অনন্ত যাত্রা - এ. এইচ. এম. আওরঙ্গজেব জুয়েল
বাংলাদেশের সব গ্রামের অবস্থা হয়তো এক নয়। তেমনি এক নয় মানুষের জীবন-যাপনের ধরন-ধারণে। নদী বিধৌত এলাকার মানুষের জীবন অনেকটাই সংগ্রামী। তাদের আচরণ তাই রুক্ষ। আবার চর এলাকার জীবনটাও অনেক বেশি বিধ্বংসী। চর দখলে লাগে রক্ত। আর সেই রক্তের যোগান দিতে গিয়ে কত মানুষের সংসার হয়েছে তছনছ তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। কত প্রেমিক তার প্রেমিকার জীবন থেকে ফেরার হয়েছে বিভিন্ন মামলার কারণে, তার ইতিহাস কোথাও লেখা না থাকলেও আমাদের সাহিত্য, আমাদের গান ও সংস্কৃতিতে সেগুলোর লোমহর্ষক বর্ণনা, অনেক কিছুই প্রকাশ করে। আবার হাওড় বা বিল এলাকার মানুষের জীবনেও আছে ভিন্নতর মাত্রা। তাদের জীবন-জীবিকার উৎস হয় বিল বা হাওড় থেকে প্রাপ্ত মাছ কিংবা শাপলা-শালুক। আবার কোনো কোনো গ্রাম শহুরে সংস্কৃতির প্রভাবে মানুষের মৌলিক না হলেও বাহ্যিক পরিবর্তন এনে দেয় ঠিকই। সেই পরিবর্তনে মানসিকতার পরিবর্তন মোটেও দেখা যায় না। বরং যুগ-যুগান্তরের আদিম প্রবণতাগুলো কালের যাত্রার ধ্বনির মতো প্রতিধ্বনিত হয় বারংবার।
গ্রাম-বাংলায় পরিবর্তনহীন জীবনে ঘানি টানা মানুষের সংখ্যাই বেশি। বৈচিত্র্যহীন গ্রামীণ এইসব মানুষের জীবনে না আছে প্রেম না আছে আবেগ। আবেগহীন মানুষের কাছে তাই সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় তাদের পেটের তাগিদ। ঘরে খাবার না থাকলে অশান্তির শেষ নেই। আর তিন বেলার খাবার যদি মজুদ থাকে তাহলে তো বাবুসাহেবের দেমাগের অন্ত থাকে না। ঘরে শুয়ে বৌ-বাচ্চার ওপর হুকুমদারির বহর দেখলে অন্য এলাকার মানুষের কাছে মনে হবে, কী আজীব মানুষ এরা! গ্রামীণ এইসব মানুষ আসলে অন্য ধাতুতে গড়া। কথায় কথায় বউ পিটানো আর সন্তানের পিঠে বাঁশের চিকন কঞ্চির সপাং সপাং মারের শব্দ তাই কারো কাছে নতুন কোনো বিষয় বলে মনে হয় না।
অবশ্য যাদের জীবনে অভাব প্রধান সাথি হিসেবে জন্মের পর থেকে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে যখন ভালোবাসা জেগে ওঠে তখন সেখানে লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, শিরি-ফরহাদ এর প্রেম তুচ্ছ বলে মনে হবে। যখন এরা ভালোবাসে মনে-প্রাণে পুরোটাই ভালোবাসে। কোনো ভাগাভাগির ধার তারা ধারে না।
মোহনপুর হাওড় ও বিল প্রধান একটি এলাকা। এই এলাকারই একটি গ্রাম সরেন যাই। বাংলার অন্যান্য গ্রামের চেয়ে সরেন যাই গ্রামের যে খুব একটা পার্থক্য আছে তা হয়তো বলা যাবে না। তবে হ্যাঁ, জীবিকার ব্যাপারে এখানকার মানুষ অলস আর কর্মভীরু। গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে বিলের ধারের বাড়িটিই আমাদের গল্পের পটভূমি।
বাড়িটি খুব বেশি দিন আগের নয়। ধলা মিয়া যখন কোনো এক অজানা জায়গা থেকে এসে এখানে ছন আর বাঁশের নতুন ঘর তোলে তখন বৈশাখ বা আষাঢ় মাস বা এর যেকোনো একটি সময় হবে। ধলা মিয়া তার স্ত্রী ছমিরনকে নিয়ে এসে নতুন করে এখানে বাড়ি তোলে। গ্রামের মানুষ আশ্চর্য হয়! বিলের সাথে লাগোয়া একটি বিরান ভূমিতে কীভাবে তারা বসবাস করবে! তবে স্বামী -স্ত্রীর বিশ্বাস ছিল তারা পারবে। কারণ তাদের তো এমন কোনো সম্পদ নেই যার জন্য তারা ভয় পাবে। মানুষের আসলে ভয় পাওয়ার কথা বন্য জীব-জন্তুকে কিন্তু সে আসলে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় তার সজাতিকেই।
