অটোয়া, বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪
ইচ্ছে - জয়দীপ মুখোপাধ্যায়

মৃণালবাবু আর একবছর চাকরি বাকি। অফিসের পদোন্নতির দৌলতে উনি এখন অফিসার হয়েছেন। আশি বছরের মায়ের এখন একটাই শেষ ইচ্ছা ছেলে গাড়ি কিনুক। ছেলে গাড়ি চড়ে চাকরি করতে যাচ্ছে এটা যেন উনি সগ্গে যাওয়ার আগে যেন দেখে যেতে পারেন। শ্বাশুড়ির ইচ্ছাই মৃণালবাবুর বউয়ের ইচ্ছা। স্বামী গাড়িতে চড়ে যে কাজে যেতে পারে এটা উনি পাড়ার লোককে দেখিয়ে ছাড়বেন। একমাত্র ছেলে চাকরি নিয়ে ব্যাঙ্গালোর থাকে। সুতরাং বাড়িতে বিধবা মা আর পত্নীর ইচ্ছাটা মান্যতা দিতেই হয় নাহলে গৃহ যুদ্ধ লাগতে পারে।
কিন্তু লক ডাউনের বাজারে নতুন গাড়ি বা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি দুটোর কোনো একটা কেনাই মুশকিল। ওদিকে দেরি করলে রিটার্মেন্ট চলে আসবে। গাড়ি করে অফিসে নামাটার ইচ্ছাটা পূরণ করাই মুশকিল হয়ে পড়লো। এই সময়ে ড্রাইভার পাওয়াও যাবে না। নিজেও গাড়ি তো চালাতে পারেন না। ভারী সমস্যায় পড়া গেল।
পয়সা কড়ির অভাব নেই। ছেলে মানুষ হয়েছে, অফিস থেকে দু কিলোমিটার দূরেই চারতলার ওপর নিজের দুকামরার ফ্ল্যাট। সুখের সংসার। কিন্তু করোনার দাপটে গাড়ি কেনাটা বোধহয় আর হয়ে উঠলো না।

সেদিন সন্ধ্যেবেলায় অনেকখানি হেঁটে ভারী চেহারায় থপথপ করে ঘরে ঢুকেই সোফায় শরীরটা এলিয়ে মৃণালবাবু হাঁফাতে লাগলেন। সরকারি, বেসরকারি বাসে করোনা ভীতিতে চড়া বারণ। মা ও স্ত্রী পইপই করে বলে দিয়েছে, বয়েস হয়েছে, অফিসার হয়েছ সুতরাং হয় গাড়ি চড়বে অথবা হেঁটে যাতায়াত করবে। ভালোভাবে বুক চিতিয়ে হেঁটে যাওয়ার মধ্যেও একটা আলাদা আভিজাত্য আছে।সবে বিস্কুটটা চায়ে ডুবিয়ে আলতো করে মুখে পড়েছেন মা এসে ঘরে ঢুকলেন।
-"হাঁ রে মনু, তোর তো আর এক বছর চাকরি আছে। বৌমার কাছে শুনলাম এখন নাকি গাড়ি কেনার ভীষণ হ্যাপা। গাড়ি কেনার যখন এত সমস্যা তুই বরং একটা ঘোড়া কেন। ঘোড়ায় চড়ে অফিসে যাবি আসবি। ড্রাইভার লাগবে না। পেট্রোল ভরতে হবে না, ঘাস আর ছোলায় ওর পেট ভরবে। আমাদের জন্য যে গ্যারেজ স্পেস আছে ওখানে বেঁধে রাখবি।"

মৃণালবাবু চমকে উঠলেন। নড়েচড়ে বসে উনি বললেন- "তা মন্দ বলোনি মা। রোড ট্যাক্স লাগবে না, ইন্স্যুরেন্স নেই, মোটর ভেহিকেল এ ঘুষ দিয়ে নাম্বার প্লেট নেওয়া নেই। ট্রাফিক রুল মানতে হবে না। ট্রাফিক পুলিশকে ঘুষ দিতে হবে না। তারপর পরিবেশ দূষণ নেই। টগবগে ঘোড়ায় চড়লে এক্সারসাইজ হবে, ভুড়িও কমবে।"
অফিসে তো অনেকেই গাড়ি চড়ে কিন্তু তাদের থেকে সম্মানও বেশি পাওয়া যাবে। একটা অন্য অভিজ্ঞতা অর্জন করা হবে আর অভিজাত্যও বাড়বে। অফিসের কলিগরা ওনার দিকে হিংসের চোখে তাকাবেন আর উনি ফাইলের পাহাড়ের মাঝে মিটিমিটি হাসবেন।মৃণালবাবু মনস্থির করে ফেললেন যে শেষ একবছর উনি অফিসে ঘোড়ায় চড়েই যাবেন। এখন প্রথম কাজ দেখেশুনে একটা তাগড়াই ঘোড়া কেনা।

