অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
আশ্রম: একটি চেতনার নাম - দ্বিতীয় পর্ব

বির চৌধুরী, অটোয়াঃ  আশ্রম: একটি চেতনার নাম,  লেখাটি আমি বর্ণহীন এক মানুষের বিক্ষিপ্তভাবে কিছু ছড়ানোছিটানো ভাবনার মিশেল। অথর্ব মনের এই ভাবনাগুলো আমি বিভিন্নসময়ে বিভিন্নভাবে বিভিন্নজায়গায় বলে থাকি। অতীতে এই উদ্ভট চিন্তাগুলো আশ্রমের পাতায় কখনো সম্পাদকীয়, কখনো গাল-গল্প, কখনো বা বিভিন্ন ধরনের গল্প-নিবন্ধে, সত্য আর কল্পনার সাহায্যে বুনন করার চেষ্টা করেছি। এবারও এই লেখার বিষয়বস্তু আশ্রমে প্রকাশিত আমার নিজের লেখা ধারাবাহিক গল্প বাদাইম্যার চরিত্রের সাথে একাকার করে দিতে গিয়ে মনে হলো, আমি আমার লেখার মাধ্যমে যে কথাগুলো পাঠকদেরকে বলার চেষ্টা করছি তা গল্প-উপন্যাসের সৃষ্ট কোন কাল্পনিক চরিত্রের মাধ্যমে বলার চেয়ে সরাসরি বলাই ভাল। কারণ, আমি শুধু একজন প্রকাশক নয়, একজন লেখকও। আশ্রম প্রকাশের পাশাপাশি অনেক সময় লেখালেখিও করছি। তাই নিজেকে একজন লেখক হিসেবেও দাবী করতে পারি। যদিও অনেকের মতে আমি লেখক না, কারণ লেখক হতে হলে প্রকাশিত বই থাকতে হয়, থাকতে হবে। মোদ্দা কথা যাদের প্রকাশিত বই আছে তারাই শুধু লেখক। যেহেতু আমার ধর্মই প্রথাগত প্রথার বিরুদ্ধাচারণ করা, তাই প্রাতিষ্ঠানিক লেখকের সংজ্ঞার তোয়াক্কা না করে আমি নিজেকে লেখক হিসেবে দাবী করি এবং মাথার ভিতরে তোলপাড় করা কথাগুলো শিকড়সহ উপড়ে ফেলার চেষ্টা করি। আমি মনে করি অপ্রিয় হলেও সত্য কথাগুলো লেখাই একজন লেখকের লেখা উচিত। মাথার ভিতরে গিজগিজ করতে থাকা পোকাগুলোর অপসারণ করতে গিয়ে অনেক সময় অনেক কিছ নিজে লেখার চেষ্টা করেছি, অন্যকে দিয়ে লেখাবার চেষ্টা করেছি, কতজনের হাতেপায়ে ধরেছি ‘নির্দিষ্ট’ কিছু বিষয় আসয় নিয়ে লেখার জন্য তার হিসেব নাই। কখনো সফল হয়েছি, কখনো হইনি। দাড়িপাল্লায় তুললে সফলতার পাল্লাটি মনে হয় বেশী ভারী হবে। অনেকের মতে, অটোয়াতে আশ্রমের কিছু কাজ যেমন, অটোয়ায় বসবাসকারী বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সংবর্ধনা দেওয়া, পাঠকনন্দিত লেখক ড. মীজান রহমানকে সংবর্ধনা দেওয়া, অটোয়ায় স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে “একক সঙ্গীতানুষ্ঠানের” আয়োজন করা, সর্বোপরি অটোয়ার প্রথম বাংলাদেশি সংগঠন “বাকাওভের” প্রয়োজনের কথা বারবার অটোয়ার সাধারণ বাঙালিদেরকে বলা এবং “বাকাওভ” করতে উৎসাহিত করাসহ স্থানীয় নতুন লেখকদেরকে আশ্রমে  লিখতে বলার কথা অস্বীকার করা দুরূহ হবে। আমি মনে করি সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার জন্য সুস্থ সাহিত্য চর্চা আর সঠিক ইতিহাস চর্চার প্রয়োজন আছে। আমরা অনেকেই তা বিশ্বাস করি বিধায় টিম হরটন্সের কফির আড্ডায়, ঘরের ড্রয়িং রুমের, অথবা বড় বড় অনুষ্ঠানে থিয়েটারের লবিতে এই চর্চাগুলো করে থাকি। ১৫/২০ ডলার দিয়ে ঠিকেট কেটে আমরা অনুষ্ঠানে যাই গান শুনবো বলে, কিন্তু গান না শুনে আমরা লবিতে সমাজের অনাচার, অবিচার নিয়ে এমনভাবে আলোচনায় লিপ্ত হই, হলের ভিতরে কখন অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যায়, তা খেয়ালই রাখি না। আনন্দের জন্য, সময় কাটানোর জন্য, যে কারনেই হোক- আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, সবই মানুষের কল্যাণ বয়ে আনে। অনেকে লবিতে আলোচনা করে আনন্দ পান, আনন্দের উছিলায় সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতার আংশিক দায়িত্ব পালন করেন। অনেকে আবার লেখালেখি করে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন। আমি যেহেতু ড্রয়িংরুম বা কোন অনুষ্ঠানের হলের লবিতে দাঁড়িয়ে জমিয়ে আড্ডা দিতে পারিনা, তাই আমার মনের ভিতর ঘোরপাক খাওয়া কথাগুলো লেখার জন্যেই, আশ্রম: একটি চেতনার নাম  নতুন লেখার আবতারণা করিয়াছি, বলা যায় এ লেখাটি সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তির এক অদ্ভুত উপাস্য মাধ্যম!

