অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
কাঁটাতারে প্রজাপতি - আওরঙ্গজেব জুয়েল

     সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম রসুলপুর। গ্রামটি বেশ বড় না হলেও এখানকার মানুষের বসবাসের ঘনত্ব কম নয়। প্রতি বর্গকিলোমিটারে এখানে প্রায় দুই হাজার লোকের বাস। নাগরিক সুবিধা নেই; নেই জীবনের বিকাশের তেমন সুযোগ। স্কুল, কলেজ, রাস্তাঘাট সবকিছুই যেন এখানকার জন্য অপ্রয়োজনীয় বিষয়! অবশ্য বলেই বা লাভ কী! সুযোগ থাকলেই যে এখানকার মানুষের মধ্যে পড়াশুনা বা কর্ষিত মানুষ গড়ার প্রবণতা বাড়বে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
     তবে রসুলপুরে এত মানুষের বাস কেন? সহজ প্রশ্ন, তাই জবাবও হয়তো সহজ। সবাই আমরা মনে করি, বর্ডার মানেই স্মাগলিং আর রাতারাতি টাকার কুমির তৈরি হওয়ার একটা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত এলাকা। কিন্তু রসুলপুর সম্পর্কে কথাটি মোটেও সঠিক নয়। এখানকার মানুষ দীর্ঘ দিন ধরে পাশাপাশি বসবাস করার ফলে যে একটা অভ্যাসের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটাই হয়তো এই যূথবদ্ধ এবং ঠাসাঠাসি বসবাসের অন্যতম কারণ।
     গ্রামের মানুষ বেশিরভাগই অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত। কেউ কেউ আট-দশ কিলোমিটার দূরে গিয়ে পড়াশুনা করে। তবে সংখ্যায় তা হাতে গণার মতোই। রসুলপুর গ্রামের হাতে গণা ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার ব্যাপারে কেন এত আগ্রহ তা অনেকের কাছেই অজানা। যারা পড়াশুনা করে তারাই হয়তো এর উত্তর দিতে পারবে! 
     মোহিত, নাজমুল, রেশমারা প্রতিদিন বহু কষ্ট করে কলেজে যায়। রসুলপুর বা আশেপাশের গ্রামের লোকদের যাতায়াতের জন্য কোন বাস, অটো, বা ভ্যানের ব্যবস্থা নেই। তাদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হলো বাই-সাইকেল। এখানকার ছেলে-মেয়ে সবাই সাইকেল চালাতে পারে। তবে রাস্তায় যখন তারা সাইকেল নিয়ে বের হয় তখন দেখা যায় সাইকেলের চাকা প্রায় পুরোটা ধুলোয় ঢেকে গেছে। রাস্তার সংস্কার করা হয়নি অনেক বছর ধরেই। 
     রসুলপুরে দোকান বলতে কয়েকটি মুদি দোকান, একটি হার্ডওয়ার ও একটি ফার্মেসি রয়েছে। এখানকার মানুষ এইসব দোকান থেকেই তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ও কাঁচামালের প্রয়োজন মেটায়।
     রসুলপুর গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে আত্রাই নদী। নদীটি তেমন প্রসারিত নয়। বর্ষার মৌসুম ছাড়া এখানে তেমন পানি থাকে না। যতটুকু পানি থাকে তাতে স্রোতধারা থাকে না। নদীর স্রোত অনেকটা গৃহস্থ নারীর মতো বয়ে চলে। কেমন যেন একটি ধীরস্থির আর সাজানো-গোছানো মমতাময়ী মায়ের মতো বয়ে চলে সে। নদীর একপাশে বাংলাদেশ আর অন্যপাশে ভারত। এপাশ থেকে ওপাশের সবকিছুই স্পষ্ট দেখা যায়। ওপারের মানুষের জীবনের মধ্যেও তেমন বিস্তর পার্থক্য নেই। তবে বাংলাদেশের এই অংশের আশে-পাশে তেমন স্কুল-কলেজ না থাকলেও ভারতের অংশে একটি স্কুল ও কলেজ দেখা যায়। সেখানেও স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম বাই সাইকেল। ভারত অংশে সামান্য কাঁটাতারের বেড়া আছে বটে কিন্তু কোনো বিএসএফ-এর উপস্থিতি সেখানে নেই। আর বাংলাদেশ অংশে কাঁটাতারের বেড়ার কোনো বালাই নেই।
