অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
যখন পিছনে হাঁটি, তখন পিছনে হাঁটে আমার শৈশব - সুনির্মল বসু

     ছেলেবেলার দিনগুলো আজ স্বপ্ন মনে হয়,বাবা বাটার কারখানার কেরানী, সামান্য মাইনে, তাই নিয়ে সকলে মিলে বাঁচার আনন্দ ভাগ করে নিয়েছি। মাটির বাড়িতে ভাড়া থাকি। মাসে আট টাকা ভাড়া। বাবা মা কখনো অভাব বুঝতে দেননি।
     উঠোনের উপরে প্রকাণ্ড একটা ডেয়ো ফলের গাছ, ভোরবেলায় কুয়াশার মধ্যে ডেয়ো কুড়িয়ে খাই। সামনে পুকুর, পাশে জামরুল গাছ। বাড়ির ডান দিকে সরষে খেত, দূরে কলাই ক্ষেতের জমি, দূরে সীমানা জুড়ে নারকেল সুপারি গাছের সারি।
     বিকেল হলে অফিস থেকে এসে, বাবা আমাদের রামায়ণ মহাভারতের গল্প শোনান। সন্ধ্যেবেলায় চাঁদের আলোয় মাদুর পেতে উঠোনে পড়াশোনা করতে বসি। ঠাকুরমা পাখা নাড়েন ঘন ঘন। বাঁশ বাগানের ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখি, দেখি লক্ষ তারা। সকালবেলায় কাঠবাদাম গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো আসে। তখন কেমন স্বপ্ন মনে হয়। যেন দূরের পৃথিবীর বার্তা এই অজপাড়াগায় এসে পৌঁছয়।
     মল্লিকদের প্রাসাদোপম বাড়িতে বিরাট করে অন্নপূর্ণা পুজো হত। আমি আর ভাই প্রসাদের লোভে ভিখারিদের সঙ্গে বাইরে দাঁড়াতাম। কিভাবে যেন মা এটা জেনে যান। আমাদের বলেন, নেমন্তন্ন না করলে যেতে নেই। কোন কোন দিন দুপুরে মাটির মিষ্টির দোকান খুলি। তখন থেকে মাটি দিয়ে ঠাকুর বানানোর ইচ্ছে হয়। কাছেই পাঠশালায় অনিল পাল ঠাকুর বানাতেন। সেভাবেই মাটি দিয়ে সরস্বতী ঠাকুর বানিয়েছিলাম। পড়াশোনায় ভালো ছিলাম না। আমার জন্য মায়ের মনে অনেক কষ্ট ছিল। সে বয়সে অবশ্য সেসব বুঝিনি।
     সেই স্বপ্নময় সকালগুলো, শত কামনার দুরন্ত দুপুরগুলো, শত কামনার বিকেলগুলো, মায়াময় রাতগুলো কখনো ভুলতে পারিনা। ঘরের মধ্যে রাতে সুপারি গাছের ছায়া পড়তো। বাবার পাশে শুয়ে চাঁদ দেখতে দেখতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়তাম।
     একটু বড় হতেই, নঙগী স্কুলে ভর্তি হলাম। মায়ের পর, আমার জীবনের প্রথম স্যার হরেন্দ্র নাথ চট্টোপাধ্যায় বাড়িতে পড়াতে আসতেন। বড্ড ভালবাসতেন  আমায়। আমার লেখালেখির মন তৈরি হয়েছিল তার হাতে। স্যার কি সুন্দর সুর করে পড়াতেন, মৌমাছি মৌমাছি কোথা যাও নাচি নাচি। স্যার চলে যাবার পর, সারাদিন গাছের ছায়ায় আমি সেই কবিতা আবৃত্তি করে যেতাম। সেই সঙ্গে আরও কত কত নতুন নতুন বানানো কবিতা, খানিকটা যেন গানের মত, আজ আর সে সব কিছু মনে করতে পারিনা। অথচ একটা সুরের টান ছিল সেদিন, আজ যতটুকু মনে পড়ে।
     বড় হচ্ছিলাম, বুঝতে শিখছিলাম। অভাব কি আমি নিজের চোখে দেখেছি, খালি মনে হতো, বাবার পাশে দাঁড়াতে হবে। আমার কাকু, আমার চেয়ে বয়সে সামান্য বড়, অভাবের দিনে সে বাটা কারখানায় চাকরি নিল। ঠাকুমা রাতে ছাতু খেতেন। তার ভাগ পেতাম আমি আর ভাই। সে বড় অভাবের দিন। মাঝে মাঝে ভাবি, আহা, আর যদি ঠাকুমা বেঁচে থাকতেন, তাহলে বাজার কাকে বলে আমি দেখাতাম। 
