অটোয়া, সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪
প্যারিস রোড থেকে: খ’সেপড়া কয়েকটি পাতা - ফজলুল হক সৈকত

    এক: ‘আমি কান পেতে রই’
     ১৯৮৯ সালের শীতকালের কোনো এক সকালবেলা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে গেছি। মেইন গেট দিয়ে ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকতেই কিছুক্ষণের মধ্যে চোখে পড়ে ডানদিকের একটি রাস্তায় দুপাশে সুন্দর সারি সারি গাছে। মাঝখান দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে একটি সরল শীতল অজগরের মতো পাকা রাস্তা। পরে জেনেছি ইউরোপীয় গাছঘেরা এই পথটির নাম প্যারিস রোড। বাহ্। বেশতো রাজশাহীতে প্যারিস রোড! বহুকাল পড়ে, ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে সড়কপথে কলকাতা যাওয়ার সময় জানলাম ‘যশোর রোড’ যাশোর বা তার আশপাশে নয়- কলকাতা শহর থেকে নেমে সোজা যশোর সীমান্তের দিকে ধেয়ে আসা রাস্তার নাম এটি! দীর্ঘ এক পথ! বাসে যেতে যেতে মনে পড়লো, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখা অ্যালেন গিন্সবার্গের কালজয়ী কবিতা- ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। কখনো কখনো অজ্ঞতাও যে আনন্দের কারণ হতে পারে, বুঝলাম। তো, প্যারিস রোডের কথায় আসি। এই রোডের ঠিক মাঝবরাবর বাগানের ওপাশে শহীদুল্লাহ কলা ভবন। সেখানে বাংলা বিভাগ। কাজেই, কারণে-অকারণে প্যারিস রোড হয়ে উঠলো আমাদের প্রতিদিনের চলার সাথী। চলতি পথে কোনো এক এপ্রিল মাসের, পহেলা বৈশাখের, সকালবেলা। শোভাযাত্রা নিয়ে আমরা- বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা, অতিক্রম করছি প্যারিস রোড- জুবেরী ভবন থেকে ভিসি ভবন পার হয়ে সিনেট হল পর্যন্ত। ঢোল-তবলা-হারমোনিয়াম কাঁধে নিয়ে ‘এসো হে বৈশাখ’ গাইতে গাইতে। সেদিন বাগানে-বাতাসে সুর তুলেছিল শফিকুলের সাইকেলের ক্রিং ক্রিং, শরীফাদের চোখের তারা আর আমাদের সেই যুবা-বয়সের কতো অজানা স্বপ্নের হাতছানি। তারপর কত এপ্রিল, কত বৈশাখ চলে গেল। সেই সুর আজও ভাসে এখানে-সেখানে। আর ‘আমি কান পেতে রই’।
     দুই: কবিতায় ক্লান্তিমোচন
     মনে পড়ছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মতিহারের সবুজের অবিরাম খেলায় তখন মনে নতুন সুর জমেছিল। আনন্দ অসীম আর ক্লান্তির ভেতর দিয়ে যাপন করেছি বেশ কিছু সময়। তখনকার ভাবনা-প্লাবনে লেখা একটা কবিতার কথা মনে পড়ছে। ‘সারাদিন ক্লান্ত আমি’ নামের কবিতাটি রাজশাহীর একটি স্থানীয় পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। আমাদের বাংলা বিভাগের এক বড়ো ভাই, কবিতাটি পড়ে বলেছিলেন- ‘তোমার কবিতা হবে’। এই স্মৃতিচারণের অ্যালবামে কবিতাটি তুলে দিতে ইচ্ছে করছে-

গলি পেরিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকি
ক্লাস-সেমিনার আর লাইব্রেরি শেষে ক্লান্ত হই এক সময়
শরীরের ভার নামিয়ে রাখি মাঠপাড়ে কড়ইতলায় - 
রোদের তীব্রতাকে সানগ্লাসে বেঁধে
ঘাসের ওপর ফেলে-দেওয়া বাদামের খোসা
অস্তিত্ব জানায় মানুষের
দূর থেকে মেয়েলি কণ্ঠে হাসির শব্দ ভেসে এসে
মুহূর্তে মিলিয়ে যায় নীরবতায়
