অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
এ মেইডেন জার্নি ফ্রম ঢাকা টু বরিশাল - চিরঞ্জীব সরকার

বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলে যারা বাস করেন তার সিংহভাগই নদীপথে চলাচল করে। নদীপথে চলাচলের জন্য বিভিন্ন রুটে প্রতিদিন চলাচল করে অসংখ্য লঞ্চ। কয়েকটা রুটে স্টিমারও চলাচল করে। যারা একবার লঞ্চে চলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠে তারা কিন্তু বাস বা অন্য কিছুতে সহজে উঠতে চায় না। আবার এক ধরনের মানুষ আছে যাদের লঞ্চের নাম শুনলেই গায়ে জ্বর আসে। বহুদিন আগে আমার উত্তরাঞ্চলের এক বন্ধুকে যখন বললাম আমি বরিশালের বাড়িতে আসা যাওয়ায় পারতপক্ষে লঞ্চ ছাড়া অন্য কিছুতে উঠি না সে তখন এমনভাবে আমার দিকে তাঁকিয়েছিল মনে হচ্ছিল যেন আমি যে এখনো বেঁচে আছি এটাই তার কাছে আশ্চর্যের একটি বিষয়। তার মনের ভাব বুঝতে পেরে আমি তাকে বুঝালাম এখনকার লঞ্চগুলি ছোটখাট একটা জাহাজের মত, যাত্রী ধারনক্ষমতাও প্রচুর। চৈত্র বৈশাখের কালবৈশাখী ঝড়ের মৌসুম ও বর্ষাকালে যখন নদীগুলি পানিতে অনেকটা টইটুম্বুর অবস্থায় থাকে তখন একটু স্রোত,ঠেউ বা ঝাঁকুনির মধ্যে পড়লেও লঞ্চডুবি ঘটে না। যেটা ঘটে সেটা হল অপেক্ষাকৃত ছোট লঞ্চগুলি যখন ধারনক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে হঠাৎ করে তীব্র স্রোত বা ঢেউয়ের কবলে পড়ে বা অসাবধানবশত অন্য কোন নৌযানের বা থামানোর সময় পারের সাথে ধাক্কা খায় তখন কখনো কখনো দু একটা লঞ্চ ডুবে  যায়। কিন্ত দূরপাল্লার বড় বড় নৌযানগুনিতে দূর্ঘটনা তেমন একটা ঘটে না বললেই চলে। তার মুখশ্রী দেখে আমার মনে হল সে আমার বক্তব্যে কনভিন্সড্ নহে।