কোভিড পরবর্তী সময়ে নানা কারণে আশ্রমের ওয়েবসাইটে লেখা আপলোড করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তার অন্যতম কারণ, পঞ্চাশ বছর আগে শুরু করা একটি বিশেষ আরাধ্য কাজের শেষ দেখা। কাজটি কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ, তবে ভাল। এখানে মনোনিবেশ আর একাগ্রতাই মূখ্য। একটু এদিকসেদিক হলেই সব শেষ! যাপিত জীবনের সবকিছুর মতো আমার এই শুরুটাও নাটকীয়। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ যখন বেঁচে থাকার জন্যে "লকডাউন" নামক খাঁচায় বন্দি, আমি তখন আমার নতুন জীবননাটকের পাণ্ডলিপি লিখতে ব্যস্ত। কানাডা সরকারের দেওয়া মাসিক "২০০০" ডলারের কোভিড ইমার্জেন্সি "ভাতা" না নিয়ে আমি আমার জীবনের একটি অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করছি। কি উদ্ভট চিন্তা আর পাগলামী কাজ! ভোগবাদী এ বিশ্বে আমার মতো কিছু পাগল ছাড়া এসব কাজ কে করে? তবে সত্যি কথা হলো জীবনের করা সব পাগলামীর মধ্যে কোভিড পূর্ববতী সময়ে নেওয়া পাগলামো এই সিদ্ধান্তটি কোভিডের সময় পরিপূর্ণতা লাভ করে। আমার নতুন পরিচয়ের সন্ধানে সহযোগিতা করে। তাই তো বলি, আমি কোভিডের সুফল ভোগকারীদের একজন।  

