কবর কবিতার একশ বছর: প্রেক্ষিত কবিতায় প্রতিফলিত সমাজ - ড. শাহনাজ পারভীন
কবি জসীমউদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬ খ্রি.) সব্যসাচী লেখক, কবি ও শিক্ষাবিদ। জসীমউদ্দীন বাংলা সাহিত্যে পল্লীকবি হিসেবেই সমধিক পরিচিত। যদিও গবেষকদের মতে, তিনি সময়ের আধুনিক কবি। তার রচনাশৈলী আধুনিক। তাঁর জীবনযাত্রা, তাঁর পড়াশোনা, তাঁর কর্মজীবন সবই আধুনিক সময়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে পল্লীকবির খুব সহজ ব্যাখ্যা হলো এই যে, কবি জসীমউদ্দীনের অধিকাংশ কবিতাতেই উঠে এসেছে পল্লীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত নানান রূপ। তাঁর জন্ম আজ থেকে ১২২ বছর আগে। তাঁর কবর কবিতার বয়স একশ’ বছর। সেই অর্থে তিনি গ্রামের যে চিত্র এঁকেছেন, তা ১২২ বছর আগের দেখা সমাজের বাস্তব চিত্র। তখন শহরতলীতে পাকা সড়ক, গাড়ি, বড় বড় দালান কোঠা, অট্টালিকা, বৈদ্যুতিক আলো, ভালো চিকিৎসাব্যবস্থা কিছুই ছিল না। ছিল শুধু অবারিত মাঠ, জমীন জুড়ে বয়ে যাওয়া নদী, বিল-ঝিল, নালা-ডোবা, গাছ- গাছালি, ঝিঁঝি পোকা, ব্যাঙের ডাক। সে জীবনে প্রেম ছিল, ভালোবাসা ছিল, বিরহ- বেদনা ছিল, হাসি-আনন্দ ছিল, তার চেয়ে ভয়ংকর রূপে ছিল প্রিয়জন হারানোর শোক। ছিল অশিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত মানুষের সহজ সরল জীবন যাপন, যৌতুক, সান্ধ্যকালীন পুঁথি পাঠ, সাপ-ক্ষোপ, জ্বর, কালাজ্বর, কলেরা- ম্যালেরিয়াসহ নানান রোগের প্রকোপ। বেশিরভাগ সময়েই চিকিৎসার পরিবর্তে ছিল গ্রাম্য ঝাঁড়ফুকসহ নানান তাবিজ-কবচের প্রচলন। ফলে বেশির ভাগ সময়ই স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল হাতেগোনা। তখন মানুষ দু’দিনের জ্বর কিংবা সাপে কামড়ানো মৃত্যুকেই যেন স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই মেনে নিতো। কবির ‘কবর’ কবিতাটি তৎকালীন সমাজ জীবনের এমনই এক নানান জীবনঘনিষ্ঠ শোকগাথা।
এই শোকগাথার প্রতিটি পঙক্তি পাঠককে স্পর্শের মাধ্যমে আবহমান বাংলার সেই একশ বিশ বছর আগের সময়ে দাঁড় করায়। যেখানে চাওয়া পাওয়া ছিল অত্যন্ত নগণ্য। খুশি হওয়ার জন্য খুব বেশি জিনিষের প্রয়োজন ছিলো না। খুব অল্পতেই তারা হেসে উঠতো, তেমনি দুঃখ পেতেও কোন যুক্তির ধারে কাছে যেতো না। আবেগ আর ভালোবাসায় তাদের গ্রাম্যজীবন আনন্দে থইথই করে উঠতো। কবি এই কবিতায় অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সেই সময়ের গ্রামীন সমাজের প্রকৃতি ও মানুষের সমাজ দর্শনের হাসি- কান্নার সুনিপুণ রূপ কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। কবি গ্রাম-বাংলায় জন্ম নিলেও তার জীবনসংগ্রাম গ্রামে আটকে থাকে নি। তিনি শহরের আলো ঝলমলে পরিবেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়িয়েছেন, বসবাস করেছেন। তথাপি তার অন্তরে সব সময় যেন ধ্বনিত হতো গ্রামীন জনগোষ্ঠীর জীবন কাঠামো এবং প্রকৃতির অসামান্য রূপ ও আন্তরিক মাধুর্য। যা তিনি তার শৈশবে দেখেছেন, যে পরিবেশের মধ্যে বড় হয়েছেন, বেড়ে উঠেছেন এবং সারাজীবন তার অন্তরে, মনে তা ওতপ্রোতভাবে লালন করেছেন। অধিকাংশ সময় তার কলম ছিল গ্রাম-বাংলায় নিবদ্ধ। মন ছিল তার জন্মভূমিতে, প্রাণে ছিল গ্রামের জন্য আদিম মায়া।
কবি যে ঘরে বড় হয়েছেন, বেড়ে উঠেছেন, সে ঘরের সিঁড়ির দু’পাশে লেবুগাছ, মাঝখানে ডালিম গাছ, বাড়ির সামনে ছড়ানো ছিটানো পথ। কবির বাসভবনের সামনেই অবারিত মাঠ, কুলকুল ধ্বনিতে বয়ে চলা নদী, তারও আগে ধুলো ওড়া চর, শীতের শস্যক্ষেত আমাদেরকে এখনো কবির সেই একশ বিশ বছর আগের শৈশবে ফিরিয়ে নেয়। সব মিলিয়ে এই জায়গাগুলিই তার কবিতার সৃষ্টির উৎসভূমি। এই নিভৃত, স্নিগ্ধ সুন্দর পরিবেশই কবিকে নৈসর্গিক কবি হতে সাহায্য করেছে। তার লেখায় উঠে এসেছে পল্লীমানুষের জীবনের হালচাল, সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা, প্রেম, বিরহ ও বিচ্ছেদ। তিনি আমাদের শেকড়ের কবি, আত্মার কবি। খুব ছোট বেলা থেকেই তার কবিতার সাথে, ছড়ার সাথে আমাদের সখ্যতা। তার ‘মামার বাড়ি’ কবিতায় কবি লিখেছেন-