     ভারতের ওপারে যে গ্রাম রয়েছে সেই গ্রামের নাম অলকাপুর। অলকাপুর এবং রসুলপুর এই দুই গ্রামের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক কিন্তু মন্দ না। কাঁটাতারের বেড়ায় সামান্য ফুটো করে এপার থেকে যেমন ওপারে লোকজন চলাচল করে তেমনি ওপারের লোকজনেরও চলাচল রয়েছে এপারে। দুই গ্রামের মানুষের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কও আমরা দেখতে পাই। তবে সেটা সংখ্যায় খুবই কম।
     রসুলপুর গ্রামের মোহিত অনেকটা ভাবুক এবং আত্মভোলা ছেলে। শোনা যায় মাঝে মাঝে সে কবিতা চর্চা করে এবং দেশের বিভিন্ন ম্যাগাজিনে তার লেখা ছাপাও হয়। কলেজ টাইম ছাড়া বেশিরভাগ সময়ে তাকে দেখা যায় আত্রাইয়ের ধারে বসে থাকতে। বসে থাকে আর চিন্তায় মগ্ন হয়ে কী যেন ভাবে! হয়তো মাথার ভিতর শব্দের ভীড় সামাল দিতে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর তার দৃষ্টি যেন কাছাকাছি থাকে না। বরং সেটা আত্রাই ছাড়িয়ে যেন অলকাপুর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
ঘটনাটি আসলে অনেকেরই অজানা। তার কাছের বন্ধু নাজমুল ছাড়া মোহিতের মনের খবর কেউ জানে না। 
     সেদিন ছিল শুক্রবার। অলকাপুরের রাস্তা দিয়ে একটি মেয়ে সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার সময় একটি দুর্ঘটনায় রাস্তার নিচে পড়ে যায় এবং সেটা দেখে ফেলে মোহিত। গ্রীষ্মের সময় বলে নদীতে হাঁটু পরিমাণ পানি ছিল। মোহিত ছুটতে ছুটতে নদীর ওইপারে কাঁটাতারের বেড়া গলিয়ে প্রবেশ করে ভারতের অংশে এবং দেখতে পায় একটি মেয়ে রাস্তার নিচে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। সাইকেল থেকে পড়ে অজ্ঞান হওয়ার কথা নয়, হয়তো ভয়ের কারণেই সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।
     মোহিত প্রথমে বুঝতে পারে না সে কী করবে, পরে সে ঠিক করে মেয়েটির জ্ঞান ফেরানো দরকার। আত্রাই নদী থেকে পানি নিয়ে এসে মেয়েটির মুখে ছিটিয়ে দিতেই সে জেগে ওঠে এবং সামনে একটি ছেলের উপস্থিতি তাকে বিস্মিত করে। পরে সে বুঝতে পারে আসল ঘটনা। অলকাপুরের সেই রাস্তাটি তেমন ব্যস্ত রাস্তা নয়। আশে পাশে বসতিও নেই। তাই এই অচেনা ছেলের বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে এবং ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকে মোহিতের দিকে।
মোহিতই প্রথম কথা বলে মেয়েটির ভয় ভাঙ্গানোর চেষ্টা করে। মোহিত বলে, 
-আসলে আমার বাড়ি আত্রাই নদীর ওপাশে অর্থাৎ বাংলাদেশ অংশে। আমি নদীর ওইপার থেকে দেখতে পেলাম কে যেন সাইকেল থেকে পড়ে গেল এবং সে আর উঠছে না; তখন আমি কাঁটাতারের বেড়া গলিয়ে আপনাকে রাস্তার নিচ থেকে তুলে চোখে মুখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনি। দয়া করে ভুল বুঝবেন না।
আস্তে আস্তে মেয়েটি স্বাভাবিক হয়ে আসে এবং মনের ভয় কাটিয়ে বলে, 
-আপনি না এলে যে আমার কী হতো? অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
মোহিত জিজ্ঞেস করে,
-আপনার নাম কী?
