অটোয়া, সোমবার ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
ঢাকা মেইল - ইকবাল কবীর রনজু

বৃষ্টি ভেজা স্যাঁতসেতে দেয়ালের ইটের ফাঁক ফোঁকর থেকে চুন-সুড়কি খসে পরছে। দেওয়ালের কোথাও কোথাও বিবর্ণ লাল রঙ ঢেকে গুল্ম জাতীয় পরজীবি উদ্ভিদগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। আবার কোথাও লতা গুল্ম নিজের ভর সইতে না পেরে পরাজিত হয়ে বয়সের ভারে মেরুদন্ড বেঁকে যাওয়া মানুষের মত নিচের দিকে ধাবিত হয়ে অর্ধমৃতাবস্থায় ঝুলছে। অথচ কি আশ্চর্য ছাদের উপর ছোট ছোট পাইকার গাছগুলো সবুজ পাতা ডালপালা মেলে তর তর করে উপরে উঠছে যেন। পাশের চায়ের দোকানের বৈদ্যুতিক বাল্বের আলো ঠিকরে না পরলে রাতের মৃদু আলোয় হয়তো এ চমৎকার দৃশ্যটি আমার অদেখাই থেকে যেত।  

বোঝা যায় এক সময় লাল রঙে ঢাকা ছিল পুরো দেওয়ালটি। অযত্নে অবহেলায় ক্ষয়ে যাওয়া লালচে ইটগুলোর প্রায় অর্ধেকাংশ হাতির দাঁতের মতো বেড়িয়ে পরেছে দেওয়ালের বাইরে। ভাঙ্গা কাঠের দড়জাটি তালাবদ্ধ। মরিচা ধরা তালার দিকে তাকালেই বোঝা যায় অনেক দিন খোলা হয়নি। দড়জার পাশে ঝুলে রয়েছে এক খন্ড লোহার রেলের পাত। হকার নেই, কোলাহল নেই। ব্যস্ততা নেই কারো। ওয়ান ওয়ে হওয়ায় অপর একটি ট্রেনকে ক্রস করার সুযোগ করে দিতে গুয়াখড়া স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল ঢাকা মেইল। রাতের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের নিচ দিয়ে মাথা নিচু করে রেল লাইন পারাপার হচ্ছে দু চারজন মানুষ। সময়ের চেয়ে জীবন অনেক বেশি মূল্যবান হলেও সময় বাঁচাতে ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা করছে না এই মানুষগুলো। রাত এগারোটা বেজে গেলেও এপার-ওপারে কিছু দোকানপাট খোলা তখনও। আলোর ঝলকানি নেই নিভৃত পল্লীর এই ছোট্ট রেলওয়ে স্টেশনটিতে। স্টেশনটি আমার ভাল লেগে যায়।

নির্ধারিত গন্তব্যহীন আমার যাত্রাপথ। ঢাকা মেইলকে পাশ কাটিয়ে উচ্চ শব্দে হুইসেল বাজিয়ে দ্রুত গতির একটি আন্তনগর ট্রেন চলে যায়। আমি এদিক ওদিক হাটতে থাকি। ঢাকা মেইলও ভেপু বাজিয়ে ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে। ক্রসিং এর সময় আমার মতো আলসেমি এড়াতে নিচে নামা মানুষগুলো গন্তব্যে পৌছিতে দ্রুত উঠতে থাকেন ঢাকা মেইলে। এক পা দু পা করে ট্রেনের দিকে এগিয়ে গেলেও শেষতক ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক ট্রেনে উঠিনা আমি। ট্রেনের গতি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এক সময় আমাকে রেখে রাতের অন্ধকারে মিশে যায় ঢাকা মেইল। আমি কান পেতে ট্রেনটির চলে যাওয়ার শব্দ শুনি, যতক্ষণ শোনা যায়।        

