অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
সাহিত্যে ‘বঙ্গবন্ধু-যুগ’ কেন অনিবার্য - ড. মিল্টন বিশ্বাস

    বাংলাদেশের সাহিত্যে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ‘বঙ্গবন্ধু-যুগ’ প্রচলনের প্রস্তাব উপস্থাপন করছি। আমরা সকলে জানি বাংলা সাহিত্যে ‘যুগবিভাগ’কে ইতিহাসবেত্তারা বিভিন্নভাবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু ১৯৪৭ পরবর্তী বাংলাদেশের সাহিত্যে সে অর্থে কোনো বিশেষ সাহিত্যিক কিংবা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সর্বব্যাপী প্রভাবকে মূল্যায়ন করে যুগ চিহ্নিত করা হয়নি। বরং এ ভূখণ্ডের শিল্প-সাহিত্য আলোচনা কিংবা সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় ‘১৯৭১ পূর্ববর্তী’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধোত্তর’—এ দুটি পর্ব ভাগ করা হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। `মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসকে অভিব্যক্ত করে। তবে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যিনি বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আটান্নর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা-আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের মহান গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁর নামে সাহিত্যে যুগবিভাগ প্রচলন হওয়া যৌক্তিক বলেই আমি মনে করি।
     ভাষা-সাহিত্যের রূপান্তর এবং যুগান্তর সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব কিংবা মহত্ প্রতিভার ওপর নির্ভর করলেও যে কোনো ভূখণ্ডের মানুষের চেতনায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক অভিঘাত সাহিত্যের গতি-প্রকৃতিকে পাল্টে দিতে পারে। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে চৈতন্যদেবের সর্বব্যাপী প্রভাব কিংবা আধুনিক যুগে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মের বিশদ ব্যাপ্তি ‘চৈতন্য যুগ’ (পনের শতক) এবং ‘রবীন্দ্র-যুগ’ চিহ্নিতকরণে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে ‘কল্লোল’ পত্রিকাকেন্দ্রিক সাহিত্যের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলা সাহিত্যের একটি নির্দিষ্ট সময়কে ‘কল্লোল যুগ’(১৯২৩-৩০) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কখনো বা কাব্য আবার কখনো বা গদ্যের স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত হয়েছে যুগ কিংবা পর্ব বিভাজনের মধ্য দিয়ে। অবশ্য রাজনৈতিক পরিবর্তন তথা শাসকগোষ্ঠীর প্রভাবে সাহিত্যের যুগান্তর ঘটতে দেখা গেছে বিশ্বজুড়ে। ভারতবর্ষে বিদেশি শাসক তথা তুর্কি-মোগল-ব্রিটিশরা এসে যেমন আমাদের সমাজ জীবনে পরিবর্তন এনেছে তেমনি সেই প্রভাবে বাংলা সাহিত্যের রূপান্তর ঘটেছে। ১৯৪৭ পরবর্তী বাংলাদেশে পাকিস্তানি শাসকদের অন্যায়-অত্যাচারের কারণে আমাদের স্বাধিকার চেতনার জাগরণ এবং সেই জাগরণে একদিকে যেমন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থান তেমনি দমন-পীড়নের কারণে সাহিত্যের ভাব-ভাষা পাল্টে যাওয়ার চিত্র অনিবার্য হয়ে ওঠে। অর্থাত্ পাকিস্তানি রাজশক্তির দুঃশাসনে অতিষ্ঠ জনতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সেসময় সংঘবদ্ধ হয়েছিল। ফলে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য চর্চায় ১৯৫২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটে। যার কেন্দ্রে ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলন এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ঘটনা। অর্থাত্ ‘বঙ্গবন্ধু যুগ’-এর প্রথম পর্ব এদেশের সাহিত্যিকদের রাজনৈতিক অস্থিরতায় আক্রান্ত হয়েই ভাব-ভাষা চর্চায় আত্মনিয়োগ করতে হয়। ষাটের দশকের সাহিত্যের কথা এক্ষেত্রে স্মরণ রাখতে হবে। অন্যদিকে দ্বিতীয় পর্ব অর্থাত্ ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কাল সংক্ষিপ্ত হলেও নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষায় সাহিত্যিকরা উজ্জীবিত হয়েছিলেন—এটাও সত্য।
     ইংরেজি সাহিত্যে ‘এলিজাবেথীয় যুগ’ এবং ‘ভিক্টোরীয় যুগ’-এর সঙ্গে ‘বঙ্গবন্ধু যুগ’-এর  তুলনা করলে আমরা দেখতে পাই ইংল্যান্ডের রানি প্রথম এলিজাবেথের (১৫৩৩-১৬০৩) মৃত্যুর ২০ বছর পরও সোনালি যুগের শাসক হিসেবে সমাদৃত ছিলেন। তাঁর শাসনকাল ‘এলিজাবেথান এরা’ বা এলিজাবেথীয় যুগ নামে পরিচিত। শেকসপিয়রের নাটকে ‘এলিজাবেথান এরা’ ঘুরেফিরে এসেছে। রানি ভিক্টোরিয়ার সময় ব্রিটেনে ১৮৩৭-১৮৮০ সাল ছিল স্বর্ণযুগ। ‘এলিজাবেথীয় যুগ’-এর মতোই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ওই সময়ে শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টিতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। সোনালি শস্যে ভরে উঠেছিল ইংরেজি সাহিত্য। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের সাহিত্যে ‘বঙ্গবন্ধু যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত সময়কাল একেবারেই ভিন্ন। তার পরিপ্রেক্ষিত, বাস্তবতা এবং স্বপ্ন অন্যদের থেকে আলাদা।

      ২.
     রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে আমরা উপলব্ধি করিতে চাই। এমন একটি লোক চাই যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হইবেন। তাঁহাকে অবলম্বন করিয়াই আমরা আমাদের বৃহত্ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করিব, সেবা করিব। তাঁহার সঙ্গে যোগ রাখিলেই সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ রক্ষিত হইবে।’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই ব্যক্তি যাঁর মধ্যে আমরা স্বদেশকে উপলব্ধি করি। তিনি ছিলেন সমস্ত সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতিভূ। তাঁকে অবলম্বন করেই আমরা স্বদেশকে হানাদার মুক্ত করেছিলাম এবং আমাদের স্বদেশীয় সমাজ ও জনতাকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছিলাম; গণতন্ত্রকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম। আর এখনো তাঁর মাধ্যমেই সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে যেমন যোগাযোগ রক্ষিত হয় তেমনি তাঁকে স্মরণ করেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে উঠি। 
     বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘বঙ্গবন্ধু’ একটি প্রভাব বিস্তারি শব্দ। আগেই লিখেছি, স্বাধীনতার আগে ভাষা-আন্দোলন এবং পরবর্তী সময় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশের এমন কোনো বিষয় নেই যার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল না। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান ছিলেন। অর্থাৎ সে সময় তাঁকে কেউ অবহেলা-উপেক্ষা কিংবা বাতিল করতে পারেনি। তিনি মানুষের প্রতিটি চৈতন্যে প্রভাব বিস্তার করেছেন এবং মানুষ তাঁর সম্পর্কে কিছু না কিছু বলে আত্মতৃপ্তি অর্জন করেছে। ভারতীয় সাহিত্যে মাহাত্মা গান্ধী যেমন মানুষের কাছে লেখার উত্স ও প্রেরণায় পরিণত হয়েছিলেন তেমনি বঙ্গবন্ধু অনেক লেখককে কেবল নয় দেশের শিল্প-সাহিত্যের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তুতে উন্মোচিত হয়েছেন। তাঁকে কেন্দ্র করে কবির চেতনা-মননে অব্যক্ত বেদনার নির্ঝর নিঃসরণ হয়েছে। আবার বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রকাশ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আমাদের দুঃখ স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও বাংলাদেশের সাহিত্যে ‘বঙ্গবন্ধু-যুগ’ নাম দিয়ে একটি সময় পর্ব এখনো পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। অথচ ভারতীয় সাহিত্যে ‘গান্ধী যুগ’ বলে একটি কালপর্ব নির্দিষ্ট হয়েছে। বিশেষত ১৯২০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় সাহিত্যের দু’ যুগের বেশি সময় গান্ধী যুগ হিসেবে চিহ্নিত। কেন এই চিহ্নিতকরণ? কারণ এই মহামানবের জীবন ও কর্মের ব্যাপক প্রভাব। ভারতের এমন কোনো ভাষা-সাহিত্য-শিল্পকর্ম নেই যেখানে গান্ধীজি নেই। সেই তুলনায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্যে অপ্রতুল হলেও এই স্বাধীনতার মহানায়কের জীবন ও কর্ম আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের চেতনায় নাড়া দিয়েছে। বিশেষত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পটভূমি বিপুল সংখ্যক কবি-সাহিত্যিককে আন্দোলিত করেছে। মহানায়কের কথা, কাজ, শখ, বাগ্মীতা, বক্তব্য, তাঁর শারীরিক অঙ্গভঙ্গি সবকিছুরই দ্বারা আলোড়িত হয়েছেন সৃজনশীল ব্যক্তিরা। বাগ্মীতায় জনগণকে মুগ্ধ করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। সেজন্য সামাজিক মানুষের হূদয়ে প্রবেশে তাঁর কষ্ট করতে