গত সংখ্যায় লিখেছিলাম কণ্ঠশিল্পী ডালিয়া ইয়াসমিনের 'একক সঙ্গীতসন্ধ্যার' পর কণ্ঠশিল্পী সুপ্তা বড়ুয়াকে নিয়ে আশ্রমের একক সঙ্গীতানুষ্ঠান করবো। কিন্তু ব্যাটেবলে এক না হওয়ায় সুপ্তা বড়ুয়ার প্রোগ্রাম করা হয়নি। ইচ্ছা ছিল অন্য কাউকে দিয়ে “আশ্রম একক সঙ্গীতসন্ধ্যার” আয়োজন করবো। কিন্তু পৃথিবীতে হঠাৎ করে মহামারী কোভিড নামক দানবের আবির্ভাব হওয়ায় আমার পক্ষে আর কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। কোভিডের পরে এই কর্পোরেট বিশ্বের অন্যান্য মানুষের মতো আমিও আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন কিন্তু আনন্দদায়ক সময় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ইচ্ছা থাকা সত্বেও আশ্রমের কোন অনুষ্ঠান করবো না বলে সিদ্ধান্ত নেই। কারণ- এসময় কাউকে নিয়ে “আশ্রম একক সঙ্গীতানুষ্ঠানের” আয়োজন আমার জন্য হীতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। তাই অনুষ্ঠানের জন্য কৈলাস মিতাল থিয়েটারের বুকিং ক্যানসেল করে দেই। ইতিমধ্যে আশ্রমহিতৈশি কবি সুলতানা শিরীন সাজি পত্রিকা সম্পাদনা করার দায়িত্ব নিয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন শহরের মানুষের মতো অটোয়ার মানুষও স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্থ হচ্ছেন। কোভিডের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তির আনন্দে মানুষ আত্মহারা। শহরের দোকানপাট, ক্লাব, সিনেমাঘর, রাস্তাঘাট, সর্বত্রই মানুষের কোলাহল। অটোয়ার বাঙালিরাও নিজ নিজ গণ্ডীর ভিতরে আনন্দে মেতে উঠতে শুরু করেছেন। পিকনিক, গান-বাজনায় চতুর্দিক মুখরিত। প্রতি সপ্তাহেই কোথাও না কোথাও ছোট বড় অনেক অনুষ্ঠান লেগে আছে। বার্থডে পার্টি, বেইসমেন্ট পার্টি, থেকে শুরু করে বর্ধিষ্ণু বাঙালি সমাজে নতুন ট্রেন্ড বেবী শাওয়ার, এককথায় যে যেভাবে পারছেন সেভাবেই জীবনকে উপভোগ করছেন। এই উপভোগের ছোঁয়া থেকে আমিও মুক্তি পাইনা। 

এরকমই এই সামারে কৈলাস মিতাল থিয়েটারে এক  আনন্দউপলক্ষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়। প্রায় ৩ বছর পর অনেক পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হয়। পত্রিকা, আমার জীবন-যাপন, আশ্রমের সঙ্গীতানুষ্ঠানসহ নানাবিধ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কিছু সঙ্গীতপ্রিয় দর্শকশ্রোতা আশ্রমের অনুষ্ঠান দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ঐদিন অনেকের সাথে আলোচনায় মনে হলো, আশ্রম পত্রিকার খুবই শক্তিশালী একটা "উইং" স্থানীয় কণ্ঠশিল্পীদের নিয়ে আয়োজিত আশ্রমের “একক সঙ্গীতানুষ্ঠান।“ এই রেওয়াজটা চালু রাখা গেলে হয়ত নতুন কোন শিল্পীকে "উৎসাহিত" করা যাবে। কার্লটনের লবিতে এইসব আলোচনার মাঝেই অনুষ্ঠান শুরুর ঘোষণা শুনে সবার মতো আমিও কৈলাস মিতাল থিয়েটারে ঢুকতে গিয়ে কার্লটন ইউনিভার্সিটির প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর আলেক্সের সাথে দেখা হয়ে যায়। হেই আলেক্স, বলেই তাকে জিজ্ঞাসা করি ডিসেম্বরের শেষে কি হল ভাড়া নেওয়া যাবে। একমিনিট বলেই সে তার ল্যাপটপ খুলে কৈলাস মিতাল থিয়েটারের বুকিং লিস্ট দেখে বললো, হ্যাঁ নেওয়া যাবে। তবে ডিসেম্বরের ৩ তারিখ। বললাম- তাহলে আমার জন্য হলটি বুকিং দিয়ে রাখো, কয়েক দিনের মধ্যেই তোমাকে কনফার্ম করবো। আমার মনে হয় সেদিনই অনুষ্ঠানের বিরতীতে অনুষ্ঠানে আগত অনেককে ডিসেম্বরের ৩ তারিখ আশ্রম আবার যে গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে তা বলেছিলাম। এই হলাম আমি। এই হলো আমার পাগলামীর নমুনা। ভালমন্দ ভেবে দেখার চিন্তাই মাথায় আসে না। আমার জীবনের সবগুলো ডিসিশানই এভাবে নেওয়া। "বউ" ছাড়া থেকে শুরু করে লাখ লাখ ডলার নষ্ট করা। এমনকি অটোয়া থেকে বাংলা পত্রিকা প্রকাশ, আশ্রম নামরকরণ, কানাডায় আসা ইত্যাদি। সবই তড়িত এবং আবেগতাড়িত। এসব উদ্ভট কাজ দেখে অনেকেই বলেন ‘আপনি এত সাহস কোথায় পান?’ আমি বলি, শক্তিহীন মানুষের সাহসের দরকারই পরে না। আমার মতে, জীবনযাপনের ক্ষেত্রে চাওয়া-পাওয়ার হিসেবের ঊর্ধ্বে উঠতে পারলে সাহস নামক শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজনই পরে না। 