বেশ কিছু দিন যাবত আমার মাথায় গল্পের কোন প্লট আসছিল না। তাড়ণা তাড়িত না করায় জোড় করে লিখতে বসিনি। ছোট গল্প লেখায় স্বাচ্ছন্দ বোধ করলেও গত তিন চার মাসে দু একটা কবিতা ছাড়া আমার অন্য কোন লেখা পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। নতুন ছোট গল্প লেখা শুরু করলেও দু চার লাইন লেখার পর তা যুতসই মনে না হওয়ায় কি বোর্ডের ব্যাক স্পেসে গিয়ে মুছে ফেলেছি। আমার লেখা ছাপেন এমন পত্রিকার সম্পাদকদের সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হায়..হ্যালো করার সময় তারা লিখেই ফেলেন বেশ কিছু দিন হলো আপনার নতুন লেখা পাচ্ছি না। নিজের অপারগতা প্রকাশ না করে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাই আমি। নেশায় আসক্তরা প্রয়োজনের সময় নেশার দ্রব্য না পেলে যেমন অস্বাভাবিক আচরণ করেন, কষ্ট পান, তেমনি আমার মতো পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়সের একজন লেখক লিখতে না পারার কষ্টে ভুগছিলাম। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে আমার স্ত্রী সুবর্ণা আমাকে কয়েক দিনের জন্য বাইরে থেকে ঘুরে আসতে অনুরোধ করে। ব্যাগ গুছিয়ে দেয়। ঢাকা থেকে গন্তব্যহীন যাত্রায় আমি উঠে পরেছিলাম ঢাকা মেইলে । 

স্টেশনের দুই পাশের দোকানগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যায়। অচেনা এলাকা, কি করবো, কোথায় থাকবো এমন ভাব বা আবেগও আমায় তাড়িত করেনা। তাড়ায় খচিত আকাশের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকি আমি। ধীরে ধীরে তারা গুলো অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকে। আষাড়ের যে আকাশ একটু আগেও তারায় ভরা ছিল হঠাৎই সে আকাশ মেঘে ঢেকে যায়। টিপ টিপ বৃষ্টি পরতে থাকে। এখানে বারণ করার মতো কেউ না থাকায় আমি ভিজতে থাকি। অনেক দিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় না। শেষবার যখন খোলা ছাদে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম তখন আমার সাথে সুবর্ণাও ছিল।

চারপাশ নিরব, নিস্তব্ধ। বৃষ্টির বেগ একটু বেড়েছে। আলোর ঝলকানিতে একটু দুরে একটা ছায়া মুর্তির মতো কি যেন চোখে পরে আমার। আমাকে কাঁপিয়ে তোলে বজ্রপাতের শব্দ। শরীর হিম হয়ে আসছে। হ্যাঁ, মানুষই তো। লোকটা পা টিপে টিপে এগিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়ায়। মানুষটির দিকে তাকাই আমি। কত বয়স হবে অন্ধকারে বুঝতে পারি না। আন্দাজ করি চল্লিশের কোটায় হবে হয়তো।

-ভিজছেন? অপরিচিত লোকটার এমন প্রশ্নের উত্তর কি হওয়া উচিত সহসা বুঝে উঠতে পারি না আমি।

উল্টো প্রশ্ন করি, আপনি কি প্রায়শই ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভেজেন?

না। সোনিয়া যে রাতে নিখোঁজ হয় সে রাতটায় খুব ভিজেছিলাম। সারা রাত ঝড় বৃষ্টি ছিল। বাসস্ট্যান্ড, রেলওয়ে স্টেশন, আত্মীয় স্বজনের বাড়ি কোথাও খুঁজে পাইনি ওকে। শেষ রাতের দিকে শরীরে কাপুনী ওঠে, জ্বর এসে যায়। বেশ কদিন ভুগেছিলাম।

-সোনিয়া কে?

-আমার স্ত্রী ছিল।

-এখন নেই?

-ও আছে বটে, কিন্তু এখন আর আমার নেই। 

লোকটার মুখ থেকে যেন আর কথা বেড়োয় না। নিশব্দে কেটে যায় কিছু সময়। এর পর জানতে চান আমি কোথায় যাবো।

-তাইতো। আমি কোথায় যাবো তা তো একদমই ভাবিনি।

-আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে বাইরে থেকে এসেছেন। এখানে থাকার মতো কোনো হোটেল পাবেন না আপনি। চাইলে আমার সাথে অনায়াসে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারেন।

সোনিয়া নামটি এরই মধ্যে আমার মাথায় গেঁথে গেছে। মেয়েটা ওর স্ত্রী, হয়তো নিখোঁজ হয়েছিল। একটা গল্পের ক্লু অন্তত পেয়ে যাই আমি। জানি না গল্পটা কিভাবে সাজাবো। আদৌ এটা কোন গল্প হবে কি না? কিন্তু কোথাও না কোথাও তো আমাকে রাতটা কাটাতে হবে। লোকটার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই আমি। ভাবি একবার ফোন করে বিষয়টি সুবর্ণাকে জানাবো কিনা। কৌতুহল চেপে লোকটিকে অনুসরণ করে তার বাড়িতে রাত্রী যাপন করি।

