অটোয়া, শুক্রবার ১৮ অক্টোবর, ২০২৪
সুধীন্দ্রনাথের ‘সংবর্ত’: ব্যক্তির বিকাশ-ব্যাকুলতা - ড. ফজলুল হক সৈকত

দার্শনিক হীরেন্দ্রনাথ দত্তের পুত্র সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (জন্ম: ৩০ অক্টোবর ১৯০১; মৃত্যু: ২৫ জুন ১৯৬০) কলকাতার হাতিবাগানে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২২ সালে বিএ পাশ করে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ শ্রেণিতে পড়াশোনা করেছিলেন, কিন্তু সমাপ্ত করেননি। আইনশাস্ত্র পড়ার জন্য ল’ কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, তাও সমাপ্ত করেননি। ১৯৫৭-১৯৫৯ সালে আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন এবং এরপর কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ‘পরিচয়’ নামের বিখ্যাত সাহিত্যপত্রের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা এবং এটি তিনি ১২ বছর সম্পাদনা করেছিলেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের বিখ্যাত কাব্যগুলো হলো: তন্বী (১৯৩০), অর্কেস্ট্রা (১৯৩৫), ক্রন্দসী (১৯৩৭), উত্তর ফাল্গুনী (১৯৪০), সংবর্ত (১৯৫০) ও দশমী (১৯৫৯)। স্বাগত (১৯৩৮) এবং কুলায় ও কালপুরুষ (১৯৫৭) তাঁর প্রবন্ধের সংকলন। বাংলা কবিতার তিরিশোত্তর কাব্যসৃষ্টিতে যে পাঁচজন কবিকে পুরোধা রূপে চিহ্নিত করা হয়, সুধীন্দ্রনাথ তাঁদের একজন। প্রেম, হতাশা, বুদ্ধিবাদ ও দার্শনিক ভাবনা তাঁর কবিতার কেন্দ্রীয় বিষয়। তাঁর কবিতা ও প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্য হীরককাঠিন্য ও সংহত প্রকাশ। তিনি প্রয়োগ করেছেন অপ্রচলিত শব্দ, রচনা করেছেন অভিনব মাত্রার স্তবক। নৈরাশ্য, বিশশতকী সংশয় ও বিশ্বাসহীনতা এবং কলাগত উৎকর্ষ তাঁর কবিতাকে অন্যদের থেকে পৃথক করেছে।

কাব্যসংগ্রহের ভুমিকায় সুধীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘যদি প্রতিভাকে অলৌকিক বলে মানি, তাহলে বলতে হয় যে সহজাত বিশেষ একটি শক্তির প্রভাবেই উত্তম কবিতা রচনা সম্ভব।’ - সত্যিই তাই। সুধীন সারাজীবন তেমনটিই করে গেছেন। দেশ-কাল-পরিবারের সংলগ্নতায় থেকে জনকর্মে মন না দিয়ে তিনি শব্দময়, নীরব, ব্যক্তিগত কাজ করেছেন - কবিতাচর্চার ভেতর দিয়ে সময় পার করেছেন। সাধনা করেছেন কবিতা নিয়ে। কবিতার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। তাঁর আগে এবং পরে বাংলা সাহিত্যে এত ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে আর কোনো কবি কবিতা লেখেননি। জীবনের আনন্দ এবং সঞ্চিত ও অর্জিত অভিজ্ঞতাকে তিনি কবিতায় প্রয়োগ করেছেন। ‘সংবর্ত’ কাব্যপর্বে সুধীন এক বিশেষ অনুধাবনের ভেতর দিয়ে সময় অতিক্রম করছিলেন, তা হলো - ‘জগতে ভগবান যদি না থাকেন, প্রেম ও ক্ষমা যদি অলীক হয়, তাহলেও মানুষ তার অমর আকাঙ্ক্ষার উচ্চারণ করেই জগতকে অর্থ দিতে পারে।’ একথা ঠিক যে, সুধীনের কবিতার অর্থ উদ্ধার করা কঠিন কাজ। তবে তা দুঃসাধ্য নয় কিছুতেই। চেষ্টা করলে তার মধ্য থেকে তুলে আনা যায় অনাবিল আনন্দ ও গতিময় ধারা। তিনি শব্দকেই কবিতার মুখ্য উপাদান বিবেচনা করেছেন। খেলেছেন শব্দের খেলা। ‘সংবর্ত’ কাব্যের বিশেষত্ব হলো গ্রন্থের শুরুতে ‘নান্দীমুখ’ ও ‘উপসংহার’ নামে দুটি কবিতার অন্তর্ভুক্তি। প্রথম কবিতাটিতে তিনি প্রকৃতির অশেষ সৌন্দর্য ও রহস্যকে ধারণ করেন। প্রকৃতির অসীমতাও এখানে আরাধ্য হয়ে ওঠে। তিনি লিখেছেন সে-অনুভব। খানিকটা পাঠ নেওয়া যেতে পারে-
প্রকৃতির লীলা আবরি কুহেলীকানাকে.
ইঙ্গিতে যেন চায় অভিযোগ জানাতে;
তন্ময় ধ্যান ভেঙে যায় তার হানাতে।
প্রচ্ছদে ওই ছায়াপাত করে কারা?
কী নাম শুধাই - উত্তর নাই;
ঝরে শুধু বারিধারা।

