অটোয়া, সোমবার ৬ মে, ২০২৪
মেট্রো ম্যানিলার মনের গভীরে – চিরঞ্জীব সরকার

ফিলিপাইন দেশটির নাম শুনি অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন কারনে। তবে বিশেষ আকর্ষন বোধ করি আন্তর্জাতিক ধান গবেষনা ইন্সটিটিউট বা ইরির হেডকোয়ার্টাস এ দেশটিতে হওয়ার কারনে।মনে মনে ভাবতাম এখানে মনে হয় প্রচুর ধান উৎপন্ন হয়,তাইতো ইরির ঠাই এখানে হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইরির সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্থানীয় ধান গবেষনার প্রতিষ্ঠানগুলির নামকরন করা হয়েছে। যেমন গাজীপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ রাইস রিসার্স ইন্সটিটিউট বা বিরি। এরকম নামকরন বহুক্ষেত্রেই ঘটে। হলিউডের আদলে বিভিন্ন ফিল্মী ইন্ডাষ্ট্রি যেমন বলিউড, টালিউড, ঢালিউড ইত্যাদি নামে পরিচিতি পেয়েছে। ধান, নদী ও খালের দেশ বরিশালে আমার জন্ম, বেড়ে উঠা। বাড়ি থেকে বের হলেই যেটা চোখে পড়ত সেটা হল সবুজে সবুজে ঢাকা কত দিগন্তছোয়া ধানের ক্ষেত। যখন এর উপর বাতাসের প্রবাহ বয়ে যেত তখন মনে হত যেন এখানে সবুজের ঢেউ খেলে যাচ্ছে। ভাদ্র মাসে ধানের ক্ষেতগুলি যখন পানিতে পরিপূর্ন থাকত তখন ছোট নৌকায় চড়ে বাশের লগি ঠেলে ঠেলে ক্ষেতের ভিতর মহাআনন্দে ঘুরতাম। ধানের পাতার সাথে চলন্ত নৌকার দেহের ঘষাঘষিতে এক ধরনের শো শো টাইপ শব্দ তৈরী হত যা কর্নকে দিত এক মায়াবী সুখ। শৈশবের সেসব দিনগুলির কথা মনে পড়লে এখনো  মনে হয় সে ধান, জল আর এর উপর বয়ে চলা নৌকার ছন্দ ও সুর যেগুলি কানে কানে  অনেক আদর  করে আমাকে বলছে ‘অনেক হয়েছে, এবার ফিরে আয় আমার কোলে’।

এশিয়ার নোবেল পুরস্কারঃ
রেমন ম্যাগসেসে পুরস্কারটির কারনে ফিলিপাইন নামটি উঠে আসত প্রতিবছর সংবাদপত্রে। অনেকে এ পুরস্কারটিকে এশীয় অঞ্চলের নোবেল পুরস্কার বলে থাকেন। ফিলিপাইনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ম্যাগসেসের নামে এ পুরস্কারটির প্রবর্তন করা হয়। তিনি ফিলিপাইনের সপ্তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তার স্মৃতিকে ধারন করে যে সমস্ত ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান এশীয় অঞ্চলে আপমর মানুষ ও পরিবেশের কল্যানের নিমিত্তে নিঃস্বার্থে কাজ করে তাদেরকেই সাধারনত এ পুরস্কারের জন্য মনোনিত করা হয়।