কথার পিঠে কথা থাকে। আশ্রমের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা বলতে গিয়ে এতকিছুর অবতারণা। কৈলাস মিতাল থিয়েটার বুকিং দিয়েই আমি কোন কিছু না ভেবে সেদিনই অনুষ্ঠানে উপস্থিত, শহরের নামী শিল্পী আশেক বিশ্বাস, সুপ্তা বড়ুয়া, আবৃত্তিকার মাকসুদ খান, অটোয়ায় নতুন তৈরি বাংলা গানের ব্যান্ড ‘রংধনুর’ অন্যতম সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিটুসহ অনেকের সাথেই অনুষ্ঠান নিয়ে আলাপ করি এবং অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানাই। এর সবগুলোই ছিলো কৈলাস মিতাল থিয়েটারে উপস্থিত আশ্রমের শুভানুধ্যায়ীদের সাথে আমার আন্তরিক আলোচনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। আমার মনে আছে, সেই অনুষ্ঠানেই উপস্থিত ছিলেন আশ্রমের নতুন সম্পাদক কবি সুলতানা শিরীন সাজি। হঠাৎ করে নেওয়া এই সিদ্ধান্তে সাজি হতবাক না হয়ে খুবই বিচক্ষণ্নতার সাথে বলেন, “খুবই ভাল হলো। ডিসেম্বর মাস তো! আমরা পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করবো!” ক্ষণিকের আবেগে নেওয়া একটি সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে যে এক বিশাল কর্ম আর আনন্দযজ্ঞে পরিণত হবে তা কে জানত?

আজ এখানেই শেষ করবো। তবে শেষ করার আগে বলবো, আমাদের কাছে ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের দিন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটি। এই কাজটি সহজ ছিল না। পৃথিবীতে স্বাধীনজাতি হিসেবে নিজের জায়গাটুকুর জন্যে হাজার বছর ধরে বাঙালিরা আন্দোলন করেছে, রক্ত দিয়েছে। অবশেষে ১৯৭১ সালে বাঙালির মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৯ মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালিরা স্বাধীনতা অর্জন করে। ৩০ লাখ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আর ২ লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা, এই বিজয়। মুক্তির এই দিনে বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ আর নির্যাতিত মা-বোনদের প্রতি আমাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধাঞ্জলি। জয় বাংলা। (চলবে…) 

কবির চৌধুরী
প্রকাশক, আশ্রম
অটোয়া, কানাডা
১৬/১২/২০২৩