পাশের ফ্ল্যাটের রিটায়ার অসীম বাবুর সব বিষয়ে দারুন জ্ঞান। ওনাকেই ধরলেন। ঘোড়া কিনতে সম্ভাব্য কোন কোন জায়গায় যাওয়া যেতে পারে সে ব্যাপারে গবেষণা শুরু হলো। বিহারের শোনপুরের পশু মেলা খুব বিখ্যাত। সেখানে হাতি-ঘোড়া এমনকি মানুষও নাকি কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু সে তো শীতকালে। টাট্টু ঘোড়া দার্জিলিং এ পাওয়া যায়, লক ডাউনে সেখানে ঘোড়া কিনতে যাওয়া সম্ভব নয়। রেসের জকিরা যদি কিছু আলোকপাত করতে পারে ভেবে অসীম বাবু আর মৃনাল বাবু লোকের মুখে শুনে তিতুমীর নামের এক জকির কাছে হাজির হলেন। কিন্তু গিয়ে শুনলেন উনি নাকি রেসের জকি নন,  রেডিও জকি। তবে তিতুমীর বাবু ওনাদের নিরাশ করলেন না। খিদিরপুরে এক রেসের জকির সন্ধান দিলেন।

পরের দিন ট্যাক্সি ভাড়া করে ওনারা দুজনেই সেখানে হাজির। খোঁজ করে শেষে একটা ছোট বাড়িতে ওনাকে পাওয়া গেলো। বাড়িতে প্রচুর ট্রফি সাজানো। বিভিন্ন তেজি ঘোড়ার সাথে পোজ দিয়ে তোলা ছবিতে দেওয়াল ভর্তি। মুখে পাইপের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বৃদ্ধ রেসের জকি বললেন যে আজকাল তো কলকাতায় ঘোড়ার রেস হয় না। ব্যাঙ্গালোরে হয়। সব জকিরা, ঘোড়ার মালিকরা ব্যাঙ্গালোরে আস্থানা গেড়েছেন। মৃণালবাবু খুব নিরাশ হয়ে পড়লেন।

ফেরার পথে ওনারা বিকেলে রেসকোর্সের পাশের মাঠে গোটা দশেক ঘোড়াকে ঘাস খেতে দেখলেন। ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে  মৃণালবাবু কাছে গিয়ে ঘোড়াগুলোকে খুব ভালোভাবে নিরীক্ষণ করলেন। পাঁজরের হাড় বের করা বৃদ্ধ আর অসুস্থ ঘোড়ার দল একমনে ঘাস চিবচ্ছে। এমন ঘোড়া উনি খুঁজছেন না। হাজার হোক একটা মান সম্মানের ব্যাপার আছে তো। কুঁজো, বুড়ো, হেঁপো ঘোড়া নিয়ে পশুরক্ষা আন্দোলন করা যায়, প্রেস্টিজ রাখতে গেলে তেজি ঘোড়ায় সওয়ার হতে হবে।
অনেক ভাবনা চিন্তা করে রেসকোর্সের কাছে কলকাতা মাউন্টেন পুলিশের দফতরে ওনারা হাজির হলেন। অনেক সাধ্য সাধনার পর বড়সাহেবের সাথে পাঁচমিনিট দেখা করার সময় পাওয়া গেলো।পাঞ্জাবি ভদ্রলোক মিস্টার গোয়েল চশমার ওপর থেকে নির্ভেজাল ভালোমানুষ দুই বাঙালি ভদ্রলোকের আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন।
-"স্যার আমি একটা ঘোড়া কিনতে চাই। আপনাদের বাতিল হওয়া স্বাস্থ্যবতী রোগবিহীন কোনো ঘুড়ী কি পাওয়া যাবে?"  মৃনাল বাবু আমতা আমতা করে বললেন।
-"ঘুড়ী কেন?"জোয়ান তাগড়া ঘোড়া চলবে না?"  মিস্টার গোয়েল একটু মুচকি হাসি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন।
-"না মানে মায়ের জাত। একটু শান্ত শিষ্ট্য হয় আর কি। অফিসে চড়ে যাবো তো। ঘোড়ারা বড়ো চঞ্চল হয়। আমাকে ফেলে দিয়ে পারে।" মৃণালবাবুর চটজলদি জবাব।
-"কতো বাজেট আপনার?" পাক্কা ব্যবসায়ীর মতো প্রশ্ন করেন গোয়েল।
-"তাহলে বলছেন আপনারা বিক্রি করবেন। উফ নিশ্চিন্তি হলাম। তা আমার বাজেট এক লাখ টাকা। একটু বাড়লে আরো দশ হাজার বাড়াতে পারি।" 
-"ঘোড়া তো দশ লাখ থেকে শুরু হয়। এক লাখে তো মরা ঘোড়াও পাবেন না।" গোয়েল বললেন।

