শাওলি - ফরিদ তালুকদার
- শব্দ হচ্ছে কিসের? কী করছিস?
- পেরেক মারছি
- পেরেক মারছিস? কোথায়?
- হৃদয়ে
- হৃদয়ে পেরেক মারছিস? পাগলের মতো কথা বলছিস কেন?
- পাগল নয়, ঠিকই আছি এবং এখন ঠিক থেকেও সঠিক হওয়ার চেষ্টা করছি।
- মেনে নিলাম ঠিক আছিস, কিন্তু হৃদয়ে পেরেক মারতে হবে কেন?
- আলাদা আলাদা প্রকোষ্ঠ বানাবো। যার কোনোটার নাম হবে ভুল, কোনোটার নাম কষ্ট, কোনোটার নাম...
- থাম থাম আর বলতে হবে না। বুঝতে পেরেছি।
- না থামবো না। শেষ করতে দে। আর সবগুলো প্রকোষ্ঠ নিয়ে যে ঘর, তার নাম হবে শাওলি!
- থামলি? না আমি চলে যাবো?
- যা চলে যা। গত সপ্তাহে এসে বললি ব্যবাসায়িক কোনো রাজকুমার আসছে তোকে দেখতে। সপ্তাহ পরে এসে ইনিয়ে-বিনিয়ে বলবি—ভেবে দেখলাম, বাবা-মার কথা না শুনলে ওরা খুব কষ্ট পাবে! আমি হতভাগা তখন কী করবো? মাথা নিচু করে হাজারবার দেখা এই রুমের মেঝেটাকেই আবারও পড়তে পড়তে অস্ফুট স্বরে বলবো--- 'তাই কর, ওদের পছন্দই মেনে নে। সুখী হবি। জীবনে সুখটাই বড় কথা!'
কথাটা বলতে বলতে সজলের কন্ঠটা এখনই কেমন ভারী হ'য়ে এলো!
সাওলি ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
- তোর বলা শেষ হয়েছে?
- আমাদের জীবনের গল্পগুলোর দৌড় তো এমনই হয়, এক অসমাপ্ত পথে সমাপ্তি টানে! এ আর নুতন কী!
- ওকে বুঝলাম। এবার ওঠ। চল বাইরে যাবো।
- ইচ্ছে নেই।
- ইচ্ছেটা তোর না, আমার। চল ওঠ।
- কোথায় যাবি?
- বলবো না। তোকে উঠতে বলছি ওঠ!
শাওলির দিকে কিছুটা হ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকে সজল। একটু ধমকের সুরে শাওলি বলে উঠে,
- এভাবে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছিস কেন? যেভাবে আমাকে আবিস্কার করেছিলি সেভাবে জেগে ওঠ!
- তুই ভুলে যাচ্ছিস মাঝে সাতটা বছর পার হ'য়ে গেছে।
- সাত বছর আর সাতশো বছর, ভুলি নাই কিছু। আমি তোর আত্মসম্মান বোধকে ( self-esteem) অবনমনের জন্যে ভালোবাসিনি। কথাটা ভুলে যাসনে!
ক্ষয়ে গেলেও জুতোর তলায় দিয়াশলাই এর কাঠির তীব্র ঘসায় তো কেবল আগুনই জ্বলে! সজলের বুকের চাতালে এখন যেন সেই আগুনই জ্বলে উঠলো! সে কিছু না বলে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। মিনিট দুয়েক পরে বেরিয়ে এসে বললো চল।
চিলে কোঠা থেকে সিঁড়ি পথে রাস্তায় নেমে এসে শাওলি একটা রিকসা ডেকে বললো,
- বাংলা একাডেমি, যাবেন?
- যাবো আপা।
- ভাড়া?
- আপনি যা দিবেন।
রিকসায় উঠে সজল বললো,
- বুঝতে পারছি না। এখন এই সময়ে বাংলা একাডেমিতে? সব তো বন্ধ আজ ওখানে। কেন যাচ্ছি?
- ভেবেছিলাম ওখানে গিয়েই বলবো। যা হোক স্মরণ করিয়ে দেই। নিশ্চয়ই ভুলে যাসনি আমাদের প্রথম দেখার সেই দৃশ্য, কী বলেছিলি মনে আছে?
- ভুলবো কেন? এ নিয়ে কতোবারই তো আমরা কথা বলেছি।
- বলেছি। কিন্তু এখনো কিন্তু তুই আমার পায়ে চুমু খাসনি!