মনে পড়ে দিগন্তরেখার মতো অস্পষ্ট স্মৃতি
প্রিয় বান্ধবীর মুখে-চুলের গোড়ায়
পানির ছিটেফোঁটায় আহ্লাদের গন্ধ
লেপ্টে আছে যেন আলতো ছোঁয়ায়
মথে যেতে ইচ্ছে করে অকৃত্রিম সৌন্দর্য।

চকলেটের মিষ্টি গন্ধ
পেছনে ঘাসের গায়ে পায়ের শব্দ
অচেনা হঠাৎ-ভালোলাগা দুচারটি চলতে-থাকা নারী
সিগারেটের শাদা ধোঁয়া
চেতনায় ধাক্কা খেয়ে ফিরে যায়
কাছে পাবার বাসনা চেপে ধরে খুব
মনে মনে উত্তেজিত হয়ে ক্লান্ত হই।

অ্যাম্বুলেন্সের একটানা সাইরেন শোনা যায়
অনাগত অশুভের হাতছানি যেন
বাদামের খোসার পেছনের গল্প; ‘চা-গরম চা-গরম’ শব্দাবলি
আর সেমিনারের দুর্বোধ্য কথামালা মাথায় নিয়ে - বুকে নিয়ে
গোধূলির প্রান্তরেখায় ধীরপদে
ঘরে ফিরি - আনমনে -
চারদেয়ালের আবাসঘরে।
     তিন: হল না ছেড়ে...
     সেশনজটের কারণে বেশ কিছুকাল ক্যাম্পাসের সবুজে পা রাখার সুযোগ হয়েছিল। সেকেন্ড ইয়ারে আমরা ছিলাম টানা ২৮ মাস। এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের ফল পোহাতে হয়েছিল কয়েক বছর। তখন মনে হচ্ছিল - সময় কেন পার হচ্ছে না?  আর আজ ভাবছি, কেন সেদিন তাড়াহুড়া ছিল! ভালোইতো ছিলাম সেই দিনগুলিতে। ১ টাকা কাপ চা, টাকায় ২টা সিঙ্গারা, ডাইনিং-এ ৬ টাকায় রাত-দুপুরের খাবার! আহা! হলের পুকুরে সাঁতার কাটা কিংবা গভীর রাতে ছাদে বসে থাকা! একবার হল ভ্যাকান্ট হলো। আমরা ৪বন্ধু বাড়ি না গিয়ে হলে থেকে গেলাম। আরো কেউ কেউ এরকম থাকতো তখন। সামনে পরীক্ষার অজুহাত ছিল। রান্না-খাওয়া-পড়া আর লুকিয়ে লুকিয়ে থাকা - সে-কি ভয়ঙ্কর আনন্দের দিন!
     চার: কিছু লজ্জা কিছু স্নেহ
     ময়মনসিংহের মেয়ে লিজা। সুন্দরী। খটখট করে হাঁটতো উঁচু হিল পরে। জামালপুরের কালো মেয়ে রীনার সাথে চলতো সবসময়। সুন্দরীদের এই এক স্বভাব - কালো, বেঁটে মেয়েদের সাথে নিয়ে ক্যাম্পাস ঘুরতো। যেন ছেলেদের চোখ না এড়ায়। রোজীকেও দেখেছি - সমাজবিজ্ঞান না ইসলামের ইতিহাস ডিপার্টমেন্টের ওরকম এক বান্ধবী জোগাড় করে, ঠোঁটে বেগুনি লিপস্টিক দিয়ে বিকেলে বাজারে যেত। তো, একদিন ক্লাস থেকে বের হতেই বারান্দায় লিজার সাথে দেখা। বললো, কী হারুন স্যারের পিএস, জুতা এতো নোংরা কেন? খুব খটখটে মেয়ে ছিল লিজা। মুখের সামনে মনের কথা পেড়ে বসতো যখন তখন। আমি তাকিয়ে দেখি, কালো জুতা প্রায় শাদা হয়ে গেছে ধুলাবালি মেখে। লজ্জায় মাথা নত হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। আমি তখন হারুন স্যারের তত্ত্বাবধানে এমএ থিসিস করছি। আমরা ৬জন ছিলাম থিসিস গ্রুপে। অনেকদিন পরে, ২০০৭ কি ২০০৮ সালের দিকে, ময়মনসিংহ থেকে লিজা এলো আমার বর্তমান কর্মস্থল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে - আমার সাথে দেখা করতে। ছোটবোনকে নিয়ে ওপেন ইউনিভার্সিটিতে কী একটা কাজে এসেছিল। শুনলাম, তখনো বিয়ে করেনি। মনটা খারাপ হলো এই ভেবে - ‘অনেক বড় ঘরনীরও ঘর হয় না, অনেক বড় রূপসীও বর পায় না’। 
