অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
ইউরোপের পথে পথে (বারো) -দীপিকা ঘোষ

     ১৭৮৯ এর ১৪ই জুলাই বাস্তিল জেলখানাকে ঘিরে ঘূর্ণায়ত হয়েছিল ফরাসী বিপ্লবের যে যুগান্তকারী ইতিহাস, তা ছিল মূলত শত বছর ধরে জমে ওঠা রাজশক্তির বিরুদ্ধে আপামর জনসাধারণের ব্যাপক অসন্তোষের বিস্ফোরণ। এই বিদ্রোহ শাণিত হয়েছিল রাজ্যপ্রশাসনের অনাচারের বিরুদ্ধে। অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে জনতাকে শোষণের জন্য প্রচলিত অমিতাচারের বিরুদ্ধে। অসম আইন প্রচলনের বিরুদ্ধে। ক্যাথলিক চার্চের ধর্মগুরুদের রাজনৈতিক, সামজিক এবং ধর্মীয় স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে। কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুরসহ শহরের চাকরিজীবি সাধারণ মানুষ অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন সেই ঐতিহাসিক বিপ্লবের প্রয়োজনকে। আর তার ফলাফল নাটকীয়ভাবে বদলে দিয়েছিল শুধু ফ্রান্সকে নয়, গোটা ইউরোপের ইতিহাসকে।   
     অথচ ১৩৭০ থেকে ১৩৮০-র দশকের মধ্যে দুর্গটি নির্মিত হয়েছিল প্যারিস প্রতিরক্ষার প্রতিরোধ হিসেবে। ব্রিটিশ রাজ তৃতীয় এডওয়ার্ডের চাপিয়ে দেওয়া ১১৬ বছরের যুদ্ধ ফ্রান্সকে আত্মরক্ষামূলক ভূমিকা নিতে বাধ্য করেছিল দীর্ঘ দিন। ইংরেজ এবং বার্গানডিয়ান সৈন্যরা যাতে সরাসরি আক্রমণ করতে না পারে, সেই অভিপ্রায় থেকেই পাথরের শক্তিশালী দুর্গটি নির্মিত হয়েছিল। রাজা চতুর্থ হেনরির সময় (১৫৮৯-১৬১০) সেই প্রয়োজন কমে আসায় ক্যাসলটি ব্যবহৃত হতে থাকে রাজসম্পদের কোষাগার হিসেবে। কিন্তু অমিতাচারি রাজা চতুর্দশ লুইয়ের শাসনামল দ্রুতই সবকিছু বদলে দেয়। রাজতন্ত্রের স্বৈরাচারিতা ছড়িয়ে পড়ে সবক্ষেত্রে। রাজানুগত্য অস্বীকার করায়, রাজনৈতিক মতবিরোধিতা ঘটতে থাকায় সমাজের নাগরিক বুদ্ধিজীবিদের চরম শাস্তিদানের উদ্দেশ্যে দুর্গটি পরিণত হয় ভয়ংকর জেলখানায়। শত বর্ষব্যাপি মানুষের কল্পনায় প্রতিহিংসার দাবানল জ্বলেছে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে। শতাব্দী শেষে ১৭৮৯-এর ১৪ই জুলাই সেই প্রতিহিংসার আগুন দুর্ধর্ষভাবে জ্বলে ওঠে প্রথমবার। বাস্তিল দুর্গ আক্রান্ত হয়। জনরোষ স্পর্শ করে অমিতাচারের চরম দৃষ্টান্ত, ভার্সাইল রাজপ্রাসাদকেও।     
     প্রাসাদ চত্বরের বাইরে রেস্টুর‌্যান্ট কাম সরাবখানায় ঢুকতে হলো ওয়াশরুমের প্রয়োজনে। দুপুর গড়িয়ে এলেও বিদেশি পর্যটকের আনাগোনা চোখে পড়লো তখনো। নীলাভ আলোর স্বপ্নিল পরিবেশে পছন্দমতো সরাব পান করতে করতে কেউ কেউ মোজারেলা স্টিক, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই কিংবা বাফেলো উইং খাচ্ছেন। রেস্টরুমের দুটো দরজাতেই অপেক্ষারতদের লাইন। ভদ্রতা অনুযায়ী সিরিয়াল অনুসরণ না করে প্রবেশ করা চলবে না। দুজন ক্লিনিং লেডি এমপ্লয়িদের বাথরুম পরিষ্কার করে বাইরে আসতেই নিচু স্বরে শুচির মন্তব্য শোনা গেলো–
     তাড়াহুড়োতে ওখানে আবার ঢুকতে যেয়ো না!