আমার অনুমান মিথ্যে হয়নি। আশ্রয় দাতার ডাকে যখন আমার ঘুম ভাঙে তখন তার হাতে গরম চায়ের কাপ আর পাশ ভাঙা পিরিচে দুটো টোস্ট বিস্কিট। চায়ের কাপের ধোয়া উপরে উড্ডিমান। আড়মোরা ভেঙে উঠে বসি আমি। ভদ্র লোকের বয়স বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ হবে। সাড়ে পাঁচ ফিটের মতো উচ্চতা। গায়ের রং কালো। একটা চোখ টেরা মনে হলো। লম্বাটে মুখাবয়বের মধ্যে ঢুকে পরেছে ভাঙা চোড়া চল চোপড়া। কাল রাতের সামান্য কথোপকোথন আর বাস্তবতা এ দুয়ের যোগসাজসে তাকে দিনের আলোয় এক নজর দেখেই অনুমান করি মনস্তাত্বিক গভীর সংকট মোকাবেলা করে অযতœ অবহেলায় ভঙ্গুর দেহটি বহন করে কোন মতে টিকে থাকার সংগ্রাম করছে সে। আমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলি, আপনার নামটা জানা হয়নি এখনো।

-আমি রাসেল রহমান। তবে অনেকে আমাকে শিশির নামে চেনে। যখন কবিতা লিখতাম এই ছদ্ম নামটা ব্যবহার করতাম।

চায়ে চুমুক দিয়ে রাসেলকে আপাদ মস্তক নিরীক্ষণ করি আমি। আমাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি এবং ধন্যবাদ জানাই। কিছুটা ইতস্তত প্রকাশ করে রাসেল জানায়, সোনিয়া চলে যাওয়ার পর মেয়েটা কিছু দিন আমার সাথে ছিল। তারপর মেয়েটাও একসময় মায়ের কাছে চলে গেলে সেই থেকে আমি সম্পূর্ণ একা হয়ে পরি। কখনো কাজ করি কখনো বন্ধু ও পরিচিত জনদের নিকট থেকে কোন রকমে চেয়ে চিন্তে দিনাতিপাত করছি।

-কাল রাতে বলছিলেন সোনিয়ার খোঁজ পেয়েছিলেন। তার পর কি হলো?

-মুহুর্তের মধ্যে রাসেলের মুখাবয়ব বদলে যায়। তার চোখের পর্দায় সোনিয়ার সাথে কাটানো সময়ের অসংখ্য স্মৃতি ভেসে ওঠে। অতীত রোমন্থনের ফলশ্রুতিতে রাসেলের চোখ দিয়ে জল ঝরতে থাকে নিরবে। কিছু সময়  নির্বাক কাটানোর পর হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখের পানি মুছে রাসেল বলতে থাকেন তার জীবনের গল্প। আমি এখন এক কৌতুহলী নির্বাক শ্রোতা মাত্র। 

সোনিয়া ছিল অসম্ভব সুন্দরী। বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত এমন সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে গ্রামের দরিদ্র পিতা-মাতাকে অনেক সময়ই দুশ্চিন্তায় দিন কাটাতে হয়। এলাকার যুবক ছেলেদের বদ নজর থেকে সম্ভ্রম রক্ষায় আমার শ্বশুরও দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিলেন। আমি তখন বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছিলাম। বিয়ে করার উদ্দেশ্যে সোনিয়াকে যেদিন দেখতে যাই সেদিন ওর রূপ দেখে আমি স্তম্ভিত হই। সৈন্দর্য্য যেন শরীর থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছিল। তখন ওর বয়স সবে আঠারো। আমি মুগ্ধ হই এবং মনে মনে ভাবি যে কোন ভাবেই হোক এই মেয়েটিকে আমার পেতেই হবে। সোনিয়াদের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর আমার আত্মীয় স্বজন পারিপার্শ্বিক খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারেন স্বেচ্ছায় হোক আর বাধ্য হয়ে হোক ইসতিয়াক নামক এক বখাটে ছেলের সাথে সোনিয়া প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ। সোনিয়াদের বাড়িতে ইসতিয়াকের অবাধ যাতায়াত। আমার পরিবারের পক্ষ থেকে এ বিয়েতে মত না থাকলেও আমার একান্ত ইচ্ছা থাকায় শেষতক পরিবারের সবাই বাধ্য হয়ে এ বিয়েতে সম্মতি দেয়।