হো হো করে হেসে দিয়ে সজল বললো,
- ও এই জন্যে ওখানে যেতে হবে? তা এখানে এখনই খেলে কী সমস্যা? তোর পদযুগল তো এখানেও তেমনই মনোহরণ এবং আমৃত্যু এমনই থাকবে আমি জানি। রিকসাওয়ালা ভাই আপনি থামেন।
- না রিকসা থামবে না। আমরা ওখানেই যাবো এবং ঠিক যেই স্থানটায় আমি রিকসায় উঠতে উঠতে কোথা থেকে একটা উদভ্রান্ত হ্যাগার্ডের মতো ছুটে এসে বলেছিলি—‘এই মেয়ে তুমি কী জানো তোমার পা দু'টো কেমন হৃদয়হরণ! আমি কি একবার ঐ পায়ে চুমু খেতে পারি?’ আজ ঠিক ওখানেই আমি রিকসায় বসে থাকবো আর তুই আমার পায়ে প্রাণভরে চুমু খাবি।
- তাহলে চল আগে একটা মাইক নিয়ে ঘোষণা দিয়ে ওখানে লোক জড়ো করে নেই। যেদিন এই অঘটনটা ঘটিয়েছিলাম সেদিন তো ওখানে হাজার মানুষের ভিড় ছিলো। তেমন না হ'লে কি জমে? সেদিন তো চুমু খেতে দিলি না। কেমন ভীত সন্ত্রস্ত হ'য়ে অবজ্ঞা, করুণা আর দু’চোখে পৃথিবীর সব ঘৃণা এক করে তাকিয়ে থেকে শুধু বললি– ‘আপনি কি পাগল? আমি কিন্তু চিৎকার করবো। এই রিকসা, আপনি চলেন তো ভাই!’
- বলেছিলাম, কিন্তু দু'দিন পরে মেলায় সেই হাজার লোকের ভিড় থেকে তোকে কে আবার খুঁজে বেড় করলো? সে কি আমি না অন্য কেউ? এখন যা বলছি তাই কর। হাজার মানুষের সামনে চুমু খাওয়ার সখ থাকলে আগামী মেলায় আবারও খাবি! আজকে এই রিকসাওয়ালা ভাই-ই শুধু সাক্ষী থাকুক। ভাই আপনি কিছু মনে করবেন না তো?
- না আপা। আমি আর কী মনে করুম!
- বুঝলাম। কিন্তু তার পরের দৃশ্যটার একটু ধারণা দে?
- তারপর ওখান থেকে কাঁটাবনের ফুলের দোকানে।
দু'টা পরিবারের মাঝে মন-মানস, পারিবারিক নিয়ম-রীতি, অর্থ-বিত্তের তফাৎ সবটা ছবিই মুহূর্তে ভেসে উঠলো সজলের মানসপটে। সে একটু গম্ভীর হ'য়ে বললো,
- সমুদ্র দেখেছিস তো সাও?
- দেখেছি, কেন জিজ্ঞেস করছিস?
- তুই কিন্তু সাঁতার কেটে সেই সমুদ্রকে পাড়ি দেয়ার এক অসম যুদ্ধে নামছিস!
- এ নিয়ে ভাবার জন্যে আমি অনেক সময় নিয়েছি সজ! আমাদের ভাগ্যের গন্তব্য সবটাই আমাদের হাতে আছে বলে আমি মনে করি না। যে সত্যকে হৃদয়ে আবিস্কার করেছি, পৃথিবীতে যদি একদিনের জন্যেও বাঁচি তার কাছেই সমর্পিত হয়ে বাঁচবো। এটা আমার সিদ্ধান্ত। তুই আতংকিত হচ্ছিস কেন? সফল না হতে পেরে সমুদ্রে যদি ডুবেও যাই তো তোর সাথেই তো ডুববো! তো ভয় কিসের?
কমলাপুর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাওয়ার পথে রাস্তার এই অংশটি খুবই এবড়ো-খেবড়ো। গ্রাম্য কাদামাটি রাস্তায় গরুর গাড়ি যেমন, এখানে রিকসাগুলো-ও তেমনি ভাবে ক্যাঁচর-কোঁচর শব্দ করতে করতে এপাশে-ওপাশে হেলে দুলে এগোয়। সতর্ক না থাকলে মাঝেমধ্যে পড়ে যাবার উপক্রম হয়! সজলের বা হাতটা তাই শাওলির পৃষ্ঠদেশ জড়িয়ে ওকে সক্ত করে ধরে রাখলো।
ফরিদ তালুকদার
টরন্টো, কানাডা
-
গল্প//উপন্যাস
-
31-12-2024
-
-