অটোয়া, শুক্রবার ১৮ অক্টোবর, ২০২৪
করোনাকাল মোকাবেলায় একটি কার্যকরি ও জনবান্ধব বাজেটের প্রত্যাশা

     তন কুমার তুরীঃ  বিশ্বময় করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই বর্তমান সরকার বাংলাদেশের জন্য  মহান জাতীয়  সংসদে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের বাজেট পেশ করতে যাচ্ছে। ধরে নেয়া হচ্ছে যে, এই বাজেট সরকারের জন্য সর্বোতভাবেই একটি চ্যালেঞ্জিং বাজেট হবে। এমনিতেই দীর্ঘ সময় ধরে পৃথিবীর সব অঞ্চলে করোনা সংক্রমণের কারণে অর্থনৈতিক অবস্থা স্থবির হয়ে আছে। অনেক দেশেই অর্থনীতির চাকা একেবারেই ঘুরছেনা। সরকারি ব্যবস্থাপনায় পৃথিবীর দেশে দেশে চলছে সঙ্কটকালিন সময়ে  দরিদ্র মানুষদের মুখে দু' মুঠো খাবার তুলে দেয়ার বিরামহীন প্রচেষ্টা তবু্ও কিছু কিছু দেশে মৃত্যুর মিছিল থামছেইনা। এমন পরিস্থিতিতে  বাংলাদেশের মানুষের জন্য সরকার কী ধরনের বাজেট পেশ করতে পারে তা নিয়ে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই, অনেকেই মনে করছেন সরকার করোনার সর্বব্যাপি বিস্তারের কথা মাথায় রেখে একটি করোনাবান্ধব বাজেটের দিকেই হাঁটবেন। ইতিমধ্যে অনেক বিশেষজ্ঞই মতামত দিয়েছেন যে, করোনা আরো কিছু সময় পৃথিবীর মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করতে পারে ফলে করোনাকে সাথে নিয়েই মানুষকে দিননিপাত করতে হবে। সেক্ষেত্রে একটি করোনাবান্ধব কিংবা করোনা সহনশীল বাজেট প্রনয়ন করাই হবে সরকারের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ। বাজেটের মধ্যেই করোনা মোকাবেলার কৌশলপত্র এবং অর্থ বরাদ্দ থাকলে করোনা মোকাবেলায় সরকারকেও আর তেমন একটা বেগ পেতে হবেনা। এই বাজেটে সরকারকে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে করোনাকালিন সময় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলে দেশের ব্যাপক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা নেবেন। অন্যদিকে দেশের প্রায় আঠার কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় সাত কোটি মানুষ জীবন জীবিকার সাথে মিশে আছে তাদের কর্মতৎপরতা স্বাভাবিক রাখা যায় কীভাবে। এরপরে রয়েছে করোনাকালিন সময়ে দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি। এতোদিন স্বাস্থ্য খাতে সরকার একধরনের বরাদ্দ দিয়ে এসেছে বর্তমানে করোনাকালিন সময়ে সেধরনের বরাদ্দে আর কাজ নাও হতে পারে। করোনাকালিন সময় দীর্ঘায়িত হলে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সরকারকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হতে পারে ফলে স্বাস্থ্যখাতে  বরাদ্দ আরো বাড়ানোই যৌক্তিক হবে।  করোনাকালিন সময়ে সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়বে দেশের ক্ষুদ্র কুটির শিল্প এমনিতেই এসব শিল্পের পুঁজি কম এর বাইরে করোনার জন্য এসব শিল্প দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় তাদের ব্যাপক লোকসান গুনতে হয়েছে ফলে এদের আরো বেশি কীভাবে প্রনোদনাসহ তাদের বিভিন্ন কর মওকুফ করা যায় সে বিষয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। কৃষিখাত হতে বাংলাদেশের একটি অত্যাবশ্যকীয় খাত এর উন্নতি মানেই আমাদের দেশের খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা সুতরাং করোনাকালিন সময়ে এই খাতকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। কৃষকদের সার, বীজ, এবং কৃষিনির্ভর অন্যান্য জিনিসপত্র যাতে কৃষকরা এই সঙ্কটকালিন সময়ে নির্বিঘ্নে পেতে পারে সে বিষয়ে বাজেটে যথেষ্ট বরাদ্দ রাখা বাঞ্ছনীয়।
     আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে যতই সঙ্কট চলুকনা কেনো কৃষকদের  কৃষিকাজের যাতে কোনো প্রকার বাঁধার সৃষ্টি না হয় এবিষয়ে আমাদের সবার সজাগ থাকতে হবে প্রয়োজনবোধে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় বাজেট একটি নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা সম্বলিত করতে হবে। আমাদের দেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে পোশাকখাত। দেশের তৈরি পোশাক ইতিমধ্যে বিশ্ববাজারে তাদের নিজেদের অবস্থান সুসংহত করে নিয়েছে। এই পোশাক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে বাংলাদেশ যথেষ্ট পরিমান বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করে চলেছে। এই সঙ্কটকালিন কালিন সময়ে এই শিল্পের কোন কর্মি যাতে চাকুরিচ্যুত না হয় এবং এই শিল্পটি যাতে আগের মতেই পৃথিবীজুড়ে তাদের সুনাম বজায় রাখতে পারে সে বিষয়েও এই বাজেটে একটি স্পষ্ট ঘোষণা থাকতে হবে। প্রয়োজনবোধে কিছু প্রয়োনীয় শিল্পকে করোনাকালিন সময় পর্যন্ত প্রনোদনা দিয়ে হলেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তবে যেসব শিল্পে বা জায়গায় সরকার প্রনোদনা দেবেন সে প্রনোদনা সুফল আসল মানুষগুলো পাচ্ছে কীনা তা সরকারকে বিচার বিবেচনা করে দেখতে হবে, প্রয়োজনবোধে প্রনোদনার জন্য নির্বাচিত মানুষ, শিল্প কিংবা গোষ্ঠীকে একটি রেনডম মনিটরিং এর আওতায় আনতে হবে। এতে করে প্রনোদনা প্রাপ্তরা তাদের প্রনোদনা কোথায় কোথায় ব্যবহার করছেন তা স্পষ্টই বোঝা যাবে। অনেক সময় দেখা যায় যে কিছু শিল্প প্রতিষ্টান প্রনোদনা পাওয়ার পরও তাদের কর্মিদের ঠিক মতো মজুরি পরিশোধ করছেনা প্রাপ্ত প্রনোদনার টাকা অন্যখাতে খরচ করছে, এমন হলে উক্ত প্রতিষ্টানের বিরুদ্ধ দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। 