     জানি বাবা! তোকে আর বলতে হবে না! কিন্তু ওদের তো দেখে মনে হচ্ছে...!
     ঠিকই বলেছো! পাকিস্তানী, বাংলাদেশি কিংবা ইণ্ডিয়ান! ট্যাগের ওপরও লেখা রয়েছে রাহিমা আর ইদ্রিসা! কিন্তু আর কথা বলো না, শুনতে পেলে মাইণ্ড করবে!
     আমাদের কথা বুঝতে পারলে তো?
     কেন সেটা ভাবছো? বাঙালিও তো হতে পারে!
     শুচির সরু মসৃন আঙ্গুলের নিচে স্মার্টফোনের বাটনগুলো দ্রুতগতিতে ওঠানামা করছে এখন। বাস্তিলে যাওয়ার জন্য পাবলিক টান্সপোর্টেশনের তথ্য সংগ্রহ করছে সে। কিছুক্ষণ পরেই মুখ তুলে তাকালো-
     মেট্রো ট্রেন ইজ দ্য বেস্ট মেসো! দশ মিনিটের মধ্যেই পাওয়া যাবে! তাড়াতাড়ি হাঁটো! পা চালাও!
     হাঁটতে হাঁটতেও চোখে পড়লো রাজপথের পাশে দাঁড়িয়ে দুই বিশাল সাইজের ব্ল্যাক তরুণী নিমগ্ন হয়ে সিগারেট টানছে। আর নাকের ভেতর দিয়ে এমনভাবে ধোঁয়া ছড়িয়ে দিচ্ছে যেন সেগুলো তাদের অঙ্গ নয়, কারখানার দুটি চিমনি! সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে কচি তিনটি শিশু। মায়েদের ধোঁয়ার আকাশে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে তাদের মুখ! ফরাসী জনতার নিকোটিনের আসক্তি শুনেছি জগদবিখ্যাত। ফ্রান্সকে নাকি এজন্যই বলা হয় ‘ইউরোপের চিমনি’। গুড ফুড, গুড ওয়াইন এবং গুড সিগারেট ছাড়া এদের জীবন চলে না। বয়স বারো থেকে বুড়ো, সবারই ভালো মুডের জন্য সিগারেট চাইই চাই। বললাম-
     ফ্রান্সকে তো মনে হচ্ছে ধূমপায়ীদের দেশ! যেখানেই যাচ্ছি, সেখানেই দেখছি সিগারেট খেকো মানুষজন!
     শুচি সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলো-
     মামণি, এদের থেকেও বেশি স্মোক করে স্পেন, ইটালি, পর্তুগাল আর গ্রীসের লোক! ওদের ওখানে ওয়াইনের পাশাপাশি সিগারেট এক নিশ্চিত বাস্তবতা!
     এখানেও তো সেই রকমই দেখছি!
     নাঃ একদমই নয়! এখানে গভর্নমেন্টের অনেক রকম কড়া রেসট্রিকশন রয়েছে!
     থাকলেই বা মানছে কে?
     মানছে! অনেকেই মানছে! স্টুডেন্টদের মধ্যে স্মোকিং রেট ৪০% থেকে কয়েক বছরে ২৯%-এ নেমে এসেছে! আমার কথা নয়, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের সার্ভের ইনফরমেশন!