     তখন কয়লার ট্রেন ধোঁয়া ছেড়ে ছুটতো। বেশ মনে আছে, মা আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে মামা বাড়ি হাওড়ায় যাচ্ছেন। ট্রেনে সামান্য ভিড়, আমরা নিচে মেঝেতে বসে আছি। হঠাৎ উপরে জায়গা ফাঁকা হতেই, ভাই বলল, ওই তো জায়গা খালি হয়েছে, আমরা উপরে বসি। বেশ মনে আছে, মা বলেছিলেন, আমরা তো গরীব, আমাদের উপরে বসতে নেই।
     দুর্গাপূজার দিনগুলো খুব মনে পড়ে। বাবা জামাকাপড় আনলে, কী যে আনন্দ হতো, বোঝানো যাবেনা। পাঠশালায় অনিল পাল ঠাকুর বানাতেন। স্কুল ছুটির পর এসে আমরা  চেয়ে থাকতাম। ভোরবেলায় মাইকে মহালয়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যেত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সুর পুজোর আমেজ এনে দিত। ঢাকের আওয়াজ ধূপের গন্ধে কাঁসরঘন্টার শব্দে উৎসবের প্রকৃত সুর খুঁজে পেতাম। পুজো শেষ হলেই পরীক্ষার ভয়। রাত জেগে পড়াশোনা করা, বাবা-মা পাশে বসে থাকতেন। ততদিনে আমরা নতুন বাড়ি উঠে এসেছি।
     বাবা আমাকে সাইকেল চালানো শেখালেন, আমার জন্য লেজওয়ালা ঘুড়ি বানিয়ে ওড়ালেন। শুধু বলতেন, আমরা গরীব, গরীব হওয়া বড় পাপ। বাবার একটা কথা আমার বুকের মধ্যে গেঁথে আছে। মাঝেমাঝেই বলতেন, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝেনা, দাঁতটা চলে গেলে, দাঁতের মর্ম বুঝতে পারে। আজ যখন বাবা-মা কাকু নেই। তখন এই সত্যিটা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাই।
     পরপর তিনটি মৃত্যু আমার জীবনের ভিত নড়িয়ে দিয়েছে। বাবা-মা পরিণত বয়সে গিয়েছেন, কিন্তু কাকুর মৃত্যুটাকে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি। ওরা মাথার উপর ছিলেন বলে, আমি বেশ নিজের মত দিন কাটাচ্ছিলাম। ওরা না থাকায়, প্রতিদিনের অভাব অনুভব করি। ওরা চলে গেলেন, আর আমার শৈশব কৈশোরের দিনগুলো ওদের সঙ্গে চলে গেল। মনে হয় সংসারে চড়া রোদ্দুরের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে আছি। আমি আমার কাজ ভালই করতে পারি, কিন্তু পরিচালনা করবার কোন ক্ষমতা আমার নেই। তাই সংসার এর ক্ষেত্রে প্রতিদিন ঠোক্কর খাচ্ছি।
     ছেলেবেলার পুরনো বাসায় মাঝে মাঝে যাই। পুকুর পাড়ে দাড়াই। স্কুল ছুটির পর এখানেই মাছ ধরতাম। পাশের খালে একটা সাপকে জামরুল ছুঁড়ে ছিলাম বলে, সেই সময় আমার অল্প বয়সী মায়ের আমাকে নিয়ে বড় টেনশন ছিল, যদি  ঐ সাপ এসে আমাকে কামড়ায়। তেমন কিছু কখনো ঘটেনি।
     সবুজ প্রকৃতির মধ্যে বড় হয়ে ছিলাম, সবুজ রং আমার বড় প্রিয়, সরল মানুষের মুখ দেখলে, বুকের মধ্যে সমুদ্রের ঢেউ ওঠে। ভাবি একবার, সেই অভাবের দিনগুলো ছিল বটে, মা বাবা কাকা পিসির অঢেল ভালোবাসাও তো ছিল। আমার কাকু বড় ভালোবাসতো আমাদের। শালিক পাখি এনে বলতো,বাবু, একে বাঁচাতে হবে।বড় হয়ে ইলেকশন অফিসার হলে, কাকু বলেছিল,তোর ভয় করছে নাতো।বোনের অসুখে সারা রাত জেগে থাকতো কাকু।