‘আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা
ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মালা গলায় দিয়ে
মামার বাড়ি যাই।
মামার বাড়ি পদ্মপুকুর
গলায় গলায় জল
এপার হতে ওপার গিয়ে
নাচে ঢেউয়ের দল।’
এই ছড়ার মাধ্যমে প্রথম জীবনে কবির সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে। আমি, আমরা তাঁকে চিনে নেই নিজেদের হৃদয়ের ভাষা দিয়ে, অন্তরের আকুলতায়, ফুলের মালা গলায় দিয়ে নানাবাড়ির আঙিনায়।
জীবনের শুরুতেই পল্লীসাহিত্যের সংগ্রাহক হিসেবে কবি জসীমউদ্দীনের কর্মজীবন শুরু হয়। দীনেশচন্দ্র সেনের আনুকূল্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে এ বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি এ কাজে নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে এমএ পাস করার পর থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত তিনি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে দীনেশচন্দ্র সেনের অধীনে রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী ছিলেন। তিনি ১০ হাজারেরও বেশি লোকসংগীত সংগ্রহ করেছেন। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে লেকচারার পদে যোগদান করেন। এখানে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চাকরি করার পর ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে থেকে তিনি প্রথমে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকার এবং পরে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে এখান থেকে ডেপুটি ডাইরেক্টর হিসেবে অবসর গ্রহণ করে তিনি ঢাকার কমলাপুরে নিজ বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
ছাত্রজীবনেই কবি জসীমউদ্দীনের মানস জগতে কবিত্ব শক্তির প্রকাশ ঘটে। কবি জীবনের শুরু থেকেই তিনি তাঁর কবিতায় পল্লী প্রকৃতি ও পল্লী জীবনের সহজ-সুন্দর রূপ প্রকাশ করেন। আজ থেকে একশ বছর আগে যখন গ্রামে বিদ্যুৎ এবং পাকা রাস্তাঘাট ছিলো না, ছিলো শুধু পল্লীর মাটি ও মানুষের সঙ্গে তাঁর নাড়ি ছেঁড়া বাঁধন। কলকাতা বিশ্বদ্যিালয়ে অধ্যয়নকালেই তাঁর কবর কবিতা প্রবেশিকা বাংলা সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়। কবি হিসেবে এটি তাঁর এক অসামান্য সাফল্য।
জসীমউদ্দীন ছিলেন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী এক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধাব্যক্তিত্ব। জসীমউদ্দীন বাংলা সাহিত্যের একজন বিশেষ সম্মানিত ও সব্যসাচী লেখক। কবি জসীমউদ্দীন তাঁর সাহিত্য জীবনে সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করেছেন। তিনি কবিতা, গাঁথাকাব্য, খন্ডকাব্য, নাটক, স্মৃতিকথা, শিশুসাহিত্য, গল্প-উপন্যাস ইত্যাদি বিষয়ে অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন।
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে কবি জসীমউদ্দীনের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘রাখালী’ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থে মোট ১৯টি কবিতা রয়েছে। এই কাব্যের অন্তর্ভুক্ত ‘কবর’ কবিতাটি রচিত হয়েছে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে। তার প্রায় প্রতিটি কবিতায় তিনি গ্রাম জীবনের প্রতিচিত্র নির্মাণের পাশাপাশি বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মানবতাবোধকে লালন ও সমৃদ্ধ করেছেন। বাঙালির প্রাণ হলো গ্রামের সাদামাটা পরিবেশ, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, সহজ-সরল মানুষ, অভাব-আবেগ, গাঁয়ের মেঠোপথ, নদী, নালা, খাল, বিল, মাঠ, ঘাট, হাট, হিজলের বন। সবই তিনি তার কবিতায় উপস্থাপন করেছেন নিপুণ দক্ষতায়। তবে তিনি যে কেবলই পল্লীকবি, তা বললে তার সাহিত্যকর্মকে ছোট্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ করে ফেলা হবে। তিনি গ্রাম্য পরিবেশের পাশাপাশি শহর, নগর এবং দেশ থেকে দেশান্তরে ভ্রমণ করেছেন শুধু কবিতারই জন্য। তাই তাঁকে শুধু পল্লী কবির অভিধায় ভূষিত না করে আধুনিক কবি হিসাবে তাঁকে মূল্যায়ন করতে হবে। কারণ গ্রাম বাংলার মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির এক অপূর্ব মিল নিয়েই তিনি কেবল কবিতা লেখেননি বরং নাগরিক জীবনের বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নানাবিধ কবিতা লিখে গেছেন- সেসব কবিতার আবেদন চিরন্তন।