ধলা মিয়া আর ছমিরনের নিস্তরঙ্গ জীবনে বৈচিত্র্য নেই বটে কিন্তু সুখেরও যেন সীমা নেই। মাঝে মাঝে যখন ছমিরন ধলা মিয়ার লোমশ বুকে গিয়ে মাথা রাখে তখন তাদের অতীত ভালোবাসার প্রসঙ্গ-স্মৃতি হানা দেয় অবধারিতভাবে। কী জীবন ছিল তাদের! চাঁদনী রাতে বাঁশ বাগানে গোপনে দেখা করা; হাত ধরে নীল আকাশের নীচে দুজনের ঘুরে বেড়ানো। কিংবা বিলে শাপলা তোলার নাম করে দুজনের সাক্ষাতের মুহূর্তগুলি আসলেই ছিল অন্য রকম। রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে দুজনেই। তারা মনে করার চেষ্টা করে তাদের প্রথম দেখার স্মৃতি, প্রথম ভালোবাসার ইতিহাস। রাত পার হয়ে যায়। সরেন যাই গ্রামে ইতিহাসের নতুন কল চলতে থাকে তার নিজস্ব নিয়মে।
বিয়ের প্রথম বছর ধলা মিয়া আর ছমিরনের ঘরে অভাব থাকলেও সেখানে সুখের সীমা ছিল না। কিন্তু এই অবস্থা বেশি দিন স্থায়ীত্ব পায় না। তাদের ঘরে যখন আকালু এলো মা-বাবার কোল জুড়ে তখন থেকেই অতিরিক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আকালুর বাবার পরিশ্রমের মাত্রা যায় বেড়ে। সারাদিন সুখের ফানুস রচনা করে চলে আকালুকে ঘিরে। এই আকালুই হয়তো একদিন তাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। তাদের পরিবারের হাল ধরবে। ঘরে আসবে একটি দেবীর মতো মুখচ্ছবি নিয়ে কোনো সুন্দরী বউ। নাকে তার নথ, হাতে চুড়ির রিনিঝিনি আওয়াজ আর পায়ে থাকবে নূপুর। সেই নূপুরের শব্দে সারা বাড়ি আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠবে।
আকালুর বয়স এখন ছয়। শরীরে মাংস নেই। হাড়গুলো গুণা যায়। সারাদিন খেলাধুলায় কাটিয়ে দেয়। ভাতের অভাব তো আছেই আর সেই অভাব পূরণের ব্যবস্থাও সে করে ফেলেছে। বর্ষার সময় বিলের শাপলা খেয়ে সে পেট ভরাতো, নয়তো আশে পাশের বিভিন্ন গাছের কুড়ানো ফল-মূল খেয়ে তার পেটের ক্ষুধা মেটে। বাবা ধলা মিয়া অনেক কষ্ট করেও ছেলেটির সুখ-সাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করতে পারে না। একটা মাত্র হাফ-প্যান্ট আর একটা মাত্র গেঞ্জি। আর ছমিরনের পোশাকেরও একই অবস্থা। শাড়ির বিভিন্ন জায়গায় তালি মারা। আর একটা শাড়ি উঠানো থাকে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এটি ব্যবহার করা হয় না।
ধলা মিয়ার মন ভালো নেই। সে তার পরিবারের জন্য কিছুই করতে পারেনি। সন্তান ও বউ এর কোনো চাহিদাই সে পূরণ করতে পারেনি। জীবনটা তার কাছে একটা ভারবাহী পশুর মতো মনে হয়। তাছাড়া অভাবের কারণে সংসারে অশান্তি লেগেই থাকে। ছমিরন সবকিছুকেই মুখ বুজে সহ্য করে নেয়। ধলা মিয়ার অত্যাচার এখন তাকে আর বিশেষ করে ভাবিয়ে তোলে না। কিন্তু সন্তানের শীর্ণ শরীর আর পোশাকের অবস্থা দেখে মরে যেতে ইচ্ছে করে ছমিরনের। একটা মাত্র প্যান্ট আর সেই প্যান্টের পিছনে মাটির সাথে ঘষা খেয়ে খেয়ে দুইটি গোল বৃত্তের মতো হয়ে ছিড়ে গিয়েছে। ছোট ছেলেরা তার সেই ফাঁকা জায়গা নিয়ে কবিতা বানিয়ে যখন বলে,
‘আকালুরে আকালু,
ইজ্জতটারে খোয়ালু
পাছায় তোর মস্ত ফাঁকা
হয়ে আছে চাকা চাকা।’
ছোট ছেলেরা কবিতাটি বলতে থাকে আর চাকার মতো গোল হয়ে থাকা প্যান্টের সেই ফাঁকা অংশে হাত দিলে আকালুর আর সহ্য হয় না। কিন্তু রোগা-পটকা বলে সমবয়সী কারো সাথে সে মারামারিতেও কুলিয়ে ওঠতে পারে না।
একদিন আকাশের হিংস্রতা যেন মাটির পৃথিবীতেও নেমে আসে। প্রচণ্ড গরমের কারণে মানুষের সাথে সাথে পশু পাখিরাও যেন খাবি খেতে থাকে। এরকম একটি সময়ে আকালু মায়ের কাছে এসে খাবার চায়। কিন্তু বাড়িতে কোনো খাবার ছিল না। ‘ভাত নেই’, এই কথাটি নিজের সন্তানের কাছে বলা যেন এক বিরাট অপমান আর অস্বস্তি বলে মনে হয় ছমিরনের কাছে। মা ছমিরন এত অভাব আর দুঃসহ জীবনের প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে আকালুকে বলে,
‘এ্যাতো মানুষ মরে তোর ক্যানে মরণ হয়না?’
