অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
ফাউস্ট (প্রথম খণ্ড) - এ.এইচ.এম. আওরঙ্গজেব জুয়েল

ফাউস্ট (প্রথম খণ্ড) 
মূল: য়োহান ভোলফ গাঙ ফন গ্যোতে
অনুবাদ: আহমদ ছফা

     নাটক একটি সমবায়ী শিল্প। নাটকের প্রাণ হচ্ছে দর্শক। তাই নাটককে বলা হয়ে থাকে দৃশ্যকাব্য। আর কাব্য নাটক হচ্ছে কাব্যে রচিত নাটক। ‘ফাউস্ট’ ( লেখা শুরু ১৭৭৩, শেষ করেন ১৮০৭) হচ্ছে একটি কাব্য নাটক। নাটক মঞ্চে যতটা উপভোগ্য হয় পড়ায় সেই স্বাদটা তেমন পাওয়া যায় না।  তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের না পড়ে উপায় থাকে না। নাটকটি বিশ্বসাহিত্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তাই নাটকটি নিয়ে বিদ্বজ্জনের উৎসাহের অন্ত নেই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৮৬১-১৯৪১) আশি বছর বয়সে মূল জার্মান ভাষায় নাটকটি পাঠের জন্য জার্মান ভাষা শেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি এই কাজটি শেষ করে যেতে পারেননি। ‘ফাউস্ট’ নাটকের কাহিনি জার্মানির রূপকথা থেকে নেওয়া। রূপকথার কাহিনি হলেও এখানে গ্যোতের (১৭৪৯-১৮৩১) নিজস্বতা এবং প্রাতিস্বিকতা সহজেই অনুমেয়। দুই খণ্ডের ‘ফাউস্ট’ নাটকটি নাট্যকারের পঞ্চাশ বছরেরও অধিক সময়ের সাধনার ফল।
     গ্যোতের জন্মের দু’শো বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন ইংরেজ কবি ও নাট্যকার মার্লো (১৫৬৪-১৫৯৩)। তিনিও এই জার্মান রূপকথা অবলম্বনে লেখেন ‘ডক্টর ফস্টাস’ (১৫৯৩) নাটক। তবে মার্লো এবং গ্যোতের নাটকের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। সেটা কাহিনি এবং অঙ্গিকের দিক থেকেও। গ্যোতের ‘ফাউস্ট’ নাটক কেন এত ভাবুকের ভাবনার বিষয় হয়েছে সেটা আসলেই কৌতূহলের জন্ম দেয়। আহমদ ছফা এই ভাবুকদের এত আগ্রহের কারণ হিসেবে বলেন, 
 ‘‘ফাউস্ট’ নাটকের মধ্যে গ্যোতে একটা খুদে ব্রহ্মাণ্ড তৈরি করেছেন। ব্রহ্মাণ্ডে যা-কিছু আছে, যা-কিছু থাকতে পারে, ‘ফাউস্ট’ ভাণ্ডে তা অবশ্যই আছে। এটা এমন সমুন্নত মহিমার অধিকারী, এমন আশ্চর্য একটা গ্রন্থ, যে গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে পবিত্র অগ্নি বিকরিত হয়েছে, যুগে যুগে পতঙ্গের মতো ভাবুকচিত্ত তার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ অবহেলা করতে পারেনি।’’
  ‘ফাউস্ট’ এমন একটা নাটক; যেখানে সব তাত্ত্বিকের জন্য রয়েছে বিধানের ব্যবস্থা। তাই বিভিন্ন মত ও পথের পথিক এখান থেকে খোঁজেন তাঁদের অমৃতভাণ্ড। এ সম্পর্কে আহমদ ছফার মূল্যায়ন বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। তিনি বলেন,
 ‘‘ধর্মতাত্ত্বিকদের দৃষ্টিতে এই গ্রন্থ ধর্মপুস্তকের মর্যাদা বহন করে, সংশয়বাদী এই গ্রন্থে তাঁর মতামতের মর্মরিত প্রতিধ্বনি শুনতে পান, নাস্তিক্যবাদী তাঁর বিশ্বাসের রক্ষাকবচ হিসেবে, এবং বিজ্ঞানী তাঁর সন্ধান প্রক্রিয়ার যুক্তিনিষ্ঠ শৃঙ্খলার প্রতীক হিসেবে এই গ্রন্থকে বিচার করে থাকেন। এই গ্রন্থের অন্তরে এমন কিছু রয়েছে যার ফলে সকলে আপনাপন অভীষ্টের সন্ধান পেয়ে যান।’’
 ‘ফাউস্ট’ নাটকের প্রথম খণ্ডে রয়েছে মোট ২৫ টি দৃশ্য। এই প্রথম খণ্ডকে ‘গ্রেচেন ট্রাজেডি’ হিসেবেও ধরা হয়ে থাকে। নাটকীয় কাহিনি বেশ জটিল এবং শেষ পর্যন্ত ট্রাজেডির বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে। নাটকে বেশ কিছু চরিত্র থাকলেও মূলত তিনটি চরিত্র মূখ্য হিসেবে নাটকীয় ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ফাউস্ট, মেফিস্টো, মার্গারিটা চরিত্র তিনটি তাই আলোচনার দাবি রাখে। 