কবি জসীমউদ্দীনের কোনো কোনো কবিতার একেকটি লাইন যেন মানব সংসারকেই সঠিক পথের দিশা দেখায়। আবেগ এবং ক্ষমার মাধ্যমে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার যে আকুল আকুতি তা দেখা যায় কবির ‘প্রতিদান’ কবিতায়। তিনি লিখেছেন-
‘আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা, আমি বাঁধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
যে মোরে করিল পথের বিবাগী,
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি।
দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর;
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা, আমি বাঁধি তার ঘর।’
সত্যি অসাধারণ এই কবিতার লাইন প্রতিটি মানবিক মানুষের হৃদয়ের গভীরে নিদারুণ ঝড় তোলে।
কবি জসীমউদ্দীন-এর ‘কবর’ কবিতাটি ১৯২৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং চলতি বছর ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে এই কবিতার ১০০ বছর পূর্ণ হয়েছে। এটি পল্লীকবির অমর সৃষ্টি এক অসামান্য কবিতা। এটি কল্লোল পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি নিপুণ পারঙ্গমতায় গ্রামীণ জীবনের চিত্র তুলে ধরেছেন। কবিতাটি লেখার সময় কবি জসীমউদ্দীন আইএ ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। কবিতাটি একটি গ্রামীণ পরিবারের তিন প্রজন্মের করুণ মৃত্যু এবং তৎকালীন সমাজচিত্রের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি। কবিতাটি ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে কল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর দীনেশচন্দ্র সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক সাহিত্যিকের মনোযোগ আকর্ষণ করে তিনি বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ স্থান করে নেন। ড. দীনেশচন্দ্র সেন ফরোয়ার্ড পত্রিকায় যে আলোচনা করেছিলেন, তার শিরোনাম ছিল ‘অ্যান ইয়াং মোহামেডান পোয়েট’। এই আলোচনাই বিদ্বোৎসমাজের দৃষ্টি কেড়েছিল। কবিতাটি তখন নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রেও ড. সেনের ভূমিকা ছিল।
মুসলমান অভিধায় অভিষিক্ত কবি অল্প সময়ের ব্যবধানে হয়ে ওঠেন পল্লীকবি। মুসলিম সম্প্রদায়ে তার জন্ম হলেও তিনি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান সবার কবি, সব মানুষের কবি। বাংলা ভাষার অন্যতম শক্তিমান কবি, আমার কবি, আমাদের কবি। রবীন্দ্রনাথ জাতপাতের ঊর্ধ্বে ছিলেন, নজরুল জাতপাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, জসীমউদ্দীন জাতপাত নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে গ্রাম-বাংলার জনজীবনের ছবি এঁকেছেন।
কবিতাটি শতবর্ষ পার করার পরেও তার আবেদন হারায় নি এবং গ্রামীণ জীবন ও ঐতিহ্যের এক অমূল্য দলীল হিসেবে বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। যদিও বর্তমানে কোনো শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে এই কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত নেই। তবুও এই কবিতা নিবিড়ভাবে মিশে আছে বাঙালির প্রাণে। এর প্রতিটি পঙক্তিতেই রয়েছে শোক, বেদনাবোধ, আত্মিক ও মানবিক প্রকাশ। ফলে শত বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলা সাহিত্যে কবিতাটি এখনো পাঠকের হৃদয়ে স্বতন্ত্র জায়গা দখল করে হৃদয় থেকে হৃদয়ে নির্মলভাবে বিচরণ করছে। আমরা চাই, কবিতাটি আবারও তার স্বমহিমায় পাঠ্যক্রমে জায়গা করে নিক। এ ব্যাপারে আমি সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