সড়ক,আকাশ ও নৌপথের যাত্রা তুলনা করলে আমার মনে হয় নৌপথই বেশি সাচ্ছন্দের ও নিরাপদ অনেকগুলি কারনে। লঞ্চগুলো রাত্রে ছাড়ার ফলে দিনের কাজ স্বাভাবিকভাবে করে এ জলযাত্রায় সামিল হওয়া যায়। নদীর দুপাশের দৃশ্যাবলী দেখে কেবিনে রাতের একটা সুখনিদ্রা,তার আগে বিলাসী ভোজন। কয়েকশবার লঞ্চ ভ্রমন করে আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে দূষনমুক্ত বিশাল খোলা আকাশের নীচে উন্মুক্ত বাতাসে প্রচন্ড ক্ষুধা বৃদ্ধি পায়। তাই লঞ্চের সাদা ভাত, ভর্তা, ডাল, মাছ ও অন্যান্য আইটেমগুলি ভোজনে মহাতৃপ্তি এনে দেয়। মাঝে মাঝে চা কফিতো রসনার ষোল কলায় পূর্নতা আনে। এত গেল লঞ্চ ছাড়ার পরের পর্বের কথা। লঞ্চে উঠার পরপরই কেবিন সংলগ্ন চেয়ারে বসেই খাওয়া যাবে গরম গরম হাসের বা মুরগীর ডিম,চানাচুর মাখা, নারকেল চিনি দিয়ে  বাননো চিড়ে, ঝালমুড়ি, সর্ষে দিয়ে পেয়ারা বা আমড়া, কমলালেবু, লবন শুকনো মরিচ মেশানো আনারস এবং আরো কতকিছু। তবে রাত্রে একটা ব্যাপার মোটামুটি ঘটবেই। সেটা হল রাত যখন একটা বা দুটা বাজবে এবংঅধিকাংশ যখন যাত্রী যখন ঘুমিয়ে থাকবে তখন হঠাৎ করে একটা ধাক্কা লেগে ঘুমের বারটা বেজে যাবে। যারা দক্ষিনাঞ্চলের লঞ্চে নিয়মিত চলাচল করে তাদের কাছে এটা ডাল ভাত, কুচ পরোয়া নেহি, কিন্তু যাদের লঞ্চে চড়ার তেমন একটা অভিজ্ঞতা নেই, হয়ত কুয়াকাটা যাবার জন্য ঢাকা থেকে জীবনের প্রথম পটুয়াখালীগামী লঞ্চে উঠেছে তাদের কিন্তু এহেন আকস্মিক ধাক্কায় হৃৎকম্প শুরু হয়ে যায় এবং তাৎক্ষনিক প্রতিজ্ঞা করে বসে আর কোনদিন লঞ্চে উঠবে না। আমার বিশ্বাস সে প্রতিজ্ঞা বাস্তবে কেহই সামনের দিনগুলিতে রক্ষা করতে সক্ষম হয় না। এত বড় প্রশস্ত নদী যার এপার থেকে ওপার পরিস্কার দেখা যায় না তা সত্বেও রেস করে একটা লঞ্চ পাশাপাশিভাবে আর একটা লঞ্চকে ধাক্কা না দিলে চালকদের মনে হয় পেটের ভাত হজম হয় না।

নব্বই সালের প্রথম দিকের কথা।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকি। কার্জন হলে ক্লাস করতে হয়। মুক্ত জীবনের হাওয়া লাগিয়ে বেশ দিন কাটছিল। পরীক্ষার আগে ছাড়া যেহেতু পড়তাম না তাই হাতে অগাধ সময়। মহা আনন্দে এরুমে ওরুমে আড্ডা দিতাম বন্ধুদের সাথে। বুয়েটেরও কিছু বন্ধুবান্ধব ছিল। মাঝে মাঝে ওদের হলেও চলে যেতাম। আর এ লাইফস্টাইলের কারনে প্রত্যেকটা পরীক্ষার আগে চোখে সর্ষেফুল দেখতে হত। আর একটু ছুটি পেলেতো অন্য কথা নেই। ব্যাগের ভিতর দুএকটা জামাকাপড় আর একটা বেডশীট ভরে রিক্সায় সোজা সদরঘাট। গন্তব্য বরিশাল। বেডশীটটা ডেকে বিছিয়ে ব্যাগটা বালিশ হিসবে মাথায় দিয়ে একটা নিউজপেপার বা ম্যাগাজিন কিনে জার্নি শুরু হত। ভোর চারটা পাঁচটার ভিতর লঞ্চ বরিশাল নৌ টার্মিনালে পৌঁছে যেত। এমনি একদিন বাড়ি যাবার মানসে যখন সদরঘাটে আসলাম তখন দেখি নতুন একটি ঝকঝকে বিশাল লঞ্চ তার প্রথম নৌযাত্রা শুরু করবে। অনেক রকম বেলুন,রঙ্গীন কাগজ দিয়ে নৌযানটিকে সাজানো হয়েছে। হ্যান্ডমাইক থেকে লঞ্চটিতে কি কি ফ্যাসিলিটির ব্যবস্থা আছে তার ধারাবাহিক বর্ননা করা হচ্ছে। দ্বিতীয়বার চিন্তাভাবনা না করেই এ লঞ্চটিতে উঠে পড়লাম।