দ্বিতীয় কবিতায় আছে সভ্যতা, মানুষের জীবনধারা, সময় এবং প্রতিবেশের কথা। যা কিছু ফেলে আসে মানুষ, তার জীবনে, তার ভেতরে কোনো তাৎপর্য বা অর্থ খুঁজতে যাওয়া যে বৃথাকর্ম, তা কবি তাঁর পাঠককে জানাতে চেয়েছেন। তিনি জানেন, কাল সবকিছুকে গ্রাস করে। হতাশা কিংবা ক্লান্তি কোনো মানুষের ভাবনার বিষয় হতে পারে না। ‘উপসংহার’ কবিতার শুরুটা এরকম-
সমাপ্ত সর্পিল পথ দিগন্তের পর্বতশিখরে,
তার পরে অপার নীলিমা।
কী হবে উদ্দেশ খুঁজে উর্ধ্বশ্বাস নক্ষত্রনিকরে?
এখানেই পৃথিবীর সীমা।
পশ্চাতে কিছু নেই। লোকালয় - সে কেবল নাম।

‘জেসন্’ কবিতাটি মানুষের একাকিত্ব আর নিঃসঙ্গতাকে নির্দেশ করে। সামাজিক দূরত্ব যে মানুষ সভ্যতার শুরু থেকেই ধারণ ও বহন করে চলেছে, তার সত্যাসত্য পাওয়া যায় এখানে। সংঘবদ্ধ জীবনে মানুষের পদার্পণ সভ্যতার প্রয়োজনে। কিন্তু মানুষ মানুষের কাছাকাছি কতটুকু আসতে পেরেছে - আক্ষরিক অর্থেও? পারেনি। একটা নির্দিষ্ট কিংবা কাঙ্ক্ষিত অথবা অদৃশ্য দূরত্ব তো রয়েই গেছে মানুষের মাঝে। এই সামাজিক দূরত্বটা সত্যি - আর সব বানানো কথা মিথ্যা। মানুষ মানুষের জন্য খুব বেশি নিবেদিত হতে পারেনি - স্বার্থের এই পৃথিবীতে। এই কবিতায় সুধীন লিখেছেন-
ভুলে যাই একা আমি; সঙ্গে ছিল যারা,
প্রলুব্ধ বন্দরে কিংবা পথকষ্টে আজ আত্মহারা,
কে কোথায় পড়ে আছে, জানি না ঠিকানা।