দীর্ঘ ১১৮ লাইনের ‘কবর’ কবিতাটিতে তিনি তাঁর নাতিকে তার দাদীর কবর দেখাতে নিয়ে যেয়ে সেই কবরস্থানে থাকা পরিবারের অন্যান্য স্বজনের কবর সম্পর্কে এক হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা করেছেন। তিনি এই কবিতায় একে একে সব প্রিয়জন হারানোর হৃদয় বিদারক বেদনা লাইনে লাইনে গভীর দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। কবির লেখা এই কবিতাটি শুধু প্রিয়জনদের জন্য শোক নিয়েই নয়, বরং বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের প্রায় প্রতিটি পরিবারেরই এক হৃদয়বিদারক চিত্র এটি। কবিতাটিতে গাঢ় বেদনা আর ভালোবাসার রঙে আঁকা বাংলার পল্লীজীবনের এই অসাধারণ প্রতিচ্ছবি ফুঁটে উঠেছে। কাহিনী বর্ণনাকারী গ্রামীণ বৃদ্ধ দাদু আর শ্রোতা হলো তার নাতি। যে পাঁচজন স্বজন হারানোর ব্যথা বৃদ্ধ দাদু এক এক করে বর্ণনা করেছেন তারা হলেন: বৃদ্ধের স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ, নাতনি ও মেয়ে। এরা নাতির দাদি, পিতা, মাতা, বুজি ও ছোট ফুপু।
‘ওইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে, ত্রিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।’
এই বিখ্যাত লাইন দুটি দিয়েই শুরু হয়েছে অমর কবিতা ‘কবর’। সুদীর্ঘ ও আবেগী এই কবিতা এত সুপরিচিত যে, নতুন করে এর পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন পরে না। তারপরও কিভাবে যেন কবিতার পরতে পরতে সেই করুণ দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে। কবি লেখেন-
‘এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,
সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা!
সোনালি ঊষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি
লাঙল লইয়া খেতে ছুটিলাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি।
যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত
এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোরে তামাশা করিত শত।
এমনি করিয়া জানি না কখন জীবনের সাথে মিশে
ছোট-খাট তার হাসি ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে।’
কবিতায় বৃদ্ধ দাদু নষ্টালজিক হয়ে তার প্রথম জীবনের পরম প্রেমের কথা নাতিকে শুনিয়েছেন। সেই প্রথম জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-আনন্দ, তামাসার জীবন্ত গল্প বলে গেছেন নির্দ্বিধায়। পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেলে যে বয়সের শিশুরা কান্নাকাটি করে, সেই বয়সে দাদীকে তার ঘরে এনেছিলেন। তার দাদীর ছিল সোনালি উষার মতো সোনামুখী এক মায়াবি মুখ। সেই মুখের দিকে তাকিয়েই, তার সাথেই তার হাসি-তামাসার জীবন পার করার গল্প। তারপর তাকে তার প্রিয় ডালিম গাছের তলায় কবর দিয়েছেন। যা সত্যি মর্মান্তিক এক বিরহের গল্প। দাদা আবার অল্প পরেই তার শুন্য জীবনের কথা অকপটে বলেছেন-
‘তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি
যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।
শত কাফনের, শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি,
গণিয়া গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি।
এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে,
গাড়িয়া দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে।
মাটিরে আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে মিশায়ে বুক,
আয়-আয় দাদু, গলাগলি ধরি কেঁদে যদি হয় সুখ।’
জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে তিনি আর কোন মিলনের আনন্দ দেখেন না, বরং আপনজনদেরকে নিজ হাতে গহীন কবরের অতলে রেখে আসার স্মৃতি হাতড়াতে থাকেন। যে মাটিতে তার আপনজনরা ঘুমিয়ে আছেন সেই বড় ভালোবাসার মাটিতে বুক মিশিয়ে কেঁদে কেটে সুখ অনুভব করার কল্পনা করেছেন। কবি লিখেছেন-
‘আমারে ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়,
কবর দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝঝুম নিরালায়!
