অটোয়া, বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪
বেলা সাঁঝের পাণ্ডুলিপি (সাত) - দীপিকা ঘোষ

   আষাঢ় পেরিয়ে কদিন হলো শ্রাবণ শুরু হয়েছে।  অথচ বৃষ্টির এখনো দেখা নেই।  প্রকৃতির চেহারায় অকরুণ রুদ্রতা এতটাই কর্কশ, যেন বজ্রের মশাল জ্বালিয়ে চারপাশকে ছারখার করতে উদ্যত সে।  বাতাসের স্পর্শে থেকে থেকেই সাহারার হল্কা।  নীরস মাটিতে আর্তনাদের হাহাকার।  কী অসহায় আর ঊষর করা হয়েছে এককালের শ্যামলশোভন ধরনীকে।  নগরায়নের লোলুপ জিহ্বা তার সবটুকু রূপরস নিঃশেষে নিংড়ে ফেলে শুকনো খড়ের মতো প্রাণহীন করে দিয়েছে।  বহুদিন পরে সন্ধ্যার ছায়া নামতে মনীশ ত্রিবেদী এলেন।  বন্ধুকে দেখে খুশি হয়ে হাসলেন প্রতাপ।  নিজের গভীরে বহু সময় ডুবে থাকার পরেও মাঝে মাঝে বড় নিঃসঙ্গ মনে হয়।  বন্ধুর সংস্পর্শ পেয়ে তাই নীরবে আনন্দিত।  মনীশ পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন –
     দু সপ্তাহ ধরে কী হচ্ছে বলুন তো দাদা? ঘর ছেড়ে বাইরে বেরুনো দায়! গরম হাওয়া গায়ে এসে আগুনের সূঁচ হয়ে ফুটছে! জগদীশ স্যারকে ফোন করেছিলাম এখানে আসার জন্য! বললেন, ঘর ছেড়ে বাইরে বেরুতে সাহস হয় না মনীশ স্যার! চল্লিশ ডিগ্রীর ওপর তাপমাত্রা! খাঁ খাঁ করছে রোদ্দুর! ওদিকে কদিন ধরে হাঁটাহাঁটিও বন্ধ! ডায়াবেটিসের রোগী হয়ে এভাবে কি বাঁচা যায়? তারপর বললেন - গত একশো বছরের মধ্যে এমন সিভিয়ার আবহাওয়া কক্ষনো নাকি হয়নি! সত্যি দাদা, বর্ষা ঋতুতেও ছ’মাসের ওপর বৃষ্টি নেই! ভাবা যায়?   
     প্রতাপ ঘরে নয়, লম্বা বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে বাইরের বিশ্বকে দেখছিলেন।  ঈশ্বরের সৃষ্টিকে যতই তিনি দেখেন ততোই অভিভূত হন বিস্ময়ে।  মানুষের উচ্ছৃঙ্খল আচরণও তত বেশি পরিস্ফুট হয়ে ধরা দেয়।  গত বছর বারান্দার পাশে কয়েকটি দুপুরেচণ্ডী ফুলের গাছ জন্মেছিল।  এ বছর ফুল দিতে শুরু করেছে।  দুপুর হতেই তাদের রক্তরাঙা কুঁড়িগুলো প্রতিদিন একে একে পাপড়ি মেলে শান্ত চোখে চায়।  তারপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে উঠতে বুঁজে যায় একে একে।  কর্তব্যে কোথাও খামতি নেই এতটুকু।  কুটিল কামনার অসন্তোষ নেই চেহারায়।  ক্ষণিক মুহূর্তের মাত্রই তো কয়েক ঘন্টার জীবন ওদের।  তবুও কী পরম প্রশান্তিতে জীবনের গভীরতম মমত্ববোধের ভালোবাসা ছড়িয়ে ওরা পূর্ণতার আনন্দে কুঁড়ি থেকে প্রস্ফুটিত হয় প্রতিদিন।  তারপর নিঃশব্দ নীরবতায় যখন ঝরে পড়ে, তখনো অন্তরের সমাহিত মগ্নতাকে ছুঁয়ে থেকেই ঝরে যায়। 
    প্রতাপ তাদের দিকে আঙ্গুল তুলে বললেন – 
     ওই দেখুন! ওরা ঠিক দুপুরবেলা একটা নির্দিষ্ট সময়ে সবাই ফুটেছিল।  এখন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়ছে একে একে।  কোনোদিন নিয়মের ব্যত্যয় দেখিনি! প্রকৃতির অংশ হিসেবে জগতের সমস্ত জীবই প্রকৃতির নিয়মনীতি মেনে চলে।  একমাত্র মানুষ তার ব্যতিক্রম! প্রকৃতির অংশ হয়েও মানুষ সবক্ষেত্রে নিজের স্বার্থে নিয়ম ভাঙায় তৎপর! শুধু  তারই জন্য সবকিছু ভোগের সামগ্রী হয়ে উঠুক, এই তার কামনা! সে কারণেই বর্ষা ঋতুতেও আকাশ নির্মেঘ! পৃথিবী এমন বৃষ্টিহীন মনীশবাবু!   