     ভেণ্ডিং মেশিন থেকে দ্রুত টিকেট বার করতে না করতে মেট্রো ট্রেন এসে গেলো। ছুটতে ছুটতে কোনোমতে ভেতরে গিয়ে উঠলাম। এরই মধ্যে চোখে পড়েছে যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান এবং মজবুত দেখতে এক মহিলা তিনটি শিশু নিয়ে কম্বল বিছিয়ে স্টেশনের দেওয়াল ঘেঁষে বসে রয়েছে। হাতে একখানা কাগজ। তাতে ইংরেজি  অক্ষরে মোটা মোটা করে লেখা -‘প্লিজ হেলপ’! পাশেই সম্ভবত ফরাসী ভাষায় কিছু লেখা রয়েছে। মাথায় সিল্কের রুমাল বাঁধা। মুখের অনেকখানি আবৃত তাতে। এক পলক দেখেই মনে হলো মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ থেকে এসে আশ্রয় নিয়েছে। এককালে ভিক্ষাবৃত্তিকে জটিল সামাজিক সমস্যা বিবেচনা করে ফ্রান্সে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯৯৪-তে ব্যক্তির বিশেষ পরিস্থিতির শর্তসাপেক্ষে সেই নিষেধাজ্ঞা বাতিল করা হয়। কিন্তু সঙ্গে শিশু কিংবা হিংস্র পশু নিয়ে ভিক্ষে করার পদ্ধতি এখনো আইনত নিষিদ্ধ রয়েছে ফ্রান্স এবং ইটালিতে। তাই এই ধরনের দৃশ্য পরপর কয়েকটি দেখার পরেই প্রশ্ন জেগে উঠলো মনে।

     দ্রুতগতিতে ট্রেন ছুটছে বার বার মাটির অন্ধকার গহ্বর পেছনে ফেলে বাইরের আলোর রাজ্যে ডানা মেলে। আলো অন্ধকারের লুকোচুরি খেলা বেশ লাগছে উপভোগ করতে। ‘ভার্সাইল রিভ গউশ’ স্টেশনে থামতেই এক ভঙ্গুর চেহারার তরুণী উঠে এলো গলায় অ্যাকরডিয়ন ঝোলানো অবস্থায়। মাথায় ক্লোশ হ্যাট। পরিধানে জীর্ণ শার্ট আর জিনস। কাছে এসে দাঁড়াতেই সিগারেটের উগ্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো দেহের থেকে। দেখেই মনে হলো যেন বহুকাল স্নান করেনি এই মেয়ে। কিন্তু যখন সে গাইলো -‘ইলা ইলে লা’ সুরের ঝর্ণা বেয়ে পবিত্র সরোবরের স্নিগ্ধতা গড়িয়ে পড়লো গলার সুরে! কী অসাধারণ কোমল আর রোমান্টিক ব্যাপ্তিতে ভরা সুরেলা সেই কণ্ঠস্বর! শব্দের মানে কিছুই বোধগম্য হলো না। 
     তারপরেও মনে হলো-
     এ গান নিশ্চয়ই বেদনার গান! তাই প্রাণের পরে এমন করে পরশ লাগিয়ে যাচ্ছে!
     পাশের আসনে বসে থাকা শুচি অস্ফুটে বললো-
     ফ্রান্সের বেস্ট সিঙ্গার ফোঁছ গ্যালের গান! ওঁর গান এখনো খুব জনপ্রিয়! আমাদের ওখানেও!
     কিন্তু এই মেয়েটি যখন এত ভালো গাইয়ে, তখন ভিক্ষে করছে কেন এভাবে?
     করা অবশ্য উচিৎ নয়! কিন্তু সবারই তো লাইফ স্টাইল আলাদা, তাই না?
     কী যে বলিস! এটা কোনো লাইফ স্টাইল হলো?
     কে বলতে পারে, ওর হয়তো এটাই পছন্দ! 
     পরের স্টেশনেই বাস্তিল এসে পড়লো। কয়েক মিনিট হাঁটার পরে ‘প্লেস ডি লা বাস্তিল স্কয়ারে’ পৌঁছে গেলাম আমরা। দেখলাম চারপাশটা ভারি জমজমাট। অনেকগুলো সরাবখানা, রেস্তোরা, দোকানপাট, কনসার্ট হল আর লোকালেয়ের ভিড়। কিন্তু কল্পনায় যে ‘বাস্তিল প্রিজন’ এর চেহারা ধরা ছিল তার অনুসন্ধান কোত্থাও মিললো না। ঘোষের কথায় হতাশা গড়ালো-
     কী ব্যাপার শুচি, আমরা ঠিক জায়গায় এলাম তো? এ তো চারপাশে দেখছি শুধুই দোকানপাট, বাড়িঘর আর...!
     কিন্তু ঠিকই তো এসেছি মেসো! এখানেই থাকার কথা ছিল!
     আমাদের সামনেই দুই জোড়া ইংরেজি বলিয়ে নারী পুরুষ একজন ফরাসী গাইডের সঙ্গে গল্প করতে করতে চলেছেন। এতক্ষণ মনোযোগ দিইনি। হঠাৎ কয়েকটি কথায় আকৃষ্ট হয়ে কান পাতলাম। গাইড হেসে হেসে বলছেন-
     অনেক ফরেন ট্যুরিস্টরাই ভাবেন, এখানে এসে এখনো ১৩৭০ খ্রীষ্টাব্দের তৈরী সেই বাস্তিল ক্যাসলকেই বুঝি দেখতে পাবেন! গত বছর সে রকমই দুজন এসেছিলেন কানাডা থেকে! এখানকার বর্তমান পরিস্থিতি দেখে তারা তো একেবারে হতাশ!