বিয়ের দিন ক্ষণ হয়ে গেলে ইসতিয়াক আমাকে প্রাণ নাশের হুমকী দিতে থাকে। এতে সোনিয়াকে পাওয়ার আকাঙ্খা আমার আরো বেড়ে যায়। আমিও এক রোখা হয়ে পরি। আমার বাবা তখন একটা সরকারী অফিসের কেরানী। মোটামুটি ভালই বেতন পেতেন। গ্রামে সামান্য জমিজমা ছিল। শহরে ছোট্ট একটি বাড়ি। আমার বাবা মা বেঁচে ছিল তখন। কাজেই আমার সাথে সোনিয়াকে বিয়ে দিতে সোনিয়াদের পরিবারের পক্ষ থেকে কোন আপত্তি ছিলনা। ধুমধাম করেই আমাদের বিয়েটা হয়ে গেল।

বিয়ের কিছু দিন পরই হুট করে আমার বাবা মারা যান। মা আমাদের দুই ভাইকে বাবার অভাব বুঝতে দেননি। সংসারটা আগলে রাখছিলেন। মাস ছয়েক পরে কদিনের জ্বরে মাও ওপারে পাড়ি জমান। বাবা মা হারিয়ে এতিম হয়ে গেলাম। ঠিক সেই মুহুর্তে অভাব বোধ কি তা বুঝিনি। বাবার রেখে যাওয়া জমানো টাকা ফুরিয়ে এলে অভাব কি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেতে থাকি। এসময় সোনিয়া আমার পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছে। 

আমার কোন কর্ম নেই তখনও। সোনিয়া গর্ভবতী হয়। ছোট ভাই সবেমাত্র ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর করে বেড়িয়েছে। পড়া লেখায় আমি এগুতে পারিনি। ছোট বেলায় দীর্ঘ দিন টাইফয়েড জ্বরে ভুগেছি। বেশ কিছুদিন নাকি আমার মস্তিষ্ক বিকৃত ছিল। মেজাজটা এখনও খিটমিটে হয়ে ওঠে কোন কোন সময়। পঞ্চাশ পার্সেন্ট স্কলারশীপে ছোট ভাই কানাডায় পড়তে যাওয়ার সুযোগ পেলে ও ওর অংশের জমি টুকু বিক্রি করে কানাডায় পাড়ি জমায়।

আমার মেয়ে মৌমিতা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর দায়িত্ববোধ বেড়ে যায় আমার। ছোট খাট কাজে নিযুক্ত হই। মন টেকে না। এক মাস এখানে তো আরেক মাস ওখানে কাজ করি। মাঝে মধ্যেই কাজ ছেড়ে দেই। বেকার থাকি। এভাবে চলতে চলতে মেয়েটার বযস বছর দুয়েক হয়ে যায়। সংসার চালানো যখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পরে আমাকে না জানিয়েই সোনিয়া একটা স্পা সেন্টারে কাজ নেয়। স্পা সেন্টার সম্পর্কে বিরুপ ধারণা থাকায় ওর এ কাজটিকে আমি মন থেকে মেনে নিতে পারি না। কিছু দিন যেতে না যেতেই বন্ধু বান্ধব সোনিয়াকে নিয়ে নানান নেতিবাচক মন্তব্য করতে থাকে। আমি মর্মাহত হই। ওর উপার্জনের টাকায় তখন আমাদের সংসার চলে। ওকে স্পা সেন্টারের কাজে যেতে নিষেধ করলে এ নিয়ে প্রায়শই আমাদের মধ্যে বাক বিতন্ডা হতো এবং কখনো তা হাতি-হাতি পর্যন্ত পৌঁছে যেত।

আমার একটা ড্রাগ লাইসেন্স ছিল। একবার মেডিসিনের একটা দোকানও দিয়েছিলাম। হাত যশ ছিল। হাত খরচের কিছু টাকা ও লাগতো। বাড়ির আশেপাশের রোগিদের স্যালাইন, ইনজেকশন পুশ করতে আমার ডাক পরতো। এতে যৎসামান্য টাকা আসতো আমার। পরিচিত নেশায় আসক্তরা ইনজেকশন পুশ করে নিত আমাকে দিয়ে। দেখতাম, নেশার ঘোড়ে ওরা সবকিছু ভুলে থাকতো। যেদিন সোনিয়ার সাথে বড় ধরণের ঝগড়াঝাটি হতো সব কিছু ভুলে থাকতে আমিও নেশার ইনজেকশন নিতাম। ধীরে ধীরে নেশা গ্রাস করে আমাকে।