   অথচ শুনতে পাই, মানুষ নাকি সৃষ্টির সেরা জীব! সবচাইতে বুদ্ধিমান!  
     নিশ্চয়ই! সন্দেহ নেই তাতে! সব রকম সুপার মেকানিজম মাবদেহেই রয়েছে।  তাই বুদ্ধির উত্তরণে আকাশচুম্বী তার ক্ষমতা! কিন্তু কেবল ইনটেলেকট দিয়ে পার্থিব জীবনে পারফেকশন আসে না মনীশবাবু! মূল দাগের কথা, প্রকৃতির সবখানেই ডুয়্যালিজমের খেলা।  যেমন ধরুন, মানব-মানবী।  উত্তর মেরু-দক্ষিণ মেরু।  আলো-অন্ধকার।  ডাঙা-জল।  দুয়ের মিলনেই জগতের সার্থক প্রকাশ।  সুতরাং মগজের সঙ্গে হৃদয়ও থাকা চাই! 
     তাঁদের আলাপচারিতার মাঝখানে বহুকাল পরে করুণার বদলে অতিথি আপ্যায়নে আজ মোহিনীকে দেখা গেলো।  চায়ের ট্রে হাতে নয়।  শরবতের গ্লাশ হাতে বেরিয়ে এসে টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করলো –
     কাকাবাবু, আপনার জন্য কোল্ড ড্রিংকস, নাকি চা?
     নাঃ! আজ ওসব থাক মামণি।
     আপনি পছন্দ করলে বাবার মতো আখের গুড় দিয়ে লেবুর শরবতও দিতে পারি!
     আখের গুড় দিয়ে লেবুর শরবত? বাঃ দারুণ ব্যাপার! এর কাছে তোমাদের কোনো ড্রিঙ্কস দাঁড়াতেই পারে না! তাই বরং দাও মামণি! পান করে শীতল হই!   
    মোহিনী এবার হাসলো –
    বাবার অবশ্য চায়ে আপত্তি থাকে না! যত আপত্তি আমাদের পছন্দ নিয়ে!  কিন্তু এতটা গরমে আমি দু’বারের বেশি চা খেতে দিইনে! তাই কদিন ধরে বিকেলের দিকে…!   
     খুব ভালো! আজকাল আমাদের দেশে দেখছি, বিদেশী খাবারের বড় কদর! মনে মনে ভাবা হচ্ছে, ওতেই জীবনের স্ট্যাটাস বদলে ফেলা যায়! তবে বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের দেশের ট্রাডিশন্যাল খাবারগুলো কেবল উপাদেয় নয়,  স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো!
