কিছু সাম্প্রদায়িকপশু হামলে পড়েছে দলিত সম্প্রদায়ের পাড়ায়। আতংকে পলায়নরত এক তরুণীকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে কয়েকজন মানবপশু। মনো তত দিনে সশস্ত্র রাজনীতিতে জোড়ালো জায়গা করে নিয়েছে। তার লোকজন মানবপশুদের হাত থেকে পাড়াটাকে বাচাঁতে ব্যস্ত। মনো একাই পিস্তলে গুলি লোড করে গুলি ছুড়ে সেই তরুণীকে বাচাঁলো। অভয় দিয়ে তরুণীকে বাড়িতে পৌছে দিলো। এবং একাই সারারাত পাহারা দিলো তরুণীর বাড়ি। তরুণীর নাম রঞ্জনা। রঞ্জনার কাছ থেকে একদিন মনো পেল বিয়ের প্রস্তাব। এরপর বিয়ে।
নতুন সংসার সাথে আজন্ম বয়ে আনা অভাব। দণ্ডকারণ্যে মনো কাজের জন্য হন্য হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নববধূ রঞ্জনা রোজ দশ কি.মি সাইকেল চালিয়ে দুটো পয়সা এনে কোনো মতে একবেলা সামান্য আহারের ব্যবস্থা করছে। মনো বেকার! নতুন সংসারের জন্য কিছু করতে না পারার যন্ত্রণায় ছটফট করে। এর মধ্যেও থেমে থাকে না শ্রেণি সংগ্রামের লড়াই। ছোট ছোট জনসভায় মনো ঘোষণা করে-
‘যে যাহার সহায় হয়- সে তার ঈশ্বর।
যে ক্ষুধার্তকে অন্ন দেয়- সে ক্ষুধার্তের ঈশ্বর।
যে গৃহহীনকে গৃহ দেয়- সে গৃহহীনের ঈশ্বর।
যে বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেয়- সে বস্ত্রহীনের ঈশ্বর।
যে শিক্ষাহীনকে শিক্ষিত করে- সে তার ঈশ্বর।’
তিন
মনোর ভাব জগতে পরিবর্তন আর নেই। এখন সমৃদ্ধ হচ্ছে দিনকে দিন। কার্ল মাক্স, লেলিন, মাও তার আরাধনার বিষয়। তার দিনরাত পড়াশুনা চলছে, লেখালেখিও চলছে। রাজনীতি, বক্তৃতাও চলছে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর সান্নিধ্যে মনো পেয়ে যায় সাহিত্যের বিশাল আকাশ। দুই হাজার সালে প্রথম বই প্রকাশ হয়- ‘বৃত্তের শেষ পর্ব’ নামে। সে সুনামির গতিতে লিখে চলেছে-
‘বুদ্ধ পারেনি। যীশু পারেনি। মহম্মদ পারেনি। রাম-কৃষ্ণ পারেনি। হাজার হাজার বছর চলে গেছে। কত ধার্মিক এসেছে, বানী দিয়েছে। খেয়েছে, দেয়েছে, বিয়ে করেছে। বাচ্চা পয়দা করেছে। তারপর চলে গেছে। কত গুরু গোঁসাই এসেছে কেউ পারেনি। কোনো ধর্মের কম্ম নয়। পৃথিবীটা সুন্দর হতে পারে ধর্ম মুক্ত মানুষের দ্বারাই। তাই আসুন- ধর্ম মুক্ত মানুষের চাষ করি।’
চার
দুই হাজার বারো সালে বের হলো মনো’র জীবনী ‘ ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’। দ্রুত হাজার হাজার কপি শেষ। গোটা রাজ্যে তোলপাড় শুরু হলো।
বিখ্যাত পত্রিকা দৈনিক জাগরণ, মনোর ছবি দিয়ে হেড লাইন করল ‘ ছাই-ই জানে পোড়ার কি কষ্ট।’ আনন্দবাজার পত্রিকা লিখলো-‘ মনো ব্যক্তি থেকে বিষয় হয়ে গেছে’। কেউ কেউ বলতে লাগল এটাই প্রথম ‘দলিত সাহিত্য’।
দিনের পর দিন নিউজ হতে লাগল আকাশ বাংলা, জিটিভি, আরএস টিভিসহ নানা চ্যানেলে। যে মনো পুজিবাদ বিরুধী তাকে নিয়ে শুরু হলো টিআরপি-এর ব্যবসা!