মেয়েটি কিছুটা লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে বলে,
-চন্দনা। আমার বাড়ি খুব দূরে না। তিন কিলোমিটার দূরেই আমার বাড়ি। এখানে এসেছিলাম বাংলা স্যারের কাছে পড়তে। 
মোহিত প্রশ্ন করে, 
-কীসে পড়েন আপনি?
-ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে। 
মেয়েটি মোহিতকে জিজ্ঞেস করে,
-আপনার নাম?
-মোহিত।
কীসে পড়েন?
-ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে।
     তারপর মেয়েটি ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেয়। মোহিত চন্দনার চলে যাওয়া পথের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে। তার কাছে মনে হয় যেন আপনার কেউ হৃদয় ছিঁড়ে চলে যাচ্ছে তার কাছ থেকে। 
    মোহিত ফিরে আসে রসুলপুরে। দিন কাটে তো রাত কাটে না, রাত কাটে তো দিন কাটে না, এরকম একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হতে থাকে মোহিতের দিন। 
     দুর্ঘটনার দিন যে সময়ে মোহিতের সঙ্গে চন্দনার দেখা হয়েছিল ঠিক সে সময়ে মোহিত প্রতিদিন আত্রাই নদীর ধারে বসে থাকে। আবার চন্দনার সঙ্গে দেখা করার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
     ওদিকে বাড়িতে চন্দনা পৌঁছে, কিন্তু তারও কোনো কাজে মন আর বসে না। সেও ভিতর-বাহিরের ভাবনায় যেন লেপ্টে থাকে মোহিতের সঙ্গে। সে-ও ব্যাকুল হয়ে থাকে মোহিতের সঙ্গে দেখা করার আশায় আর গুনগুন করতে থাকে, 
‘আমার ভিতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে 
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।
ঢেকে রাখে যেমন কুসুম, পাপড়ির আবডালে ফসলের ঘুম।
তেমনি তোমার নিবিঢ় চলা, মরমের মূল পথ ধরে।’
     কয়েকদিন পর কাঁটাতারের বেড়ার পাশে দেখা যায় চন্দনাকে। সে যেন কার উদ্দেশে হাত নাড়তে থাকে। মোহিতের বুঝতে বাকি থাকে না কার উদ্দেশে এই হাত নাড়া। সে-ও এর জবাবে হাত নাড়ে এবং নদী পার হয়ে ওপারে গিয়ে পৌঁছে। তারপর যখন তারা এক হয় তখন কেউই কথা বলতে পারে না। মনে হয় যেন দুজনকেই বুবাতে ধরেছে। এই পরিস্থিতি বেশ কয়েক মিনিট ধরে চলতে থাকে। তারপর একসময় মোহিত সাহস করে বলে,
-তোমার অপেক্ষায় ছিলাম, এই কয়টি দিন। তোমাকে ছাড়া আমার দিনগুলি কেমন করে যে কেটেছে তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না।
     মোহিত আবেগের বশে কখন যে ‘তুমি’ শব্দটি ব্যবহার করেছে তা সে বুঝতেই পারেনি। একসময় যখন বুঝতে পারে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। অন্যদিকে চন্দনাও বলে,
-ঠিক একই অবস্থা আমারও হয়েছিল। কয়েকটি দিন কেমন এক ঘোরের মধ্যে কেটেছে। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে আমার দিন-রাতের হিসেব যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে।
তারপর চন্দনা বলে, 
-আজ আমার হাতে বেশি সময় নেই। স্যারের কাছে যেতে হবে। আগামীকাল বিকেল ঠিক চারটায় এসো আবার দেখা হবে।