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়,
আমার দাদীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়।’
এই কবিতায় কবি জসীমউদ্দীন খুব কম কথায় বিরহের যে চিত্র এঁকেছেন তা সত্যি বিরল। দাদা তার নাতিকে হাত জোড় করে কবরবাসীর জন্য, তার দাদীর জন্য মহান প্রভুর কাছে দোয়া করতে বলছেন, যেন তিঁনি তার দাদীকে বেহেশতবাসী করেন। কবি তার নাতীকে উদ্দেশ্য করে আবারও লিখেছেন-
‘এইখানে তোর বাপজি ঘুমায়, এইখানে তোর মা,
কাঁদছিস তুই? কী করিব দাদু! পরাণ যে মানে না।
সেই ফালগুনে বাপ তোর এসে কহিল আমারে ডাকি,
বা-জান, আমার শরীর আজিকে কী যে করে থাকি থাকি।
ঘরের মেঝেতে সপটি বিছায়ে কহিলাম বাছা শোও,
সেই শোওয়া তার শেষ শোওয়া হবে তাহা কী জানিত কেউ?’
আহা! হৃদয়ের গভীর থেকে একান্ত পুত্রের শেষ বিদায়ের মুহূর্তকে অসামান্য বর্ণনায় মূর্ত করে তুলেছেন কবি জসীমউদ্দীন। দু’দিনের জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ছেলেটি তার শেষ হয়ে গেলো। এ যেন গ্রাম বাংলার এক শাশ্বত মৃত্যূর ছবি। তিনি লিখেছেন-
‘মরিবার কালে তোরে কাছে ডেকে কহিল, বাছারে যাই,
বড় ব্যথা র’ল, দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই;
দুলাল আমার, যাদুরে আমার, লক্ষী আমার ওরে,
কত ব্যথা মোর আমি জানি বাছা ছাড়িয়া যাইতে তোরে।
ফোঁটায় ফোঁটায় দুইটি গন্ড ভিজায়ে নয়নজলে,
কী জানি আশিস করে গেল তোরে মরণ ব্যথার ছলে।’
কবিতায় বৃদ্ধ দাদু তার জীবনের সব প্রিয়জনকে হারিয়ে জীবনের বোঝা আর বইতে চান না। দিনের অবসানে যেমন রাত্রি ঘনিয়ে আসে, তেমনি তিনিও যেন জীবনের শেষে মৃত্যূকে আলিঙ্গন করতে চান। একই সাথে তিনি তার নাতিকে মহান প্রভু দয়াময় খোদার কাছে সকল কবরবাসীর জন্য বেহেসত নসীব কামনা করে দোয়া করতে বলেন। তাই তিনি নাতিকে বলছেন-
‘ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিয়ে ঘন আবিরের রাগে
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।
মজিদ হইতে আযান হাঁকিছে বড় সুকরুণ সুরে,
মোর জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দূরে।
জোড়হাত দাদু মোনাজাত কর, আয় খোদা! রহমান।
ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যূ-ব্যথিত প্রাণ।’
একটি অসামান্য দীর্ঘ কবিতা কবর। যা একশ বছর পরেও কবি জসীমউদ্দীনকে বাংলা সাহিত্যে অমর করেছে। এই কবিতায় কবির সাথে সাথে সকল পাঠকও তাদের জীবনের দুঃখগাথার সঙ্গে অবচেতন মনে হয়তো নিজেকেই খুঁজে নিয়েছেন। তাই একশ বছর পরও কবিতাটি স্বমহিমায় পাঠকের হৃদয়ে বেঁচে আছে। এখানেই কবিতার সার্থকতা। এখানেই কবির সার্থকতা। জয়তু কবি জসীমউদ্দীন, জয়তু আমাদের প্রিয় কবি জসীমউদ্দীন।
......
তথ্যসূত্র: গুগল, ইউকিপেডিয়া, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং কবি জসীমউদ্দীন এর গ্রন্থরাজি।
.......
ড. শাহনাজ পারভীন
লেখক: কবি, গবেষক, কথাসাহিত্যিক
অধ্যক্ষ,
তালবাড়ীয়া ডিগ্রি কলেজ, যশোর।
তারিখ: ১৮ আগষ্ট, ২০২৫ খ্রি.
-
নিবন্ধ // মতামত
-
22-09-2025
-
-