অটোয়া, শুক্রবার ১৩ জুন, ২০২৫
নতুন প্রভাত - রত্না দত্ত

     জ সুদীপবাবু খুশির সঙ্গে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পর। এবার একে একে বাড়ি ভর্তি আত্মীয় - স্বজনদের বিদায়ের পালা। আজ সুদীপ বাবুর নিজেকে বেশ কিছুটা হাল্কা বলে মনে হচ্ছে। কো - দিন পরেই তো অষ্টমঙ্গলা,  মেয়ে - জামাইয়ের আসার আনন্দে ও বুকভরা খুশিতে সুদীপ বাবু ও অপর্ণা অপেক্ষাতে তার তোড়জোড় শুরু করলেন। অবশেষে এল সেই প্রতীক্ষার দিন। সকাল থেকেই বাড়িতে সাজসাজরব, আজ যে অষ্টমঙ্গলা।
     - মা? বাবা? কোথায় তোমরা?  আমরা এসে গেছি!  ভাই কোথায় তুই?
     - ও মা........। মামণি? তোরা এসে গেছিস?
     এসো বাবা অর্ণব! বাড়ির সবাই ভালো আছে তো?  তা বাবা অর্ণব তোমার কাছে আমাদের একটা আর্জি ছিল,
     - কি বলুন না মা?
     - আজ কিন্তু তোমাকে থেকে যেতে হবে বাবা! বুবুন ও বলছিল আর এটা  আমাদের ও অনুরোধ।
     - কিন্তু মা! বাবা! আমার তো অফিসের ছুটি মোটামুটি শেষ, পরশু জয়েন করতেই হবে।
     - ঠিক আছে, ঠিক আছে, ওসব বিষয়ে পরে আলোচনা করলেও চলবে। অর্ণব ওপরে যাও একটু বিশ্রাম করো গিয়ে
     - বুবুন? জামাইবাবুকে নিয়ে ওপরে যাও।
     - মামণি, মা আমার কেমন আছিস বল?
     - কেন বাবা? আমি কি তোমার কাছে বোঝা হয়ে গেছিলাম? আমি কি তোমার কুৎসিত মেয়ে যে আমাকে পার করতে  গেলে তোমাকে বহু পণ দিতে হবে? তবে কেন বাবা?
     - কেন মামণি? একথা বলছিস? তুই ভালো আছিস তো? তবে এসব কথা কেন আজকের এই শুভ দিনে।
     - না, বাবা? আমি ভালো নেই।
     - কেন? অর্ণব কি কিছু বলেছে? বা তোর ওপরে কি কোনরকমের অত্যাচার করেছে?
     - না, বাবা? অর্ণব খুব ভালো ছেলে।
     - তবে? তবে কি হয়েছে?
     - কি আবার হবে। ওই যে অর্ণবের মা! আমার শাশুড়ি আজ সবেমাত্র সাত দিন হয়েছে, আমার হাতের মেহেন্দি এখনও রয়েছে, এরই মধ্যে শাশুড়ি সবসময় আমাকে উঠতে বসতে কাজের খোঁটা, রান্নার খোঁটা দেন, কোনকিছুতেই উনি সন্তুষ্ট নন আমি আর পারছিনা বাবা!
     - কেন অর্ণব কি বলে?
     - অর্ণব? অর্ণব কিছুই বলে না। বলতে গেলে বলে অ্যাডজাস্ট করতে হবে। কিন্তু অ্যাডজাস্ট করে কী করে চলবো? সেই আমি যে ছোটবেলা থেকে এক গ্লাস জলও গড়িয়ে খাইনি তাকে কিনা আজ রান্নাবান্না, ঘরের কাজ এমনকি অসুস্থ শাশুড়িকে দেখাশোনা সবটাই তো আমাকে করতে হবে।
     - কিন্তু মামণি, এটা তো প্রত্যেক মেয়েদের কর্তব্য। তোর মা - ও এই বাড়িতে বৌ হয়ে এসে তার সমস্ত কর্তব্য একা সামলেছে। আমিও সন্তুষ্ট ছিলাম আর তোর ঠাকুমা - ঠাকুর্দা ও সন্তুষ্ট ছিলেন। তোর কাকু ও পিসিদের নিয়ে মায়ের তো কোনদিন কোনো নালিশ ছিল না বা অনুতাপ ও ছিল না বরঞ্চ মা সবসময় খুশিতে ও আনন্দেই ছিল।
     - কি অপর্ণা? বল? তাই না?