দুজনই মনখারাপ করে হেঁটেই ফিরছেন। মুখে মাস্ক পরে হাঁটতে হাঁটতে হাঁফ ধরে যাচ্ছে। ভিক্টোরিয়ার সামনে এক টাঙ্গা দেখে দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়লেন। কোনো খদ্দের নেই বলে ওর মালিক টাঙ্গায় বসে মাস্ক গলায় রেখে বিড়ি টানছে। দড়িবাঁধা ঘোড়াটা পাশে চরতে চরতে ঘাস, গাছের শুকনো পাতা,কাগজ খাচ্ছে।
-"ভাই ঘোড়া কোথায় কিনতে পাওয়া যাবে?"  মৃণালবাবু টাঙ্গাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করেন। 
বিকালবেলায় দুই ভেতোবাঙালী বাবু হটাৎ ঘোড়া কিনতে কেন বেরিয়েছে ও তা ঠিক বুঝতে পারলো না।
-"বাবুদের কি টাঙ্গার ব্যাবসা আছে?" ওই উল্টে প্রশ্ন করে।
-"না না অফিস যাবার জন্য আমার একটা ঘোড়া লাগবে।" মৃণালবাবু বলেন।
-"কেন আপনাকে আমি রোজ অফিসে টাঙ্গা করে পৌঁছে দেবো?"  টাঙ্গাওয়ালা একটু উৎসাহিত হয়ে বলে। এখন ব্যবসায় মন্দা চলছে।
-"না না আমার ঘোড়াই চাই। একটা ঘুড়ী কিনবো। আমি নিজে চড়ে অফিসে যাবো।"
টাঙ্গাওয়ালা ফিক করে হেসে ফেলে। টাঙ্গা থেকে নেমে আশেপাশে দেখে অসীম বাবুকে হাত ধরে একটু দূরে টেনে নিয়ে গিয়ে ওনার কানে কানে জিজ্ঞাসা করলো- "ওই বাঙালি বাবুর কি মাথা খারাপ?"
অসীম বাবু কিছু না বলে মৃণালবাবুকে টেনে নিয়ে হনহন করে হাঁটা লাগলেন। পিছন থেকে টাঙ্গাওয়ালা চিৎকার করে বললো,
-"রাজাবাজার চলে যান, ওখানে আব্দুল মিয়া ঘোড়া ওয়ালা-র সাথে দেখা করুন।"

