অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
শেখ ফজলুল হক মণি ও বর্তমান যুবলীগ - ড. মিল্টন বিশ্বাস

ডিসেম্বর শেখ ফজলুল হক মণি’র (১৯৩৯-১৯৭৫) জন্মদিন। ২০২০ সালে এই শহীদ রাজনীতিবিদকে বেশি করে স্মরণ করার বিশেষ তাৎপর্য আছে। কারণ এবছর যুবলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষিত হয়েছে। বিশেষত যুবলীগের নতুন চেয়ারম্যান ও সেক্রেটারির নেতৃত্বে নতুন কমিটি দেশসেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন। শেখ মণি ছিলেন যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান চেয়ারম্যানের পিতা। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুব শাখা হলো যুবলীগ। দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং যুবকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মণিকে দেশের যুবকদের একত্রিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে তিনি মুজিব বাহিনী (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স-বিএলএফ) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান গেরিলা বাহিনী। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো শেখ ফজলুল হক মণিও ১৯৩৯ সালের ৪ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৬ সালে ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউট থেকে এসএসসি, ১৯৫৮ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৬০ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলা সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি এবং আইনেও একটি ডিগ্রি অর্জন করেন।

আদর্শবাদী রাজনীতির অন্যতম দিশারি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর সেই রাজনীতির দীক্ষা গ্রহণ করে নিজেকে তৈরি করেছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। মণির রাজনৈতিক জীবন ছাত্রকাল থেকেই শুরু হয়েছিল। তিনি ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বৈরাচারী শাসক আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনের সময় তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ছিলেন। পাকিস্তানি শাসকদের তৈরি গণবিরোধী শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ১৯৬২ সালে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং ছয় মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন তিনি। ১৯৬৪ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন চ্যান্সেলর ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের কাছ থেকে তিনি সার্টিফিকেট গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। তিনি শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনের প্রতিবাদে সমাবর্তন ত্যাগ করার একটি অভিযানের নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর ডিগ্রি বাতিল করে দেয় যার বিরুদ্ধে তিনি আদালতে যান, অবশ্য সেই রায় তাঁর পক্ষে যায়। শেখ মণিকে ১৯৬৫ সালে আবার জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং তাঁকে দেড় বছরের জন্য আটক রাখা হয়। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকার জন্য তিনি কারাবরণ করেন। এরপর তিনি ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের সময় মুক্তি পেয়েছিলেন। দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য ১৯৭১ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তিনি আওয়ামী লীগের আরও তিন নেতার সাথে কলকাতায় পালিয়ে যান। নেতারা হলেন তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক ও সিরাজুল আলম খান। তাঁরা বাংলাদেশকে মুক্ত করতে মুক্তিবাহিনীকে সংগঠিত করেছিলেন। মণি এবং তৎকালীন গবেষণা ও বিশ্লেষণ শাখার (পূর্ব) শাখার যুগ্ম পরিচালক মুজিব বাহিনীকে পরিকল্পিতভাবে পরিচালনা করেন। তিনি একটি ফ্রন্টে কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। প্রথমদিকে তাজউদ্দীন আহমদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলেও তিনি আমাদের স্বাধীনতাকালীন অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন করেছিলেন। তবে যুদ্ধের সময় কিংবা পরে সবসময় তাঁকে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর একান্ত অনুগত হিসেবে দেখা হত।

মণি ছিলেন লেখক ও সম্পাদক। বেশ কয়েকটি উপন্যাসের লেখক ছিলেন তিনি। তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর লেখা গল্পগুলো নিয়ে একটি ছোটগল্পের সংকলন বের হয়। তিনি জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা ‘‘দৈনিক বাংলার বাণী’’র প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯৭০ সালের ১১ ই জানুয়ারি বাংলা সাপ্তাহিক বাংলার বাণী প্রথম সম্পাদক হিসেবে ফজলুল হক মণির প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হয়। আগেই বলেছি, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মুজিব বাহিনী গঠনের পথিকৃত ছিলেন। প্রধান হিসেবে তিনি ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট, চট্টগ্রাম, এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় ওই বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সাপ্তাহিক বাংলার বাণী দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয় এবং ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শেখ মণি সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালের ২৩ আগস্ট তিনি সাপ্তাহিক সিনেমা এবং ১৯৭৪ সালের জুনে ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস চালু করেন যার সম্পাদক ছিলেন তিনি নিজে। তিনি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সচিব ছিলেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় মণি তাঁর স্ত্রী আরজু মণিসহ নিহত হন। তিনি ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়ক থেকে দুই কিলোমিটার দূরে থাকতেন। তাঁর বাড়ির উপর হামলাটির সাক্ষী ছিলেন মাহফুজ আনাম(ডেইলি স্টারের সম্পাদক), যার বাড়ি মণির বাড়ি থেকে লেকের বিপরীত দিকে ছিল। মণির দুই ছেলে- ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, এখন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এবং ঢাকা-১০ আসনে তিনবারের সংসদ সদস্য ছিলেন। অপরজন শিক্ষাবিদ শেখ ফজলে শামস পরশ যিনি এখন যুবলীগের চেয়ারম্যান। ১৯৭৫ সালে তাঁরা প্রাণে বেঁচে ছিলেন ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থেকে। তাপসের তখন তিন বছর আট মাস বয়স ছিল, আর পরশের বয়স ছিল প্রায় পাঁচ বছর। যুবলীগের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক পরশ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- ‘…পুরো পরিবার স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। গোলাগুলি আবারও তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়া শুরু করে, তখন আমার খালা আমাকে এবং তাপসকে ড্রেসিংরুমে নিয়ে গেলেন এবং আমাদের মেঝেতে শুয়ে থাকতে বললেন। তখন আমরা ধানমন্ডির ১৩ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে থাকতাম, এখন এটি মেডিনোভা হাসপাতালের বিল্ডিং। কিছুক্ষণ পরে আমরা আমাদের চাচী এবং দাদীর সাথে বাসা ছেড়ে চলে গেলাম এবং একই গলির শেষের দিকে একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম, সম্ভবত এটি কোনও রাষ্ট্রদূতের বাসভবন বা অফিস ছিল। আমার মনে আছে সৈন্যরা আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করে এবং সেই বাসা থেকে লুটপাট করতে থাকে।’