     সামাদী স্যার ছিলেন সেকালের স্মার্ট শিক্ষক। খুব ভাবসাব। জাহাঙ্গীর নগর থেকে পাশ করা। কাউকে পাত্তা দেয় না। ইনসাল্ট করা তাঁর স্বভাব। একদিন লাঞ্চের পর কী একটা কাজে ডিপার্টমেন্টে ঢুকছি। হালকা শীত পড়েছে তখন। সাহেব বাজারের ফুটপাত থেকে কেনা একটা জলপাই রঙের পাতলা সোয়েটার গায়ে আমার। স্কিনটাইট। পড়লাম সামাদী স্যারের সামনে। প্রায় ধাক্কা লেগে যায় এমন অবস্থা। তিনি হুট করে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন - ‘কী গায়ে দিয়েছে এটা? ফজলুল, তুমি না ডিপার্টমেন্টের ফার্স্টবয়! এই তোমার কাণ্ডজ্ঞান!’ এতো লজ্জা পেয়েছিলাম সেদিন। তখন ভেবেছিলাম ইনসাল্ট করছেন- অনেক পরে ভেবেছি, এটা স্নেহও হতে পারে! সত্যি স্নেহ কি? 
     পাঁচ: পাতা নেই, সিট নেই সমাচার
     আমাদের সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব পরিচিত একটা প্রসঙ্গ ছিল - লাইব্রেরিতে বই-এর পাতা কাটা। দরকারি যে খুঁজতে যাবো, খুলে যে অধ্যায় বা পৃষ্ঠাগুলো পড়ার জন্য খুলে দেখবো- দেখবো পাতা নেই। ঠিক ঠিক ওই কয়টা পৃষ্ঠা ব্লেড দিয়ে কাটা। ব্যস্। শুনেছি শীতকালে কেউ কেউ চাদরের নিচে লুকিয়ে অনেক বই চুরিও করেছে। কাজেই, ক্যাটালগে আছে কিন্তু সেলফে নেই - এমন গ্রন্থের সংখ্যাও কম ছিল না। আরেকটা ব্যাপার - বাসে উঠেই দেখা যেত, সব সিটে হয় ইট, না-হয় খাতা, না-হয় কলম - একটা-না-একটা কিছু রাখা। তার মানে এটা বুক করা। একটা খোয়া (ইটের ছোট্ট টুকরো) রেখে আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে চা-সিগারেট খান- কোনো টেনশন নেই, সিট আপনার দখলে!
     ছয়: ব্যথা নিয়ে বিদায়
     মাস্টার্স-এর রেজাল্টোর দিন। আগে থেকেই কানাঘুষা চলছিল - আমি ফার্স্টক্লাস পাচ্ছি না। অনার্স ফার্স্ট ইয়ার থেকে থার্ড ইয়ার পর্যন্ত টানা তিনবার প্রথম হয়েছি। তখন আপার সেকেন্ড ক্লাস বলে একটা শ্রেণি ছিল। প্রথম শ্রেণির পরেই তার স্থান। তো, অনার্সে আমি আপার সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট। শুনছি, কোনো এক প্রভাবশালী স্যারের মেয়েকে বিয়ে করার আশ্বাসে মেধা তালিকায় আমার পেছনের একজনকে প্রথম শ্রেণি দেওয়া হচ্ছে। আর তাকে যেহেতু প্রথম শ্রেণি দেওয়া হচ্ছে, এ জন্য অন্য একজন শিক্ষক তাঁর গ্রুপসহ লবিং করছে তল্পিবাহক আরেকজনকেও যেন প্রথম শ্রেণি দেওয়া হয় সেই তদ্বিরে। পরে কানাকানির খানিকটা সত্যি হলো - সেই দুইজন প্রথম শ্রেণি পেল (না, দেওয়া হলো)। কিন্তু, পরীক্ষা কমিটির প্রভাবশালী শিক্ষকের মেয়েকে যে বিয়ে করার কথা! না, সে-টুকু আর সত্যে পরিণত হতে পারেনি। মাস্টারেরও যে ওস্তাদ থাকে সেদিন বুঝেছিলাম। ইদানীং শুনতে পাই, সেই প্রথম শ্রেণি দেওয়া ছাত্রদের একজন এখন তাঁর শিক্ষকদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছেন। একেই বলে পানিশমেন্ট অব ন্যাচার! যাই হোক, রেজাল্টের দিন অপমানে, লজ্জায়, দুঃখে, হতাশায় ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম কমিটির চেয়ারম্যানের রুমে। তিনি নিজেই নাকি শীট দেখে দেখে রেজাল্ট ও নম্বর বলে দিচ্ছেন। শহীদুল্লাহ কলাভবনের দোতলায় প্রায়-অন্ধকার একটা রুমে বসেন তিনি (ওই অন্ধকারে থেকে থেকে হয়তো কখনো আলোর পথে আসতে পারেননি!)। আমি ঢুকতেই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বিনয়ী কণ্ঠে বললেন - ‘কনগ্রেচুলেশান’। আমি বললাম - ‘কেন স্যার?’