রাত নটার দিকে বিশাল শব্দের ভেপু বাজিয়ে বরিশালের উদ্দেশ্যে এ নৌযানটি অনেকটা টাইটানিকের মত তার মেইডেন বা প্রারম্ভিক যাত্রা শুরু করল। যাত্রীরাও মহা আনন্দে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ল। এতক্ষন পর্যন্ত সব মোটমুটি সঠিক ভাবেই চলছিল। ঘন্টা পাঁচেক পর একটা কোলাহলে ঘুম ভেঙ্গে বুঝলাম প্রাথমিক বিপত্তি শুরু হয়েছে। লঞ্চ আর চলছে না। একটা ডুবো চড়ে আটকে গেছে। বাঁশের লগি দিয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে এটা আবার মুভ করতে পারে। কিন্তু একচুলও এদিক ওদিক হচ্ছে না। এটা হবারও কথা নয় কারন এটা তো আর কোন একটি ছোট নৌকা নহে যে বৈঠা বা লগি দিয়ে মুভ করানো যাবে। এটি  আপামর লোহা দিয়ে তৈরি বিশাল ওজনের একটি জলযান। এহেন বিপাকে পড়ে অনেক যাত্রী আক্ষেপ করতে লাগল কেন তারা এ লঞ্চটিতে উঠল। লঞ্চের চালক ও সহকারীরা জানাল জোয়ার না আসা পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করতেই হবে। এদিকে পারের অদূরে এরকম একটি বিশাল লঞ্চ আটকে আছে এটা দেখতে চরের লোকজন জড়ো হতে থাকে এবং নতুন একটা আশংকা তৈরি হল। সেটা হচ্ছে সম্ভাব্য ডাকাতি। ট্রলার নিয়ে এসে যদি কোন ডাকাতদল লঞ্চটিতে উঠে পড়ে কন্ট্রোল নিতে পারে তাহলে তো এক ভয়াবহ পরিবেশ সৃ্স্টি হবে। যদিও লঞ্চটিতে রাইফেলসহ কয়েকজন আনসার ডিউটিরত আছে তবুওতো এ আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। পার থেকে বারংবার লঞ্চটির দিকে টর্চলাইট মারা হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত এরকম কিছু ঘটল না, জোয়ারে নদীর পানি বৃ্দ্ধি পেল, চর থেকে লঞ্চটি অবমুক্ত হল এবংনতুন করে যাত্রা শুরু করল।

ঘন্টা দুয়েক পর আর একটা নতুন বিপত্তি। লোকজন বোঝাই কয়েকটি ট্রলার লঞ্চটির প্রায় কাছকাছি এসে এাটাকে থামানোর জন্য চিৎকার করছে। কিছুক্ষন পর ব্যাপারটি পরিস্কার হল। লঞ্চটি নদীতে ইলিশ মাছ ধরার জন্য যে ভাসানো জাল পাতা থাকে তার উপর দিয়ে জেলেদের জাল ছিন্নভিন্ন করে চালিয়ে এসেছে। তাই তারা জালের ক্ষতিপূরন আদায় করতে এসেছে। লঞ্চের চালক নার্ভাস হয়ে ইঞ্জিনের গতি বাড়িয়ে দিল। ট্রলারের কি সাধ্য আছে বড় ভাইয়ের সাথে গতিতে পাল্লা দেয়ার। কিছুক্ষনের মধ্যেই দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল ট্রলারগুলি।

এদিকে বেশি গতিতে চালাতে গিয়ে চালক লঞ্চটির  কন্ট্রোল হারিয়ে নদীর এক পারে এনে ফেলল এবং এটি বিশাল এক ধাক্কা খেয়ে কাত হয়ে প্রায় ডুবে যাচ্ছিল। যাক সে যাত্রায় সলিল সমাধি ঘটে নাই। ধাক্কায় লঞ্চের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। এটা মেরামত শেষে রাত আটটার দিকে যখন বরিশাল লঞ্চ টার্মিনালে লঞ্চটি পৌঁছে তখন দেখি পুরো টার্মিনাল যাত্রীদের উদ্বিগ্ন স্বজনে পরিপূর্ন।

চিরঞ্জীব সরকার। অটোয়া