     নিজের স্কুলে শিক্ষক হলাম একসময়। মা বাবার আত্মত্যাগ দেখেছি বলে, কখনো একলা বাঁচা শিখি নি। অজস্র ছাত্র-ছাত্রী আমার দেশে বিদেশে। একসময় সাংবাদিক হতে চেয়েছিলাম, অথচ শিক্ষক হিসেবে জীবন কেটে গেল। সাহিত্য কে ভালোবাসার শিখিয়েছিলেন, আমার মা-বাবা ও শিক্ষকেরা। কোথা দিয়ে কেটে গেল, আমার স্বপ্নের ‌দিনগুলো। মাঝে মাঝে ওপাড়ায় যাই। পুকুর পাড়ে দাঁড়ালে, সেই দৃশ্যটা মনে ভাসে, ভাই জলে পড়ে গেছে, আমি চিৎকার করে মাকে ডাকছি, গলায় স্বর বেরোচ্ছে না। পাড়ার সবাই খবর দিতেই মা ঝাঁপিয়ে পড়ে, ওকে জল থেকে তুলে আনেন। আজও যাই সেখানে, এই জমির উপর আমার মায়ের পা পড়েছে, মনে মনে কতবার জায়গাটাকে প্রণাম করি।  এই পথ, অফিসের এই ঘর, আমার বাবার স্মৃতি জড়ানো। এই অমূল্য স্মৃতির কোনোটাই আমি হারাতে চাইনা। লাল ডাটা গাছগুলো এখন আর নেই, অথচ এখানে দাঁড়িয়ে আমি চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই, বৃষ্টিতে টিয়া পাখি গাছের মাথায় ভিজছে।
     জীবন এগিয়ে গেছে বহুদূর, দারিদ্র ও ভালবাসার সহাবস্থান দেখেছি, শীতল দীঘি, পাখি ওড়া আকাশ, লিচুতলা, চাঁপা ফুলের গাছের তলা দিয়ে কত স্বপ্নময় দিন রাত্রি কেটে গেছে। আকাশটা তখন ঘন নীল ছিল, গাছের পাতাগুলো ছিল সবুজ, সংসারে ভালোবাসার কত মানুষ ছিল। কত সামান্য মানুষের কত বড় মন ছিল। না চাইতেই, ভালোবাসা ছিল। ধু ধু মাঠের মতো মানুষের মনও প্রসারিত ছিল। মায়ের হাতে বসানো ফুল গাছ থেকে কৃষ্ণা, বীথিরা যখন সকালে ফুল নিতে আসতো, তখন মুগ্ধচোখে ওদের চেয়ে দেখেছি। ওদের বিয়ে হয়ে গেছে। ওরা এখন কে কোথায় আছে, জানিনা। কত পুরনো বন্ধু আজ আর পৃথিবীতে নেই। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আমার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওদের ডাকতে ইচ্ছে করে, কোথায় গেলি তোরা, আমি যে বড় একা হয়ে গেলাম।
     নদীর ঢেউয়ের মতো জীবন বয়ে চলে। মল্লিক বাগানে আখ চুরি, বন্ধুরা মিলে নারকেল চুরি করে মজা করে কাটানো দিনগুলো মনে পড়ে। মনে পড়ে, বাটা সিনেমায় জীবনের প্রথম হিন্দি ছবি দেখা। রাজেন্দ্র কুমার, ধর্মেন্দ্র ও সায়রা বানুর আই মিলন কি বেলা ছবি। সেই থেকে অনুভব করি ভালোবাসাকে, প্রেম সম্পর্কে আগ্রহ জাগে। কিন্তু নিতান্ত ছাপোষা বাড়ির ছেলে বলে, কখনো সাহস করে এগোতে পারিনি, চাইও নি। সেই না পাওয়ার বেদনা গুলোই, আমার কবিতায় গল্পে উপন্যাসে বারবার ফিরে ফিরে আসে। তখন দারিদ্র ছিল, সামাজিক অনুশাসনের ভয় ছিল, মনের গোপন কথাটি সহজে প্রকাশ করা যেত না। তাছাড়া ,তখন আমার আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই চলছে। ছেলেবেলার এই দৃশ্যপটগুলো আমার কাছে আজও স্থিরচিত্র হয়ে আছে। কোন মূল্যে এই সোনার স্মৃতিগুলো আমি হারাতে চাই না। 
     সবাই বলে, ভুলে যেতে হয়, না ভুলতে পারলে বাঁচা যায় না। আমি জানি, অথচ, আমি অতীতের দিনগুলো কিছুমাত্র ভুলতে পারিনা। এতোটুকু ভুলে যেতে চাই না। ওরা যে আমার কাছে মণিমাণিক্যের মত দামী। বয়স হয়েছে বলে কিনা জানিনা, আমার স্মৃতিগুলো আজো বড্ড বেশি প্রখর, আজও সমান ভাবে সতেজ। আমার ভাবনাও উল্টো পথে চলে, বাইরে থেকে এসে অদ্ভুত কল্পনা করি, বাবা যেন আগের মত সোফাতে বসে আছেন, মা যেন প্রশ্ন করছেন,
     বাবু, পড়িয়ে ফিরতে এত দেরি হল কেন,
     অথচ, কতদিন হল, ওরা পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন। রাত গভীর হলে, আমি প্রিয় মানুষদের সঙ্গে প্রতিদিন কথা বলি। আমি ওদের ছবিতে মালা পরাই নি, ওরা তো আজও আমার কাছে সেদিনের মতোই জীবন্ত হয়ে রয়েছেন।

সুনির্মল বসু। পশ্চিমবঙ্গ, ভারত