- তুমি সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট হয়েছো। (সে বছর থেকেই আপার সেকেন্ড ক্লাস তুলে দেওয়া হয়েছে। দেশে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এই শ্রেণি ছিল না বলে - সমতা বিধানের চেষ্টায়।) 
- আমি তো ফার্স্টক্লাস পাওয়ার কথা। পেছন থেকে টেনে-টুনে পছন্দের ছেলেদের ফার্স্টক্লাস দেওয়া হয়, আর আমি যেন ফার্স্টক্লাস না পাই সে জন্য আপনারা বাড়ি বাড়ি ঘুরেছেন। ঠিক আছে, মনে রাখবেন - একদিনের জন্য হলেও আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবো। 
     তারপর বেশ কিছুদিন ঘুমুতে পারিনি আমি। শিক্ষকেরা কেন যে শিক্ষার্থীদের জীবনের ওপর, ভবিষ্যতের ওপর এমন আঘাত হানেন, ভেবে পাই না আজও। প্রিয় ক্যাম্পাস, মতিহার থেকে, প্যারিস রোড থেকে সেদিন বুকে ব্যথা নিয়ে ফিরে এসেছিলাম। ২০০৩ সালে, আমার পিএইচডি অ্যাওয়ার্ড হওয়ার পর, (সে ডিগ্রিও ওই শিক্ষকেরা আটকানোর চেষ্টা করেছিল। কেননা, আমি নাকি ভোকাল, ডিপার্টমেন্টে ঢুকে গেলে তাঁরা তাল সামলাতে পারবেন না। কারণ, আমি যে স্যারের ‘আন্ডারে’ গবেষণা করেছি, সেই স্যারের সাথে তাঁদের ব্যক্তিগত রেষারেষি!), বাংলা বিভাগের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখেছি - ওই সব শিক্ষকেরা পেছনের সারিতে বসে আছেন, কেউ কেউ হলরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন, আর দু-একজন ‘রাগ করে’ অনুষ্ঠানেই আসেননি। আর, প্রোগ্রাম উপলক্ষে যে প্রকাশনা তাঁরা বের করেছেন, তাতে অনেক ইতিহাস জায়গা পেয়েছে - মাস্টার্সে মেধাবী শিক্ষার্থীর তালিকা, এমফিল-পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের ছবিসহ নামধাম ছেপেছেন; কিন্তু অনার্সের কোনো রেজাল্ট ছাপেননি। কারণ, তাঁরা এমন ঘটনা অনেক ঘটিয়েছেন - অনার্সে ফার্স্ট হওয়া শিক্ষার্থীদের মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস দেননি। 
     প্রিয় ক্যাম্পাস নিয়ে অনেক ভালো ভালো, সুন্দর সুন্দর স্মৃতিও আছে। কিন্তু সে-সব কথা বলার অনেক লোক আছে - তারা বলুক। আমিও হয়তো বলবো অন্য কোনো দিন। কিন্তু আমার বুকে তো অনেক ব্যথা। এ ব্যথা কোথায় রাখি?

ফজলুল হক সৈকত 
ঢাকা, বাংলাদেশ।