সোনিয়ার সাথে বিভিন্ন সময়ে খুনসুটি, ঝগড়া ঝাটি, হাতা-হাতি হলেও এভাবেই অতিবাহিত হয়ে যায় আরো কয়েক বছর । মৌমিতা স্কুলে যায়। ও অষ্টম শ্রেণীতে ওঠে। সোনিয়া তখনও স্পা সেন্টারে কাজ করে। আমার সাথে কাটানো জীবন দূর্বিসহ হয়ে উঠেছে বলে মাঝে মধ্যেই ও আমাকে তালাক দেওয়ার হুমকী দেয়। আমাকে বাধ্য করে বসত বাড়িটি সোনিয়া নিজের নামে গোপনে রেজিষ্ট্রি করে নেয়। সংসারটি যেন টিকে থাকে এ আশায় আমি বাড়িটি পর্যন্ত ওর নামে করে দেই।

সোনিয়া আবার গর্ভবতী হয়। এটি গত বছরের কথা। এক রাতে বাসায় ফিরে শুনি স্পা সেন্টার থেকে ফিরে সোনিয়া বাড়ির পাশের দোকানে ওষুধ কিনতে গেছে। অনেক সময় পেরুলেও সোনিয়া বাড়িতে ফেরে না। আমি আশ পাশের দোকানে সোনিয়ার খোঁজ করি। কেউই ওর সন্ধান দিতে পারে না। আমি ফোন করলে সোনিয়া জানায়, জীবনের প্রতি ও খুবই বীতশ্রদ্ধ। আত্মহত্যা করতে রেল লাইনে গেছে। আমার মাথায় যেন বাজ পরে। অনেক রাত তখন। দিগ্বিদিক হারিয়ে নিকটস্থ রেল লাইনের দিকে হাঁটতে থাকি। আকাশে মেঘ জমে। ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়। সারা রাত ঝড় বৃষ্টি ছিল। রেল পথ, রেলওয়ে স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, আত্মীয় স্বজনের বাড়ি কোথাও খুঁজে পাইনি ওকে। শেষ রাতের দিকে শরীরে কাপুনী ওঠে, জ্বর এসে যায়। বেশ কদিন ভুগেছিলাম।

তিন দিন পর এক সকালে মহুয়া এসে আমাকে জানায় তার স্বামী মনোয়ার সোনিয়াকে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে এবং তাদের বাড়িতে নিয়ে গেছে। এ খবরে আমার সারা শরীর অবশ হয়ে আসে। মুখ দিয়ে যেন কোন কথা বেরুচ্ছিল না। আমার ভেতরটা তখন ভেঙ্গেচুরে চুরমার হচ্ছিল। মনোয়ারকে আমি চিনতাম। সোনিয়াদের দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। সেই সুবাদে মাঝে মধ্যে মনোয়ার আমাদের বাসায় আসতো। আমরাও যেতাম মনোয়ারদের বাড়ি। তবে ওদের মধ্যে সম্পর্ক আছে বা হয়েছে এটা কখনো টের পাইনি আমি।

মেয়ে মৌমিতাকে দেখে যদি আবেগাপ্লুত হয়ে ফিরে আসে এ আশায় মেয়েকে নিয়ে মহুয়াদের বাড়ি যাই আমি। মনোয়ারদের বাড়িতে তখন কৌতুহলী মানুষের উপচে পড়া ভীড়। মৌমিতা বা আমাকে দেখে বিন্দু মাত্র মায়া মমতা হয়নি সোনিয়ার। কেন এমন করলে আমার এমন প্রশ্নের উত্তরে সোনিয়া জানায়, আমাকে শিক্ষা দিতেই সে এটি করেছে। সোনিয়া স্পষ্ট জানিয়ে দেয় সে প্রায় এক বছর আগে আমাকে তালাক দিয়েছে। মনোয়ারের সাথে তার বাড়িতে ওঠার প্রায় চার মাস আগে মনোয়ারকে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। তবে তালাকের কোন নোটিশ পাইনি আমি। পরে শুনেছি স্থানীয় পিওনকে ম্যানেজ করে নোটিশের কপি গুলি সোনিয়া নিজেই তার হস্তগত করেছে। 