      দুজন দুজনের কাছে থেকে বিষণ্ন মনে বিদায় নেয়। আর অপেক্ষা করতে থাকে পরের দিন চারটার জন্য। 
     মোহিত মনে মনে অনেক কথা গুছিয়ে নেয়। কাল তাকে কী বলবে এবং কীভাবে বলবে। মনে মনে কিছুটা দ্বিধা থাকলেও এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুকূলে না থাকলেও আবেগের তোড়ে বন্যার পানির মতো সব দ্বিধা ভেসে যায়। বয়সটা আবেগের যতটা, যুক্তি দিয়ে সবকিছু বিচার করার ততটা নয়। তাই ভৌগোলিক এবং ধর্মীয় বিষয় তার মনে বিন্দুমাত্র দাগ কাটতে পারে না। যেন যা হয় হবে, এমন একটি ভাব। অবশ্য ভালোবাসায় যুক্তির চেয়ে আবেগের মূল্য অনেক বেশি। এজন্যই হয়তো জ্ঞানীদের কপালে কখনো প্রেম ভালোবাসার তিলকের দেখা মেলে না।
     পরের দিন ঠিক চারটায় আবার তাদের দেখা হয়। নীরবে নিভৃতে দুটি প্রাণের মধ্যে যে আবেগের উতাল-পাতাল ঢেউ বয়ে চলছিল তা তাদের নিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেলেও তা কেউ প্রকাশ করতে পারছিল না। ফলে সাজানো সব কথা যেন অগোছালো হয়ে যায়।
     মোহিতের কথায় অগোছালো একটি ভাব থাকলেও চন্দনা অনেকটাই সেই অবস্থা থেকে মুক্ত। সে সহজ সরলভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে নির্বিকারভাবে বলে দেয় তার মনের কথা। চন্দনা বলে,
-দেখ মোহিত, তোমাকে প্রথম দিন দেখার পর থেকেই কেমন একটা শিহরণ আমার মনের মধ্যে কাজ করে যাচ্ছে। জানিনা এর নাম ভালোবাসা কিনা! যদি তাই হয়, তবে আমি বলব, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
     মোহিত কিছুটা বিস্মিত হলেও বুঝতে পারে চন্দনা তার চেয়ে সাহসী। যে কথাটি তার বলার কথা ছিল সেটা চন্দনার মুখ থেকে বের হওয়ার কারণে সে কিছুটা স্বস্তিবোধ করে। তারপর সেও বলে,
-আমিও তোমাকে ভালোবাসি। তবে তোমার মতো করে এত সহজে বলার সাহস আমার নেই।
চন্দনা বলে,
-সাহস না থাকলে প্রেম করবে কী করে? জানোই তো, সাহসী না হলে প্রেমের ক্ষেত্রে সফলতা আসে না। কাজেই তোমাকে সাহসী হতে হবে। এবং প্রচলিত সামাজিক বাধা ডিঙানোর প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে।
     মোহিত চন্দনার কথার ইঙ্গিত বুঝতে পারে। এটাও বোঝে যে, সে ধর্ম এবং অন্যদেশের নাগরিকের যেসব সমস্যা সেদিকে ইঙ্গিত করছে। মোহিতও বিষয়টি নিয়ে যে একেবারে ভাবেনি তা নয়। তাই সেও বলে,
-ধর্ম এবং দেশ যতই আলাদা হোক তোমাকে আমার কাছ থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না। একমাত্র মৃত্যুই পারে তোমার কাছ থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করতে।
চন্দনা রসিকতা করে বলে,
-থাক থাক আর বাহাদুরি দেখাতে হবে না। সময় হলেই সেটা দেখা যাবে। আর একটা কথা মনে রেখ, তুমি যা বলেছ, সেটা আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমিও তোমাকে ছাড়া জীবন কল্পনা করতে পারি না। যা কিছুই হোক না কেন, আমরা এক সাথেই থাকবো। 