     রমনীদের একজন উত্তরে বললেন-
     আমারও সেই রকমই ধারণা হয়েছিল! জানতাম ক্যাসলটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে! কিন্তু সেটা যে এতখানি এভাবে, অনুমানই করতে পারিনি!
     গাইড আশ্বস্ত করতে বললেন-
     তবে সম্পূর্ণ হতাশ হওয়ার কারণ নেই! এখনো নদীর দিকটায় অরিজিনাল ক্যাসলের টুকরো টুকরো কয়েকটি নিদর্শন রয়েছে!
     গাইডের বক্তব্যে কয়েক সেকেণ্ড মনোযোগ ধরে রাখতেই স্পষ্ট হলো, বর্তমানে বাস্তিলের এই উত্তরপূর্ব দিকের অংশটুকু শহরের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের প্রধান আখড়া। কনসার্ট, বিভিন্ন মেলা কিংবা নগর জীবনের অন্যসব অনুষ্ঠান উদযাপনের জন্য এখানকার কনসার্ট হলগুলো ব্যবহৃত হয়। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘প্লেস ডি লা বাস্তিল স্কয়ারে’ বিদেশি দর্শনার্থীদের ভিড় জমে ওঠে ক্যানাল ট্যুর, রিভার ক্রুজ আর ওয়াকিং ট্যুরের আকর্ষণে। রাতের বেলায় চারপাশটা সরব হয়ে ওঠে ক্যাফে, বার, নাইট ক্লাব, কনসার্ট মিউজিকের প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাসে।
     মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগের সময় সীমায় ফ্রান্সের শক্তিস্তম্ভ আর রাজস্বৈরাচারিতার প্রতীক হয়ে সদম্ভে দাঁড়িয়েছিল যে ‘বাস্তিল প্রিজন’, তার যৎসামান্য ভগ্নাংশই পড়ে রয়েছে আজ। জনশক্তির বিরাট ক্রোধের নিচে ১৭৮৯ থেকে ১৭৯০-এর মধ্যে বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে অন্য সবকিছু। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক গুরুত্বের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের আকুলতা তাতে এতটুকুও কমেনি আধুনিক ফ্রান্সের। ১৪ই জুলাই ‘বাস্তিল ডে’ নামে প্রতি বছর পালিত হয় জাতীয় দিবস হিসেবে। ফরাসী বিপ্লবের গুরুত্বকে স্মরণীয় করার উদ্দেশ্যে ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দে নির্দিষ্ট জায়গাতেই নির্মিত হয়েছে বিশাল মনুমেন্ট, ‘লে জেনি ডি লা লিবার্টে(Le Genie De La Liberte)’! ইংরেজিতে- ‘The Spirit of Freedom'. অর্থাৎ মুক্তির উদ্দীপনের প্রতীক। এই প্রতীক ব্রোঞ্জের চমৎকার একটি সুপুরুষ মূর্তি! মনুমেন্টের মাথায় দুটি ডানা মেলে বন্ধনহীন মুক্তির আকাশে ওড়ার ভঙ্গিতে এমনভাবে দাঁড়িয়ে, যাতে সুদৃঢ় বলিষ্ঠতা, শক্তিশালী আত্মপ্রত্যয়, স্বাধীন জীবনের মহিমা সোচ্চারভাবে ঘোষিত হয়।
     জনকোলাহল ছেড়ে নদীর একপাশের নিরালা জায়গাটায় চলে এলাম একসময়। কাশবনের মতো লম্বা লম্বা হোয়াইট ফিদার প্যাম্পাস ঘাসের টুকরো ঝাড়ের পাশে চুপচাপ বসে রয়েছে এক রমনী। অবিন্যস্ত সোনালি চুল হাওয়ার হিন্দোলে মৃদু কল্লোলে নাচছে। সামনের অনন্ত আকাশে দৃষ্টি প্রসারিত। আর কিছু দেখা যায় না। আর কিছু জানা যায় না তার। রবীন্দ্রনাথ এমন কাউকে দেখেই কি বলেছিলেন -‘নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ, সুন্দরী রূপসী/ হে নন্দনবাসিনী ঊর্বশী’? চলবে…

দীপিকা ঘোষ
ওহাইয়ো, আমেরিকা।