কথাটি মায়ের বুকে বড় বাজে। কিন্তু সে কি-ই বা এমন করতে পারে এই অবোধ ছেলের জন্য। তারপর আকালুকে বাড়ির কোথাও আর খুঁজে পাওয়া যায় না। চারিদিকে অনেক খোঁজার পর সন্ধান মেলে পাশের বাড়ির করিমের সাথে আকালু শাপলা তুলতে বিলে গিয়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। হাঁস-মুরগি সব ঘরে তাদের অবস্থানে আশ্রয় নিয়েছে। এমন সময় আকালু সম্পূর্ণ লেংটু হয়ে বাড়ি ফেরে। বাবা ধলা মিয়া জিজ্ঞেস করে,
‘কিরে আকালু, তোর প্যান্ট কই?’
আকালু এই ভয়টাই পাচ্ছিল। একটি মাত্র প্যান্ট, আর সেটিও যদি না থাকে তাহলে তার ভাগ্যে আজ কী আছে তা আল্লাই জানেন! ধলা মিয়ার চিৎকারে হুঁশ আসে আকালুর। অবশেষে ভয়ে ভয়ে বলে,
‘প্যান্ট শুকনা জায়গায় খুইল্যা রাইখ্যা বিলে গেচিলাম শাপলা-শালুক আনতে, আইয়া দেহি প্যান্ট নাই। কেউ চুরি কইরা নিয়া গ্যাছে।’
সারাদিনের পরিশ্রম আর অভুক্ত শরীর অন্যদিকে ছেলের প্যান্ট হারানোর সংবাদ ধলা মিয়াকে পাগলপ্রায় করে তোলে। ঘরের বেড়ায় গুঁজে রাখা একটা লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকে আকালুকে। আকালুর চিৎকার চেচামেচিতে আশে-পাশের লোকজন এসে পড়ে এবং ধলা মিয়ার হাত থেকে লাঠিটি কেড়ে নেয়। মাথা ঠাণ্ডা হলে ধলা মিয়া বিড়বিড় করে একান্ত মনে বলে,
‘হামি তোর কোনো সাধ পুরণ করতে পারি নাই, একটা প্যান্ট কিইন্যা দিবার যোগ্যতাও হামার নাই। তুই হামারে মাপ কইরা দিস বাজান।’
রাত গভীর হতে থাকে। ক্লান্ত ঝি ঝি পোকারা বিদায় নেয় তাদের দায়িত্ব থেকে। মাঝে মাঝে কুকুর আর অজানা কোনো পাখির কণ্ঠ ভেসে আসে। হঠাৎ করে গুঙানির শব্দে ঘুম ভাঙে ধলা মিয়া ও ছমিরনের। ধলা মিয়া এবং ছমিরন বুঝতে পারে আকালুই এমন শব্দ করছে। কাছে গিয়ে দেখে গায়ে ভীষণ জ্বর। সারা গা পুড়ে যাচ্ছে যেন কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আর সে চেতন-অবচেতনের মাঝামাঝি অবস্থান থেকে বিড় বিড় করে বলছে,
‘আর মারিস না বাজান, হামি আর বিলে শাপলা তুলতে যামু না।’
কথাটি ধলা মিয়ার কাছে চাবুকের বাড়ির মতো ঠেকে। ছেলের এই অবস্থা সে দেখতে পারে না। ছুটে যায় ডাক্তারের কাছে। তখন অনেক রাত। নগেন ডাক্তারকে অনেক ডেকে, ঘুম থেকে উঠিয়ে, বাড়িতে আসে ধলা মিয়া। নগেন আকালুর অবস্থা দেখেই বুঝতে পারে, এই ছেলে হয়তো বেশি সময় টিকবে না। কিছু ওষুধ দিয়ে নগেন ডাক্তার বাড়ি ফিরে যায়। অর্ধচেতন অবস্থায় আকালু বিড়বিড় করে বলতে থাকে,
‘আর মারিস না বাজান, হামি আর বিলে শাপলা তুলতে যামু না।’
আকালু আর কোনোদিন শাপলা তুলতে যাবেনা। এই পৃথিবীর কোনো ঘাটে সে আর তরী ভিড়াবে না। তার যাত্রা অনন্তের পথে। কোনো অভাব তাকে আর কোনো দিনও স্পর্শ করবে না। কোনোদিন তাকে আর বলতে হবে না,
‘আর মারিস না বাজান, হামি আর বিলে শাপলা তুলতে যামু না।’
এ. এইচ. এম. আওরঙ্গজেব জুয়েল
শরীয়তপুর, বাংলাদেশ।
-
গল্প//উপন্যাস
-
25-06-2020
-
-