পরদিন অসীম বাবুর কাজ থাকায় উনি যেতে পারলেন না। মৃণালবাবু বিকেলে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের উল্টোদিকের ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আব্দুল মিয়ার খোঁজ করতে লাগলেন। যাকেই জিজ্ঞাসা করেন সেই একজন আব্দুল এর সাথে দেখা করিয়ে দেয়। সেই আব্দুলরা ওনার সাথে দুটো কথা বলেই হাসতে শুরু করে। একটা জায়গায় এত আব্দুল কিকরে থাকতে পারে সেটা মৃণালবাবু বুঝে উঠতে পারছেন না। একটা ঘিঞ্জি গলির মুখে দেখলেন প্রায় গোটা চারেক বড় জুরিগাড়ী দাঁড়িয়ে  আছে। ময়ূরপঙ্খী জুরিগাড়িও সেখানে আছে। এগুলো বিয়েবাড়িতে বা কোনো ধার্মিক অনুষ্ঠানে ভাড়া দেওয়া হয়। একটা গাড়িতেও ঘোড়া লাগানো নেই। জুরিগাড়ীর ওপরে বসা বেশ বয়স্ক লোকটাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন- "এখানে আব্দুল মিয়াকে কোথায় পাবো বলতে পারেন?" 
-"কি দরকার?"
-"ঘোড়া কিনবো।"
লোকটা নড়েচড়ে বসলো। বললো- " আপনি কি আব্দুলমিয়া ঘোড়া ওয়ালার কথা বলছেন?"
-"হা হা ঠিক বলেছেন।"
-"ওই সামনে ওনার অফিসে চলে যান। একটু পরেই বন্ধ হয়ে যাবে।"
মৃণালবাবু আব্দুলমিয়াকে দেখে নমস্কার করলেন। একমুখ গোলাপি রং করা দাড়ি আর ঘাড় পর্য্যন্ত চুলের অধিকারী আব্দুলমিয়া তখন লুঙ্গি পরে সবে নামাজ সেরে মাটি থেকে উঠেছেন। উনিও নমস্কার জানালেন।
-"বলেন বাবু, আপনার জন্য কি করতে পারি?"
-"আমার একটা সুন্দর, শান্ত, স্বাস্থ্যবতী ঘুড়ী চাই।"
-"কেন আপনার ঘোড়ার বহু খুঁজছেন।"
-"আরে, না না। আমার কোনো ঘোড়া টোরা নেই। আমি অফিস যাবার জন্য একটা ঘুড়ী পুষবো"
-"আমার কাছে একটা এক বছরের একটা সুন্দর ঘুড়ী আছে -সেলিমা নাম। ও কিন্তু আপনার এই মোটা শরীর বইতে পারবে না। বাচ্ছা ঘুড়ী। আমার সন্ধানে থাকলে আপনাকে জানাবো। ফোন নাম্বার দিয়ে যান।"

মৃণালবাবু  ভীষণ নিরাশ হলেন। কিন্তু মাতৃআজ্ঞা পালন করতেই হবে। ফ্লিপকার্ট, আমাজন কোথাও ঘোড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ওয়েলেক্স, ইবে  সব জায়গায় সন্ধান করলেন। কোথাও আশার আলো নেই।সেদিন সন্ধ্যেবেলায় অসীমবাবুর ফাঁকা ফ্ল্যাটে গ্লাসে পানীয় নিয়ে অসীমবাবুর সাথে মৃণালবাবু মনের দুঃখ শেয়ার করেছেন তখনই প্রথম প্রস্তাবটা পেলেন। আচ্ছা সুন্দর বড় মতো একটা গাধা কিনলে কেমন হয়। কলকাতা শহরে প্রচুর গাধা ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। ব্যারাকপুর অঞ্চলে প্রচুর গাধা বিক্রিও হয়। পশু হিসেবে গাধার মতো সুশীল প্রাণী আর একটাও নেই। ভীষণ শান্তশিষ্ট,  প্রভুভক্ত,  পিঠে নিজের থেকেও বেশি ওজন বইতে সক্ষম,  অহংকারী নয়,  যেমনটি চালাবে বলবে তেমনটি করবে, লাথি মারলেও কিছু বলবে না,  খাবে কম কিন্তু খাটবে বেশি। এর থেকে আর ভালো কি হতে পারে? রঙিন পানীয়র রঙ্গে মোহিত হয়ে মৃণালবাবু কল্পনা করতে লাগলেন উনি এক তাগড়াই গাধার পিঠে চড়ে ধর্মতলা দিয়ে অফিসের পথে চলেছেন। ট্রাফিক পুলিশরা ওনাকে সেলাম ঠুকছে। অফিসে ঢুকে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় উনি গাধাটিকে বেঁধে সবে পিছন ফিরেছেন দেখেন সামনেই অফিসের জেনারেল ম্যানেজার হাসিমুখে একটা পুষ্পস্তবক নিয়ে দাঁড়িয়ে ওনাকে দেখে মিটিমিটি হাসছেন। মৃণালবাবুকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন উনি। কিছুতেই ছাড়তে চান না। ছলছল চোখে উনি বললেন- "আপনি আমাদের অফিসের গর্ব।" 
মৃণালবাবু হাত জোড় করে গদগদ হয়ে বললেন- "আমি আপনার আজ্ঞাবাহক দাস।।"
জেনারেল ম্যানেজার এগিয়ে গিয়ে গাধাটির গায়ে হাত বোলালেন এবং বললেন- "এদের জন্যই আমরা টিকে আছি। ঈশ্বরের এই অপূর্ব সৃষ্টিকে এখানে না বেঁধে অফিসের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিন। যদি এদের আরো কিছু গুণ কর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।"
মৃণালবাবু মত্ত অবস্থাতেও বললেন- "ইয়েস স্যার।"

জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। কলকাতা