     তারপর তারা দুজনের কাছ থেকে বিদায় নেয়। বিদায়ের মুহূর্ত তাদের কাছে যে কতটা বেদনার তা তাদের মুখের দিকে চাইলেই বোঝা যায়। কী এক গভীর বিষণ্নতা যে তাদের ঘিরে ধরে তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। ঠিক হয় পরের সপ্তাহে তাদের একই সময় একই জায়গায় দেখা হবে।
     মোহিত এবং চন্দনার সম্পর্কের কথা তারা গোপন রাখলেও প্রকৃতি যেন তা গোপন রাখে না। বাতাসে-বাতাসে, কানে-কানে ফিসফিস করতে করতে যেন তা সবার কাছেই গিয়ে পৌঁছে। যদিও তারা অত্যন্ত গোপনে দেখা করতো তারপরও সেটা আর গোপন থাকে না। বরং তরু মর্মরের শব্দের মতো যেন সবার কানেই পৌঁছে যায়।
     মোহিতের বাবা মতিউর ব্যাপারি কথাটি প্রথমে শুনার পর থেকেই কেমন যেন আনমনা হয়ে যান। তিনি একজন ব্যবসায়ী মানুষ হলেও অর্থের প্রতি তার মোহ ততটা না থাকলেও সম্মানের প্রতি সে সজাগ। একদিন মোহিতকে ডেকে তিনি বলেন,
-হুনলাম, ঐ পারের এক মাইয়ার লগে নাকি তোর সম্বন্ধ। কথাডা কি ঠিক?
     কথাটি শুনার পর মোহিত কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। কিন্তু বাবার সামনে সে কখনো মিথ্যা বলেনি। তাই সে সাহস সঞ্চয় করে বলে,
-হ বাবা, তুমি যা শুনছ তা ঠিক।
মতিউর ব্যাপারি বলে,
-তুই তো জানোস, তারা ভারতের নাগরিক। তাছাড়া তার বাবা তো হিন্দু। তারা কি তোদের বিষয়টা মা্ইনা নিবো? আমি না হয় মাইনা্ নিলাম, কিন্তু তার বাবা যদি মাইনা না নেয়, তখন কি হইবো? ভালো করে চিন্তা ভাবনা কইরা দেখ। তোর জীবন একান্তই তোর। কার সঙ্গে তুই ভালো থাকবি সেটা একান্তই তোর ব্যাপার।
     মোহিত কী বলবে ভেবে পায় না। যে পথে সে এগিয়ে গিয়েছে ফেরার কোনো পথের দিশা সে খুঁজে পায় না। এবং যে শপথ তারা দুজনে করেছে সেটাও মোহিত ভুলতে পারে না। শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার সিদ্ধান্তে সে অটল থাকে।
     পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা হৃদয়ের ধার ধারে না। তাদের কাছে ধর্ম, দেশ সবচেয়ে বড় ব্যাপার হয়ে ওঠে। তাই চন্দনার বাবা অখিল ঘোষ যখন তাঁর মেয়ের সম্পর্কের বিষয়টি টের পান তখন চন্দনাকে কড়া ভাষায় জানিয়ে দেন তাঁর সিদ্ধান্তের কথা। মেয়েকে শাসিয়ে বলেন,
-দরকার হলে তোকে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেব, কিন্তু কখনোই ওই মুসলমানের পোলার সঙ্গে তোর কোনো সম্পর্ক থাক তা আমি মেনে নিব না। এরপরও যদি বাড়াবাড়ি করিস তাহলে তোর পড়াশুনা বন্ধ করে দেব।
     বাবার কড়া শাসনে চন্দনা মনে ব্যাপক কষ্ট পেলেও তার সিদ্ধান্তে সে থাকে অটল। কিন্তু সে মুখ ফুটে তার হৃদয়ে তোলপাড় করা কথাটি বাবাকে বলে না। অখিল ঘোষ ভাবে এরপর তার মেয়ে হয়তো আর সাহস পাবে না ওই ছোট লোকের পোলার সঙ্গে মিশতে।
     কয়েকদিন পর চন্দনা আবার পড়তে যাওয়ার পথে দেখা করে মোহিতের সঙ্গে। চন্দনাকে দেখে মোহিত বুঝতে পারে চন্দনার হৃদয়ে কোন এক অজানা ঢেউ এর তোলপাড় শুরু হয়েছে। মুখ কেমন জানি ফ্যাকাসে আর রক্তশূন্য। যে মেয়েটির চোখে-মুখে কথা ফুটতো আজ সেই চন্দনা কোথায়? সেও বুঝতে পারে একটা কিছু হয়েছে নিশ্চয়। মোহিত জিজ্ঞেস করে,
-কী হয়েছে তোমার?