সব শুনে মৌমিতাকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি আমি। মহুয়ার বাবা, মনোয়ারের বাবাসহ দুই পরিবারের লোকজনই চাচ্ছিল সোনিয়া আমার কাছে ফিরে আসুক। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমিও চাচ্ছিলাম সোনিয়া ফিরে আসুক। মহুয়ার বাবা থানা পুলিশকে পর্যন্ত বিষয়টি জানিয়েছিল। তাতেও কোন কাজ হয়নি। সোনিয়াকে ফেরাতে পারিনি আমি। থানা পুলিশকে ডিভোর্স এবং দ্বিতীয় বিয়ের কাগজ পত্র দেখিয়েছিল সোনিয়া ও মনোয়ার। থানা পুলিশও আর বিষয়টি নিয়ে এগোয়নি।

অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবারের ছেলে মনোয়ার। মনোয়ারের বাড়িতে গৃহাস্থলী কাজ করতে হতো সোনিয়াকে। দিন কতক যেতে না যেতেই হাঁপিয়ে উঠেছিল ও। হাঁপিয়ে ওঠায় ও পারিবারিক অশান্তি চরমে পৌছায় মনোয়ারের বাড়িতে থাকা খুব কষ্টকর হয়ে পরেছিল সোনিয়ার পক্ষে।

ওখানে টিকতে না পারায় আমাদের মফস্বল শহরে এক কামড়ার একটি বাসা ভাড়া নেয় সোনিয়া। মৌমিতা মাঝে মধ্যে ফোনে কথা বলতো ওর মায়ের সাথে। আমি কেমন আছি, কিভাবে কাটছে আমাদের মেয়ের কাছ থেকে এসব খোঁজ খবর নিত। এক রাতে সোনিয়া আমাদের কাছে ফিরে আসে।

আমাকে ডিভোর্স দেওয়া, মনোয়ারের সাথে সোনিয়ার চলে যাওয়া ও মনোয়ারকে দ্বিতীয় বিয়ে করার কথাটি আমাদের পাড়ায় চাউর হয়ে গিয়েছিল। ছোট বড় সবাই বিষয়টি জানত। তাই সোনিয়া যখন আবার আমাদের কাছে ফিরে আসে, আমাদের সাথে বসবাস করতে থাকে বিষয়টি নিয়ে পাড়ায় কানাঘুষা শুরু হয়। লজ্জায় আমি যেমন বাইরে মুখ দেখাতে পারতাম না তেমনি সোনিয়াও। এসময় মনে হতো আমরা যেন চোরের মত বসবাস করছি। অন্যদের কাছ থেকে নিজেদের লুকিয়ে রাখতাম আমরা। এতেও শেষ রক্ষা হলো না। পাড়ার কতিপয় মানুষের প্রতিবাদের মুখে সোনিয়া ওর বাবার বাড়িতে চলে যেতে বাধ্য হয়।                                 

আমি সোনিয়ার খোঁজ খবর রাখতাম। মৌমিতা মাঝে মধ্যে মায়ের কাছে মাঝে মধ্যে আমার কাছে থাকতো। এভাবে আরো কয়েক মাস কেটে যায়। এতসব ঝড় ঝঞ্জার মধ্যে সোনিয়ার দ্বিতীয় সন্তানটি পরিণত লাভ করতে থাকে মায়ের গর্ভে। আমি গ্রামের একখন্ড জমি বিক্রি করে নগদ টাকা হতে রাখি। সোনিয়ার প্রসব বেদনা উঠলে সে টাকায় হাসপাতালে সোনিয়ার ডেলিভারী করাই। আমাকে ডিভোর্স করার পরও এক বছর সোনিয়া আমার সাথে সংসার করে। আর এই এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার চার মাস পূর্বে সোনিয়া মনোয়ারকে বিয়ে করে। নবাগত সন্তানটির পিতা কে আমি না মনোয়ার এ মনস্তাত্তিক দ্বন্দ্ব আমার মনে বারবার ঘুরপাক খেলেও সোনিয়া আবার আমার কাছে ফিরে আসবে ভেবে এ নিয়ে আমি সোনিয়াকে একটি প্রশ্নও করিনি কখনো।

আমার সর্বশেষ জ্বালানো সিগারেটটি পুড়তে পুড়তে হাতের আঙ্গুলে তাপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন কথা শেষ হয় রাসেলের। পূর্বাকাশে সূর্যের তীর্যক আলো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে রাসেলের বদন মন্ডলে পরেও যেন তার অশ্রু শুষে নিতে পারছে না। কপোল বেয়ে পতিত অশ্রুধারা ভূমিকে যেন শীতল করছে।

-ইকবাল কবীর রনজু 
পাবনা, বাংলাদেশ