অধ্যাপক শেখ ফজলে শামস পরশ যুবলীগের কলঙ্কিত ভাবমূর্তি উদ্ধারের দায়িত্ব নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটির সঙ্গে কাজ শুরু করেছেন। ২০১৯ সালে যুবলীগের কংগ্রেসে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংগঠনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে দীর্ঘদিন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার পরে তিনি ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পান। তাঁর চাচা শেখ ফজলুল করিম সেলিম আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং যুবলীগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ছিলেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বলেছেন, ‘আমি আমার দায়িত্ব সততার সাথে পালন করব।... আমি চেয়ারম্যান হিসেবে নয়, যুবলীগের একজন কর্মী হিসেবে আমার কাজটি করব।’ তাঁর মতে, ‘তরুণ প্রজন্ম প্রায় বলে থাকে- ‘‘আমি রাজনীতি ঘৃণা করি’’- এ  সংস্কৃতি থেকে বের করে আনার চেষ্টা করবেন যাতে তারা জাতি গঠনে নিযুক্ত হতে পারে। তিনি মনে করেন- যুবলীগের নেতা ও কর্মীরা ভাল মানুষ। তাদের কোনও লোভ নেই। তারা সর্বদা শেখ হাসিনার মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করে। কর্মীরা কেবল ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা চায়।

অধ্যাপক শেখ ফজলে শামস পরশের পথ হলো পিতার দেখিয়ে যাওয়া আদর্শের পথ। কারণ ‘মুজিববর্ষ’ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তাঁর পিতা শেখ ফজলুল হক মণির দেশপ্রেম, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও নীতিকে কাজে লাগিয়ে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব। বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ মণি সাহস ও অনুপ্রেরণার নাম এবং তিনি তাঁর আদর্শের কারণে বেঁচে থাকবেন আরো বহুদিন। তিনি অত্যন্ত জ্ঞানী ছিলেন এবং তাঁর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা বঙ্গবন্ধুর সরকার ও দেশকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছিল। তাঁর ছিল যুবকদের সংগঠিত করার জন্য অনন্য সাংগঠনিক দক্ষতা। এজন্যই মুজিব বাহিনী নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতে সক্ষম হয়। তিনি বেঁচে থাকলে আজকে রাজনীতিতে কালোছায়ার প্রভাব পড়ত না। কিন্তু আদর্শের মৃত্যু নেই। তাঁর দেশপ্রেমের প্রচারের জন্য বর্তমান যুবলীগের নেতাকর্মীদের কাজ করতে হবে। বর্তমান কমিটিকে শেখ মণির মতোই নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সাহস ও সামর্থ্য অর্জন করা জরুরি। মণি ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে সম্পর্ক ও সমঝোতা খুব গভীর ছিল, সেই সংযোগ ভাঙার অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছিল কিন্তু কেউ সফল হয়নি। দুটি সংবাদপত্র এবং একটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সম্পাদক, মণির শিক্ষা, চিন্তাভাবনা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা শত্রুদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়েছিল। এ কারণেই তারা মুক্তিযুদ্ধের পরে তাঁকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারা সফল হলো হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। তবু শেখ মণি বেঁচে আছেন আর তাঁর আদর্শের সংগঠন যুবলীগও এগিয়ে যাবে মানবসেবায় অধ্যাপক শেখ ফজলে শামস পরশের যোগ্য নেতৃত্বে।

ড. মিল্টন বিশ্বাস, ঢাকা 

(লেখক: ড. মিল্টন বিশ্বাস,  বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)