     এ বিষয়ে একটি নীতিমালা থাকলে এসমস্ত প্রনোদনার অর্থের অপব্যবহারকারিদের বিরুদ্ধে একটি কার্যকরি ব্যবস্থা নেয়া সহজ হবে। স্বাধিনতাত্তোর বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যতোগুলো বাজেট হয়ছে প্রায় সব বাজেটেই শিক্ষাখাতটি উপেক্ষিতো হয়েছে। ব্যাপক জনগোষ্ঠীর দেশে অন্যান্য দেশের তুলনায় শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে অপেক্ষাকৃত কম। বর্তমানে করোনাকালিন সময়ে দীর্ঘদিন শিক্ষার্থিরা তাদের কার্যক্রমের বাইরে রয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্টানের সাথে তাদের যোগাযোগ নেই বললেও চলে। যদিও কিছু প্রতিষ্ঠান অনলাইন ভিত্তিক তাদের শিক্ষার্থিদের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে তার সংখ্যা একেবারে হাতে গোনা। করোনাকালিন সময়ে সরকারও চেষ্টা করছে সংসদ টিভির মাধ্যমে শিক্ষার্থিদের শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে তাতে তেমন একটা সফলতা আসেনি। আসলে অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা ছাত্র - শিক্ষকের সরাসরি সংযোগ না থাকায় এই উদ্যেগ তেমন একটি জনপ্রিয়তা পায়নি ফলে করোনাকালিন সময়ে শিক্ষার্থিদের লেখা পড়ার এই দীর্ঘ শূন্যতা পূরন করতে বাজেটে শিক্ষাখাতে কী ধরনের বরাদ্দ রাখে তা দেখার বিষয়। প্রকৃতপক্ষে এই বাজেটটি করোনাকালিন বাজেট হওয়ায় দেশের বিভিন্ন চ্যালঞ্জ মোকাবেলায় সরকার বাজেটে কী ধরনের বরাদ্দ রাখে এবং দেশ পরিচালনায় এই বাজেট কতোটুকু সংকট মোকাবেলা করতে পারবে সেটি দেখার জন্য বিশ্লেষকরা মুখিয়ে আছেন। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর বহু বাজেট এসেছে এবং গেছে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের বাজেটটি সত্যিই বর্তমান সরকারের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ কারণ এই বাজেটেই নির্ধারিতো হবে করোনাকালিন সময়ে বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের ভাগ্য, রুজিরোজগার এবং  বেঁচে থাকা। এর বাইরে এই অর্থ বছরে প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং ধরে রাখাও সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে।  তবে আশার কথা হলো করোনাকালিন সময়ও দেশে বৈদেশিক মূদ্রার রির্জাভ বেশ ভালোই আছে বলা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকে তিন হাজার কৌটি ডলারেরও ওপরে রির্জাভ আছে যা যে কোনো বছরের তুলনায় রের্কড। তবুও এই অর্থ বছরে সরকারকে বেশ কিছু নতুন সমস্যার মোকাবেলা করতে হতে পারে। যেহেতু পৃথিবীজুড়েই করোনা পরিস্থিতি চলছে সেহেতু সরকারকে এই কঠিন সময়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতো একটি সার্মথ্যবান বাজেট পেশের দিকে মনযোগি হতে হবে।  তবে খুব বেশি বিলাসি বাজেট পেশ না করে জনবান্ধন এবং করোনাকাল সহনশীল বাজেট হলে সরকারের জন্য এবং জনগণের জন্য মঙ্গল হবে। এমন কঠিন পরিস্থিতি উত্তরণের মাধ্যমে দেশের সব মানুষের কাছে বাজেটের সুফল পৌঁছে দিতে সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজেটের বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ে মন্ত্রণালয়গুলো যাতে অধিক স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারে সেদিকেও সরকারকে নজর রাখতে হবে। প্রয়োজনবোধে বাজেটের বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় কীভাবে হচ্ছে তা যাচাই বাছাই করে দেখার জন্য আলাদা কমিটি করা যেতে পারে। সব মিলিয়ে সরকারকে এই বাজেট পাশ থেকে ব্যয় পর্যন্ত বরাবরই সঠিক পথে থাকতে হবে। এর অন্যথা হলে জিডিপি অর্জন এবং জনগণের কাছে করোনাকালিন সময়ের বাজেটের সুফল পৌঁছে দিতে বেশ কঠিন হবে।
     তাই আমাদের প্রত্যাশা সরকার এমন বাজেট প্রনয়নয় করবেন যা হবে সঙ্গতভাবেই গণমূখি, দরিদ্র এবং করোনাবান্ধব,যে বাজেটে থাকবে করোনাকাল মোকাবেলা এবং অতিক্রম করার সকল কলাকৌশল।

রতন কুমার তুরী। বাংলাদেশ
লেখক - কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, বাংলাদেশ।