হয়নি। জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সহজ-সরল মাধ্যম ব্যবহার করেছেন বঙ্গবন্ধু; তাতে মানুষের কাছে সহজে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। একই কারণে গান্ধীজি পরিহিত একখণ্ড সাধারণ পোশাকই মহিমান্বিত হয়ে উঠেছিল সারা ভারতবর্ষে। গৌতম বুদ্ধ আর রামকৃষ্ণ পরমহংস—মহান ব্যক্তিদের উত্তরাধিকারই ছিলেন তিনি। মানুষ ও তার সমাজকে নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে পাল্টানোর ক্ষমতা এঁদের ছিল। যদিও গান্ধীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন মিথ ও কিংবদন্তি আর তিনি তাই পাল্টে ফেলেছিলেন তাঁর নীতি-আদর্শ প্রচারের পন্থা। সাংবাদিকতাকে আশ্রয় করেছিলেন তিনি। ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’, ‘নবজীবন’, ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’ এবং ‘হরিজন’ পত্রিকা ছিল তাঁর মুখপত্র। আর তিনি বিরামহীন ভাবে পদযাত্রা করেছিলেন ভারতবর্ষের বিস্তৃত জায়গায়। এভাবে মানুষকে তিনি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন। গান্ধীর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে প্রভাব জনগণের মধ্যে বিকশিত হয়েছিল, চেতনাকে করেছিল পরিশুদ্ধ, ধারণা দিয়েছিল পাল্টে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন সাহিত্য-চলচ্চিত্র-কবিতার মুখ্য উপাদান। ১৯৮২ সালে নির্মিত Richard Attenborough-এর ‘গান্ধী’ চলচ্চিত্রটি পৃথিবীব্যাপী মানুষকে আন্দোলিত করেছিল। ইংরেজিতে লেখা মুলক রাজ আনন্দ্, রাজা রাও, আর কে নারায়ণের উপন্যাস পড়ে এ ছবির নির্মাতা গল্পের উপকরণ সাজিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এধরনের ছবি বাংলাদেশে এখনো তৈরি হয়নি। তবে গান্ধী যেমন ভারতের ভাষা-সাহিত্যকে নতুন উদ্দীপনায় মুখরিত করেছিলেন তেমনি বাংলা সাহিত্যকে বঙ্গবন্ধু তাঁর চিন্তা ও জীবনযাপন দিয়ে সচকিত করে তুলেছিলেন। তাঁকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঘটনা গল্পের প্রয়োজনে পুনর্বিন্যস্ত হয়েছে। অধিকাংশ গল্প-উপন্যাস ঘটনাকেন্দ্রিক হলেও বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত পরিস্থিতি, তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ, মানুষের জন্য ত্যাগের মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে। গ্রাম বাংলার সহজ-সরল মানুষের কাছে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে তাঁর মৃত্যু ছিল হাহাকারের; সেই অবস্থা তুলে ধরেছেন সাহিত্যিকরা। যদিও কোনো উপন্যাসে ‘মুজিববাদ’-এর অনুপুঙ্খ রূপায়ণ নেই তবু একটি ‘বাঙালি আদর্শ’ তাঁর জীবনকে কেন্দ্র করে তুলে ধরেছেন লেখকরা। নাগরিক মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে লোকায়ত মানসে মুজিব চিরন্তন হয়ে ওঠার কাহিনিও তৈরি হয়েছে। এই মহানায়ক জীবনকে গড়ে নিয়েছিলেন বাঙালি ঐতিহ্যের পরিপূরক করে। আর শ্রমজীবী মানুষের প্রাণের নেতা হওয়ার জন্য তাঁকে হাসিমুখে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হয়েছিল। এই সাধারণ জনতার কাছে তাঁর পৌঁছে যাওয়া এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তাঁর চেতনা ছড়িয়ে পড়েছিল যাত্রায়, পালায়, কীর্তনে। গান্ধীজি ভারতবর্ষকে ‘সীতা মা’-তে পরিণত করেছিলেন আর ব্রিটিশ শাসককে করেছিলেন রাবণের প্রতীক। রামায়ণের ধারণা ঢুকিয়ে স্বাধীনতার চেতনাকে করেছিলেন প্রসারিত কেবল ধর্মভাবকে কাজে লাগিয়ে। বঙ্গবন্ধু সাধারণ জনতার কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন মানুষের অধিকারের কথা বলে। এজন্যই জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে তাঁর জীবন, আদর্শ, মতবাদকে কেন্দ্র করে অজস্র কবিতা লেখা হয়েছে। চিত্রকলা ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর অভিব্যক্তিকে কেন্দ্র করে।
     পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরে কবি-লেখকরা সামনে কোনো বিকল্প দেখতে পাননি। এ কারণে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছেন সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে। এঁদের মধ্যে অনেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রও ধরেছেন কোনো কোনো লেখক। আর সেসময় থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করেছেন সংগোপনে। তারই পরিণতিতে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করেই সাহিত্যে নতুন চিন্তার অঙ্কুরোদ্গম হয়েছে। ধনী থেকে গরিব, জ্ঞানী থেকে নিরক্ষর তাঁকে কেন্দ্র করে রচিত ও পরিবেশিত গানের মুগ্ধ শ্রোতা এখনো। যে জনতা নয় মাসের যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছে, সেই দেশবাসীর প্রতি তাঁর অকৃত্রিম দরদ টের পেয়েছিলেন সকলে। অসহায়, দুঃখী, দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে তাঁকে সাধারণ মানুষের মতোই জীবন-যাপন করতে হয়েছিল।
     মূলত বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, তাঁর অতি সাধারণ জীবন-যাপন তাঁকে লেখকদের কাছে ভক্তি ও শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত করে। তিনি যদিও আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন, কিন্তু বৃহত্তর অর্থে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল সর্বস্তরের মানুষের মাঝে। তাঁর সম্পর্কে কিংবদন্তির প্রয়োজন ছিল না যদিও তাঁকে কেন্দ্র করে স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে নানান রহস্যময় ঘটনার প্রসঙ্গ। রাজা রাও, মুলক রাজ আনন্দ্ এবং আর কে নারায়ণের গল্প-উপন্যাসে গান্ধীকে যেমন কাহিনি বর্ণনায় নানা ঘটনা ও চরিত্রের বিচিত্র প্রকাশে তুলে ধরা হয়েছে; তেমনি বাংলা গল্প-উপন্যাস-কবিতায় উপস্থাপিত হয়েছে—বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনা, শতাব্দী লালিত মূঢ়তা থেকে মুক্তির মন্ত্র। তাঁর আন্দোলন ছিল হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। সাধারণ মানুষকে অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে রক্ষার জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করা ও ভালোবাসায় সকলকে কাছে টানা ছিল বঙ্গবন্ধুর অন্যতম বিশিষ্টতা। অপরাধ ও অপরাধীকে প্রশ্রয় না দেওয়া, সত্ ও নীতিপরায়ণ থাকা এবং ভণ্ডামি না করা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি না দেওয়া, জনগণের সঙ্গে প্রতারণা না করা তাঁর সমগ্র জীবনের মুখ্য আদর্শ।

    ৩.
     লেখাবাহুল্য, বর্তমান বাংলা সাহিত্যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছড়িয়ে গেছে গভীর থেকে গভীরে। এজন্যই বাংলাদেশের সাহিত্যে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ‘বঙ্গবন্ধু-যুগ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার এখনই সময়। যদিও তাঁর চেতনার প্রভাব শতাব্দী থেকে শতাব্দী প্রসারিত হয়েছে এবং আগামীতে তা বহাল থাকবে তবু মাতৃভূমির জন্য তাঁর অবদানকে স্মরণ করে সাহিত্যের ‘দশক ওয়ারি যুগ বিভাজন ও হিসেবে’র পরিবর্তে বাংলাদেশে তাঁর আদর্শের জয়গান উচ্চারিত হবে ‘বঙ্গবন্ধু-যুগ’ চিহ্নিতকরণের মধ্য দিয়ে। 

ড. মিল্টন বিশ্বাস। বাংলাদেশ

(লেখক: ড. মিল্টন বিশ্বাস,  বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)