মানুষের প্রয়োজন বদলাচ্ছে। পাল্টাচ্ছে তাদের স্বভাব ও চরিত্র। সুধীন জানেন সে-কথা। সমাজেও প্রবেশ করেছে পরিবর্তনের প্রবাহ। রাষ্ট্র কিংবা সামাজিক কাঠামোও এক জায়গায় স্থির নেই। সৌন্দর্য, স্বপ্নময়তা জায়গায় হাত বাড়িয়েছে কঠিন-কঠোর বাস্তবতা - কর্মমুখর হয়েছে জীবন। আবেগের স্থানে থিতু হয়েছে বেগ ও বিজ্ঞান। ভালোবাসাটা এখন যেন মুখ্য নয় - কী পেলাম আর কী পেলাম না, সেই হিসাব এখানে প্রধান হয়ে দাঁড়ায় - যেন ‘প্রেম হেথা স্বভাব বণিক।’ তবে, প্রেমের বেলায় শরীর নয় শুধু - মন-ই হয়ে ওঠে আরাধ্য ও প্রধান ব্যাপার। ‘কাস্তে’ কবিতায় সুধীন দত্ত বলছেন সেইসব পরিবর্তনের খবর। যেন তিনি ভাষ্যকার - কোনো এক বদলে যাওয়া সমাজের। রুচিশীল, স্নিগ্ধ এই কবির কথা-
আকাশে উঠেছে কাস্তের মতো চাঁদ.
এ-যুগের চাঁদ কাস্তে।
বিপ্রলব্ধ প্রেতের আর্তনাদ 
মানা করে ভালোবাসতে। 
সংগমে মিছে খুঁজে মরি নিরাপত্তা,
ক্রমায়ত ঋণে ন্যস্ত আমার সত্তা,
আসে সে-বেতাল, তুমি যার বাগদত্তা,
দন্তিল হাসি হাসতে।

- এভাবে কবি সুধীন জীবনের সৌন্দর্যকে, আনন্দকে, সত্যিটাকে স্পর্শ করতে চেষ্টা করেছেন। পাওয়া-না-পাওয়ার হিসেবে মানুষের মন যে দারুণ স্থিতি ও গতির খেলায় মত্ত, তা তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। সুধীন দত্ত তাঁর কবিতচিন্তায় যে-বৈচিত্র্য ও অভিনবত্ব প্রকাশ করেছেন, তার সাথে পাঠকের পরিচয় ঘটে এই কাব্যের কবিতাগুলোর মধ্য দিয়ে। তাঁর 'বিপ্রলাপ’ কবিতায় পাই ঈশ্বরভাবনার প্রকাশ। তিনি বলছেন-
হয়তো ঈশ্বর নেই: স্বৈর সৃষ্টি আজন্ম অনাথ;
কালের অব্যক্ত বৃদ্ধি শৃঙ্খলার অভিব্যক্ত হ্রাসে;
বিয়োগান্ত ত্রিভুবন বিবিক্তির বোমারু বিলাসে;
জঙ্গমের সহবাসে বৈকল্যের দুঃস্থ সন্নিপাত।

ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন: 'ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে ভদ্রপল্লিতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। আর সুধীন অন্যত্র বলেছেন: ‘ভগবান তুমি কি নেই, আদৌ নেই’? পৃথিবীতে যাবতীয় অনিয়ম-অত্যাচার আর অত্যাচরীদের দাপট ও সুখের বহর দেখে হয়তো তিনি এ মন্তব্য করে থাকবেন। এই কবিতাটির শেষে তিনি বলছেন: ‘আমার শাস্তিতে, মানি, ক্ষান্ত তার অবরোহী পাপ।’ পাপের দুনিয়ায় মহান স্রষ্টার অবস্থিতি বা তাঁর অদৃশ্য রূপ সম্বন্ধে নানান অভিব্যক্তি রয়েছে। সুধীনের অবস্থানও তারই একটি মাত্র। ‘যযাতি’ কবিতায় আছে মুত্যু-ভাবনা আর পৃথিবীব্যাপি মানুষের গড় আয়ু-শান্তি-স্বস্তি আর কিছু করতে-পারা-না পারার কথা। তিনি বলছেন-
উত্তীর্ণ পঞ্চাশ: বনবাসে প্রাচ্য প্রাজ্ঞদের মতে
অতঃপর অনিবারণীয়; এবং বিজ্ঞানবলে
পশ্চিম যদিও আয়ুর সামান্য সীমা বাড়িয়েছে
ইদানীং, তবু সেখানেই মুত্যুভয় যৌবনের 
প্রভু, বার্ধক্যের আত্মাপরাহক। আশ্রুত তারক
অন্যত্রও অনাগত।