মনো যত বড় সাহিত্যিক হোক না কেন, পেশা কিন্তু আগেরটাই। এতবড় সাহিত্যিক এইসব কাজ করে! এটা ভেবে পণ্ডিত সম্প্রদায়ের চোখ কপালে উঠে। সে দিকে মনোর নজর নেই। সে তো কারো মন জয় করার জন্য লেখে না। তার একটাই লক্ষ্য- দলিত জাতির মুক্তি।
লেখালেখির সুবাদে দুঃখ কষ্টের জীবনে হরেক রকমের সুখকর আনন্দ যোগ হচ্ছে মনোর জীবনে। তার জীবনী পড়ে নানান জায়গা হতে লোকে ফোন করে সাধুবাদ জানায়। অনেকদূর থেকে এসে একজন তার সাথে দেখা করে বলল, ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন-এর দ্বিতীয় খন্ড কবে ছাপা হবে? আসছে বই মেলায় এই বই চাই। যা খরচ হবে সব আমি দেব।’ মজার ব্যাপার, লোকটা নগদ সত্তর হাজার টাকা দিয়ে দিলেন নাম না প্রকাশ করার শর্তে!
সারাদেশে মনোর ডাক পড়তে লাগল বক্তৃতা করার জন্য। তার বক্তৃতা শোনার জন্য লোকের ভীর উপচে পড়ে। সে যেখানেই যাক না কেন তার গলায় থাকে গামছা। এ গামছা তার শ্রেণির প্রতীক, জাতির প্রতীক। বড়লোকদের সমাজে গিয়ে যেনো তার সমাজকে ভুলে না যায় তার জন্য এই গামছা সবসময় সাথে রাখে। গামছাটা আবার কখনো আত্মরক্ষার হাতিয়ারও! গামছার এক কোনায় এক টুকরো ইট বেধে যদি ঘুরাতে পারে তাহলে দশ বিশ জন দুশমন ধারের কাছে আসতে পারবে না। এভাবে বেশ কয়েকবার নিজেকে বাঁচিয়েছে সে। তাই যেখানে মনো সেখানে গামছা! নিজ সমাজের কাছে প্রার্থনা করে- যেনো সর্বত্র নমশূদ্র নামটা উজ্জল করতে পারে।
পাঁচ
শেষ বিকেলে সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। পুকুর পাড়ে বসে নিজের দায়িত্ব নিয়ে ভাবছে তারুণ্যদীপ্ত বৃদ্ধ মনো। সমাজের পরিবর্তনই যার সাধনা। বিশেষ করে দলিতদের। নিজে দলিত হওয়ায় সে ভালো করে জানে তাদের কষ্ট, যন্ত্রণা, দুর্ভোগ। সে চায় কিছু খুনী তৈরী করতে। যারা সমাজের লুটেরাদের খুন করতে পারবে। কায়েম করবে সাম্য। লাল টকটকে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে পরিচিত এক লোক তেত্রিশ দিন জেলবাস করে ছাড়া পেয়ে এলো মনোকে ধন্যবাদ জানাতে। মনো তো অবাক! কারন এই লোককে জেলে পাঠানো কিংবা জামিনে তার কোনো হাত নেই। তাহলে ধন্যবাদ কেন? লোকটা জানাল, আপনার বিভিন্ন লেখা পড়ে জেল বিষয়ে খানিক আগাম ধারণা হয়েছিল। কোন সমস্যা কিভাবে মোকাবিলা করতে হবে তা সবই আপনার বই থেকে আগেই পেয়েছি। তাই তেত্রিশ দিন তেমন অসুবিধা হয়নি।
জাকির সোহান
টাঙ্গাইল
বাংলাদেশ।
-
গল্প//উপন্যাস
-
07-01-2025
-
-