 ‘ফাউস্ট’ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফাউস্ট। তিনি একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। বিভিন্ন বিদ্যায় তিনি পারদর্শী। জীবনের সাধ-আহ্লাদকে বিসর্জন দিয়ে তিনি জ্ঞান সাধনায় থেকেছেন ব্যস্ত। তার মধ্যে মাঝে মাঝে যে জীবন উপভোগের ব্যাপার কাজ করতো না, তা কিন্তু নয়। তবে স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসী থাকার কারণে তিনি নিজেকে সবসময় গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এই জ্ঞানীব্যক্তির জীবনে পরাজয় ঘটে শয়তানের চক্রান্তে। লাভ করেন নবযৌবন। জীবনকে ভোগের উপাদান হিসেবে পান অনেক কিছুই। ফাউস্ট মার্গারিটার প্রেমে পড়েন এবং শয়তান মেফিস্টোর সহযোগিতায় তিনি প্রেমে সফল হন। কিন্তু একটা সময় তিনি বুঝতে পারেন জীবনের মানে। তাঁর ভেতরে তীব্র অনুশোচনা কাজ করতে থাকে এবং মার্গারিটার করুণ জীবনের জন্য নিজেকে দায়ী করে প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছেন। এজন্য প্রেমিকা মার্গারিটা বা গ্রেচেনকে তিনি জেলখানা থেকে মুক্ত করার পদক্ষেপ নিলেও সফল হতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তিনি শয়তান মেফিস্টোর চলার পথের সঙ্গী হয়েই পথে বেরিয়ে গেছেন। ফাউস্ট দ্বান্দ্বিক চরিত্র হলেও তার ভেতরের দ্বন্দ্ব সর্বাংশে বিকশিত হয়নি।
     শয়তান মেফিস্টো একটি শক্তিশালী চরিত্র। তার মধ্যে মানুষকে বিপথে নিয়ে যাওয়ার যে গুণাগুণ, সেই সার্থক বিকাশ নাটকটিতে চমৎকারভাবে প্রকাশিত হয়েছে। স্রষ্টার সাথে শয়তানের দ্বন্দ্ব সবসময়ই ছিল। স্রষ্টার বিশ্বাস ছিল মানুষকে বিশেষ করে জ্ঞানী ফাউস্টকে শয়তান মেফিস্টো বিপথে নিয়ে যেতে পারবে না। কিন্তু শয়তান স্রষ্টার সাথে এক ধরনের বাজি ধরে এবং সে দৃঢ় আত্মবিশ্বাসে তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। মেফিস্টো কুকুরের ছদ্মবেশে ফাউস্টের কাছে আসে এবং তাকে ভুল পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়। 
     মার্গারিটা বা গ্রেচেন চরিত্রটি স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসী। কিন্তু ভালোবাসার ফাঁদে পড়ে সে তার মহিমাকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছে। তাঁর জীবনে কোনো শান্তির পরশ ছিল না; বরং আত্মদহনে সে বার বার হয়েছে ক্ষত-বিক্ষত। বাধ্য হয়েছে মা এবং সন্তানকে হত্যা করতে এবং তার ভাই ভ্যালেন্টিনের মৃত্যুও হয় অনেকটা তার কারণেই।  অবশেষে তার ঠিকানা হয় জেলখানা। জেলখানায় মার্গারিটা অপেক্ষায় থাকে মৃত্যুদণ্ডের জন্য। ঠিক সেরকম একটি সময়ে ফাউস্ট তাকে উদ্ধার করতে আসে শয়তান মেফিস্টোর সহযোগিতায়। কিন্তু মার্গারিটা না পালিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় জেলখানায় থেকে যেতে। সে মনে করে, তার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হয়তো এভাবেই হতে পারে, পালিয়ে গিয়ে নয়। নারী হৃদয়ের গভীর বেদনাঘন একটি দৃশ্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে নাটকের প্রথম খণ্ডটি। ফলে মার্গারিটার করুণ দৃশ্য আমাদের মধ্যে তৈরি করে এক ভয়াবহ আবেশের; এবং তার বিচ্ছেদ বেদনায় একটি ট্রাজিক সুর ধ্বনিত হতে থাকে পাঠক হৃদয়ে।
     ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় নিয়ে আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১) অনুবাদ কর্মটি নিষ্পন্ন করেন। নাটকের প্রতিটি পাতায় পাতায় অনুবাদকের প্রযত্নের ছাপ রয়েছে। সহজ-সরল এবং চমৎকার কাব্যিক সুষমায় তিনি ‘ফাউস্ট’ নাটকটি অনুবাদ করেছেন। সম্পূর্ণ বিদেশি স্থান-কাল-পাত্রে তিনি আরোপ করেছেন দেশীয় পরিমণ্ডল এবং আবহ। ফলে নাটকটি আরও প্রাঞ্জল এবং সুখপাঠ্য হয়েছে।

প্রকাশক: মাওলা ব্রাদার্স (প্রথম প্রকাশ: ১৯৮৬, তৃতীয় মুদ্রণ: মার্চ ২০১৫)
মুদ্রিত মূল্য: ৩৫০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২৩৯
গ্রন্থের প্রকৃতি: কাব্য নাটক

এ.এইচ.এম. আওরঙ্গজেব জুয়েল

শরীয়তপুর, বাংলাদেশ।