উন্নত বিশ্ব - ইউরোপ-আমেরিকার সাথে এশিয়ার জীবনধারার তুলনামূলক বিশ্লেষণের একটা ইঙ্গিত এই কবিতায় পাওয়া যায় বটে। ভারতে মানুষের জীবন, আর অন্যত্র মানুষের জীবন এক নয় - ভিন্নতর নানান অভিব্যঞ্জনায়। ফরাসি কবি র‌্যাঁবোর কথা তুলে তিনি বলছেন-
কিন্তু গত শতকেও উল্লিখিত গ্রামের সন্ধান
পায়নি স্বয়ং র‍্যাঁবো, সার্বজন্য রসের নিপাত
মৃগতৃষ্ণানিবারণে অসমর্থ বলে, সে যদিও
ছুটেছিল জনশূন্য পূর্ব আফ্রিকায়, পরকীয় 
সাম্রাজ্যবাদের প্রায়শ্চিত্ত কল্পে যেন (সাকী আর
কবিতা সেখানে যেমন অভাবনীয়, মদিরার 
অপর্যাপ্তি তেমনই দারুণ)। আমি বিংশ শতাব্দীর
সমানবয়সী; মজ্জমান বঙ্গোপসাগরে;

কবি র‍্যাঁবো একই সাথে কবিতা এবং অস্ত্রকে ভালোবাসতেন। লিখতেন কবিতা। আর বাণিজ্য করতেন অস্ত্রের। উনিশ ও বিশ শতকের বিশ্ব-পরিস্থিতির আলোকে বাঙালি সমাজ ও বাঙালি কবির সামাজিক অবস্থানের কথা বলতে চেষ্টা করেছেন সুধীন। আমাদের ভাবের বীরত্ব যে সবসময় কাজে লাগেনি- সভ্যতা ও পথ তৈরিতে, তা তিনি প্রকাশ করেছেন শৈল্পিক ভাষায়। শেষত কবি সুধীন, যাবতীয় কোলাহল, প্রতিযোগিতা, সভ্যতার ঘোরদৌড় থেকে নিজেকে ও অপরকে মুক্ত করে মুক্তির-পথ-অন্বেষায় আচ্ছন্ন হয়েছেন। প্রত্যাবর্তনের নেশায় ব্যাকুল হয়েছেন। ‘সংবর্ত’ গ্রন্থের শেষ কবিতা ‘প্রত্যাবর্তন’-এ জারি করেছেন উদাত্ত আহ্বান। জীবনের শেষ বেলায় মানুষের চিন্তা, প্রত্যাশা আর পাওয়া-না-পাওয়ার হিসেব দাঁড় করিয়েছেন তিনি। লিখেছেন- 
গোধূলি উড়িয়ে, সন্ধ্যায় হাওয়া যখন ওঠে,
নিস্কলঙ্ক, নিত্য সভস্তলে
নক্ষত্রের প্রাক্তন কারুকার্য ফোটে,

আর তিনি কল্পনা করেন অবারিত সুন্দরের - ‘বামে বিস্তৃত নারিকেলবীথি – বনচ্ছায়া স্বচ্ছ বিরল গ্রামের ধবল লেপে; - শাদার ভেতরে যে শান্তি, তা-ই হয়তো শেষাবধি খুঁজেছেন কবি সুধীন। তিনি দেখেছেন চারিদিকে বড়ত্বেও দৌড় এক সময় থেমে যায়- নয়তো প্রকৃতিই কোনো-না-কোনোভাবে থামিয়ে দেয়। তাঁর ভাষায়: ‘আকাশে পাতালে উত্থান পাত একদা থামে,’ - সুবিধাবাদেরও একদিন সমাপ্তি ঘটে। চারপাশে চলে কেবল ব্যক্তির বিকাশের আকুলতা। খানিকটা পাঠ নিচ্ছি এই কবিতার শেষাংশ থেকে- 
ইস্তানবুল্ সাধে গম্বুজ, মিনার থেকে;
কৃষ্ণসাগর গর্জায় উত্তরে।
সুবিধাবাদের ক্লৈব্য বাচাল দম্ভে ঢেকে,
নাতিদূরে কারা সুয়েজের ধুয়ো ধরে?

এইভাবে পৃথিবীর, সভ্যতার, মানুষের বিচিত্র চিন্তা আর চরিত্র প্রকাশ করেছেন কবি সুধীন্দ্রনাথ আপন অভিজ্ঞতা আর ভাবনার ঔজ্জ্বল্যে।  

ড. ফজলুল হক সৈকত। বাংলাদেশ
(ড. ফজলুল হক সৈকত: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ; সংবাদ পাঠক, বাংলাদেশ বেতার; ফ্রেঞ্চ ভাষার প্রশিক্ষক; কলামিস্ট; কবি ও গল্পকার।)