চন্দনা বলে,
-কই, কিছু হয়নি তো। এমনিতেই মনটা একটু খারাপ।
     মোহিতের অনেক চাপাচাপির কারণে চন্দনা শেষ পর্যন্ত তার বাবার উচ্চারিত কথাগুলো বলে এবং নিজের ভালোবাসার জন্য সে সবকিছু করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে। মোহিতও তার বাবার কথা খুলে বলে। চন্দনাকে আশ্বস্ত করে মোহিত বলে,
-চিন্তা করো না। তোমার বাবা মেনে না নিলেও আমার বাবার অমত নেই। তাই তুমি চাইলে যে কোনো সময় চলে আসতে পার আমার বাড়িতে।
     চন্দনার মনটা হঠাৎ করেই ভালো হয়ে যায়। সে ভাবতে থাকে, একটা পথ রুদ্ধ হলেও আরেকটি পথ রয়েছে প্রশস্ত। কাজেই এ নিয়ে আর সে কোনো চিন্তা করবে না। 
     কিন্তু চন্দনার এই সুখস্বপ্ন হঠাৎ বিঘ্নিত হয় তার ভাইসহ আরও কয়েকজনের আগমনে। তারা এসেই মোহিতকে জোর করে ধরে নিয়ে যায় তাদের বাড়িতে। চন্দনার চিৎকার নদীর ওপারে পৌঁছায় না। আত্রাই এর পানিতেই তা যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে তারই কাছে। মানুষ যেখানে মানুষের হৃদয় বোঝেনা সেখানে নদীর এমন কি-ই বা করার থাকে! তাই মোহিতের বাড়ির কেউ বিষয়টি জানতে পারে না। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মোহিতকে কঠোর ভাবে হুঁশিয়ার করে দেয় চন্দনার বাবা। কিন্তু মোহিত বলে,
-যতক্ষণ জীবন আছে, ততক্ষণ চন্দনা আমার। আমি তাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।
চন্দনার বাবা গর্জে ওঠে। এবং বলে,
-যতবড় মুখ নয় ততবড় কথা!
     তারপর মোহিতের ওপর নেমে আসে এক অকথ্য নির্যাতন। সেই নির্যাতন ততক্ষণ পর্যন্ত চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত সে অজ্ঞান না হয়ে পড়ে। তারপর অজ্ঞান অবস্থায় তাকে চন্দনার ভাই আরও মার-ধোর করে। আস্তে আস্তে মোহিতের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। যখন তারা নিশ্চিত হয়ে যায়, মোহিত আর বেঁচে নেই তথন তাকে রাতের অন্ধকারে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রেখে আসে।
     রাত শেষে চন্দনাকে কোথাও আর খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেক খোঁজার পর সকালবেলা দেখা যায় কাঁটাতারে দুটি লাশ ঝুলছে। চন্দনার পরিবারের আর বুঝতে বাকি থাকে না, দ্বিতীয় লাশটি সম্পর্কে। লাশদুটি মৃত্যুর পরেও যেন তাদের শপথ ভুলেনি। তাই তারা একসাথে ঝুলে থাকে কাঁটাতারে যেমন করে ঝুলে থাকে প্রজাপতি।

 আওরঙ্গজেব জুয়েল
শরীয়তপুর, বাংলাদেশ