কেমন দেশ এটিঃ
২০১৭-এর অগাষ্টের প্রথম সপ্তাহে পদার্পন করলাম ফিলিপাইনের রাজধানী মেট্রো ম্যানিলার পিচঢালা পথে ২৪তম আসিয়ান রিজিওনাল ফোরামে অংশগ্রহনের জন্য। অনেকগুলি দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে ফিলিপিন রাষ্ট্রটি যার ভিতর কেবল ২০০০ টিতে লোকবসতি রয়েছে। বৃহত্তম দ্বীপ হল লুজন ও মিন্দানাও। এ দেশটির অবস্থান প্রশান্ত মহাসাগর ও দক্ষিন চীন সাগরের মধ্যে। পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম ইংরেজী ভাষাভাষীদের দেশ এটি। যদিও এখানকার সরকারী ভাষা ফিলিপিনো এবং ইংরেজী। ইংরেজী ভাষায় দক্ষতার কারনে জনশক্তির বাজারে ফিলিপিনোদের ব্যাপক প্রাধান্য দেখা যায় বিদেশে। ১কোটি ১০ লক্ষের অধিক ফিলিপিনো নাগরিক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত আছে। বিশ্বের সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় প্রচুর ফিলিপিনো সেবিকা প্রতিনিয়ত সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। নারিকেল উৎপাদন ও রপ্তানীতে দেশটির অবস্থান পৃথিবীতে দ্বিতীয়। দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার অধিকাংশ দেশে বৌদ্ধরা যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে কিন্তু এ দেশটির প্রায় আশিভাগ জনগোষ্ঠী রোমান ক্যাথলিক খ্রীষ্টান। আবার এশিয়ার অধিকাংশ দেশগুলিতে যেখানে প্রধানত ফুটবলই সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা সেখানে ফিলিপাইনের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হল বাস্কেটবল। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সামূদ্রিক ঝড় টাইফুনের সাথে সহাবস্থান করতে হয় ফিলিপাইনকে যেমনটি করতে হয় আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়াকে দাবানলের সাথে। ১৯৫ মাইল বেগে দেশটিতে আঘাত হানা সুপার টাইফুন হাইয়ানের কথা অনেকের হয়ত এখনো মনে আছে।

কিভাবে নামকরন হল দেশটিরঃ
১৫২১ সাল থেকে ১৮৯৮ সাল পর্যন্ত ফিলিপাইন ছিল স্পেনিস সাম্রাজ্যের কলোনী। স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের নামে তখন দেশটির নামকরন করা হয় ফিলিপাইন। এ দেশটির আয়তন ৩ লক্ষ বর্গকিলোমিটার। স্পেনিশদের হাত থেকে এটি দ্বিতীয় বিশ্বযু্দ্ধ পর্যন্ত মার্কিনীদের কর্তৃত্বে থাকে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযু্দ্ধের সময় জাপান ফিলিপাইনকে তাঁদের অধিকারে নেয় কিন্তু এ বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের কারনে তাঁদেরকে ফিলিপাইন ত্যাগ করতে হয়।

মেট্রো ম্যানিলাঃ
পৃথিবীর অন্যতম জনঘনত্বপূর্ন শহর ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা। মেট্রো ম্যানিলা মুলতঃ ১৬ টি সন্নিহিত শহরের সার্বিক সংযু্ক্তির একটি নেটওয়ার্ক। ম্যানিলার বানিজ্যিক এলাকা হল মাক্তাই। ম্যানিলার পার্কগুলিতে প্রচুর বাশেরঝাড়ের দেখা মেলে। শহরটির কোল ঘেষে রয়েছে সমূদ্র যা ম্যনিলা বে নামে পরিচিত। ওখানকার একটি দোকান থেকে এক রাতে ডাবের পানি ও কলার ট্রেডিশনাল কেক খেলাম প্রানভরে। ডাবটাকে এত সুন্দর করে কেটে শৈল্পিকভাবে পরিবেশন করল যে মনে হয় যেন আহারের চেয়ে দর্শনও কম গুরুত্বপূর্ন নহে। এখানে উল্লেখ্য যে ফিলিপাইনে প্রচুর কলা উৎপন্ন হয়। কলা দিয়ে বানানো ব্যনানা কেচাপ  ফিলিপিনোরা নানা লোকাল ফুড আইটেম যেমন ফ্রাইড চিকেন, চিপস্‌, ওমলেট, মাছ, এমনকি মাংসেও ব্যবহার করে।