     মোহিনী অসম্মতিতে তর্ক না করে নিঃশব্দে মুচকি হাসলো।  মনে মনে নিশ্চিত হলো , জেনারেশন গ্যাপের বিষয়টা তাহলে শুধু কল্পনার নয়।  সমাজের প্রতি ক্ষেত্রে সেটাই বাস্তবতা। 
    মনীশ শরবতের গ্লাশে সতৃপ্তিতে চুমুক দিয়ে তৃষ্ণা মিটিয়ে মুখ খুললেন – 
      আমাদের ফ্লাটে গত দশদিন ধরে জলের খুব ঘাটতি চলছে দাদা।  ঘুম ভাঙতেই জল সংগ্রহ নিয়ে একচোট যুদ্ধ শুরু হয় রোজ! হবে নাই বা কেন? মানুষ বাড়লেও জলের পরিমাণ তো বাড়ছে না! ষাট সত্তর ফিট মাটির নিচ থেকে জল তুলতে হচ্ছে! এরপরে ভবিষ্যতের জন্য আর কোনো আশাব্যঞ্জক চেহারা আমি তাই দেখতে পাইনে!  
    প্রতাপ তাঁর এতবড় নিরাশার জবাব না দেয়ায় মনীশ ফের বললেন – 
     ভয় হয়, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মরা দরকারে পানীয় জলটুকু পাবে তো? এমনকি হতে পারে দাদা, পৃথিবী একেবারে জলশূন্য হয়ে যাবে একদিন?   
     জানি না! তবে অসম্ভব নয়! নাসার বিজ্ঞানীরা বলছেন, মঙ্গল গ্রহেও একদিন নদনদী, সাগরমহাসাগর সবই ছিল। আজ সেসব কোথায়? পৃথিবীতে ষাট শতাংশের বেশি নদ-নদী আপাতত মৃত।  ওদিকে মাটির নিচেকার সঞ্চিত জলও অতি ব্যবহারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে! সাগরগর্ভও রাজ্যের বিষাক্ত জঞ্জালে ভরাট হচ্ছে ক্রমাগত! কাজেই …!  
    মনীশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে কী ভেবে মুখ উজ্জ্বল করে বললেন –
    বুদ্ধিমান মানুষ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজির মাধ্যমে সুপার ইন্টেলিজেন্ট মেশিন যখন আবিষ্কার করতে পেরেছে, তখন আশা করা যায়, ভবিষ্যতের প্রয়োজনে বৃষ্টিও নিশ্চয়ই সৃষ্টি করতে পারবে! আপনি কী বলেন?   
    প্রতাপ চিলতে হাসলেন – 
     পারুক না পারুক, আশা তো করা যেতেই পারে।  মানুষ তো এমনও আশা করে, বিজ্ঞান পৃথিবীতে একদিন জীব সৃষ্টি করবে! জীবন আসে জীবন থেকে, সে সত্য বিজ্ঞান মানতে চায় না যে!  
     মনীশ দাদার কথার মর্মে প্রবেশ না করে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন – 
     বহু বছর আগে যিশু খ্রীস্টের অলৌকিক কাহিনী নিয়ে লেখা একখানা বই পড়েছিলাম।  তাতে অনেক ঘটনা ছিল।  একটা ঘটনায় লেখা ছিল, তিনি অন্ধ মানুষকে যেমন দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে পারতেন, তেমনি প্রয়োজনে বৃষ্টিও ঝরাতে পারতেন!
     আমিও পড়েছিলাম, বিধবা মায়ের আকুল অনুনয়ে ভারতের এক মহাসাধক, মায়ের একমাত্র মৃত সন্তানের জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন! কিন্তু যে বুদ্ধিমান মানুষ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজির আবিষ্কর্তা, তার পক্ষে এই অসাধ্যসাধন কি এখনো পর্যন্ত সম্ভব হয়েছে মনীশবাবু?   
     এতক্ষণ পরে মনীশ ত্রিবেদী মুখে নিরাশার ছায়া ফেলে সচেতন হয়ে তাকালেন –
     তাহলে তো অনর্থক আশা করে লাভ নেই দাদা!
     প্রতাপ রহস্যময় হেসে উত্তর দিলেন – 
কিন্তু আশাই তো জীবনে বেঁচে থাকার পাথেয়! আশা করতে দোষ কী!

দীপিকা ঘোষ। যুক্তরাষ্ট্র