অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
একটি মধুর আখের গল্প – চিরঞ্জীব সরকার

মাদের বাড়ি নদীবিধৌত বরিশাল জেলার বানারীপাড়া থানায় বা বর্তমানের বানারীপাড়া উপজেলার বাইশারী গ্রামের প্রমত্তা সন্ধ্যা নদীর পশ্চিম দিকে। প্রমত্তা বলছি এ কারনে যে আমাদের এপারের অংশে সে কবে থেকে যে সর্বনাশা ভাঙ্গন শুরু হয়েছে অদ্যাবধি তা চলছে। সহপাঠী মামুনদের বাড়িটা সম্ভবত এখন মাঝনদীতে। নদী বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত স্যার একবার বলেছিলেন যে নদী আসলে ভাঙ্গে না সেটা আসলে বিশুদ্ধ নদীর সংজ্ঞায় পরে না। তিনি আরও বলেছিলেন মানুষের মনের গতি প্রকৃতি নাকি নদীর মত। যেমন মানুষ সোজা সরলরেখায় না চলে একটু এঁকেবেঁকে চলতে পছন্দ করে। গ্রামের মাঠের ভিতরের ফসল কাটার পর এর ভিতর থেকে যখন মানুষ হাটে তখন পায়ের ছাপে নরম মাটির যে অস্থায়ী পথটা তৈরী হয় সেটার দিক যদি আমরা খেয়াল করি তবে দেখতে পাব যে ও পথটা একদম সরলৈখিক নহে,একটু আঁকানো বাঁকানো।

বানারীপাড়া একটা সময় ধান চালের ব্যাবসাকেন্দ্র হিসাবে বেশ বিখ্যাত ছিল। আমাদের এলাকার বালাম চালের সুখ্যাতি ছিল সর্বত্র। কিন্তু এখন আর সে বালাম চাল বাটি চালান দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বছর তিনেক আগে আমি বানরীপাড়ার বন্দরের এক চাল ব্যাবসায়ীকে বালাম চালের ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলাম। আমার এ চালের ব্যাপারে আন্তরিকতা ও আগ্রহ দেখে বললেন “ভাইজান, আপনার মোবাইল নাম্বারটা আমার কাছে রেখে যান, যদি আমি আনতে পারি আপনাকে জানাব। “ইরি ধানের সুনামীতে অন্য ধানের অবস্থা এখন ত্রাহি ত্রাহি। তবে আশার কথা হচ্ছে এগুলো কিন্তু এখনো সম্পূর্ন বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। আজ থেকে তেইশ বছর আগে বাংলাদেশ রাইস রিসার্স ইনস্টিটিউটে একবার গিয়েছিলাম। তখনি সেখানকার বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন সারা দেশের কয়েক হাজার প্রজাতীর ধান তারা এখানে গবেষনাগারে সংরক্ষন করে রেখেছে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে।

আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন বানারীপাড়া খেয়াঘাটের বাইশারীর দিকের দক্ষিন ভাগে সন্ধ্যা নদীর বুকে বিশাল ধান চালের হাট বসত। অসংখ্য নৌকায় নদীর প্রায় অর্ধেকটা ভরে যেত।ধান চালের বিক্রি নদী মাঝে নৌকার মধ্যেই হত। সারা দেশ থেকে বিশেষ করে দক্ষিনাঞ্চলের জেলাগুলির ব্যাবসায়ীরা সামিল হত এ চাল বেচাকেনার হাটে। এখন এ হাটটি টিকে আছে কিনা আমার জানা নেই। যদি টিকে থাকে তবুও নিশ্চিত করে বলতে পারি সেদিনের সে জৌলস নেই। এখন আমাদের এখানের নতুন জৌলস হচ্ছে ঝালকাঠীর ভিমরুলীর ভাসমান পেয়ারা বাগান, সাতলার বিলের শাপলাকে নৌকায় চড়ে প্রদর্শন এবং দুহাতে কয়েকটি ও এক কানে একটি রক্তিম বা শ্বেত শাপলা পুস্প রেখে ছবি তোলা এবং অতঃপর ফেসবুকে আপলোড করা।
 আখ নিয়ে লেখক
যাক্ ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গেয়ে তো তেমন একটা লাভ নেই। বছর দশেক আগের কথা। ঢাকা থেকে সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে এসেছি। কখনো সামন্যতম সুযোগ নষ্ট করি না গ্রামের বাড়ীতে যেতে। কি যে একটা মধুর ভালবাসা মিশে গেছে গ্রামের সে মাঠ,ঘাট, পুকু্র‌, জঙ্গল, খাল, নদী, গাছপালা সর্বোপরি কত পরিচিতজনদের মুখস্মৃতির সাথে। আমাদেরি নিকট প্রতিবেশী মান্নানরা। যদি শুনতে পায় বাড়িতে এসেছি অবশ্যই চলে আসবে। আমরা অনেক রাত ধরে গল্প করতাম। যখন আর ঘুমে চোখ ধরে রাখতে পারতাম না তখন আমরা সেদিনের মত বিদায় নিতাম। সেবার মান্নানের সাথে যখন গল্প করছি হঠাৎ করে বলল আপনার জন্য একটি আখ রেখেছি। আখটি সেই ফলিয়েছে। কালকে সকালে আমাকে উপহার হিসাবে দিবে। বেশ ভাল কথা। আখ  খেতে কে না ভালবাসে। ছোটকালে বাজার থেকে আখ কিনে চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে থাকতাম। মাঝে মাঝে চিবানো আখের রসের ফোটায় জামা আঠালো হয়ে যেত। ঢাকা শহরে এসেও আখ কেনা আমার বন্ধ হয়নি। ভ্যানগাড়ি থেকে সু্ন্দর সাইজ করা আখ যা ঢাকায় গেন্ডারী নামে পরিচিত তা কিনতাম আর মনের সুখে চিবাতাম। অনেকে বলত এত বেশী আখ খেলে ডাায়াবেটিস হতে পারে। তবে ডাক্তার বন্ধুদের সাথে আলাপ করে আমার যেটা ধারনা জন্মেছে সেটা হল শর্করা জাতীয় খাবারই যে ডায়াবেটিস রোগ তৈরী করবে একথা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। ঢেকি স্বর্গে গেলেও নাকি ধান ভাঙ্গে। ভিয়েতনাম ও কেনিয়াতে বসেও আমার আখ কেনা বন্ধ হয়নি।

পরের দিন সকালে মান্নান যখন খালি হাতে আসল আমি জিজ্ঞেস করলাম আমার আখ কোথায়। মান্নান বলল আখ তো কেটেছি কিন্তু আনতে পারছি না আখটা অনেক লম্বা হওয়ার কারনে। ওটা আনতে একটা বাঁশ কাটা লাগবে এবং বাঁশের সাথে বেঁধে আনতে হবে। আমি এরকম আজগুবি কথা এর আগে শুনিনি যে সিঙ্গেল একটা আখ পরিবহনে একটা বাঁশের দরকার হয়। আমি মান্নানের কথা শুনে হাসতে লাগলাম। হাসা শেষ হলে আমাকে বলল সত্যিই বাঁশের সাহায্য ছাড়া সে অখন্ড ইক্ষুদন্ড  আনতে সক্ষম নহে। তবে কেটে কেটে সে আঁটি বেঁধে আনতে পারবে সেক্ষেত্রে এহেন ইক্ষু দর্শনের মজা একেবারেই মাটি হয়ে যাবে। মান্নানকে আমি তাঁর প্রয়োজনমত একটি বাঁশ আমাদের বাড়ির বাগান থেকে কেটে নিয়ে যেতে বললাম। ঘন্টাখানেক পর গালিবারের মত লম্বা সে আখখানি নিয়ে মহা আনন্দে হাজির হল।

চিরঞ্জীব সরকার। কানাডা