টেক্সট ও সেলফি ক্যাপিটালঃ
ফিলিপিনোরা মোবাইলে এত পরিমান মেসেজ বিনিময় করে যে ফিলিপাইনকে বলা হয়  পৃথিবীর টেক্সট ক্যাপিটাল। আর মোবাইলে সেলফি তুলবে না সেটা কি করে হয়। তাইতো মেট্রো ম্যানিলার মাক্তাই পরিচিতি পেয়েছে বিশ্বের সেলফি ক্যাপিটাল হিসাবে। এ সেলফি তুলতে গিয়ে কেউ ট্রেনে কাটা পড়ছে, কেউ কেউ ফেরি থেকে নদীতে ছিটকে যাচ্ছে, আবার অনেকে পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে চূর্ন হয়ে যাচ্ছে। বছর দুয়েক আগে ইংরেজী নববর্ষের দিনে আমি কুয়াকাটার সমূদ্র সৈকতে ছিলাম। সেখানে বিকেলে দেখলাম এক নবদম্পতি সৈকতের পানিতে নেমে শুয়ে সেলফি স্টিক দিয়ে যেইনা ক্লিক করতে যাচ্ছে অমনি একটি ঢেউ এসে ঢলে পড়ল স্টিকসহ মোবাইলের উপর। স্টিকটি উদ্ধার করতে বেশ কষ্ট করতে হয়েছিল। আর পানিতে ভেজা মোবাইল সারাতে তাঁদের কত টাকা লেগেছিল  তা আমার জানা নেই।

ইমেলদা মার্কোসঃ
ফিলিপাইনের এক  সময়কার ফাস্ট লেডি ইমেলদা মার্কোসকে একটা সময় সবাই চিনতো জুতা প্রীতির জন্য। তাঁর স্বামী  ফার্দিন্যান্দ মার্কোস যখন ক্ষমতা থেকে চ্যুত হন তখন তাঁদের রাজপ্রাসাদে ইমেলদার তিন হাজার জোড়া পাদুকার সন্ধান মিলে। ক্ষমতা থেকে উৎখাতের পর মার্কোস দম্পতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহন করেন এবং তখন তাঁদের সন্তানদের দুধের খরচ মিটানোর জন্য আমেরিকার জনগনের কাছে হাত পাততে হয়েছিল। সতিৎই এ পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে কখন কে রাজা আর কখন কে ফকির হবে বিধাতা ছাড়া আর কেউ তা বলতে পারে না। বিশ বছরেরও অধিক সময় মার্কোস ফিলিপাইন শাসন করেছিল।

দুয়ার্তে দর্শনঃ
ফিলিপিনের বর্তমান প্রসিডেন্ট দুয়ার্তে তাঁর কার্যকলাপের জন্য বিখ্যাত। মাদকের বিরুদ্ধে যু্দ্ধ করতে গিয়ে তিনি খবরের শিরোনামে এসেছে বারবার। আরো কিছু বেফাস মন্তব্যের করনেও বহুবার তিনি সমালোচিত হয়েছেন। সামিট মিটিং-এর হলঘরে রদদ্রিগো দুয়ার্তকে যখন  দেখছি তখন আর একজনের কথা মনের অজান্তেই আমার ভেসে আসছিল। সে হল উত্তর কোরিয়ার দাপুটে প্রেসিডেন্ট কিম জং উন। যিনি কিছুদিন পরপর পারমানবিক পরীক্ষা ও জাপানের দিকে পরীক্ষামুলক মিসাইল ছুড়ে দুনিয়াকে একেবারে গরম করে ফেলে।

ম্যানিলা ছেড়ে আবার রওহনা হই দেশের পথে। প্লেনের উইন্ডো সিটে বসে নীচের প্রবাহমান মেট্রো ম্যানিলাকে বাই বাই জানাচ্ছি। মনে হচ্ছিল এইতো ইরি থেকে আবার বিরিতে ফিরে যাচ্ছি।

চিরঞ্জীব সরকার। অটোয়া, কানাডা