     - হ্যাঁ, তাই তো?
     হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মামণি বলে ওঠে,
     - তাহলে বাবা, তুমি কি মায়ের মতো হতে বলছ?
     - নিশ্চয়ই! আমাদের সন্তান হয়ে আমাদের শিক্ষাদীক্ষায় মানুষ হয়ে আজ তুই আমাদেরকে কারও কাছে ছোট করতে পারিস না। আমি ভবিষ্যতে চাইব তোর জন্য যেন আমাদের মাথা হেঁট না হয়। আমরা যেন গর্ববোধ করি তোকে নিয়ে। একটা কথা মনে রাখিস যে, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে- 
     - না, বাবা! আমি যে কিছুতেই পারছি না।
     - হতে পারে না। মাত্র এই সাতদিনে তুই যেমন শাশুড়িকে বুঝতে পারবি না তেমনি শাশুড়িও তোকে বুঝতে পারবেন না, সময়-সাপেক্ষর ব্যাপার। তাই অপেক্ষা কর, একদিন আসবেই যেদিন আমার মামণি সংসারের প্রকৃত গিন্নি হয়ে উঠবে ও সকলের মন জয় করবে। 
     দুই বছর পরে, ফোনে..
     - বাবা? সবাই কেমন আছো? আমরা ভালো আছি।
     - কি করছিস মামণি?
     - আমি শ্বাশুড়ির পায়ে তেল মালিশ করছিলাম। বড্ড ব্যথা গো? রাতে ঘুমোতে পারেন না তা- ই।
     - আচ্ছা, তোর কাজকর্ম সব হয়ে গেছে?
     - হ্যাঁ। বিট্টু মনে তোমাদের নাতিকে তো মা-ই সব দেখাশোনা করেন। নতি-অন্ত প্রাণ বলতে পারো। আমাকে উনি কিছুই করতে দেন না, আর নাতিও হয়েছে ঠাকুমা অন্ত প্রাণ।
     - বাহ্ বুকটা ভরে গেলো রে। এই দিনটার অপেক্ষাতেই তো ছিলাম। আজ নিশ্চয়ই বাবার ওপর তোর জমানো অভিমান ধুয়ে মুছে গেছে। আমি সেদিনও ভুল ছিলাম না আর আজও ভুল নই। শুধু তোর মনের ভুল ধারণাটাকে আমি পাল্টে দিতে চেয়েছিলাম। সেদিন যদি আমি তোর সমস্ত অভিযোগে সায় দিতাম তাহলে আজ আরও একটা সংসার ভেঙে যেত। আজ আরও একজন মা ছেলেকে হারাত আর আরও একজন ছেলে মা হারা হতো। সেটা কখনই কাম্য নয়। ভালোবাসা দিলে তবেই ভালোবাসা পাওয়া যায়, কষ্ট করলে তবেই তো কেষ্ট মেলে। আর আজ সেটাই হয়েছে। তাই মামণি আমাদের আশীর্বাদ সবসময় তোদের সঙ্গে ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। সবাই ভালো থাকিস, সুস্থ থাকিস আর আমাদের বিট্টু দাদুভাইকে খুব আনন্দে রাখিস। আমাদের আশীর্বাদ রইল।
     ফোনটা রাখার সঙ্গে সঙ্গে সুদীপ বাবুর দুচোখের যে অশ্রুধারা  দু-গাল বেয়ে নেমে আসছিল, তা তিনি অপর্ণার কাছে লুকিয়ে রাখতে পারলেন না, এ -অশ্রু যে আনন্দাশ্রু, ব্যথার অশ্রু নয়। তিনি অপর্ণাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন আর বললেন,
     - দেখো অপর্ণা আজ আকাশের ঐ সূর্যটা কত উজ্জ্বল, আজ বোধহয় আমরা এক নতুন প্রভাতের খোঁজ পেলাম।

রত্না দত্ত। হুগলী